মাসরুর আরেফিনের ‘আড়িয়াল খাঁ’তে স্নানের পর
হাসান হামিদ
আদিমকাল থেকেই মানুষের প্রবল আগ্রহ গল্প শোনা এবং বলার প্রতি। এই আগ্রহের কারণেই নানা কাহিনির উদ্ভব হয়েছে যুগে যুগে। এভাবেই ক্রমে সুপ্রাচীন কাব্য, মহাকাব্য হয়ে আজকের আধুনিক সাহিত্যের সৃষ্টি। আর আধুনিক কালের অনন্য বিশিষ্ট এক ধরনের শিল্পরূপ হলো উপন্যাস।
এই শিল্প মাধ্যমটি মূলত কাহিনি রূপ একটি উপাদানকে বিবৃত করার বিশেষ কৌশল। উপন্যাসের সংজ্ঞায় বলা হয়: a fictitious prose narrative or tale presenting picture of real life of the men and women portrayed. আবার এরই একটি বিশেষ শাখা আঞ্চলিক সাহিত্য। এর ক্ষেত্রে বলা হয়, Regional literature is a fiction or poetry that focuses on the characters, dialect, customs, topography, and other features particular to a specific region.
যদিও আমরা অনেকেই জানি কোনো একটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গল্প বা উপন্যাস লেখা হলেই তাকে আঞ্চলিক সাহিত্য বলা যায় না। অবশ্য এ কথা চিরন্তন, সব বৃহৎ সাহিত্যকর্মেই কোনো না কোনো অঞ্চলের মানুষের প্রতিফলন কম-বেশি থাকে। সম্প্রতি পড়ে শেষ করলাম, এই সময়ের অন্যতম চর্চিত এবং আলোচিত কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিনের ‘আড়িয়াল খাঁ’ উপন্যাসটি। এই বইটি সংগ্রহ করার সময় আমার ভাবনাটি ছিল, এটি নিশ্চয়ই একটি আঞ্চলিক উপন্যাস।
আমার এমন ভাবনার কারণ আছে। এর আগে নদীকেন্দ্রিক অনেক উপন্যাস আমরা বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি। উদাহরণ হিসেবে অনেক নাম বলা যাবে- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’; অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’; সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’; আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ কিংবা দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ ইত্যাদি। আজকের এই লেখাটি মাসরুর আরেফিনের ‘আড়িয়াল খাঁ’ নিয়ে। তবে শুরুর আগে আড়িয়াল খাঁ নদ সম্পর্কেও দু’লাইন জানিয়ে রাখি। পদ্মার একটি প্রধান শাখা নদ এই আড়িয়াল খাঁ। এটি ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশাল জেলায় বয়ে চলেছে। একসময় এ নদটির নাম ছিল ভুবনেশ্বর। ঠগি দমনের জন্য ১৮০১ সালে আড়িয়াল খাঁ নামক একজন জমাদার ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। ওই সময়ে ভুবনেশ্বর নদ থেকে একটি খাল খনন করিয়ে তা সংযুক্ত করা হয় প্রাচীন পদ্মার দক্ষিণাংশের সঙ্গে।
এই খালটিই কালক্রমে প্রবল রূপ ধারণ করে এবং সাধারণ জনগণের কাছে পরিচিত হয় আড়িয়াল খাঁ নামে। আর এ নামেই মাসরুর আরেফিন লিখেছেন তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘আড়িয়াল খাঁ’। এতে একটি অঞ্চলের জীবনযাত্রা প্রতিফলিত হলেও এর মধ্যে বৃহত্তম মানব জীবনের নানা আয়োজন প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে সেই অঞ্চলের কয়েকটা চরিত্রের মনের চেতন-অবচেতন কিংবা প্রাক চেতনের বিশ্লেষণ এমনভাবে এসেছে, কখনো মনে হয়েছে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় শক্তিই আদতে এই বিষয়গুলো।
আমরা দেখি ‘আড়িয়াল খাঁ’র গল্প জাহেদ নামের এক বালকের চিন্তার জগৎ ও চারপাশ নিয়ে। ছেলেটির ভাবনার মধ্যেও কোনো বেড়া নেই। লেখকের ভাষায়, ‘দারিদ্র্যে ভরা শৈশবের স্মৃতি, মারাত্মক শিশু যৌন-নিপীড়ন, চরম সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস, ভয়াবহ লিঙ্গবৈষম্য, বহিরাগত রেলগাড়ি-ভেঙে-খাওয়া লোকেদের কৃপাহীন সন্ত্রাস আর বাংলা সাহিত্যে অভূতপূর্ব-অশ্রুতপূর্ব যৌনতার বোধের উন্মেষের এক বিভীষিকাময় কাহিনি— যার শুরু ভয়-শঙ্কা ও আশঙ্কায়, যার মাঝখানটা ভরা হাঁস-মুরগি-কুকুর-গুইসাপ আর পানাপুকুরের মানুষপ্রতীম আচরণে, আর যার শেষটা বিদ্রোহে (সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে লেখকের ভাষিক বিদ্রোহসহ), যেহেতু সেটাই নিয়ম এই পৃথিবীর’। তবে এ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রেক্ষাপট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড। প্রসঙ্গটি উপন্যাসের ক্লাইমেক্সে ভালো ভূমিকা রেখেছে।
কোনো উপন্যাস পড়ার সময় আমরা বুঝতে পারি লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শনটা আসলে কেমন ছিল। কারণ মোটামুটি সব উপন্যাসে বিশেষত আঞ্চলিক সাহিত্যে মানবজীবনসংক্রান্ত কোনো না কোনো সত্যের উদ্ঘাটন পরিস্ফুটন হয়। আমরা যাকে গল্প বলি, সেটির কতটুকু আসলে বানানো? কাল্পনিক হলেও সেটি কি একই সঙ্গে জীবনের চিত্র এবং জীবনের দর্শন এই দুটিকে পুঁজি করে লেখা হয় না? ‘আড়িয়াল খাঁ’ উপন্যাস পাঠ করতে করতে ভাবছিলাম, মানবজীবনসংক্রান্ত কোনো সত্যকে গভীরভাবে মাসরুর আরেফিন উপলব্ধি করে তা আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন? কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া ঢাকা লিট ফেস্টের এক সেশনে ‘উপন্যাসকে একান্তই আখ্যান হিসেবে ভাবেন নাকি তাতে তত্ত্বগত বিষয়ও আসে’ এমন প্রশ্নের জবাবে মাসরুর আরেফিন বলেছিলেন, ‘আমরা ইতিহাসের মাঝেই আছি। ইতিহাসই আমার লেখার উপজীব্য। আমরা ইতিহাস নির্মাণ করি না। ইতিহাস আমাদেরকে নির্মিত করেই রেখেছে। আমার লেখার মেরুদণ্ড হলো আমার দর্শন।’
এই দর্শনের কথা বলার ফাঁকে ‘আড়িয়াল খাঁ’ থেকে কয়েক লাইন পাঠ করতে চাই, ‘মানুষেরা প্রজাতি হিসেবে হাস্যকর। তারা গর্বোন্মাদ, কুৎসিত, স্বার্থপর ও নিজেদের ব্যাপারে ভুল ধারণায় আত্মভোলা’। কিংবা ‘এই পৃথিবী অনেক পুরোনো এবং সে বার বার একেকজনের কাছে নতুন হয়ে ওঠে ক্রোধ ও ঘৃণা তাকে নতুন নতুন রূপ দেয় বলেই’। আবার যেমন, ‘পৃথিবী পুরনো হতে পারে, আকাশজুড়ে ছুটে চলা ধূমকেতুদের সঙ্গে ভাটিখানার প্রতিটা বাড়ির প্রতিটা ইটের সম্বন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর তালা এক স্থির ও মোটা পাথরে বানানো তালা এবং সে তালার কোনো চাবি কারও কাছে নেই, কারণ পৃথিবীর আত্মা বলে কিছু আসলে নেই’ (পৃষ্ঠা-২২, ৩৯, ৪০)।
লেখক মাসরুর আরেফিনের আগ্রহ প্রধানত মানুষের জীবনকে ঘিরে। এ কারণে তিনি ‘আড়িয়াল খাঁ’ নির্মাণ করেছেন নদীকেন্দ্রিক সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে। সোজা করে বললে আশির দশকের বরিশাল অঞ্চলের একটি এলাকার কিছু চরিত্র আত্মসাৎ করেই মাসরুর আরেফিন লিখেছেন এই উপন্যাস। শুধু জাহেদ নয়; এখানকার পারভিন, মালেক হুজুর, কাশেম, রহিমা বেগম, এনায়েত, মিজান, আনোয়ারা, ফোরকানউদ্দিন, আঁখি, শামছু, বামন হায়দার কিংবা ডাক্তার হরলাল আমাদের অচেনা কেউ নয়। আর এই মানুষগুলোই উপন্যাসে বিচরণ করেছে এবং গল্পের ঠাসা বুননে হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত।
পাশাপাশি ‘আড়িয়াল খাঁ’র তীরে বিধৃত জীবনগুলো আঞ্চলিক সত্তার প্রতীক হয়েও চিরন্তন মানবিকতার স্পর্শ পেয়েছে বলা যায়। আরেকটি কথা বলতেই হয়; ‘আড়িয়াল খাঁ’র অনেক জায়গায় পরিবেশের বিবরণের চেয়ে চরিত্রের নিজের মুখের একটি সংলাপ সেই চরিত্রকে উপলব্ধির জন্য বেশি শক্তিশালী মনে হয়েছে। যেমন একটি সংলাপ- ‘তখন দোকানদার বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ‘মা, তোমার বয়স আমি পার হয়ে আসছি। তুমি পঙ্কজকান্তি কিনতে আসো নাই। তুমি আসছ আড়িয়াল খাঁয় নাগর নিয়া ঘুরতে। তোমার লাগবে রাজা কনডম, মাইন্ড কইরো না’।
‘আড়িয়াল খাঁ’ পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে না ঘটনাই মুখ্য, চরিত্র সৃষ্টি গৌণ। বরং মনে হবে ঘটনা ও চরিত্র একটি অন্যটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মাসরুর আরেফিনের শক্তিমত্তার পরিচয় পাই জাহেদের চরিত্রচিত্রণে। কিংবা ধরুন পারভিনের কথা। লেখকের বয়ানেই শোনা যাক পারভিন সম্পর্কে: ‘আড়িয়াল খাঁ‘ আমার চতুর্থ উপন্যাস, আমার একদম অন্য মেজাজের এক লেখা। আর এতে ১৯৮০-র এমন এক বাংলাদেশের, এমন এক ঘন-বুনো-জংলী-সান্দ্র বাংলাদেশের গল্প আছে যে, যারা সেই মানুষ-গাছ-পাখি-পশু-নক্ষত্র-হাওয়া একসঙ্গে মিশে থাকা অবাক হলুদ ও অবাক নীলের সম্মিলনের আশ্চর্য শ্যামল-সবুজ বাংলাকে দেখেননি, যাদের জন্ম হয়েছে ধরা যাক তার পরে, তারা সেই বিস্ময়-বাংলাকে এ উপন্যাসে দেখবেন আর ভাববেন- হুম, বোঝা গেলো, এটা তাহলে ‘পারভিন’ নামের এক নক্ষত্রমণ্ডলীর গল্প, এই পৃথিবীর নয়।
যেমন- নায়ক জাহেদের সুন্দরী বড় বোন পারভিনকে জাহেদের এনায়েত স্যার বলছেন, ‘ধরো পারভিন, তোমার নামটাই ধরো। কতো প্রোডাকটিভ একটা নাম সেটা। পারভিনের অর্থ জানো? সাত-বোন তারামণ্ডলী- ৪৪৪ আলোকবর্ষ দূরে আছে পৃথিবীর সবচাইতে কাছের যে-নক্ষত্রম-ল, তার নাম পারভিন। রাতের আকাশে আমাদের পৃথিবী থেকে স্পষ্ট খালি চোখে ওই পারভিনকেই শুধু দেখা যায়। বি-টাইপ নক্ষত্র ওরা, টরাস তারাম-লীর উত্তর-পশ্চিমে থাকে। বুঝলে কিছু গালে-টোল-ফেলা মেয়ে, বুঝলে কিছু তুমি?’
ঔপন্যাসিক মাসরুর আরেফিন ‘আড়িয়াল খাঁ’তে দেশকালগত সত্যকে পরিস্ফুটিত করতে পরিবেশকে নির্মাণ করেছেন নিজের মতো করে। এই পরিবেশ বলতে কিন্তু কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্যকে বোঝায় না। এর মানে আসলে স্থান-কালের স্বাভাবিকতা এবং ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক জীবন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর রচিত চিত্রকল্প বেশ লেগেছে। আবারও ‘আড়িয়াল খাঁ’ থেকে কয়েক লাইন- ‘সন্ধ্যা দ্রুত পায়ে এই শহরের প্রান্তসীমার গ্রাম-গ্রাম এলাকাটাতে নামছে আর তেরো বছরের বাচ্চা ছেলে জাহেদের ততই বেশি করে মনে হচ্ছে, আজ রাতের নৌকায় বাবার সঙ্গে আড়িয়াল খাঁ নদীতে যাবার ব্যাপারে এ বাড়ির লোকগুলোকে রাজি করানোর সময়টুকু তার কমে আসছে, কমেই আসছে। ‘রাতের নৌকা’, শব্দ দুটো নিয়ে ভাবলো সে। তার মনে হলো, ব্যাপারটার মধ্যে কেমন এক শান্ত ও কম্পনশূন্য কী যেন আছে, আর সারাদিন ধরে গড়িয়ে চলে রাতে পৌঁছানো দিনের মধ্যেও তো আছে কেমন অচাঞ্চল্য, স্থিরতা’ (পৃষ্ঠা-৭)।
‘আড়িয়াল খাঁ’ মাসরুর আরেফিন না লিখে যদি আর কেউ লিখতেন, তাহলে কী হতো; কেমন? মাসরুর আরেফিন রচিত সাহিত্যকর্মের ভাষাগত অবয়ব, জীবনদৃষ্টি কিংবা জীবনসৃষ্টির শৈলী নিঃসন্দেহে তাঁর সময়ের যেকোনো লেখকের চেয়ে আলাদা। আর এটাই তাঁর বিশিষ্টতার পরিচায়ক। নয় কি?
এইচআর/জিকেএস