তিন মিনিটের কবিতা: তিন কালের কথা

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০১:৪৭ পিএম, ২৩ জুন ২০২২

আজ যে বইটি হাতে নিয়েছি, তার নাম ‘তিন মিনিটের কবিতা’। কবির নাম সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। প্রথমেই বইয়ের নামটি শুনে কী মনে হতে পারে? একটি কবিতা তিন মিনিটেই পড়ে ফেলতে পারবেন? না, একটি কবিতা পড়তে বড়জোর ত্রিশ-চল্লিশ সেকেন্ড সময় লাগবে। তাহলে ধরে নিতে পারি, এর প্রতিটি কবিতা লিখতে কবির তিন মিনিট করে সময় লেগেছে। ‘তিন মিনিটের কবিতা’ কানাডা প্রবাসী কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সিরিজ কবিতা। এই সিরিজে পঞ্চাশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। পঞ্চাশ থেকে এক—এই উল্টোক্রমে কবিতাগুলো সাজিয়েছেন তিনি। এসব কবিতায় একটি ব্যতিক্রমী ধারার অবতারণা করেছেন।

কবিতার শুরুতেই কাওসার খান বলেছেন, ‘তিন মিনিটের কবিতাগুলো কবির নির্বাচিত নয়, বরং বলা যেতে পারে প্রাক অস্তিত্বশীল এই কবিতাগুলো আলোকিত হওয়ার জন্য, দীর্ঘ অন্ধকার পথ পরিভ্রমণের শেষপ্রান্তে এসে তাদের স্বপ্নের কবিকে খুঁজে পেয়েছে।’ কাওসার খান শেষদিকে এসে বলেছেন, ‘তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো তিন মিনিটের কবিতার নেভিগেশন পাঠককে সংকট এবং ম্যাজিক স্বপ্নের যে বহুমাত্রিক জগতে পৌঁছে দেয়, সেখানে এই ছোট ছোট ফুলের মতো কবিতাগুলো পাঠককে একটাই কথা বলে—কথাটি খুবই পুরনো, পৃথিবী জন্মের সময় এই কথাটিই প্রথম শুনেছে আই লাভ ইউ। আমরা যে সমাজে বাস করি, যে রাজনীতির মধ্যে বাস করি, এই সমাজ, এই রাজনীতি কিন্তু আমাদের বলে না—আই লাভ ইউ।’

তবে কবি মনে করেন, তিন মিনিটে নুডলস হলে এবার তিন মিনিটে কবিতাও জন্ম নেবে। সেখানে থাকবে তিন কালের কথা। কবির ভাষায় তাই বলতে হয়—
‘তিন মিনিটে নুডুলস্,
এবার তিন মিনিটে কবিতা।
-চা খাবেন?’
শুধু তা-ই নয়, কবির কাছে একটি বিকেল কবিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ কারণেই হয়তো কবির এই তিন মিনিট আমাদের নিয়ে যাবে তিন কালে।

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সত্তর দশকের কবি হলেও দশকীয় বন্ধন অনেক আগেই ছিন্ন করেছেন নিজস্ব কাব্যগুণে। যতটুকু আধুনিকতায় নিজেকে রাঙানো যায়, তারও বেশি সমৃদ্ধ করেছেন তার সাম্প্রতিক কবিতাগুলোকে। নিজেই গড়ে তুলেছেন নিজস্ব এক কাব্যসত্তা। তার কবিতার আড়ালের ইঙ্গিত পাঠ করা কঠিন—যা সম্ভব নয়, অর্থভেদে কিংবা সংকেত পাঠে তা সম্ভব। এরকম জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া তার সাম্প্রতিক কবিতায় পাওয়া যায়।

কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের জন্ম ১৯৫৮ সালে ৩০ মে শেরপুরে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলতে পারি, নিঃসন্দেহে তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কারণ কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন ছড়া-শিশুসাহিত্য, উপন্যাস, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, গীতিকবিতা, প্রবন্ধ। এমনকি সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন ধরনের বই।

ছাত্রজীবনে ঐতিহ্যবাহী দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে ১৯৯৬ সালে বিএনপির শাসনামলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তারপর স্বাধীনভাবে লেখালেখি, সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজে মনোনিবেশ করেন। গড়ে তোলেন দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি এখন আবার সাংবাদিকতা পেশায়ই যুক্ত আছেন। দৈনিক ইত্তেফাকের কানাডা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।

আমার মনে হয়, তিনি অভিমান নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। অবস্থান করছেন দেশের বাইরে। তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেই চলছে তার জীবন। তাই তার কবিতায় ঘুরেফিরে আসে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতার সম্পাদনা ছাড়াও ‘আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ’ শিরোনামে কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছে ২০২০ সালে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে—সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব, শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ: মুজিব হত্যা মামলা, বঙ্গবন্ধুর ছাত্রজীবন, কানাডার কাশিমপুরে খুনি নূর চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু: ১০০ কবির ১০০ কবিতা।

তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত ধারণা রাখা যায়। তার লেখা তৃষ্ণার্ত জলপরী (১৯৮২), তবু কেউ কারো নই (নাসিমা সুলতানার সাথে যৌথ, ১৯৮৫), অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো (১৯৮৭ এবং ১৯৮৯), শহরের শেষ বাড়ি (১৯৯১), ঘাতকের হাতে সংবিধান (১৯৯০), একি কাণ্ড পাতা নেই (১৯৯৫), দ্রবীভূত গদ্যপদ্য (১৯৯৯ এবং ২০০১), ঐক্যের বিপক্ষে একা (২০০০), মুক্তিযুদ্ধের পঙক্তিমালা (২০০১), এলোমেলো মেঘের মন (২০০০), নির্জনে কেনো এতো কোলাহল (২০০০), পরের জায়গা পরের জমি (২০০৪), নিদ্রার ভেতর জেগে থাকা (২০০৪), ঘৃণিত গৌরব (২০০৫), কবিতাসমগ্র (২০০৬), নীড়ে নিরুদ্দেশে (২০০৮), সাতে নেই, পাঁচে আছি (২০১২), রবি ঠাকুরের প্রাইভেসি (২০১৫), পাখিদের গ্রামে আজ একটি গাছের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা (২০১৭), ফেরোমনের গন্ধে নেশাগ্রস্ত প্রজাপতি (২০১৭), তোমার বাড়ি কত দূর (২০১৭), প্রেমের আগে বিরহে পড়েছি (২০১৮), সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো (২০১৯), পাখিদের অবিবাহিত জীবন (২০২০) পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।

কবিতায় তার ভাষাশৈলী পাঠককে মুগ্ধ করে। বাক্যগঠন ও শব্দচয়নে নিজস্বতার পরিচয় দেন। তার রূপক পাঠককে ভাবনার জগতে ভ্রমণ করায়। কেননা রূপকের অন্তর্জাল মুহূর্তেই জড়িয়ে নেয় পাঠককে। তার উপস্থাপন কৌশল মুহূর্তেই পাঠকের হৃদয়ে দাগ কাটে। যেমন—
১. সম্পর্কের তৃষ্ণা পেলে কাকে বাবা বলে ডাকবো?
২. করুণার মতো শুয়ে আছো তুমি অসহায় শিশু
৩. মুগ্ধতার দিকে হাত বাড়িয়ে লাভ নেই
৪. আমরা ছিলাম পাখির মতো—অবিবাহিত।
৫. টেমসে তালা ঝুলিয়ে ফেলে দেবো চাঁদ এবং চাবি।
৬. তুমিও কি মাওলানার মতো বদলে যাও; পুরুষ হয়ে ওঠো?
৭. আমাদের এক মা, আমাদের বাবা তিনজন।
৮. মানব চাষ সীমাবদ্ধ থাকেনি পৃথিবীর সীমান্তে।
৯. প্রার্থনার মতো আবৃত্তি করি মুখস্থ করি তার মন।
১০. পাখির মনেও বহুবিদ বেদনা থাকে, একাকিত্ব থাকে।
তাই বলা যায়, কবিতায় ব্যতিক্রমী বিষয় বেছে নেওয়া তার পছন্দ। ভবিষ্যতে তিনি কোন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখবেন, তারও ইঙ্গিত দেন অন্য কবিতায়। পাঠককে জাগ্রত রাখেন পরবর্তী কবিতা পাঠের নেশায়।

তার কবিতায় গ্রামবাংলা থেকে শুরু করে নগরায়ন, নাগরিকের জীবন, জীবনের জটিলতা, মানবের প্রেম, পরবাস, পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। তাই বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান বাংলা কবিতার মূলধারাকে তিনি শাণিত করছেন, বাঁক ও বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন। ফলে অন্তর্গত মর্ম বেদনা ফুটে ওঠে তার কবিতায়। পাশাপাশি দেশপ্রেম ফুটে ওঠে পঙক্তিতে। বাবার মৃত্যু নাড়া দেয় প্রবাসী কবির অন্তরে। প্রবাস জীবনে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন কবি। সে জন্যই তার উচ্চারণ এমন—
‘ব্যতিক্রম পাকঘর। আগে আসতো রান্নার সৌরভ।
এখন শুধু মসলার ঝাঁঝালো ঝাঁঝ আর আগুনের ঘ্রাণ।’
তার কবিতার ভেতরে ব্যক্তি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এসে ধরা দেন অবচেতনে। আবেগ ও বিরহের সুর বেজে ওঠে অদৃশ্য বাঁশিতে।

তাই বইটি থেকে কিছু পঙক্তি এখানে উদ্ধৃত করার সাহস পাই। পাই অসীম প্রেরণা। কবির ভাষায়ই বলতে চাই—
১. অথচ সংসারে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন নেই,
টিনঘরে শুধু বৃষ্টি! শীলাবৃষ্টিতে ভিজতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন।

২. স্বদেশ বিরোধী মা বলছে:
ভাত ছাড়; রাইস খা—
বাংলা ছাড়; বাংলা ভাষার ভেতর চেপাশুঁটকির গন্ধ,
শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট প্রাগৈতিহাসিক হ্যালুইনের গল্প।

৩. স্নান শেষ সন্ধ্যায় ফিরে বকপাখি।
তখন স্তনের নিচে হা করে ঝুলে থাকে তৃষ্ণার্ত যুবক,
যে ভাবে ঝুলে থাকে শুঁটকি মাছ!

৪. স্নানঘর হোক মানুষের প্রকৃত বিশ্বস্ত ধর্মঘর।

৫. বাবার কবরে দাঁড়িয়ে মঈনের মতো বলি—
‘আর কটা দিন, আমিও আসছি বাবা’
আমরা এক সাথে চাঁদ দেখতে দেখতে কুড়িগ্রাম যাবো।

সবশেষে বলা যায়, তার প্রতিটি কবিতা জীবনের গভীর ক্ষতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তুলে আনে অনন্ত হতাশা। মূল্যবোধ বিবর্জিত সমাজের মুখপাত্র হয়ে ওঠে চরণগুলো। এমনকি কবিতায় রূপকথা, ভূতের গল্প, বিপ্লব, কৌতুক, যৌনতা—কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। তবে তার কবিতায় শ্লেষ ধরা দেয় ভিন্ন আঙ্গিকে। কবি বলেন—
‘ভালোবাসি বলেই ঘৃণা করতে পারি না,
তাই গরুর রচনা দিয়ে নদীর রচনা লিখি।’
আমার বিশ্বাস, তার পঙক্তিগুলো পাঠককে আন্দোলিত করবে, অভিভূত করবে, করবে আত্মপ্রত্যয়ী। শেখাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার মন্ত্র। আমি তার কবিতার বহুল পাঠ প্রত্যাশা করছি। কবিতার জয় হোক। কবি দীর্ঘজীবী হোন।

বই: তিন মিনিটের কবিতা
কবি: সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
প্রকাশক: স্বরব্যঞ্জন
প্রচ্ছদ: আল নোমান
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২০
মূল্য: ১২৫ টাকা

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।