নিরুদ্দেশ: জীবনমুখী গল্পগ্রন্থ
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
মানুষের জীবনযাপন, আনন্দ-বেদনা ও দুঃখ-দহন ধারণ করে থাকে সাহিত্য। লেখকরা গল্প-উপন্যাসে বহুমাত্রিক সমাজবাস্তবতার কথা তুলে ধরেন। একেক লেখকের হাতে একেক ঘটনা স্বতন্ত্র রূপ পায়। তাই জীবনের গভীরতম বোধ ও ভাবনাগুলো লেখকদের হাতে বহুভাবে বিচিত্র হয়ে ওঠে।
কাজী এনায়েত উল্লাহ দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। ইতোমধ্যে তার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি ‘বিশ্বপ্রবাস’, অন্যটি ‘ভালোবাসার রূপান্তর’। এর মধ্যে বিশ্বপ্রবাস ইংরেজি ভাষায়ও প্রকাশিত হয়েছে ‘The Living World’ নামে। তবে দুটি বইয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান। তার তৃতীয় গ্রন্থ ‘নিরুদ্দেশ’ও একই বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বইতে ১৬টি গল্প আছে।
বইটির নামগল্প ‘নিরুদ্দেশ’। পোষাপ্রাণী টমি এ গল্পের মূল অনুষঙ্গ। গল্পকথকের সাথে টমির সম্পর্ক নিবিড়। টমিও গল্পকথককে পছন্দ করত। গল্পকথকের ভাষ্য: ‘টমির সব ভালোবাসা ছিল আমার প্রতি। টমি ছিল আমার আপনের অধিক। পড়ার টেবিলে যতক্ষণ থাকতাম, সে জানালার ওপারে বসে থাকত আমার দিকে মুখ করে।’
গল্পকথক উচ্চশিক্ষার জন্য প্যারিসে পাড়ি জমাবেন। সে জন্য গোছগাছ চলছে, কিন্তু টমি তার প্রিয়জন প্রস্থানের খবরটি টের পেয়েছে। তাই সে আগের মতো আচরণ করে না। প্যারিসে যাওয়ার বিদায়ক্ষণে গল্পকথক টমিকে আর খুঁজে পাননি। আশপাশে কোথাও টমি ছিল না। প্রবাসে গিয়েও লেখক টমিকে ভুলতে পারেন না। পরে মায়ের মাধ্যমে জানতে পারেন তার প্যারিস-যাত্রার দিন টমি উধাও হয়েছে, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। এরপর সময় গড়িয়েছে চল্লিশ বছর। গল্পকথক আজও নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া টমির অপেক্ষায় থাকেন। এভাবেই গল্পটি শেষ হয়। এ গল্পের বুনন সাবলীল, শব্দচয়নে লেখক পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। সব মিলিয়ে গল্পটি পোষাপ্রাণীর প্রতি গভীর মমত্ববোধের এক শৈল্পিক উদাহরণ।
একজন প্রবাসীর দুঃসহ জীবনের গল্প ‘স্বপ্নভঙ্গ’। গল্পের প্রধান চরিত্র সাইমুম ঋণ করে সিঙ্গাপুরে যায়। সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়িতে টাকা পাঠায়। প্রবাসে থাকাবস্থায় মা মারা গেলেও ছুটি না পাওয়ায় মায়ের মুখখানি শেষবারের মতো দেখতে পারে না। তার পাঠানো টাকায় বোনদের বিয়ে হয়, পরিবারে সচ্ছলতা আসে। মায়ের মৃত্যুর পর বাবাও নতুন বিয়ে করেন। প্রবাসজীবনের সাড়ে এগারো বছরে সাইমুম বিরানব্বই লাখ টাকা পাঠিয়েছিল বাবার নামে। এক যুগ পরে সে দেশে ফেরে মাত্র নব্বই হাজার টাকা নিয়ে। তার বিশ্বাস ছিল, তার পাঠানো সব টাকা আছে। দেশে ফিরে সে বিয়ে করবে, সুখে-শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু তেমনটি আর হয়নি। বাবা তাকে কড়াস্বরে জানিয়ে দেন, টাকার হিসাব তিনি দিতে পারবেন না। সাইমুমের টাকায় তিনি নিজের নামে জমি কিনেছেন। সেই জমির ভাগ অন্যরাও পাবে। তখন সাইমুম মাত্র সোয়া দুই বিঘা জমি ভাগে পায়। প্রবাস থেকে ফিরে টানাপোড়েনের ভেতর সাইমুম বিয়ে করেছিল। এক যুগ প্রবাসে থাকার পরও দেশে ফিরে সে আজ উল্টো চার লাখ টাকা ঋণী। নিজ পরিবারের এ বঞ্ছনা সাইমুমকে কুরে কুরে খায়। সে আত্মহত্যার কথাও চিন্তা করে।
‘স্বপ্নভঙ্গ’ গল্পটির মূল চরিত্র সাইমুম এ দেশের জনজীবনে দুর্লভ নয়। সাইমুমের মতো অসংখ্য প্রবাসী নিকটজনের কাছ থেকে এমন প্রতারণা ও নির্মমতার শিকার। নিঃসন্দেহে কাজী এনায়েত উল্লাহর এ গল্প সমাজ বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি।
বইটির অন্যতম গল্প ‘সংগ্রামী জীবন’। গল্পটির মূল চরিত্র ছমিরন বেওয়া। সাতক্ষীরা অঞ্চলের সাগরঘেঁষা সুন্দরবন অঞ্চলে দুই সন্তান নিয়ে তার বাস। স্বামী হায়দার আলী পেশায় মৌয়াল। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বাঘের ভয়কে ম্লান করে হায়দার আলী সুন্দরবনে মধু সংগ্রহে যান। মেয়ে রুমি অল্প বয়সে অপচিকিৎসায় মারা যায়। এরপর ছমিরন বেওয়ার জীবনে একের পর এক বিপদ। হায়দার আলী ও ছেলে ফজল মধু সংগ্রহ করতে গেলে বাঘের আক্রমণের মুখে পড়ে। হায়দার আলীকে বাঘে নিয়ে যায়। আহত ফজলও দু’বছর তিন মাস পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। পৃথিবীতে ছমিরন বেওয়ার বাঁচার অনুষঙ্গ আর রইল না। যে কারণে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ মুহূর্তে জীবনসংগ্রাম চালিয়ে নেওয়াকেই বেছে নেন। আলোচ্য গল্পটি সুন্দরবনসংলগ্ন মানুষের সুখ-দুঃখকে চিত্রায়িত করে। বিশেষত মৌয়ালদের জীবনের সাথে গল্পটির যথার্থ মিল রয়েছে।
নিরুদ্দেশ গ্রন্থের সর্বশেষ গল্প ‘মোমবাতি’। গল্পে সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। গল্পকথকের সাথে জামিল ও তাদের পরিবারের রয়েছে সুসম্পর্ক। গল্পকথককে জামিলের মা ও বোন স্নেহ করতেন। কিন্তু হঠাৎই জামিলদের পরিবার একের পর এক দুর্ভাগ্যে পতিত হয়। প্রথমে ঘূর্ণিঝড়ে জামিলের তিন বছরের ছোট ভাই করিম মারা যায়। বছরখানেকের মধ্যে জামিলের মা-ও সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। গল্পকথকের বাসার পেছনে জামিলের মা-ভাইকে কবরস্থ করা হয়। যুদ্ধের সময় জামিল ও তার বাবা পাকিস্তানে চলে যায়। কিন্তু গল্পকথক তাদের স্মৃতি ভুলতে পারেন না। জামিলের মায়ের কবরে প্রতিবছর শবে বরাতে গল্পকথক মোমবাতি জ্বালাতেন। কবরটি ছিল তার কাছে পবিত্র জায়গা। কবরের পাশে ছিল আমগাছ। গল্পকথক সেই গাছ থেকে আম পাড়তে গিয়ে ডাল ভেঙে কবরের পাশেই পড়ে যান। গাছ থেকে পড়ে গল্পকথকের মৃত্যুও হতে পারত। কিন্তু তার কাছে মনে হয়েছে, জামিলের মা মাতৃস্নেহে তাকে রক্ষা করেছেন। গল্পটিতে দুই পরিবারের সৌহার্দ্য, পারস্পরিক সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব ও বিশ্বাস উচ্চকিত হয়েছে।
বইয়ের অন্য গল্প হচ্ছে ‘কথার পৃথিবী’, ‘সন্ধান’, ‘উপলব্ধি’, ‘তুষারাবৃত স্বপ্ন’, ‘চায়ের স্বাদ’, ‘মরীচিকা’, ‘অতন্দ্র প্রহরী’, ‘ভালোবাসার পৃথিবী’, ‘বোবা কান্না’, ‘অর্থহীন বেঁচে থাকা’, ‘বন্দিজীবন’ ও ‘শিকারি’। গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই জীবনঘনিষ্ঠ। যাপিত জীবনের নানাবিধ ঘটনা গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। গল্পগুলোর কোনো কোনো অংশ বা চরিত্র পাঠককে ব্যথিত করবে, কোনোটি পাঠকের মনে আনন্দ সঞ্চার করবে। গল্পগ্রন্থে শহর, গ্রাম, প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবেশ ও জনজীবন উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকাশ পেয়েছে পোষাপ্রাণীর প্রতি গভীর মমত্ববোধও। সামাজিক অসঙ্গতি, প্রত্যাশা, বিশ্বাস, কুসংস্কার, দরিদ্রতার উপস্থাপনও এ গ্রন্থে উল্লেখযোগ্য। গল্পের সরল বর্ণনাভঙ্গি ও সমাজনিবিষ্টতার জন্য কাজী এনায়েত উল্লাহকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
নিরুদ্দেশ প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান। ১১২ পৃষ্ঠার মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। পাওয়া যাবে প্রথমা ও রকমারিসহ দেশের অভিজাত বইবিপণীতে।
এসইউ/জিকেএস