প্রতীচ্যের চোখে রবীন্দ্রনাথ: পর্ব-০২

যাই হোক, এ সময় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে মানুষের মনে একটা অস্বাভাবিক কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল বৈকি। যেখানেই তাঁকে দেখা গেছে; সেখানেই মানুষ শিশুর মতন বিস্ময় নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, একটা সন্ধ্যায় কবি লন্ডনের কুইন্স হলে একটা কনসার্ট দেখতে গেছেন। সেখানে মানুষের উপচেপড়া কৌতূহল দেখে লন্ডনের ‘New Leader’ পত্রিকা লিখছে, ‘কিন্তু রবীন্দ্রনাথ? তাঁর মুখের দীপ্তিময় চাহনি জুড়ে ছিল এক ধরনের প্রশান্ত ও অমোচনীয় হাসি। কিন্তু এটা কি তাঁর সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরাগসঞ্জাত?’ বহুদিন ধরে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বুঁদ হয়ে ছিলেন। লন্ডনে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি সে সময় নতুন এক আবহ সৃষ্টি করেছিল। যে-ই তাঁর সাথে দেখা করেছে; সে-ই মুগ্ধতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। লন্ডনে কবির উপস্থিতি নানান দিক দিয়ে ঘটনাবহুল। তিনি একবার আইরিশ কবি স্টপফোর্ড ব্রুকের সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। ব্রুক রবীন্দ্রনাথকে ম্যানচেস্টার স্কয়ারে নিয়ে যেতে বলেন। তবে আগেই জানিয়ে দেন, রবীন্দ্রনাথকে যেন বলে রাখে তিনি তাঁর মতো এত আধ্যাত্ম মানুষ না। তাঁদের দুজনের সেদিন অসাধারণ সন্ধ্যা কাটে। ব্রুক বলে ওঠেন, ‘এবং আমি এটি খুব কম দেখেছি; যখন আমি যাই তখন আমি অনুভব করি যে আমার আত্মা এটিকে তাড়িত করবে। না, আমি এই ক্ষুদ্র জগতের আরও অনেক কিছু পাওয়ার আগে সমস্ত কিছুতে মিশে যেতে চাই না।’ রবীন্দ্রনাথও বলে ওঠেন, ‘When I go from hence let this be my parting word, that what I have seen is unsurpassable.’ তবে এর যে বিপরীত কিছু ঘটেনি, তা নয়।

Arosnson এর তথ্যমতে, লয়েস ডিকিন্সন নামে একজনের বাড়িতে বার্ট্রান্ড রাসেলের সাথে আরও কয়েকজনসহ দেখা হয় রবীন্দ্রনাথের। জায়গাটা ছিল ক্যামব্রিজের কিংস কলেজ। তিনি সেই সন্ধ্যার কথা এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘এটা ছিল কেমব্রিজে জুন মাসের এক সন্ধ্যা। মি রাসেল এবং আমি রবিঠাকুরের পাশে গিয়ে বসলাম। তিনি আমাদের কিছু কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর ও ভিন্নরকম একটা মনোবল সেই অন্ধকার ছাপিয়ে উপস্থিত সবাইকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এরপর রাসেল কথা বলতে শুরু করেন। কথাগুলো যেন অন্ধকারের মাঝে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। তার কথাগুলো শেষ হলে রবীন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, রাসেলের কাছ যে কথাগুলো শুনলাম সত্যি সেগুলো অপূর্ব। তিনি যেন সেখান থেকে অতি দূরে গিয়ে চেতনার উচ্চমার্গিক এক স্তরে পৌঁছে গেছিলেন। কিন্তু আমার বিস্ময় জাগে, সত্যি কি তিনি এই কথাগুলো কর্ণকুহরে নিয়েছিলেন?’

রাসেলের সাথে এই সময়টা রবীন্দ্রনাথের মোটেই সুখকর হয়ে ওঠেনি। কারণ রাসেল ছিলেন অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ও মারমুখী। রবীন্দ্রনাথ এর জবাব দিয়েছেন পরের সকালে। সে সম্পর্কে The Nation লিখছে, ‘সত্যটা হলো একটা পবিত্র গণ্ডির মাঝে আমি খুব দ্রুত চেতনার দ্বিতীয় একটা স্তরে পৌঁছে গেছিলাম এবং একটা বোধ আত্মস্থ করে উঠলাম। প্রসেফর কী যেন একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন আমি এখন মনে করতে পারছি না যদিও আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনেছিলাম। এবং তার বাগ্মিতার তারিফ করেছিলাম। কিন্তু সেটা সর্বাংশে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক। রাসেল ও রবীন্দ্রনাথের এই আলাপ-আলোচনাটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টো কারণে। প্রথমত দু’টো ভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষের চিন্তাধারা সম্পর্কে দু’জনেই পরিচিত হয়েছেন। একজন প্রাচ্যের ভাববাদ, অন্যজন পাশ্চাত্যের বাস্তববাদ ও বিশ্লেষণী বৈজ্ঞানিক চেতনা। রাসেল কেন রবীন্দ্রচেতনার সাথে একমত হননি সেটা অত্যন্ত পরিষ্কার। যে সময় তাঁরা একে ওপরের সাথে মিলিত হন; সে সময় রাসেল ক্যামব্রিজে কেবল ব্রাডলিয়ান ভাববাদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছেন। ভাববাদকে বিদায় জানানোর ভেতর দিয়ে তিনি যে আধ্যাত্মবাদকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তা বুঝি বুঝতে বাকি ছিল না কারো।’

অন্যদিকে উল্টোটা ঘটলো আইরিশ নাট্যকর ও সাহিত্যিক জর্জ বানার্ড শ’র ক্ষেত্রে। ১৯৩৪ সালে বানার্ড শ’র সাথে রবীন্দ্রনাথের মুখোমুখি হওয়াকে এমনভাবে দেখছেন Aronson। লন্ডনের মর্নিং পোস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখছেন, ‘শ’ যখন কথা বলছিলেন; তখন রবিঠাকুর যেন স্বপ্নের ঘোরে ছিলেন এবং এই স্বপ্নের থেকে আর কোনো কিছুই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এবং এই কথা বলার সময় শ’র তেমন কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছিল না এটা ছাড়া। তাদের একে অন্যের সাহচার্য উপভোগ করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। রবিঠাকুর বাদে প্রাচ্যের মিষ্টিসিজমের কোনো মানেই হতে পারে না।’

যাই হোক, টি স্টুজ ম্যুর নামে এক ইংরেজ ভদ্রলোকের মাধ্যমে প্রথম নোবেল কমিটির কাছে রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে। স্টুজ ম্যুর ছিলেন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অব লিটালেচারের সভ্য। তিনি অবশ্য কবি সম্পর্কে বেশি কিছু নোবেল কমিটির কাছে জানাননি। নোবেল বাছাই সদস্য হিসেবে ছিলেন প্যার হলস্ট্রম, যিনি ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে একটা মতামত দেন বইটা সম্পর্কে। ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে তিনিও খুব বেশি কিছু জানতেন না। তিনি সরাসরি লিখে দেন, ‘বিশুদ্ধ ধর্মীয় কবিতার জন্য এই পুরস্কার দেওয়া নোবেল দর্শনের পরিপন্থী।’ আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘প্রতিটা কবিতাই একটা প্রার্থনা ও ঐক্য ও সম্প্রীতির আশ্রয়, হয়তো আপনি এগুলোকে একঘেয়েমি বলতে পারেন কিন্তু এটা ঠিক, আপনি এটা ঈশ্বরকে উপলব্ধির নতুন পথ অনুসন্ধানের উপায়কে বর্জন করে ফেলছেন।’ পরিশেষে নোবেল কমিটি এর সামগ্রিকতা গভীরভাবে অনুধাবন করে।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সুইডেনের মানুষের খুব বেশি ধারণা ছিল না, অবশ্য ধারণা থাকার কথাও নয়। তবে দু’একটা ঘটনা ছিল ব্যতিক্রম। কার্ল হেমার গ্রেন নামে একটা তরুণ একবার ভারতবর্ষে এসেছিলেন ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য। ওই সময় তিনি ঠাকুরপরিবার সম্পর্কে বেশ ধারণা নেন। ভিনদেশের এই যুবক এক পর্যায়ে এখানকার জল-আবহাওয়ার সাথে একাত্ম হয়ে ওঠেন। কিছু ধনী মানুষের বাড়িতে ফ্রেন্স ও জার্মান ভাষা শিখিয়ে উপার্জন করতেন। ওই টাকায় তিনি গরিব ছাত্রদের লেখাপড়ার জন্য দান করেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে দেশে তিনি জন্মাননি, সে দেশ হয়ে উঠল তার একান্ত ভালোবাসার জায়গা, প্রাণের জায়গা। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিল, তার এই মেলামেশার ফলে সে সব সময় ভয়ে থাকতো এখানকার সংস্কৃতির মান চলে যায় কি না! একদিন তার মৃত্যু হয়। তাকে দাহ করা হয় তার ইচ্ছে অনুযায়ী এখানকার মাটিতেই। রবীন্দ্রনাথ তার সম্পর্কে ১৯২২ সালে Creative Unity-তে লিখেছেন: ‘তাঁর মনের মনোভাব, তাঁর জীবনযাপনের ধরন, তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য, তাঁর বিনয়, এমন লোকদের জন্য তাঁর অবিচ্ছিন্ন আত্মত্যাগ, যারা তাদের প্রদত্ত কোনো উপকারের প্রচার করার ক্ষমতাও রাখে না, তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা ভারতে ইউরোপীয়দের সাথে মেলামেশা করতে অভ্যস্ত ছিলাম, যা আমাদের মনে বিস্ময়ের সাথে সীমাবদ্ধ ভালবাসার অনুভূতির জন্ম দেয়।’ রবীন্দ্রনাথ হেমারগ্রিন নামে এই সুইডিশকে প্রকৃত একজন ভারতীয় সন্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। এই আত্মত্যাগ এবং নিজেকে উৎসর্গ করার ঐকান্তিক কর্মধারার জন্যই রবীন্দ্রনাথ East West প্রবন্ধে তাকে ভারতীয় সাধু পুরুষ বলে আখ্যা দেন।

১৯১২ সালের বসন্তে সুইডেন ও নরওয়ের ডিউক অব সোদারম্যানল্যান্ড খ্যাত প্রিন্স উইলহেলম কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করে পরের বছর একটা বই লেখেন ‘Where the sun shines: recollections and notes from a journey in the Orient’ নামে। তিনি ওই বইতে ভারতবর্ষের মানুষের ইংরেজ মনোভাব ব্যক্ত করে লেখেন, ‘ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা গোপনে জ্বলতে থাকে, যে কোন সময় অগ্নুৎপাতের জন্য প্রস্তুত একটি ধোঁয়াটে আগ্নেয়গিরির মতো।’ উল্লেখ করার মতো ব্যাপার যে, উইলহেলমের এই বক্তব্যের মধ্যেও যে ঠাকুরপরিবারের ভেতর এক রকম ইংরেজ বিদ্বেষ ছিল, সেটা প্রকাশ পেলো। ইউরোপে এ ধরনের সংবাদ প্রচারের পর রবীন্দ্রনাথের প্রতি ইংরেজদের আস্থা কমতে থাকে। তবে অস্বীকার করলে চলবে না, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝে বা পরপরই ব্রিটেনে রবীন্দ্রনাথ রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে আসেন। তিনি সেখানে মানুষের কাছে এতটাই অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠেন, যা একটা ঘটনা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে।

১৯২০ সালে সুসান ওয়েন নামে এক ব্রিটিশ নারি রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় একটা চিঠি লেখেন। চিঠিটা শুরু করেন এভাবে, ‘প্রিয় স্যার রবীন্দ্রনাথ’ (যদিও ব্রিটিশ রানী কর্তৃক প্রদেয় ‘স্যার’ উপাধি তিনি নিজেই বর্জন করেন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার পর) আমি আপনার কাছে চিঠিটা লেখার সাহস নিয়েছি, যখনই শুনলাম আপনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। একটা ইচ্ছে প্রকাশ করার জন্যই আমার লেখাটা। লেখিকা রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের ঠিকানা জানতেন না। শুধু খামের ওপর ‘রবীন্দ্রনাথ’ কথাটা লিখলেন এই ভেবে যে, তিনি এদেশে যেখানেই থাকুন; ডাক বিভাগ ঠিকই তাঁর কাছে পৌঁছে দেবেই। তিনি লিখেছেন, ‘...প্রায় দুই বছর আগে, আমার প্রিয় বড় ছেলে শেষবারের মতো যখন যুদ্ধের জন্য বের হলো, তখন আমরা দু’জনেই বিমর্ষ বেদনা নিয়ে ফরাসি অস্তাচল সূর্যের পানে চেয়ে সমুদ্রের ওপারে একসাথে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কবিপুত্র তখন উচ্চারণ করলো আপনার অপূর্ব সেই কথাগুলো, ‘যাবার দিনে এই কথাটি/ বলে যেন যাই—/যা দেখেছি যা পেয়েছি/ তুলনা তার নাই।’ (গীতাঞ্জলির ৯৬ সংখ্যক কবিতা) এবং যখন তার পকেট থেকে পাওয়া একটা চিরকুট আমার কাছে দেওয়া হলো; তখন ওই কথাগুলোই আমি পেলাম যার নিচে লেখা ছিল আপনার নাম।’ এই কবিতার কী সে অর্থ, যার মধ্যে একজন সাধারণ মানুষ দেশ রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়? এই মহাপৃথিবী তার মাঝে আমাদের জীবন এবং এই বিশ্বসংসার নিয়ে আমাদের উপলব্ধি সংক্রান্ত এক অপূর্ব নান্দনিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি এখানে।

তিনি আরও লিখছেন, ‘এই জ্যোতিঃ সমুদ্র মাঝে/ যে শতদল পদ্মরাজে,/ তারি মধু পান করেছি/ ধন্য আমি তাই/ যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই/ বিশ্বরূপের খেলা ঘরে/ কতই গেলেম খেলে,/ অপরূপকে দেখে গেলেম/ দুটি নয়ন মেলে।’ এই বিশ্বজগত কবির কাছে একটা আকারহীন খেলাঘর। এবং তিনি যা দেখেছেন, বুঝেছেন তা বুঝি তুলনাহীন। সাথে সাথে এই আকারহীন বিশ্বভূমি দর্শনও তাই আকারশূন্য। তাহলে কি জীবনের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিচয় নেই? শুধুই কি এখানে নির্মম কঠোরতা? আসলে এখানেই রবীন্দ্রচিন্তায় প্যারাডক্স তথা জীবনের হেঁয়ালি। একদিকে জীবনের বিশালতা, আশ্চর্য মাধুর্যময় তন্ময়তা; অন্যদিকে দুঃখ, বেদনা আর অনর্থক পরিক্রমা। সুসান ওয়েনের ছেলে উইলফ্রেড ওয়েনের এই রবীন্দ্র অনুভূতি ছিল সত্যি সত্যি হৃদয়স্পর্শী।

চলবে...

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।