গল্প শুধু গল্প নয়

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০২:৩৩ এএম, ১৩ মার্চ ২০১৬

এ বছরের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশ হয়েছে তরুণ শিশুসাহিত্যিক মিজানুর রহমান মিথুনের শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘স্কুলের সাহসী ছেলেটি’। এই গ্রন্থে মোট ১০টি গল্প স্থান পেয়েছে। প্রত্যেকটি গল্প পড়ে মনে হয়েছে, এতো শুধু গল্প নয়- আমাদের ইতিহাস, আমাদের সচেতনতা।

‘স্কুলের সাহসী ছেলেটি’ গ্রন্থে মামার সাথে ঈদ, জন ও জয়িতার লঞ্চ ভ্রমণ, আবীরের নানা ভাই, অতশীর নেপালি বন্ধু, জাগতে হবে জাগাতে হবে, রাসেলের সঙ্গে দেখা, রাসেলের জন্য অপেক্ষা, ইমন ও ছোট মামা, স্কুলের সাহসী ছেলেটি ও নানা ভাইয়ের স্কুল শিরোনামে গল্পের সঙ্গে পরিচিত হলাম। গল্পের গভীরে ডুব দিয়ে শুধুই রসবোধ নিয়ে ফিরিনি, ফিরেছি অনুপ্রেরণা, ইতিহাস আর সচেতনতা নিয়ে।

সায়েমের মামাকে কেন্দ্র করে ‘মামার সাথে ঈদ’ গল্পটি। ঈদে মামার সাহচার্যে আনন্দিত হয় সায়েম ও মিশু। এবার ঈদে মামার আসার কথা থাকলেও হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় আসা হয় না তার। উল্টো মায়ের সাথে ঢাকা যেতে হয় ওদের। তবে গল্পে মামার পরিণতি স্পষ্ট নয়। হাসপাতালের বেডে মামা ঘুমাচ্ছেন। তার ঘুম ভাঙার অপেক্ষার মধ্যদিয়েই গল্পের সমাপ্তি।

‘জন ও জয়িতার লঞ্চ ভ্রমণ’ গল্পটিকে পুরোপুরি শিশুতোষ বলতে পারছি না। কারণ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীর অভিজ্ঞতার চিত্র ফুটে উঠেছে তাতে। গল্পে সময়ের ঐক্যও রক্ষিত হয়েছে কিনা তা ভাবনার বিষয়।

‘আবীরের নানা ভাই’ গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। নানার সঙ্গে আবীরের গভীর বন্ধুত্ব। আবীরের সব প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। নানার সব কাজেই আবীরের উপস্থিতি। গল্পের শেষে প্রসঙ্গক্রমে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার কথা ছিলো, কিন্তু গল্পটা বলার আগেই গল্পটা শেষ হয়ে গেলো। হয়তো ছোটগল্প বলেই এমন হলো।

‘অতশীর নেপালি বন্ধু’ গল্পে হিমালয় দেখতে বাবার সঙ্গে নেপালে যায় অতশী। পাঁচদিনের সফরে নেপালি বন্ধু উথান মায়া তাদের সঙ্গ দেয়। পরে নেপাল ভ্রমণের একবছর পর নেপালে ‘ভূমিকম্পের’ খবর দেখে উথানের কথা মনে পড়ে। কিন্তু উথানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। কান্নায় ভেঙে পড়ে অতশী।

দুর্যোগ বিষয়ক আরেকটি গল্প ‘জাগতে হবে জাগাতে হবে’। এটাকেও শিশুতোষ বলা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু তরুণের ভালো উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে গল্পে। তথ্যে-উপাত্তে ঠাসা গল্পটিকে কিছুটা প্রবন্ধই মনে হবে। ‘হাফেজ পাগলার’ দৃশ্যটুকু বাদে পুরোটাই দুর্যোগ বিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ।

এক শিশু সাংবাদিকের স্বপ্নে ‘রাসেলের সঙ্গে দেখা’ হওয়ার অনুভূতি নিয়ে চমৎকার একটি গল্প পাঠ করতে পারবেন। ঘুমের ঘোরে শেখ রাসেলের বাসায় ফোন করে শিশু সাংবাদিক তানিয়া। কথা হয় রাসেলের মায়ের সঙ্গে। কিন্তু ঘুম ভাঙার সাথে সাথে স্বপ্নও ভেঙে যায় তানিয়ার।

‘রাসেলের জন্য অপেক্ষা’ গল্পে নাভিদের সঙ্গে কথা বলার কেউ নেই। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। এ নিয়ে নাভিদের মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি নাভিদের বাবাকে বিষয়টি ফোনে জানান। নাভিদের বাবা বাসায় এসে কথা বলে নাভিদের সঙ্গে। নাভিদের মনের ইচ্ছা জানতে চান। নাভিদ জানায়, শেখ রাসেলের একটা ছবি এঁকেছে সে। ছবিটা টুঙ্গিপাড়ায় রেখে আসতে চায়। এ কথা শুনে নাভিদের ইচ্ছা পূরণের জন্য রওয়ানা হন তারা।

বিচ্ছিন্ন তিনটি ঘটনা নিয়ে ‘ইমন ও ছোট মামা’ গল্পটি। প্রথমে ধূমপানের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়েছে। পরের দুটো ঘটনা ইলিশ মাছ নিয়ে। শেষের ঘটনাটা একটু অসামঞ্জস্য মনে হয়েছে। তবে শিশুমনে তো কত খেলাই উদয় হতে পারে। তবে গল্পের বিষয়বস্তু খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি।

গ্রন্থের নামগল্প ‘স্কুলের সাহসী ছেলেটি’। আনিস মামার কক্ষে বঙ্গবন্ধুর চারটি ছবিকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকে গল্প। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী থেকে গল্পের প্লট নির্মাণ করা হয়েছে। গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘সেই সাহসী ছেলেটি’র কথা উঠে এসেছে গল্পে।

‘নানা ভাইয়ের স্কুল’ গল্পে রাফিদ স্কুলে নতুন ভর্তি হবে। কিন্তু রাফিদকে শোনানো হয় তার নানা ভাইয়ের স্কুলে ভর্তি হওয়ার কাহিনি। হয়তো রাফিদকে সাহস জোগানো বা নানার অভিজ্ঞতা শেয়ার করাই উদ্দেশ্য ছিলো।

তবে গ্রন্থের বেশকয়েক স্থানে বানান ভুল চোখে পড়েছে। যা হয়তো যথাযথ সম্পাদনার অভাবেই হয়ে থাকবে। লেখক ও প্রকাশকের আরো একটু যত্নশীল হওয়ার দাবি রাখা যায়। প্রায় গল্পেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে নানা-মামা এসেছে। কোনো কোনো গল্পে দাদা-চাচা এলেও মন্দ হতো না। কেমন যেন একটু দৃষ্টিকটুই মনে হয়। প্রত্যেক শিশুর জীবনে দাদা-চাচাদেরও একটা প্রভাব থাকে।

সে যাই হোক- সবমিলিয়ে ভালো লেগেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে এমন সাবলীলভাবে গল্পে তুলে আনা কষ্টসাধ্যই বটে। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালির ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে থাকা সর্বহারা একটা পরিবারের কাহিনি গল্প আকারে এনে লেখক আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা শিখিয়েছেন।

শিশুদের শুধু হালুম-হুলুম, চাঁদ-তারা ও ভূতের গল্প না শুনিয়ে এমন কিছু মৌলিক গল্প উপহার দেয়া যেতেই পারে। তাতে আমরা সকলেই উপকৃত হতে পারি। উপকৃত হতে পারে দেশ, মাটি ও মানুষ।

বইটি প্রকাশ করেছে সাহস পাবলিকেশন্স। মনিরুজ্জামান পলাশের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণে নতুন মাত্রা পেয়েছে গ্রন্থটি। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৩৪ টাকা।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।