ম্যানচেষ্টারে ‘বাউলা কে বানাইলো-রে’


প্রকাশিত: ০৬:৩৫ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

বাউলদের গান মাটি নিয়ে, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আর জাতি নিয়ে । প্রতিবাদ-আধ্যাত্মিকতা নিয়েই তাদের সাঁই সাজা। গানেই তাদের পরিচয়। একতারা কিংবা দোতরা নিয়ে বিভাগী হওয়া মানুষগুলো খুব স্বাভাবিক অর্থে পরিচ্ছন্ন কোনো মানুষ নয়। দাড়ি-গোঁফ সব মিলিয়ে এরা যেন অন্য এক জগতের মানুষ। এরা আধুনিক মার্কসবাদ কিংবা লেনিনবাদের ধারক কিংবা বাহক নয়, এরা নাস্তিকও নয়। কিন্তু জাগতিক সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে এরা অন্য এক দর্শনের কথা বলে, এখনও বলে যায়। এ দর্শনে আছে মাটির ঘ্রাণ। এ দর্শনে আছে স্রষ্টার গুনগান। আবার ঐ দর্শনেই এরা কখনো-বা স্রষ্টার মুখোমুখি দাঁড়ায় অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নিয়ে।

গানে গানে, ভাবের আদানপ্রদান চলে ভবের এই মেলায়। আর এখানেই হয়ত বাধ সাদে অনেকেই। আর তাই তাত্ত্বিকভাবে বললে বলা যায় বাউল দর্শনের উদ্ভব একটি বিপ্লবী চেতনার ভিতর দিয়ে। গোপাল হালদারের ভাষায়- ‘মধ্যযুগের ইউরোপ এশিয়ার বহু দেশের শ্রেষ্ঠ মানুষেরা পৃথিবীর অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে স্বভাবতই এই আধ্যাত্মিক পথে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সন্ধান করতেন। ভারতের নানক কবীর থেকে বৈষ্ণব আউল বাউল প্রভৃতি সকলে আসলে সমস্থ মধ্যযুগের ভেতরকার বিপ্লবী চেতনার প্রকাশ। এরা প্রত্যেকে অর্থোডক্স রিলিজিয়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী।’

ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সময় গ্রামকে তছনছ করে ফেলা হলো। সোনা মাটি পরিণত হলো নীল চাষের মতো জঘন্য কাজে। জমিদাররা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। তারা দুয়ে মিলে বাঙালির দেহের রক্ত আর মাটির রস দুই শুষে নিয়েছে। সাধারণ কৃষকরা সেই অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে।  বাউলরা কিন্তু তখন ঘরে বসে থাকেনি। তারাও তখন কৃষকদের পক্ষে দাঁড়ায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, ‘কাঙাল হরিনাথের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জিতে দেখি সত্যি সত্যি লালন চরিত্র ভোলা বাউল আবার প্রয়োজন হলে হতে পারেন জাঁদরেল লাঠিয়াল। হাতের একতারাটি রেখে জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লাঠিও ধরতে পারেন। কাঙাল হরিনাথ তাঁর পত্রিকা ‘গ্রামবার্তা’য় জমিদারের প্রজানিপীড়নের খবর ছাপানোর জন্য সেই যখন কাঙাল হরিনাথকে শায়েস্তা করার জন্য লাঠিয়ালের দল পাঠান, তখন লালন তাঁর দলবল নিয়ে নিজে লাঠি হাতে সেই লাঠিয়ালের দলকে আচ্ছা করে টিক করে সুহৃদ কৃষক-বন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন।’
 
বাউলরা তাদের মনের অজান্তেই হয়ত এক প্রচলিত সমাজবিরোধী মনোভাব নিয়ে সাঁই সেজেছে। অন্য অর্থে এই সমাজে তারা যেন বিদ্রোহী এক গোষ্ঠী। সেকারণেই বিভাগী এই মানুষগুলো তথাকথিত সুশীল আর সভ্য সমাজের অবহেলা আর তাচ্ছিল্য নিয়ে নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে। এবং হয়ত তাই তারা যেন তাদের দাড়ি আর গোঁফের আধারে এই সমাজটাকেই লুকোতে চায়। এই লুকোনোটাই তাদের জন্যে কাল হয়। অভিযোগ-অনুযোগ নিয়ে স্রষ্টার মুখোপেক্ষি হয়ে গেলেই মৌলবাদীদের কিংবা স্বার্থন্বেষীদের শ্যেন দৃষ্টি তাদের বিদ্ধ করে। চার বছর আগের রাজবাড়ির বাউলদের উপর হামলা এরকমেরই এক আক্রমণ। পাকিস্তান আমলে এক মন্ত্রীর দাদা আফসার উদ্দিনের দাপটে কুষ্টিয়ার বাউলরা তখন তটস্থ ছিলো। এই লোকটি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত লালনের আখড়াতে কোনো উৎসব হতে দেননি।  

১৯৫৩ সালে একবার বাউলরা দোল পূর্ণিমা পালনের উদযোগ নিয়েছিলো। আফসার উদ্দিন সেদিন লালনের আঘড়াতে বাউলদের ধরে চুল-দাঁড়ি কেটে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশেও ঘটেছে এরকম নির্যাতন। ২০১১ তে। চুল-দাড়ি কেটে দিয়ে বাংলাদেশের বাউলিয়াপনা বন্ধ করে দিতে চেয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। বাউল মতবাদ উদ্ভবের শুরু থেকেই এই দ্বন্দ্ব আছে। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। সবলরা মনে করে নির্যাতন করে দাড়ি-গোঁফ কেটে দিলে বাউলরা সব ছেড়ে-ছোড়ে ঐ সবলদের হাতের পুতুল হয়ে যাবে। বাউলিয়াপনা বন্ধ হয়ে যাবে। সেই ষাট বছর আগের নির্যাতনেও বাউলরা পিছনে যায় নি। কারণ বাউলরা একটি দর্শনে বিশ্বাস করে। জাগতিক ধ্যান-ধারণার উর্ধ্বে উঠে এদের ভাবনার জগত প্রসারিত। মানব প্রেম ছাড়া এদের সঞ্চয় বলতে আর কিছু নেই।

সে হিসেবে ‘বাউলা কে বানাইলো-রে’- ব্রিটেনের ম্যানচেষ্টারে তথা নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডে কোনো প্রতিবাদী গানের অনুষ্ঠান নয়। যান্ত্রিক ঝড়-ঝঞ্ঝায় আমাদের চলমান নাগরিক সভ্যতায় আমরা ছুইয়ে দিতে চাইছি শুধু সেই শুদ্ধ উচ্চারণগুলো। অন্তরে লালন করা লালন ফকির থেকে শুরু করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথেরও বাউলিয়া মন প্রতিমুহূর্তে বাঙালি হৃদয়কে প্রাণিত করেছে কোনো এক আধ্যাত্মিক জগতের দিকে।

ব্রিটেনের অধিকাংশ বাঙালির মনজগতে যেখানে হাসন রাজা কিংবা দুরবীন শাহ কিংবা শাহ আব্দুল করিম কিংবা শিতালং শাহ ছায়া দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত, সেই ছায়াকে অনুসরণ করেই অনুরণিত হলো ম্যানচেষ্টার, ইংরেজি বছরের শুরুতে, গত ৩ জানুয়ারি রোববার। নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শিল্পীদের বাউলা গান দীর্ঘ পাচ ঘন্টাব্যাপী আনন্দ দিয়েছে ম্যানচেষ্টার তথা নর্থওয়েষ্ট ইংল্যান্ডের নারী-পুরুষ-শিশুদের। আয়োজক সংগঠন চেতনা ইউকে’র এই আয়োজন প্রতিটি বছরেই হবে ম্যানচেষ্টারে। এই আয়োজনকে ঘিরে বাঙালি প্রাণ আন্দোলিত হয়েছে, অনুরণন জেগেছে এই পরবাসে, সেই অনুরণন ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশময়, এই অনাবাসী ভূমে।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।