মায়াবতী: পর্ব ৩৯
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
উপন্যাসের মনোবৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট, মনোবিশ্লেষণ ও মনোসামাজিক ব্যবচ্ছেদ
মা ও মেয়ের আবেগ, চিন্তা, বোধ কিংবা প্রত্যক্ষণের জটিল মিথস্ক্রিয়ায় এ উপন্যাসের যাত্রাপথে উন্মোচিত হয়েছে জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল।
আবেগ, চিন্তা, প্রত্যক্ষণ হচ্ছে মনের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া বা অঙ্গ। সোশ্যাল লার্নিংয়ের কারণে বদলে যায় প্রত্যক্ষণ। বদলে যায় চারপাশ প্রত্যক্ষ করার ধরন। চিন্তনের বুনটে ঢুকে যায় ত্রুটি, নানামুখী আবেগের উদগিরণ ঘটে মায়ের মনে, মেয়ের মনে। পারিবারিক প্রেক্ষাপটে ঘণীভূত হয় নেতিবাচক আবেগ। আবেগের ঘূর্ণির দাপটে নিয়ন্ত্রণ হারায় রিয়া। ভুল করে বসে। ভুল করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, বখাটে সন্ত্রাসীদের পাতা জালে পা দেয়।
জীবনের ঘূর্ণির কেন্দ্র হচ্ছে এই ‘ভুল’।
ভুলের মাশুল দিতে দিতে চলতে থাকে রিয়ার জীবনের গতিপথ, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, সফলতা-ব্যর্থতার জালে জড়াতে থাকে সে। চারপাশের প্রিয়জনেরা, বন্ধুরা ভিড় করে চলার পথে অথবা জীবনের সহজাত গতিময়তায় ভেসে যায় রিয়া, অন্যদের ভেতরে-বাইরে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। উল্টোভাবে বলা যায়, মায়াবতী, রূপবতী মেয়েদের জীবনের গোপন কিংবা প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার মনস্তত্ত্বে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, শিক্ষণতত্ত্বের মৌলিক বিষয়গুলো বয়সের অভিজ্ঞতার আগেই তাকে ঝালাই করে, গড়ে তোলে। উপন্যাসের শেষ দৃশ্যপট পর্যন্ত শিক্ষণের সেই নির্যাস রিয়াকে প্রত্যয়ী হতে শক্তি জোগায়, দৃঢ় মনের স্ফূরণ দেখা যায় তার কথায়, আচরণে, বিশ্লেষণে। সে ভাঙে, গুঁড়িয়ে যায় না। বিধ্বস্ত হয় না। ভাঙতে ভাঙতে আবার গড়ে ওঠে, গড়ে তোলে নিজেকে। নৈরাশ্য তাকে স্পর্শ করতে পারে না, চরম কষ্টের মাঝেও দেখা যায় প্রচণ্ড আশাবাদী এক তরুণীকে। যে তরুণী পরাজয় মেনে নেয়। পরাজয় মেনে নেওয়ার শক্তি হচ্ছে অন্তর্গত শক্তির গোপন রাসায়নিক পদার্থ। পরাজয়ই আবার তার মনে জোগান দেয় জয়ের আশা। অর্থাৎ পরাজয়ের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েও সে জয়ের সংগীত গায়। এটা বিরাট শক্তি। এই শক্তির উদ্ভাস ঘটে ভেতরগত প্রেষণা থেকে। এই প্রেষণাও মনের স্বাস্থ্যের আরেকটি শক্ত পিলার। জীবনের শিক্ষা রিয়ার প্রেষণাকে মজবুত ভিতের ওপর গেড়ে দেয়। সে লক্ষ্য থেকে ছিটকে যায় না। অবিচল এগোতে থাকে লক্ষ্যপথে।
রিয়া ও কুসুম―দুই বান্ধবী। অন্তরঙ্গ বান্ধবী। দুজনই রূপবতী। মায়াবতী। মেধাবী। সেজে বের হলে তাদের রূপের ঝলক বেড়ে যায় বহুগুণ।
মেয়েরা সাজবে, এই ইস্যুতে মায়ের মন আনন্দিত হওয়ার কথা। খুশি মনে সবকিছু বিচার করার কথা।
মায়ের মন খুশি হয় ঠিক। খুশি চাপা পড়ে যায়, উদ্বেগের কারণে কাঁপন জাগে বুকে।
উদ্বেগ কেন এলো মায়ের মনে?
উদ্বেগ নেতিবাচক আবেগ। এই আবেগ স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের নীরব ক্রিয়া জেগে ওঠে, নেতিবাচক ঢেউ তোলে। মনে এমন কিছু ধারণা আসে, যা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র বা অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেমকে আলোড়িত করে নেতিবাচক আবেগ তৈরি করে। এই আবেগের টানে নিয়ন্ত্রিত হয় মায়ের আচরণ, চিন্তা।
গভীরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শৈশবের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষের মধ্যে কতগুলো মৌলিক চিন্তার বিকাশ ঘটে। এসব চিন্তাকে বলে ‘কোর বিলিভ’। ‘কোর বিলিভ’ মানুষের অন্য চিন্তা এবং সমগ্র জীবন প্রভাবিত করে। এগুলো দুই ধরনের হতে পারে। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক। কোর বিলিভ ক্ষতিকর। ছোটখাটো ঘটনা প্রবাহ তিলে তিলে মনের অতলে অভিজ্ঞতার ছাপ বসিয়ে রাখে। অভিজ্ঞতা জমতে জমতে ‘এক্সক্লুসিভ ডিসফাংশনাল এজাম্পশান’ বা ত্রুটিপূর্ণ ধারণা গড়ে ওঠে। সম্মুখ জীবনে ঘটতে থাকা ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে জটিল ঘটনা ‘ডিসফাংশনাল এজাম্পশান’গুলো সক্রিয় করে তোলে। তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে স্বতঃস্ফূর্ত না-বোধক চিন্তার জাল বিন্যস্ত হতে থাকে। এই অটোমেটিক থটস বা স্বয়ংক্রিয় গতিতে জেগে ওঠা চিন্তনের আক্রমণে দৈহিক উপসর্গ আসতে পারে, আচরণগত উপসর্গ আসতে পারে, মোটিভেশনাল বা অন্তর্গত প্রেষণার নিজস্ব পরিবর্তন হতে পারে, আবেগের পরিবর্তন হতে পারে, কগনিশন বা নিজের অবহিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। ফলে দেহমনে উপসর্গের জোয়ার বইয়ে যেতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক থিওরি ‘কগনিটিভ মডেল’ দিয়ে এসব বিষয় আমরা বিশ্লেষণ করে যেতে পারি:
মিসেস রাহেলা চৌধুরী হচ্ছেন রিয়ার মা। রিয়া ও তার বান্ধবী কুসুমকলিকে একা বাইরে যেতে দিতে চাচ্ছেন না। ইনিয়ে-বিনিয়ে তিনিও তাদের সঙ্গে যেতে চাইছেন।
কেন?
বৈজ্ঞানিক কী ভিত্তি মায়ের মনে কাজ করেছে?
মা কি মেয়েকে সন্দেহ করছেন? নাকি মায়ের মন ভয়ে সংকুচিত হয়েছে?
কিসের ভয়? কী সন্দেহ?
‘সন্দেহ’ হচ্ছে চিন্তা।
‘ভয়’ হচ্ছে আবেগ।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে, চিন্তা ও আবেগ মনের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুটো অঙ্গ।
চিন্তা ও আবেগের কারণে ঘটে যাচ্ছে ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়াগুলো।
কগনিটিভ মডেল বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, মায়ের মন সামাজিক ঘটনা থেকে অনেক কিছু শিখেছে, প্রত্যক্ষ করেছে।
কী প্রত্যক্ষ করেছে?
সমাজে মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে, যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, টিজের শিকার হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কিডন্যাপের শিকার হচ্ছে, ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে। মেয়েদের ফাঁদে ফেলার নানা জাল চারদিকে ছড়িয়ে আছে।
মেয়েদের মন মিষ্টি কথায় সহজে পটে যায়, গলে যায়। সহজে তারা মুগ্ধ হয়। মুগ্ধতার বলয়ে আটকে গেলে একটা মেয়ের অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক সমস্যা হয়। সেই বলয় থেকে বেরোনো সহজ হয় না। জটিল হয়।
এতকিছু মা প্রত্যক্ষ করেছেন, করছেন প্রতিদিন।
ফলে বুকের ধনকে তিনি বুকে রাখতে চান। বুকে আগলে রাখতে চান। পাহারা দিয়ে রাখতে চান। খোঁজখবর রাখতে চান―মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে। আসলেই সেখানে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি চিন্তা তার মনে ঘুরপাক খায়। এভাবে মায়ের আচরণ নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে।
এই আচরণের অর্থ মেয়েকে অবরুদ্ধ করা না, মেয়ের স্বাধীনতা হরণ না। মায়ের ‘বোধ’ হচ্ছে মেয়ের কল্যাণ কামনা। শান্তি কামনা।
আর মেয়ের ‘বোধ’ কী?
মেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনার আলোকে ঘটনা বিশ্লেষণ করছে, অথবা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসা মায়ের আচরণ দ্বারা ঘটনা মাপছে, মেপে মনে করছে মা স্বাধীনতা দিতে চায় না। আটকে রাখতে চায়। মা তাকে বিশ্বাস করে না।
মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে সে-ই ঠিক।
মায়ের অবস্থানে মা ভাবছে, তার ভাবনা ঠিক।
দুজনে দুজনার অবস্থানে ঠিক।
মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’-এর মাঝে তৈরি হচ্ছে গ্যাপ।
এই গ্যাপই সংঘাতের উৎস।
এই গ্যাপকে বলা যায় জেনারেশন গ্যাপ।
জেনারেশন গ্যাপের মূল দিক হচ্ছে আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতার মাত্রাগত পার্থক্য। উপলব্ধির তারতম্য। কগনিশনের ব্যবধান।
এই ব্যবধান সংঘাত তৈরি করে দেয়।
রিয়ার মনে সুনামির মতো তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে, রাগ তৈরি করে দেয়। এই ক্ষোভ ও রাগে অন্ধ হয়ে যায় রিয়া। ভুল করে বসে। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত।
রিয়া যেখানে গেছে, যত আনন্দপূর্ণ ঘটনাই ঘটুক না কেন, ‘ভুলটা’ তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।
উপন্যাসের শিক্ষা হচ্ছে, রিয়া বিধ্বস্ত হলেও হেরে যায়নি। তলিয়ে যায়নি। নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়নি। বরং নিজেকে আরও উদ্দীপ্ত করেছে, সমুজ্জ্বল করেছে। নিজের সমৃদ্ধিতে নিজেই সমৃদ্ধ হয়েছে। ভুলের প্ল্যাটফর্ম থেকে শুদ্ধতার পথে হেঁটে গেছে, মাথা উঁচিয়ে হেঁটে গেছে।
সাধারণত এমনটা ঘটে না। সাধারণত ভুল করে তলিয়ে যায় সবাই। ভুলের মাশুল দিতে দিতে জীবন পার করে দেয়। উঠে দাঁড়াতে পারে না।
কিন্তু উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মাত্রা।
এই মাত্রায় সংযোজন হচ্ছে সাহস। প্রেরণা।
সাহস ও প্রেরণা এসেছে রেজা মামার কাছ থেকে। রিয়া সেই প্রেরণায় শক্ত থাকতে পেরেছে। সাহসী হয়েছে। আত্মবিশ্বাসে ফাটল তৈরি হয়েছিল। বিপদ থেকে উদ্ধারের কারণে সেই ফাটল আবার ‘রিপিয়ার’ হয়ে যায়, পুনর্নির্মাণ ঘটে ফাটলে। পুলিশের অ্যাডিশনাল কমিশনার ফারুক সাহেবের সহযোগিতা ছিল সাহসের মধ্যে প্রাণরসায়ন। এই রসায়নের শক্তি এসেছে বাল্যবন্ধুর প্রতি মমতা থেকে। ভালোবাসা থেকে।
বাল্যবন্ধুর মৌলিক টান উপন্যাসের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে। উপন্যাসের গতিতে ঐশ্বর্য ঢেলেছে। সাধারণত ব্যবহারিক ফিল্ডে, যাপিত জীবনে এমন দেখা যায় না। পুলিশ প্রশাসন এত আন্তরিকতা নিয়ে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য পেতে হলে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফারুক সাহেবের পেছনে পোড়ানো কাঠখড় হচ্ছে ছোটবেলার গভীর বন্ধুত্বের বন্ধন। স্মৃতি। এই বন্ধন অনেক বেশি মৌলিক। নির্মল। সত্য ও সুন্দর। এটা হচ্ছে অতীত-আশ্রিত অনুভূতির বর্তমানের টান। মনস্তত্ত্বের নির্মোহ ভাষা এই টান মহিমান্বিত করেছে।
চলবে...
এসইউ/জিকেএস