মায়াবতী: পর্ব ৩৭

মোহিত কামাল মোহিত কামাল , কথাসাহিত্যিক, মনোচিকিৎসক
প্রকাশিত: ০২:৩৭ পিএম, ০৮ এপ্রিল ২০২২

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

ছত্রিশ.
আগামীকাল ফিজিয়োলজি আইটেম পরীক্ষা আছে। পড়া দরকার। হোস্টেলে নিজের রুমে পড়তে বসেছে রিয়া। পড়ায় মন বসছে না। বারবার অর্কর কথা মনে পড়ছে। অর্কর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেছে। বাপির সঙ্গে কথা বলেছে। ডিটেইলস বলেনি। বলেছে একটা অসহায় ছেলের চিকিৎসার ভার আমি নিতে চাই বাপি।
ইমরুল চৌধুরি বলেছেন, তোমার ইচ্ছামতো খরচ করবে। নো প্রবলেম।
বাপির আশ্বাস পেয়ে প্রসন্ন আছে ও। তবুও মন বসছে না বইয়ের পাতায়।
তাবিন্দার রুমে চলে এলো রিয়া। তাবিন্দার রুমমেটরা রাতে লাইব্রেরিতে পড়ে। এটাই সুবিধা। ওর রুমে ডিসকাস করা যায়।
দুজনে একসঙ্গে পড়লে পড়া এগোয় ভালো। একঘণ্টা পড়েই প্রিপারেশন নিয়ে সন্তুষ্টি জাগে। স্বস্তি নিয়েই নিজের রুমে ফিরে আসছিল সে।
মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে ওঠে। আননোন নম্বর।
সাধারণত আননোন নম্বর ধরে না ও। এখন ধরল।
আপা আমি পেখম। পুনম আপার ছোট বোন পেখম, চিনেছেন আমাকে?
হ্যাঁ। চিনেছি।
পুনম আপার খুব বিপদ হয়েছে। আপনি এখন কোথায়?
আমি তো মেডিক্যাল হোস্টেলে। কী বিপদ?
প্লিজ ঢাকা মেডিক্যালের ইমারজেন্সিতে আসবেন এখন? পুনম আপার রক্তপাত হচ্ছে। আপা তো মরে যাচ্ছে। প্লিজ আসুন। আমরা ইমারজেন্সিতে আছি।
মরে যাচ্ছে? রক্তপাত ঘটছে?
হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি আসুন।
তাবিন্দাও শুনছে রিয়ার কথা।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে। অর্কর রক্তপাত হচ্ছে?
রিয়া উত্তর দেয়, না। অর্ক না। পুনম আপার অবস্থা খারাপ। চল, ইমারজেন্সিতে যাই।
পুনম আপাটা কে?
আমার ক্লোজ একজন। চল পরে কথা বলব।

দুজন একসঙ্গে হোস্টেল থেকে বেরিয়ে জরুরি বিভাগে শুনতে পেল ইমারজেন্সি থেকে গাইনি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিয়েছে পুনমকে।
রিয়া আর তাবিন্দা ছুটে গেল সেখানে। ব্লাড দরকার। জরুরি ব্লাড দিতে হবে রোগীকে, বললেন ডিউটি ডাক্তার। জরুরি অপারেশনও লাগবে।
রক্তের গ্রুপ জানা আছে, আপা? পুনমের পাশে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে রিয়া।
পুনম জবাব দেয়, বি পজিটিভ। এখনো বেশ শক্ত আছে পুনম। সেন্স আছে।
আপা ভয় পাবেন না। আমার ব্লাড বি পজিটিভ। আমিই এখন রক্ত দেবো।
ব্লাড গ্রুপিংয়ের ফরমালিটিস সেরে নেয় ও। তাবিন্দাকে পুনম আপার পাশে রেখে ছুটে যায় ব্লাডব্যাংকের দিকে।
হঠাৎ মনে হলো যেবু আপার কথা। যেবু আপার অন্তরঙ্গ বান্ধবী পুনম আপা।
যেবু আপাকে রিং করে। দুঃখিত। এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না।
রিয়া একা। একা ছুটে যায় ব্লাডব্যাংকে। ছোটা অবস্থায় কল করে রেজা মামাকে। ভেবেছিল রেজা মামার কাছে যেবু আপার খবর পাবে। একই কথা শুনতে পায় ও। মোবাইল সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না।
ব্লাডব্যাংক থেকে নিজের রক্ত কালেক্ট করে। সব মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ মিনিট সময় লাগে। রক্ত নিয়ে ফিরে এসেছে রিয়া।
ততক্ষণে স্যালাইন চলেছে। বিভিন্ন ওষুধ দেওয়া হয়েছে। পুনম আপার চোখ শূন্য। শূন্যতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি রিয়ার দিকে।
ডিউটি ডাক্তার এসেছেন। স্যালাইন সরিয়ে ব্লাড লাগিয়ে দিয়েছেন। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে, রিয়ার রক্ত ঢুকে যাচ্ছে পুনমের শরীরে।
পুনম কৃতজ্ঞ চোখে ব্লাড সেটের দিকে তাকিয়ে দেখছে রক্তের গতি।
আপা কী হয়েছিল আপনার? রিয়া জানতে চায়।
পুনম ঠান্ডা গলায় বলল, ওদের একটু বাইরে যেতে বলো।
ওরা যাওয়ার পর বলল, কনসিভ করেছিলাম। এমআর করাতে গিয়ে কমপ্লিকেশন হয়েছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।
কনসিভ করেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার তো বিয়ে হয়নি।
হ্যাঁ। বিয়েবহির্ভুত কারণে ঘটেছে।
ইচ্ছায়? নাকি রেপড হয়েছেন? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিয়া।
পুনম চুপ থাকে। তার বলতে ইচ্ছা হয়েছিল সত্য কথা―ইচ্ছায় করেছি। সত্য লুকায় সে। বলল, রেপড হয়েছি।
কে করেছে?
অফিসের এক কলিগ।
আব্বুর অফিসের কলিগ? আপনি তো আব্বুর অফিসেই কাজ করছিলেন।
পুনম আর কথা না-বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
রিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। যেবু আপার কথা রেখেছিল ও। বাপিকে বলে নিরাপদ চাকরির ব্যবস্থা করেছিল। সেই পুনম আপার এই দশা? তার কারণেই কি আপার বিপদ হলো? নিরাপদ আশ্রয়েও কি তবে নারী নিরাপদ নয়?
হায়! নারীরা কোথায় নিরাপদ?
রিয়া ফোন করে বাপিকে।
ইমরুল চৌধুরি ফোন ধরেন।
তুমি কোথায় বাপি?
বাসার পথে।
গাড়ি ঘোরাও। ঢাকা মেডিক্যালে এসো।
কেন?
কোনো প্রশ্ন কোরো না বাপি। দ্রুত এসো। পুনম আপার খুব বিপদ। রক্ত দিতে হচ্ছে তাকে। রক্ত চলছে এখন।
ইমরুল চৌধুরি বললেন, আমি আসছি। তুমি ওর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করো।

অল্প সময়ের মধ্যে ইমরুল চৌধুরি এসে হাজির হলেন গাইনি ওয়ার্ডে। রিয়া আর পেখম বসে আছে। তাবিন্দাও আছে। সে যায়নি। রিয়া কাছে ডাকে বাপিকে।
এদিকে এসো। একটু সরে গিয়ে বলল, তোমার অফিসের কোনো স্টাফ আপাকে রেপ করেছে। ওই পশুর বিচার চাই আমি। হাউ ডেয়ার সে-ই স্টাফ!
ইমরুল চৌধুরি চমকালেন। চমকে শক্ত গলায় বললেন, বিচার করব। এখন ওর জীবন বাঁচাও। বিষয়টা ফাঁস হলে অফিসের দুর্নাম হবে। আগে সুস্থ করে তোলো ওকে।
ইমরুল চৌধুরি পুনমের পাশে এসে কপালে হাত রাখেন।
এখন কেমন আছো, মা?
মা ডাক শুনে পুনম চোখ বোজে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘মায়াশূন্য আলিঙ্গনে’ কবিতার কয়েকটি চরণ মনে মনে আওড়ায় সে:
একদিন কাছে বসলেই
দূরত্বকে পেয়ে যাবে হাতের মুঠোয়।
পচা এক কমলার মতো তাকে পিষে করতলে
আঙুলের ফাঁকে রস ঝরিয়ে ফেলার পর
খোসাটিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠবে―হাঁ,
দ্যাখো দ্যাখো দূরত্ব কোথায় যায় একবার বসো যদি কাছে।’

অনেকক্ষণ পর প্রশ্নের জবাব দিলো পুনম, এখন ভালো।
ইমরুল চৌধুরি রিয়াকে বললেন, যাও মামণি তোমরা হোস্টেলে চলে যাও। আমরা অফিসিয়ালি ওর দেখভালের ব্যবস্থা নেব।
বাপির দায়িত্ববোধ নিয়ে তার কোনো শঙ্কা নাই। সন্দেহ নেই। বাপিকে পেয়ে একশ ভাগ স্বস্তি পেল রিয়া।
বাপির আশ্বাস পেয়ে রিয়া আর তাবিন্দা চলে আসার উদ্যোগ নেয়।
আসার মুহূর্তে একবার পুনম আপার হাত চেপে ধরে রিয়া।
পুনম চোখ মেলে তাকিয়ে রক্তের ফ্লো দেখতে থাকে। রিয়ার রক্ত চুষে নিচ্ছে নিজ দেহ। নিজ দেহের কোষে কোষে মিশে যাচ্ছে রিয়া। নিজের অস্তিত্বে বেজে ওঠে রিয়ার জয়গান।
এই রিয়া শান্তির দূত। এই রিয়া ঐশ্বরিক মায়ার সাগর বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ রিয়াকে কষ্ট দেওয়া যায় না। মায়া করা যায়। এই রিয়া সুখের জন্য সব করবে সে। বেঁচে উঠলে এই রিয়াকে নিজের মমতা আর ভালোবাসার বর্ম দিয়ে আগলে রাখবে। ভাবে পুনম।
রিয়া চলে গেল।
পুনম তাকিয়ে ওর যাওয়া দেখতে লাগল। নিজের মধ্যে অনুভব করল অন্যরকম সাহস। অন্যরকম শক্তি। মনে মনে ভাবে, এই শক্তির মর্যাদা রাখবে সে। পরাজিত হবে না আর। যে-কোনো ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে ভবিষ্যতে।

সাইত্রিশ.
বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে রিয়া। তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে যাওয়ার জন্য রেডি হয় ও। আজ ফিজিয়োলজি আইটেম পরীক্ষা আছে। পরীক্ষা হচ্ছে সুপ্রিম প্রায়োরিটি। এখনকার জরুরি সময়েও অর্কর কথা মনে পড়ল। পুনম আপার কথা মনে পড়ল। যেবু আপা আর রেজা মামার কথা মনে পড়ল। কুসুমকলি আর মাহিনের কথাও মনে পড়ছে। মুনার জন্য কষ্ট হচ্ছে। বাঁধনের ক্রমাগত জয় সব কষ্ট ছাপিয়ে দেয়। বাঁধনের উচ্ছাস খুব ভালো লাগে। ওর সামনে থাকলে মনে দুঃখ থাকে না। দুঃখ পালিয়ে যায়। সবার কথা ভাবতে ভাবতে দ্রুত হাতে ইলেকট্রিক কেতলি অন করে ও। এক কাপ গ্রিন টি বানিয়ে নেয়। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হাতের কাজ গুছিয়ে নেয় রিয়া। অ্যাপ্রন পরে মোবাইল ফোন খুঁজতে থাকে। রাতে মোবাইল অফ করে শোয়। পেয়ে যায় সে মোবাইল সেট। টেবিলেই আছে। একটা খাতার তলে আছে সেটটা।
এ সময় তাবিন্দা এসে ওর রুমের সামনে দাঁড়ায়। দরজা খোলা আছে। ভেতরে না ঢুকে হাতের ইশারায় বলল, কুইক।
রিয়া চায়ের কাপ রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

চলবে...

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।