সুলতানার স্বপ্ন: আদর্শ বৈজ্ঞানিক ইউটোপিয়া
ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীরা যেমন- সাঁ সিমো, ফুরিয়ের, শার্লো প্রমুখ কল্পনা করেছিলেন ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও বৈষম্যহীন সমাজের কথা। ইউটোপিয়ার গুরুত্ব এইখানে যে, ইউটোপিয়া একটা সময় পর আর ইউটোপিয়া থাকে না। বিজ্ঞানসম্মত যে কোনো নির্দেশনা পরবর্তী সময়ে বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুশৃঙ্খল পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখে। যেমন- ইউটোপিয় সমাজতন্ত্রীদের চিন্তা-চেতনা ফরাসি বিপ্লবে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯০৫ সালে তদানীন্তন ভারতবর্ষে ইংরেজিতে প্রকাশিত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ‘সুলতানা’স ড্রিম’ তেমনই একটি আদর্শ ইউটোপিয়া। যা পৃথিবীর নারী মুক্তি আন্দোলন, বিজ্ঞাননির্ভর সমাজব্যবস্থায় দর্শন, শিক্ষানীতি, অর্থব্যবস্থা, কৃষিনীতি কেমন হতে পারে তার একটি নির্দেশনা। যা তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। হুমায়ুন আজাদ ‘নারী’ গ্রন্থে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন বৈজ্ঞানিক ইউটোপিয়া।’ রাজিয়া খান আমিন ‘A worker and an Educationist’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘Sultana’s Dream, a fantastic, is an astounding example of some of our earliest science fiction.’
বেগম রোকেয়ার বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাই তাঁকে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি জানতেন বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস। তাই তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব জয়জয়কার যাত্রাপথটি। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অভিযানে মানব সভ্যতার বিকাশ ও পরিণতিকে কল্পনায় বেঁধেছিলেন রোকেয়া, যা দৈনন্দিন জীবনে আজ আমরা প্রত্যক্ষদর্শী। রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’তে সৌরশক্তির ব্যবহার প্রাত্যহিক জীবনে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই চিন্তা করেছেন ১৯০৫ সালে। আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছি।
বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’র নারীস্থানে সমস্ত কর্মকাণ্ডে নারীরা নিয়োজিত। এ রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিচালনা পর্ষদে সবাই নারী। রোকেয়া বলেন, ‘এ দেশের নাম নারীস্থান’। এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন। পুরুষের অবস্থান সেখানে নেই বলে এমনটা বোঝায় না যে, তিনি পুরুষবিদ্বেষী। বরং নারীর উন্নত অবস্থা অর্জনের মাধ্যমে একটা আদর্শ সমাজ কেমন হতে পারে; সেই নির্দেশনাই ইউটোপিয়া আকারে রোকেয়া দিয়েছেন। যদিও সুলতানার স্বপ্নতে নারীর এই মহতি অর্জন সহজ কোনো পথে হয়নি। হাজারো প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে। তাই ‘সারা’ নামের ভগিনী সুলতানার কাছে বলে, ‘এই পরিবর্তনের পূর্ব্বে আমরাও আপনাদের মতো কঠোর অবরোধ বন্দিনী থাকিতাম।’ রোকেয়া এই উক্তির মাধ্যমে এটাই ইঙ্গিত দিতে চান যে মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে চিন্তা-চেতনায় এমনতর উচ্চ রুচি-সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব, যা অনাগত ভবিষ্যতের জন্য অনাবিল জীবন তৈরি করতে পারে।
সুলতানার স্বপ্নতে নারীস্থানের যে শিক্ষা ব্যবস্থা রোকেয়া কল্পনা করেছেন তা অত্যন্ত আধুনিক। নারীস্থানে রোকেয়া বিজ্ঞান শিক্ষার কথা বলেছেন। যেখানে নারীর যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠবে। তাই তিনি রসায়ন বিজ্ঞান ও পদার্থ বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক অর্জনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ জীবন কামনা করেছেন। রাষ্ট্রের সাধারণ নারীরাই শুধু নয়, স্বয়ং রাষ্ট্রের অধিপতি মহারানিও বিজ্ঞানে পড়াশোনা, গবেষণা এবং নিবিড় অনুসন্ধান কাজে নিয়োজিত থাকবেন। যা জ্ঞানচর্চা এবং বিজ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। রোকেয়া লিখেছেন, ‘মহারাণী বাল্যকাল হইতেই বিজ্ঞান চর্চা করিতে ভালোবাসিতেন। সাধারণ রাজকন্যাদের ন্যায় বৃথা সময় যাপন করিতেন না। একদিন তাহার খেয়াল হইলো যে তাঁহার রাজ্যের সমুদয় স্ত্রীলোকই সুশিক্ষাপ্রাপ্ত হউক।’ ফলে নারীস্থানের রানির সদিচ্ছার কারণেই অতঃপর বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ায় বাল্যবিবাহ বিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা আধুনিক শিক্ষানীতির বৈশিষ্ট্য—‘বাল্যবিবাহ প্রথাও রহিত হইলো। একুশ বৎসর বয়ঃক্রমের পূর্ব্বে কোন কন্যার বিবাহ হইতে পারিবে না—এই আইন হইল।’
বেগম রোকেয়া বুঝেছিলেন আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হবে বুদ্ধি। কারণ বুদ্ধিলব্ধ প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নত শারীরিক পরিশ্রমের গুরুত্বকে কমিয়ে দেবে। কেবল শারীরিক শক্তি বেশি হলেই কেউ অন্যের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা প্রভুত্ব দাবি করতে পারে না। কারণ আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে মানসিক শক্তি অর্থাৎ বুদ্ধিমত্তার ওপর ভিত্তি করে, নিছক পেশীশক্তির ওপর ভর করে নয়। তাই সারার কণ্ঠে রোকেয়ার উক্তি, ‘কেবল শারীরিক বল বেশি হলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না। সিংহ কি বলে বিক্রমে মানব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলিয়া কি কেশরী মানবজাতির উপরে প্রভুত্ব করিবে?’
রাজ্যের মহারানির বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা কাঠামো গোটা নারীস্থানের নারীদের বিজ্ঞানমনস্ক এবং জ্ঞানপিপাসু করে তুলেছিল। রোকেয়া যেসব আবিষ্কার এবং বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রার ইঙ্গিত দিয়েছেন তা অভাবনীয়। নারীস্থানে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত ঘটানোর পদ্ধতির কৌশল তিনি উল্লেখ করেছেন। রাসায়নিক উপাদানের সাহায্যে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের বিষয়টি মার্কিন বিজ্ঞানী ভিনসেন্ট শেফার ও আরভিং ল্যাংমুর আবিষ্কার করেন রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের তিন দশক পরে। রোকেয়া দেখাতে চেয়েছিলেন বেলুনের সাহায্যে আকাশে মেঘের জল নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা, যা আধুনিক বিশ্বে আমরা দেখতে পাই। কিছুদিন পূর্বে দুবাইতে কৃত্রিম পদ্ধতিতে বৃষ্টিপাত ঘটানোর দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই।
বেগম রোকেয়া ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর প্লেনে চড়েন। ১৯০৫ সালে যখন রোকেয়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লেখেন; তখনও ভারতবর্ষে প্লেন আসেনি। ‘আকাশ পথে পঞ্চাশ মাইল’ প্রবন্ধে রোকেয়া বলেন, ‘যে সময় আমি সুলতানার স্বপ্ন লিখিয়াছিলাম, তখন এরোপ্লেন বা জেপেলিনের অস্তিত্ব ছিলো না; এমন কি সে-সময় ভারতবর্ষে মোটরকারও আসে নাই। বৈদ্যুতিক আলোক এবং পাখাও কল্পনার অতীত ছিল। অন্ততঃ আমি তখন সে সব কিছুই দেখি নাই।’
আসলে ইতোমধ্যে প্লেন আবিষ্কার হয়ে গেছে, কিন্তু ভাগলপুরের সেই বিদ্যুৎবিহীন, আলোবিহীন পরিবেশে থেকে প্লেন সম্পর্কে না জেনেও রোকেয়ার প্রসারিত মন এবং অনুসন্ধানী মনন কাঠামোই তাঁকে নিয়ে গেছে সমসাময়িক সমস্ত আবিষ্কারের অভিযানে। স্বপ্নকে জীবনমুখী করে তিনি লিখলেন, ‘To this plank, she attached two smoot and well -polished balls. When I asked her what the balls were for, she said they were hydrogen balls and they were used to overcome the force of gravity.’
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, অরভিল রাইট (১৯ আগস্ট ১৮৭১-৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮) এবং উইলবার রাইট (১৬ এপ্রিল ১৮৬৭-৩০ মে ১৯১২) এই দুজন মার্কিন প্রকৌশলীকে একবিংশ শতাব্দীতে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বরে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কিটি হকে প্রথম নিয়ন্ত্রিত, শক্তিসম্পন্ন এবং বাতাসের চাইতে ভারী সুস্থিত মানুষ বহনযোগ্য উড়োজাহাজ তৈরি করেন। মূলত তাঁরা ১৯০০ সালে একটা গ্লাইডার তৈরি করেন, যার পাইলট উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণ করবেন। পরবর্তী দু’বছর তারা তাদের উড়ন-যন্ত্রটিকে অনড়-পাখাবিশিষ্ট উড়োজাহাজে রূপান্তরিত করেন। তার মানে ১৯০৩ সালে বিমানে ইঞ্জিন বসানো এবং উড্ডয়ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে। পরীক্ষামূলক বিমান নির্মাণে সর্বপ্রথম না হলেও তাদের আবিষ্কৃত উড়োজাহাজ একজন নিয়ন্ত্রকের সাহায্যেই একটি অনড়-পাখাবিশিষ্ট উড়োজাহাজের ন্যায় উড্ডয়নে সম্ভব হয়।
১৯০৩ আর ১৯০৫ সালের মাঝখানে মাত্র দুটি বছরের ফারাক তো বটেই, আবার আমেরিকা ও ভারত বর্ষের দূরত্বও লক্ষ লক্ষ মাইল। তাতে বোঝাই যাচ্ছে রোকেয়ার বায়ুযান আজকের উড়োজাহাজ। যা তিনি আবিষ্কারের প্রথমেই চিন্তা করেছেন। হাজার বছরের পিছিয়ে থাকা ভারতবর্ষের নারীদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি রোকেয়া গুরুত্ব দিয়েছেন। অযৌক্তিক শোষণ নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট নারী সমাজ কীভাবে দেহ-মনে যুগের পর যুগ পিছিয়ে আছে; তা-ই তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন তুলনামূলক চিত্র অঙ্কন করে। গোটা ভারতবর্ষের ভঙুর স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতের বিপরীতে রোকেয়া তুলে ধরেছেন সুপরিকল্পিত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান। তুলনামূলক চিত্রে তিনি দেখিয়েছেন মহামারীর মতো প্লেগ, শিশুমৃত্যু কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়। তিনি সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন স্বাস্থ্যহানীর কারণ অনুসন্ধানে। সব রোগের কেন্দ্রে পৌঁছাতে চেয়েছেন। খাদ্যের অভাবকে যাবতীয় স্বাস্থ্য জটিলতার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্লেগ টেলেগ কিছুই নহে—কেবল দুর্ভিক্ষপ্রপীড়িত লোকেরা নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে। একটু অনুধাবন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গ্রাম অপেক্ষা নগরে প্লেগ বেশী,—নগরে ধনী অপেক্ষা নির্ধনের ঘরে প্লেগ বেশী হয় এবং প্লেগে দরিদ্র পুরুষ অপেক্ষা দরিদ্র রমণী অধিক মারা যায়। সুতরাং বেশ বুঝা যায়, প্লেগের মূল কোথায়—মূল কারণ ঐ অন্নাভাব। আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালিরিয়া আসুক তো দেখি।’ মানবদেহে আক্রমণকারী রোগ-জীবাণুর উল্লেখ প্রমাণ করে রোকেয়ার নিশ্চয়ই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞান ছিল।
মানুষের জ্ঞান, মেধা, মনন, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতিকে কতটুকু ধারণ করা যায় তার ওপর। পুরুষের মস্তিষ্ক নারীর মস্তিষ্ক থেকে উন্নত—এই প্রবাদ বাক্য সমাজ মননে পুরুষতান্ত্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও প্রথা প্রতিষ্ঠানগুলো যুগ যুগ ধরে নর-নারীর মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সুলতানার স্বপ্নতে রোকেয়া এই অবৈজ্ঞানিক তথাকথিত বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন সারার মাধ্যমে। পুরুষের মস্তিষ্ক রমণীর তুলনায় বৃহত্তর বলাতে সারার উত্তর, ‘মস্তিষ্ক গুরুতর হইলেই কি? হস্তীর মস্তিষ্কও ত মানবের তুলনায় বৃহৎ এবং ভারী, তবু ত মানুষ হস্তীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছে।’ অথচ মস্তিষ্কের আয়তন দিয়ে দুটি প্রাণী বা দুজন মানুষের মধ্যে যে বুদ্ধির পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না, কারণ শারীরিক উচ্চতা ও গঠনের ওপর মস্তিষ্কের আয়তন নির্ভর করে—এটা বর্তমান জীববিজ্ঞানের আবিস্কার।
আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন বেগম রোকেয়া তাই মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পুরুষের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন না। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে সামরিক শক্তি নির্মাণের পথনির্দেশ তাঁর আছে। কথিত পুরুষ নয়, এখানে বহিঃশত্রু আক্রমণ মোকাবিলা করা হয় জ্ঞানের শক্তিতে বিনা রক্তপাতে, উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে। সামরিক শক্তি ব্যবহার প্রসঙ্গে সুলতানার স্বপ্নর আরও কথপোকথন:
‘...মনে করুন আমাদের সঙ্গে অন্যুন দ্বিসহস্র সার্চলাইট ছিল, অবশ্য সে যন্ত্রগুলি ঠিক সার্চলাইটের মত নয়, ...কেবল আপনাকে বুঝাইবার জন্য তাহাকে সার্চলাইট বলিতেছি। ষ্টীমারের সার্চলাইটে উত্তাপের প্রাখর্য্য থাকে না, কিন্তু আমাদের সার্চলাইটে ভয়ানক উত্তাপ ছিল। ছাত্রীগণ যখন সেই সার্চলাইটের কেন্দ্রীভূত উত্তাপ রশ্মি শত্রুর দিকে পরিচালিত করিলেন, তখন তাহারা হয়ত ভাবিয়াছিল, কি ব্যাপার। শত সহস্র সূর্য্য মর্ত্তে অবতীর্ণ। সে উগ্র উত্তাপ ও আলোক সহ্য করিতে না পারিয়া শত্রুগণ দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হইয়া পলায়ন করিল। নারীর হস্তে একটি লোকেরও মৃত্যু হয় নাই-এক বিন্দু নরশোণিতেও বসুন্ধরা কলঙ্কিত হয় নাই—অথচ শত্রু পরাজিত হইল। ...তাহাদের সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র সূর্য্যকিরণে দগ্ধ করা গেল। ...তদবধি আর কোন প্রতিবেশী রাজা মহারাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করিতে আইসেন নাই।’
বেগম রোকেয়া তাঁর প্রজ্ঞার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন, আধুনিক জগতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উৎকর্ষের জগতে প্রবেশ না করলে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত থাকবে না। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে নারীস্থানে নিয়ন্ত্রণ করা হয় খরা, মশার কামড়, মহামারী বা অকালমৃত্যু। সেখানে আছে কলকারখানা, বিশাল জলাধার বেলুন যা দিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়, আছে সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ-যন্ত্র, আছে সৌরচুল্লি যার সাহায্যে গরমকালে হয় ধূমবিহীন রন্ধন আবার শীতকালে ঘরে থাকে পর্যাপ্ত উত্তাপ। বিদ্যুতের সাহায্যে কৃষি ফসল উৎপাদন, সেচ প্রকল্প, ভারী বোঝা উত্তোলন ও বহনের কাজ বিদ্যুৎচালিত যন্ত্র দিয়ে করতে চান। সুলতানা বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ এর সাহায্যে চাষ করিয়া থাকি। চপলা আমাদের অনেক কাজ করিয়া দেয়, ভারী বোঝা উত্তোলন ও বহনের কার্য্যও সে-ই করে। আমাদের বায়ু শকটও ত দ্বারা চালিত।’
বেগম রোকেয়া পরিবেশ বিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান রাখতেন বলেই প্রাণ প্রকৃতি এবং পরিবেশের ভারসাম্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি ভারতবর্ষের রুগ্ন পরিবেশের বিপরীতে একটি সুন্দর পরিপাটি সুশৃঙ্খল নগরীর চিন্তা করেছেন, যেখানে প্রাণ প্রকৃতি ও মানবকূল থাকবে সুবিন্যস্ত। তিনি নারীস্থানের সমস্ত নগরীকে একটি কুঞ্জভবনের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতি রাণীর লীলা কানন’। তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, ‘ভারতবাসী ইচ্ছা করিলে কলিকাতাকে ইহা অপেক্ষা অধিক সুন্দর পুষ্পাদ্যানে পরিণত করিতে পারেন’।
বিজ্ঞানমনস্ক বেগম রোকেয়া বৈষয়িক উন্নয়নের পাশাপাশি আত্মিক উন্নয়নের গুরুত্বও উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি জানতেন, এ দুয়ের সংমিশ্রণ ব্যতীত প্রশান্তিময় জীবন গঠন সম্ভব নয়। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই নারীস্থানে মহারানির আত্মিক উন্নয়ন এবং বৈষয়িক পরিমিতিবোধ সবার মন জয় করেছে। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে সত্যানুসন্ধান এবং জ্ঞান অর্জনই তাদের জীবনের মূলমন্ত্র। তাই থানা-পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই সে দেশে। সুলতানার স্বপ্নতে মহারানির উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমরা অপরের জমি জমার প্রতি লোভ করিয়া দুই দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না; অথবা একখন্ড হীরকের জন্য যুদ্ধ করি না,—যদ্যপি তাহা কোহেনূর অপেক্ষা শতগুণ শ্রেষ্ঠ হয়; কিম্বা কাহারও ময়ূর সিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞান সাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি।’
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জিকেএস