আমিনুল ইসলামের গুচ্ছ কবিতা
রানিং ট্র্যাক থেকে
রানিং ট্র্যাকেই আছি; কিন্তু কো-রানারদের সাথে
দৌড়াতে দৌড়াতে সহসাই কমে আসে গতি,
রাস্তার পাশে আহত দৃশ্য হয়ে উঠি;
পরে বুঝতে পারি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল;
সংলগ্ন বৃক্ষ ডাক দেয়, বলে,
আরে কি লাগি দৌড়াও!
তারচেয়ে এসো, বসো এ ছায়ায়,
কান পাতলে শুনতে পাবে
হাওয়ার আঙুল সবুজ শাখায় বাজিয়ে চলেছে
কানাইলালের দুরন্ত দোতরা!
সেই সুরে কান দিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি!
জেগে উঠে দেখি—
রানিং ট্র্যাকের কাছাকাছি এসে গেছে আরেক দল।
দৌড় লাগাই। নানা কূটকথা আসে কানে;
বুঝতে পারি নতুনরা আমাকে উপদ্রুব জ্ঞানে
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চায়;
তবু দৌড়াতে থাকি; মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে
যমুনার জল ছুঁয়ে আসা হাওয়া হয়ে ওঠে আবদুল আলীম;
কৈশোর এসে জড়িয়ে যায় পায়ে। কমে আসে গতি।
ধাক্কা দেয় নতুনের দল: আরে ভাই,
রাস্তার মাঝখানে থাকতে হলে জোরে দৌড়ান,
না হলে রাস্তা ছেড়ে বসে পড়েন কোথাও।
আমি না ঠিকমতো দৌড়াই,
না রাস্তার দুপাশের বৃক্ষদের সাথে সারিবদ্ধ হই।
একটি করাত বারবার দু’ভাগ করে দিয়ে যায় এই আমাকে
অথচ দুপুরের গায়ে রোদের মতো
আমার দুঠোঁটে লেপ্টে থাকে হাসি
আমার এই হাসি দেখে হাসে অগুনতি নদীমাতৃক উপহাস!
****
মাঝিকে
নৌকা তো সেই পুরোনো দিনের
বুকের তলায় স্রোতের দাগ
হাইল ও গুড়া রয়েছে অটুট
তুমিও ভোলোনি যোগের ভাগ।
পারানের কড়ি পাচ্ছো যে মাঝি
এই নিয়ে খুশি অন্তহীন
ঢেউ ছাড়া কোনো ঝুঁকি আছে কি না
উদাসীন তুমি রাত্রিদিন।
কানায় কানায় ভরেছে কখন
জল ছুঁই ছুঁই গলুই ধার
ঝড়ের চেয়েও বড় ভয় আজ
বাদাম অদূরদর্শিতার।
ও রে ও মাঝি কেন যে ভোলো
নৌকাডুবির রয়েছে রিস্ক
নূহের নাও-ও লাগতো না কূলে
যাত্রী ওঠালে সংখ্যাধিক।
****
নিঃসঙ্গতা ধুয়ে দিয়ে যায়
ইতিহাসে মাথা রেখে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মুঠোফোন;
তার বুকেও শতবর্ষের নির্জনতা।
পাপিয়ার কান্না বা শিরিষশাখার গজল
তরঙ্গের পিঠে সওয়ার হয়ে
আসেনি এসবের কোনোটাই।
যদিও তুলোহীন
তথাপি পৃথিবীর কানে বাজেনি
স্বাতী ও অরুন্ধতির কানাকানি;
এমনকি মার্কিনী আগ্রাসনের মতো
অগ্রগামী যে-অন্ধকার
তার উল্লসিত পদধ্বনিও নয়।
ফলে ওয়াকওভারের পায়ে
চলে আসে অন্ধকার
তার হাতে গুটিয়ে যায় সোনালি আলোর চাদর।
অধিকন্তু, তুষারের চতুর্মুখী সাক্ষ্যে
মিথ্যা হয়ে আছে ফল্গুধারার দাবি।
তবু একটা রোদেলা দুপুরের স্বপ্নে
সারেং বউয়ের চোখে পৃথিবীর দৃষ্টি প্রসারিত।
কোনো এক দুপুরে
আলবার্টাসের ডানার শব্দে ভেঙেছিল
হিমশাসিত নির্জনতার চূড়া,
সে-কথা মনে রখে
একটা প্রবাদের গায়ে হেলান দিয়ে
সে জেগে আছে;
অথচ ঐতিহাসিক দায়িত্বের কথা
বেমালুম ভুলে আছে ইতিহাস।
****
ব্যর্থতার প্রেসনোট
দ্যাখো—গায়ে ভালোবাসার ইউনিফর্ম আর
হিরোইনসেবীদের মতো জড়িয়ে সে—
বহুগামী অন্ধকারের শরীরে,—যেখানে
জোছনাকে কুকুরের চোখ বলে মনে হয়!
তথাপি চেষ্টা করেছি। একবার। বহুবার।
কখনো একাদশীর চাঁদ কখনো পূর্ণিমা।
পারলাম না। মনটা খারাপ। আকাশের গায়।
মাই লর্ড, ইওর অনার,
ব্যর্থতা কি শুধুই আমার!
পায়ের কাছে বঙ্গোপসাগরের অফুরন্ত রিজার্ভ
কিন্তু আকাশ কি পারে
শ্রাবণের ঝারি দিয়ে—
মুক্ত করতে শীতলক্ষ্যাকে দূষণের গ্রাস থেকে?
সাফল্য দ্রৌপদীর সন্তান
প্রতিটি ব্যর্থতার পেছনে থাকে বহুমুখি বন্ধ্যা সহবাস।
****
বীজ না ভূমি
তোমার বুকে পড়েছিল—জানে সবাই
তথাপি তো ওঠেনি অংকুর।
ব্যর্থতার দায় সরিয়ে লাফাচ্ছো যে এত,
চিমটি দিয়ে মেপেছো কি উর্বরতার থিতি?
তোমার তো কষিজ্ঞান, সনদে প্রমাণ;
সেও তো ছিল না কোনো হাইব্রিডের বীজ!
উপরন্তু, জৈবসারে পুষ্ট বীজতলা।
তবে এই পলিমাটির দেশে
কে তাহারে ব্যর্থ করে, তুমিই বলো,
রঙচোরা বালি, নাকি পাষাণের কণা?
তোমার বুকে না পড়ে,
ধরো, যদি বিহঙ্গীরও ঠোঁটে পেতো ঠাঁই,
শস্যময় হতো নাকি
দারুচিনি দ্বীপ কোনো চোখের আড়ালে?
দেবতাগণেরও হয়;
আমি তো কেবল এক বদ্বীপ নিবাসী,
মৃত্তিকার নেশা লালশোণিতের স্রোতে;
কাদাধুলো ছোঁবে না এ গা,
এই খত দিইনি তো কোনো মহাজনে!
তবে আর কাম কী কারণ নির্ণয়ে!
তারচেয়ে সেই ভালো—
কণ্ঠভোটে মেনে নাও এই তো ঘটনা।
এসইউ/জিকেএস