দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গুচ্ছ কবিতা

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু , সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৩:৫১ পিএম, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪

চিঠিটি লেখা হয়নি আজও

প্রিয়তমা, এলোকেশী বধূ আমার
তুমি একটি দীর্ঘ চিঠি চেয়েছিলে, দীর্ঘ চিঠি
আমার ঈশ্বর জানেন, এই চিঠি লিখতে গিয়ে
কতবার সূর্য অস্ত গেছে অথচ চিঠি লেখা হয়নি আজও।

একবার দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার ঘাটে স্নানে নামিয়ে
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বলেছিলে
এই তাকাও; আমার দিকে তাকাও
তোমার ত্রিনয়নে শ্রেষ্ঠাঙ্গিনীর চওড়া কপাল দেখব
মনে আছে?

একবার শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায়
নির্জন প্রত্যুষে গ্রীবায় ওষ্ঠ ছুঁয়ে বলেছিলে
যেদিন তোমার চিঠি আমার হাতে আসবে সেদিন
আমাদের জীবনের উঠোনজুড়েও এমন আবহ তৈরি হবে
মনে আছে?

একবার চেরাপুঞ্জিতে মেঘলা বিকেলে
রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ আওড়াচ্ছিলাম
অমিত-লাবণ্যের সংলাপপর্ব শুরুমাত্র
দু’হাত তুলে করতল দেখিয়ে বলেছিলে
তুমি আমাকে এমন দীর্ঘ একটি চিঠি লিখবে, দীর্ঘ চিঠি
মনে আছে?

একবার ছেঁড়াদ্বীপে জোয়ারের উজানে দাঁড়িয়ে ছিলাম
তোমার উচ্ছৃঙ্খল আউলা চুলের ঝাপটায়
ঢেকে যাচ্ছিল আমার মুখাবয়ব
ঝাপটামুক্ত রাখতে পরাস্ত হয়ে
স্কন্ধে চিবুক ঠেকিয়ে মৃদুকণ্ঠে বলেছিলে
এসো যুগলবন্দি ঝাঁপ দিই
সময় বয়ে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না
আমি তোমাকে টানতে টানতে
প্রাণপণে ছুটছিলাম ভাটি ছেড়ে
মনে আছে?

একবার পাহাড় বেয়ে, মেঘ কেটে কেটে
দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল যেতে যেতে
বুকে চেপে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলে
যেদিন তোমার চিঠি পাব
সুনীলবাবুর বরুণার মতো নয়
সেদিন সত্যিই আমার বুক আতরগন্ধি হবে
মনে আছে?

শরীরের সঙ্গে শরীর, ভাবনার সঙ্গে ভাবনা, স্বপ্নের সঙ্গে স্বপ্ন
যেখানে সংলগ্ন সেখানে চিঠিতে আর কী লিখব এমন প্রশ্নের
উত্তর দিয়েছিলে, উচ্চারণে-স্পর্শে সবকিছুর ছোঁয়া পাই না
তোমার নান্দনিক প্রকাশ
শৈল্পিক অনুভূতির কোনো মানে বুঝিনি সেদিন
নীরবতা গ্রাস করেছিল, পৃষ্ঠদেশে পৃষ্ঠদেশ ঠেকিয়ে
বলেছিলে, তুমি বড্ড সরল
মনে আছে?

সন্তান শৈশবের গণ্ডি ছাড়িয়ে কৈশোরের দিকে পা বাড়িয়েছে
কেটে গেছে আসমুদ্র হিমাচল সময়
এর পরও সেই চিঠির কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছ
তুমি নিরুপম, নিরন্তর চিন্তা, জোছনা কিংবা সূর্যকিরণ
কিন্তু জানো, এসব কোনো কিছুই আমার চাওয়ার ইতি ঘটায় না
তোমার চিঠি চাই; দীর্ঘ চিঠি
মনে আছে?

বিনিদ্র কত রাত কাটিয়েছি জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে
কখনো কখনো পাশ ফিরে ডিমলাইটের আলোয় দেখেছি
ঘুমকাতুরে তুমি শয্যায় যেন সমুদ্রের তরঙ্গায়িত ঢেউ
আমার দৃষ্টি তোমার অন্তর্দৃষ্টি এড়ায়নি
ঈষৎ চোখ মেলে প্রতিবারই বলেছ
নিঃশব্দের শব্দ আর গহিন বনের নীরবতার আকুতি দীর্ঘদিনের
মনে আছে?

চিঠিটি আজও লেখা হয়নি, শেষ করব বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েও পারিনি
তবে ক্ষান্ত দিইনি, যা লিখি সবই মনে হয় শুধু আঁকিবুঁকি।

তুমি একাত্তরে আমার মানচিত্র অর্জনের রক্তস্নাত পাণ্ডুলিপি
স্বাধীন দেশে প্রথম আনন্দ-মিছিল
সব হারানোর বেদনা ভুলে যাওয়া
তুমি উদার আকাশ, দিনের আরম্ভ, আদিত্য
তুমি লাবণ্য, তুমি কারু, ধ্রুপদ খেয়ালে পারদর্শী শিল্পী
আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা, সর্বদর্শী নিবেদন
চুম্বনের ধ্বনিহীন ধ্বনি
তুমি গন্ধর্ব দলের প্রতিনিধি।

তুমি স্বর্গের উদ্যানস্থ বৃক্ষ, তুমি সময়ের সারথি
তুমি সাংস্কৃতিক-গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ
যোজনব্যাপী বিস্তৃত গৌরব, মঙ্গল শোভাযাত্রা
তুমি অ-গতির গতি, নিরাশ্রয়ী গৃহীর গৃহ
চিঠিটি লিখব, যে চিঠি লেখা হয়নি আজও
সেখানে বর্ণিত হবে সব উপমা ছাড়িয়ে অখণ্ড বিবরণ
তুমি আমার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।

দুই.
তুমি নির্মাণে সৃজনে
(দেবাশীষ চৌধুরী রাজাদা ও সুপর্ণা দিদিকে)

আমি চাইলাম জল, শুধুই জল
তুমি করতল মেলে দেখালে ভূমণ্ডল
আমি চাইলাম নির্জনতার শব্দ
তুমি গিটারে আঙুল রেখে শোনালে তারের ঝংকার।

আমি চাইলাম একমাথা অবাধ্য চুল
তুমি দেখালে পুষ্পসম প্রস্ফুটিত প্রভাত
আমি চাইলাম কফির পেয়ালা নিয়ে অবিরত কথা বলতে
তুমি শাড়ির আঁচল টেনে উড়িয়ে দিলে স্বপ্নঘুড়ি।

আমি চাইলাম নক্ষত্রখচিত রাত
তুমি দেখালে উচ্ছল ঝর্ণার জলধারা
আমি আম্রকাননে, জ্যোতিষ্কমণ্ডলে তোমাকে চাইলাম
তুমি অবলীলাক্রমে সব দূরত্ব অতিক্রম করে গেলে।

আমি বললাম ভালোবাসার গভীরতা ও কষ্ট দুই-ই সমান্তরাল
তুমি বললে শীতের চাদরের মতো জড়ানো থাকে সৃজনশীলতা
আমি বললাম ভালোবাসা কখনও কখনও সুখের অসুখও হয়
তুমি বললে জীবনটাই তো পণ্যবাহী ট্রলার।

তোমার সঙ্গে যুক্তিযুদ্ধে আমি পরাস্ত
তুমি যেন পৃথিবীর আশ্চর্যতম এক আত্মা
তুমি পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে বরফগলা রোদ
তুমি আমাকে ইচ্ছেমতো রাজা হওয়ার স্পর্ধা দিয়েছ।

তিন.
বিপন্ন মানবতার প্রলম্বিত ছায়া

বেদনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা
সেই আয়নাল কুর্দির কথা কি সভ্যতা-মানবতা মনে রেখেছে
যে বালিতে মুখ গুঁজে সুমদ্রতীরে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেছিল?

‘আমার সন্তানেরা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু।
ওরা প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙাত
খেলা করত আমার সঙ্গে
এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে?
এ সবকিছুই হারিয়ে গেছে।’
সিরীয় শিশু আয়নালের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দির
শোকার্ত ওই উচ্চারণও কি
কথিত মানবিক বিশ্ব মনে রেখেছে?

তুরস্কের সৈকতে লাল শার্ট, হাফ প্যান্ট পরা
নিথর আয়নাল কিছু বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিলো
অভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপের নির্লিপ্ত নেতাদের
শেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙালেও এরই মধ্যে
আয়নালের ভাই গালিব আর তার মা রেহানাসহ
গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার প্রায় আড়াই হাজার মানুষের প্রাণ
ভূমধ্যসাগরে চিরতরে ডুবে গিয়েছিলো!

তুর্কি আলোকচিত্র সাংবাদিক নিলুফার দেমি বলেছিলেন,
‘যখন বুঝতে পারলাম ছেলেটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই নেই
মনে হলো, ওর ছবি তুলি; বেদনাদায়ক ঘটনাটা দেখুক সবাই
আশা করি, এই ছবি যে ধাক্কা দিয়েছে
তা চলমান সংকট সমাধানে সহায়ক হবে।’

বালু দিয়ে আয়নালের ভাস্কর্য বানিয়ে এর মর্মস্পর্শিতার
প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়েক।
ভাস্কর্যের পাশে তিনি লিখেছিলেন,
‘ভেসে যাওয়া মানবতা... লজ্জা লজ্জা লজ্জা’।

আলোকচিত্র সাংবাদিক দেমি, ভাস্কর পট্টনায়েক
তোমাদের সেই বেদনাকাতর আবেদন
মেরুকরণের বিশ্বে ভূ-রাজনীতির সমীকরণের বৃত্ত ভেদ করে না
গাজায় চরম মানবিক বিপর্যয়েও পরাশক্তির ভোঁতা বিবেক জাগে না
ইসরায়েলের জিঘাংসায় হাজার হাজার শিশু জন্মসনদের আগেই
মৃত্যুসনদ নিয়ে ফের প্রশ্ন রেখেছে, এই কি সভ্যতার উৎকর্ষ আলো!

যুদ্ধ নয় শান্তি চাই শান্তিপ্রিয়দের এই চিৎকার কে শোনে
রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও বিশ্বের কত দেশেই
বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানবতার প্রলম্বিত ছায়া!

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।