ছোটগল্প: মোহন সন্ধ্যায়, রাই
রাই দাঁড়িয়ে আছে ইস্টার্ন প্লাজার সামনে! ঈদের ছুটির পর অফিস আদালত খুলেছে আজ প্রথম দিন। রাস্তাঘাট এখনো একেবারে সুনসান ফাঁকা। মানুষজনের দেখা নেই বললেই হয়। নিত্যদিনের চেনা শহর ঈদের সময়টাতে কেমন যেন বদলে যায়। জনশূন্য শহরটাকে খুব শান্ত শান্ত লাগে। সেই সঙ্গে কিছুটা ভৌতিক মনে হয় যেন। তখন মনে হয় নিত্যদিনের জ্যামে ঠাসা সড়ক মহাসড়ক, গলি উপগলি, রাস্তায় পথচলতি মানুষের উটকো ভিড়, অকারণ চিৎকার চেঁচামেচি, রিকশার টুংটাং শব্দ, গাড়ির হর্ন, ফুটপাত দখল করে থাকা ফেরিওয়ালা, চা সিগারেটের দোকান—এসব না হলে এই শহরটা যেন ঠিক জমে না। রাস্তায় হেঁটে চলার সময় ফুরফুরে বাতাস, উতল হাওয়ায় গায়ে এসে হঠাৎ পড়বে শুকনো পাতা, পাতাটার ঝরে পড়ার শব্দটুকুও টের পাওয়া যাবে—এমন মনোহর সৌন্দর্য, এমন আরামদায়ক নীরবতা এই শহরের মানুষকে মানায় না। এসব যেন এই শহরের নাগরিকদের জন্য বিলাসিতা!
ছয়টা বাজে। কিন্তু বর্ষা বিকেলে এখনো রোদের তেজ বেশি। একফোটা বাতাস নেই কোথাও। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। রাই ভাবছে বাসায় যাবে। আবার মন বলছে রাবিদকে একটা ফোন দিতে। ও এলে রিকশা করে ঘোরা যায়। এই প্যাঁচপ্যাঁচে গরমের বিকেলে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। ভেবে ভেবে কোনো কিছু ঠিক করে উঠতে পারার আগেই কোত্থেকে ঝড়ের বেগে রাবিদ এসে হাজির! মুখে একরাশ হাসি। রাবিদকে দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায় রাইয়ের। আবার কিছুটা ভয়, কিছুটা দ্বিধাও কাজ করে মনে। তবে রাবিদকে এসবের কোনোটাই বুঝতে দেওয়া যাবে না। বুঝতে দেওয়া মানেই হলো বিপদ! কঠিন বিপদ! একেবারে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত! রাই নিজেকে যতটা সম্ভব নিস্পৃহ রাখার চেষ্টা করে। পুরোপুরি নিস্পৃহ না, চোখে মুখে এক ধরনের বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তোলে বরং!
তুমি হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলে?
বিনিময়ে কিছুই বলে না রাবিদ। কোনো শব্দ না করে শরীর ঝাঁকিয়ে হাসে।
কী হলো, কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন?
রিকশায় করে ঘুরবে?
কথাটা বলেই রাইয়ের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই একটা রিকশা ডেকে উঠে বসে সে। একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয় রাইয়ের জন্য। কিছু না বলে উঠে বসে রাই। হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে দেয় রাবিদ। রাই রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, মামা সিগারেট ফেলেন!
অ্যাই কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমার কিন্তু বাসায় ফিরতে হবে।
এবারো কিছুই বলে না রাবিদ। রাইয়ের দিকে তাকিয়ে ক্যাবলার মতো হাসে শুধু। তাকে দেখে এসময় কিছুটা নার্ভাস মনে হয়। কিছুটা মায়া লাগে রাইয়ের। নরম সুরে বলে, খুব তো পরিবাগ সড়ক পরিবাগ সড়ক জপ করো সারাদিন! ওই রাস্তায় নিয়ে চলো!
হাতিরপুল বাজার হয়ে রিকশা যাচ্ছিল কাঁটাবনের দিকে। রাইয়ের কথায় রিকশা ঘোরাতে বলে রাবিদ। ঘুরে যায় রিকশা পরিবাগ সড়কমুখী। অল্প একটু পথ ফাঁকা রাস্তায় মুহূর্তেই পেরিয়ে যায় তারা। পরিবাগ সড়ক ধরে শাহবাগ না গিয়ে ডানে মোড় নিতে বলে আবিদ। রিকশা এগিয়ে চলে কাঁটাবন সিগন্যালের দিকে। এরপর কাঁটাবন নীলক্ষেত মোড় হয়ে পলাশী, পলাশী থেকে বাঁয়ে ঘুরে ফুলার রোডের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রিকশা। বকবক করে যাচ্ছে রাবিদ। ভালো লাগছে খুব রাইয়ের। কিন্তু বুঝতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। মনে মনে ভাবে রাই। এই ছেলেটা খুব নাছোড়। একটু লাই পেলেই মাথায় উঠে বসে। তখন আর তাকে মাথা থেকে নামানো যায় না। অবশ্য নামানোর চেষ্টাও করে না রাই। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েক চক্কর খায় তাদের রিকশা। রাইয়ের হাতটা একটু ধরার জন্য মন ছটফট করে রাবিদের। নানা ছুতা খোঁজে হাত ধরার। রাই বোঝে সবই। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের অনুমান খুব প্রখর হয়। রাইও চায় রাবিদ তার হাতটা একটু ধরুক। আলতো করে ছুঁয়ে দিক তার কপালের চুল। কিন্তু একটা কাঠিন্য নিয়ে থাকে সে। ওদিকে রাবিদ ছটফট করে। এদিকে রাই ছটফট করে। দুজন ভেতরে ভেতরে তৃষ্ণায় মরে। কেউ কাউকে বলে না। রাবিদ রাইয়ের দিকে এগোতে পারে না। রাই রাবিদকে তার দিকে এগোতে দেয় না। দিতে ইচ্ছে করে তবু দেয় না।
তোমার কি জ্বর? বলে রাবিদ! বলেই তাকায় রাইয়ের কপালের দিকে।
না, না আমি ঠিক আছি। কোনো জ্বর নাই আমার।
তারপরেও রাবিদ হাত রাখে রাইয়ের কপালে। দীঘির জলের মতো ঠান্ডা রাইয়ের কপাল!
বললাম তো জ্বর নাই। তারপরেও ধরলে কেন?
রাইয়ের কথার উত্তরে হালকা করে হাসে রাবিদ।
আমি যদি বলতাম জ্বর আছে! তাও তুমি ধরতে। এখন নেই বলেছি, তাও ধরেছো।
সবই যখন বোঝো, তাহলে আর এতো কথা কেন বলছো!
একটুক্ষণ আগের রোদের তেজ মরে গেছে। বিকেলটা ছোট্ট শিশুর মতো এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। বাড়ি ফেরার তাড়া দেখাচ্ছে রাই। আরও কিছু সময় থাকতে চায় রাবিদ। রিকশা চলছে। ঘুরতে ঘুরতে তারা পুরান ঢাকার দিকে চলে যায়। বকশী বাজারের মুখে এসে রাই বলে, সময় থাকলে সদরঘাট গিয়ে নৌকা করে ঘোরা যেতো!
চলো যাই।
লাফ দিয়ে ওঠে রাবিদ।
বলেছি সময় থাকলে যাওয়া যেতো। আজকে সময় নেই হাতে!
সামনে একটা খালি সিএনজি অটোরিকশা দেখলে সেটাতে করে বাড়ি ফিরতে চায় রাই। রাই সিএনজিতে উঠলে রাবিদও তার পাশে বসে। না না করে তেড়ে ওঠে রাই। কিন্তু রাবিদ কি আর কথা শোনার ছেলে! অবাধ্য বেয়াড়া রাবিদ গোঁয়ারের মতো বসে থাকে রাইয়ের পাশে। সিএনজি চলছে জনশূন্য নগরের ফাঁকা রাস্তায়। অটোরিকশার শো শো শব্দের সঙ্গে মিলেছে তীব্র বাতাস। রাইয়ের কপালে বাঁধন ছেড়া মেঘের মতো উড়ছে একরাশ চুল। ভেসে আসছে মুগ্ধকর সৌরভ। রাবিদের নাকেমুখে লাগছে রাইয়ের চুলের ঝাপটা। রাবিদের ইচ্ছে করে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় রাইয়ের কপালের খুচরো চুল। এক পর্যায়ে খুব সযতনে রাইয়ের হাতটা নিজের হাতে টেনে নেয় রাবিদ। রাই একবার চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। মুখে কিছুই বলে না। তবে তার চোখেমুখে খেলা করে রাজ্যের রহস্য। রাবিদ তার কিছুটা বোঝে। বোঝে না অনেকটাই। ধীরে ধীরে রাবিদের হাত নেমে আসে রাইয়ের কপালে। আলতো হাতে রাবিদ সরিয়ে দেয় রাইয়ের কপালের চুল।
শ্যামলীর কাছে এসে রাবিদকে নামিয়ে দেয় রাই। খুব মন খারাপ নিয়ে নামে রাবিদ। তার আরও অনেকটা সময় থাকার ইচ্ছে ছিল রাইয়ের সুবাসে। রাইয়ের বাতাসে। রাইয়ের স্পর্শে। রাইয়ের পাশে। রাইয়ের কাছে।
রাই অবশ্য বলেছিল, এই অটোরিকশাটা নিয়ে রাবিদ চলে যাক। ও আরেকটা সিএনজি নিয়ে নেবে! রাইটা বরাবরই এমন! স্যাক্রিফাইস করতে চায় নিজেকে। রাইয়ের সঙ্গে রিকশায় ওঠার পর থেকেই গলা শুকিয়ে কাঠ রাবিদের। এক সময় রাইয়ের কাছে পানি চেয়েছিল সে। পানি ছিল না রাইয়ের কাছে। তবে সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি থামিয়ে পানি কেনার কথা বলেছিল রাই। অথচ সন্ধ্যার আগেই তার বাড়ি ফেরার তাড়া!
রাই চলে যাওয়ার পর খুব নিঃসঙ্গ লাগে রাবিদের। ফাঁকা শহরটাকে আরও ফাঁকা মনে হয়। মনে হয় কোনো নির্জন দ্বীপের নির্বাসিত এক মানুষ সে। যার আজীবনের দণ্ড হয়েছে। রাইকে কখনো আর দেখতে পাবে না সে। আর কখনো রাইয়ের সঙ্গে বসা হবে না। রাইয়ের হাতে হাত রাখা হবে না আর কোনোদিন। আর কোনোদিন পাবে না রাইয়ের সুবাস। রাইয়ের ঘাড়ের কালো তিলটা দেখতে পাবে না আর কোনোদিন! কেন এতো নিঃসঙ্গ লাগে তার? কেন নিজেকে এতো মূল্যহীন, স্বজনহীন মনে হয় তার! আচ্ছা রাই কি তাকে ভালোবাসে? মনে হয় বাসে না। কিন্তু রাইয়ের হাত ধরার পর, শরীর ঘেঁষে বসার পর খেঁকিয়ে উঠেছিল রাই—একটু সরে বসো! এতো জায়গা থাকতে একেবারে গায়ের উপর উঠে বসেছো কেন? হঠাৎ রাইয়ের এমন আচরণে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল রাবিদের। সঙ্গে সঙ্গে রাবিদের হাত চেপে ধরেছিল রাই—চোখে চোখ রেখে বলেছিল, মন খারাপ করি নাই!
সিএনজি চলছে দ্রুত গতিতে। রাবিদ আরেকটি সিএনজি না নেওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল রাই। পাল্টা অটোরিকশায় এখন ফিরছে রাবিদ। সন্ধ্যা মিলিয়েছে মাত্র। এরই মাঝে আকাশে বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। এতো উজ্জ্বল তার আলো—মনে হচ্ছে আকাশজুড়ে কেউ জ্বালিয়ে দিয়েছে মিহি রুপালি আলোর রোশনাই। হঠাৎ কী মনে হয় রাবিদের, অটোরিকশা ছেড়ে নেমে পড়ে সে। হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন। হাঁটছে তো হাঁটছে। এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করে সে চন্দ্রিমা উদ্যানে। মানুষজন খুব একটা নেই। পার্কে ঢোকার মুখের গেটে অলস বসে আছে দুজন পুলিশ সদস্য। একটু দূরে আরেকজন পুলিশ হাতের লাঠিটা পাশে রেখে মাথা নিচু করে ঝিমুচ্ছে। এই ঈদে হয়তো তাদের ছুটি মেলেনি। হয়তো শহর থেকে অনেক দূরে তাদের পরিবার-স্বজন পথ চেয়ে ছিল তারা বাড়ি ফিরবেন। চার-পাঁচ বয়সী ছোট্ট কোনো সন্তান আছে হয়তো তাদের। আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। কিন্তু দায়িত্বের তাগিদ তাদের ফিরতে দেয়নি। হঠাৎ নিজেকে আরও একা লাগতে শুরু করে রাবিদের। এই শহরে তার কোনো স্বজন নেই। শহরে কি, আসলে কোথাও তার আপন কেউ নেই। কেউ তার জন্য অপেক্ষায় থাকে না। ঈদ-পার্বন-উৎসব এলে তাই বাড়ি ফেরার, স্বজনের কাছে ফেরার কোনো তাড়না থাকে না তার। এতিমখানায় মানুষ হওয়া রাবিদ জানে না, কোত্থেকে এসেছে সে। কোথায় ছিল তার বাড়ি।
রাস্তায় চলাফেরার সময় প্রায়ই চোখে পড়ে বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ছোট্ট কোনো শিশু। হয়তো রিকশায় বাবা-মার মাঝখানে কোলের মধ্যে বসে আছে তিন-চার বছর বয়সী বারবি ডলের মতো সুন্দর বাচ্চা। এসব দৃশ্য দেখে এক সময় খুব খারাপ লাগতো তার। মনে মনে ভাবতো এমন সুখী কোনো পরিবারেই কি জন্ম হয়েছিল তার? সবার মা-বাবা আছে, আমার কেন নেই? এমন ভাবনা পেয়ে বসতো তখন তাকে। আর তখন কোত্থেকে জানি বানের জলের মতো বাঁধভাঙা অশ্রুজল নেমে আসতো তার দুচোখ বেয়ে। একটা সময় বড় হয়েছে রাবিদ। ছেড়ে এসেছে এতিমখানা। পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও একেবারে খারাপও ছিল না কখনো। কীভাবে কীভাবে যেন একটা এমবিএ ডিগ্রি বাগিয়ে ফেলেছে। আর সেই ডিগ্রির জোরে একটা মাঝারি গোছের চাকরিও জোগাড় করে ফেলেছে। সব মিলিয়ে এখন তার অবস্থা ভালো। অন্তত সীমাহীন অর্থনৈতিক কষ্ট থেকে মুক্তি মিলেছে তার। এরমাঝে একদিন হঠাৎ করেই ইস্টার্ন প্লাজার সামনে রাইয়ের সঙ্গে দেখা। অনেকগুলো শপিং ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে অটোরিকশা খুঁজছিল রাই। কিন্তু একজন চালকও সেই অফিস ভাঙা বিকেলে মিরপুর যেতে রাজি হচ্ছিল না। এদিকে একটার পর একটা সিএনজির পেছনে ছুটেতে ছুটতে হয়রান রাইয়ের হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল অনেকগুলো ব্যাগ। আর সেগুলো তুলতে গিয়ে রাই দেখে, অল্পদূরে একটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে! রাগে মাথার তালু গরম হয়ে গিয়েছিল তার।
ছেলেটাকে খুব কড়া একটা কথা বলতে যাবে রাই। তখনই ছেলেটা এগিয়ে এসে রাইয়ের ব্যাগগুলো তুলে নিয়ে মিষ্টি করে হাসে। নিতান্ত পরিচিতের মতো জিজ্ঞেস করে, খুব বুঝি তাড়া আছে আপনার? কোথায় যাবেন? রাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। শ্যামলা রঙের একটা ছেলে। স্বাস্থ্য একেবারে হাড় জিরজিরে নয়, আবার খুব মোটাও নয়। ছেলেটা নিজের নাম বলে রাবিদ। রাবিদ ইমাম। সেদিন রাবিদই একটা সিএনজি অটোরিকশা ঠিক করে দিয়েছিল রাইকে। এরপর প্রায়ই ইস্টার্ন প্লাজার সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে মনে মনে রাবিদকে খুঁজেছে রাই। রাবিদের দেখা মেলেনি। এর প্রায় মাস দুয়েক পর হঠাৎ এয়ারপোর্টে রাবিদের সঙ্গে দেখা। বন্ধুদের সঙ্গে মালয়েশিয়া ঘুরতে যাচ্ছে রাই। বোর্ডিং এলাকায় ঢুকে যাওয়ার মুখে রাই দেখে হালকা নীল রঙের একটি শার্ট পরা রাবিদ—খুব জোরে জোরে হাত নেড়ে কাকে যেন বিদায় জানাচ্ছে। কী মনে করে পেছন থেকে রাবিদ বলে ডাক দেয় রাই। আর রাবিদও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে রাইয়ের চোখে চোখ রেখে খুব স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছেন? রাইকে হঠাৎ এখানে দেখে একটুও অবাক হয় না সে। যেন এখানে, এই এয়ারপোর্টে শত মানুষের ভিড়ে রাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যাবে—এটা আগেই ঠিক করা ছিল। এরপর সেদিন আর কথা বেশি এগোয়নি। রাবিদ তার অফিসের বসকে বিদায় দিতে এসেছিল। রাইয়েরও ফ্লাইট ধরার তাড়া ছিল। তবে সেদিন রাবিদ চেয়ে নিয়েছিল রাইয়ের ফোন নম্বর। এরপর প্রায়ই কথা হয় তাদের। আর আজকের এই বিকেলের মতো মাঝে মাঝে হুটহাট করে দেখা হয়ে যায় তাদের। কিন্তু কখনোই, না রাবিদ, না রাই কেউ কাউকে বলেনি ভালোবাসি। কেউ কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবুও যেন রাইয়ের ওপর কেমন একটা অধিকার কাজ করে রাবিদের।
রাত অনেক হয়েছে। প্রায় দশটা বাজে। রাবিদ শুয়ে আছে একটা গাছের নিচে। একজন আনসার সদস্য এসে তাড়া দেয় রাবিদকে—এতো রাইতে আপনে পার্কে কী করেন? এখন থাকার নিয়ম নাই। যান যান বের হোন। এতো রাতে পার্কে কেন থাকার নিয়ম নাই? কথাটা মুখে চলেই আসে রাবিদের। কিন্তু এই সুনসান রাতে ঝগড়া বাঁধাতে ইচ্ছে করে না। ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করে রাবিদ। তার খুব কান্না পেতে থাকে। অকারণেই। মনে হতে থাকে আর কখনো রাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না তার। আর কখনো কাছে পাওয়া হবে না রাইকে।
ওদিকে রাই কি রাবিদকে ভাবে? তারও কি রাবিদের জন্য কষ্ট হয়? সেও কি জানালা ধারে বসে অথবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাবিদের কথা ভাবে? একই শহরে একই চাঁদের নিচে জোছনায় ভেজে দুজন! আলো-আঁধারিতে ভাসে। তবু কারো মনের খবর কেউ জানে না। কারো কষ্টের সঙ্গী কেউ হয় না। অথবা কে জানে হয়তো তারা পরস্পর পরস্পরের মনের খবর জানে। হয়তো একে অপরের জন্য তৃষ্ণা ধরে। হয়তো গোপনে চোখের জল ফেলে রাইও। আমরা কেউ সেই খবর পাই না।
জীবন আসলে এমনই! অনন্ত আক্ষেপ অথবা পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনার সমষ্টি।
এসইউ/জিকেএস