গল্পের মোড়কে মানুষ: পূর্ণাঙ্গ জীবনের উপাখ্যান
অদ্রি আরিফ
‘কারো সর্বোচ্চ মাত্রার উপস্থিতিই হলো অনুপস্থিতি।’
শেষ থেকেই শুরু যেমন সময়ের, তেমনই জীবনের, ‘গল্পের মোড়কে মানুষ’ নামক কাব্যিক আখ্যানের। অমিয় শুধু উপাখ্যানের প্রধান চরিত্র নয়। সে একটি বাউণ্ডুলে, ঋদ্ধ, মানবিক ও পরিণীত মানুষের সুখ, দুঃখ নিজের সত্তায় লুকিয়ে এক উচ্চাসনের প্রতিবিম্বের মতো মহাকালের চিরস্থায়ী চরিত্র। যা আমাদের চারিপার্শ্বে বা সমাজের অসংখ্য যুবকের চিন্তাশীলতার, উন্মাদনার, সংগ্রাম ও সিদ্ধান্তহীনতার, দুর্বার যৌবনের প্রেরণা ও সরলতার এক জটিল সংমিশ্রণ। যেখানে বসন্তের আগমনীর মতো রং-বেরঙের হাসনাহেনা, রুপা, বিলাসীদের জটিল সুবাসে আনন্দ অনুভূতিতে দগদগে দাগ কেটে থাকে আমৃত্যু। সবই যেমন জীবনের গল্প, তেমনই আবার সবই নিয়তিও নয়, তবুও এমন দাগ অসংখ্য ভালোবাসার প্রাণ বয়ে বেড়ায়!
‘লেখক-গভীর মমতা ও কৌতূহলের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন তার চারপাশের নাগরিক মধ্যবিত্তের অন্তর্গত শূন্যতা এবং এক আশ্চর্য নিরাসক্তির গল্প। স্বল্প পরিসরে সে গল্পের এক একটি চরিত্র নিছক চরিত্র নয়, তারা আসলে এক-একটি জীবন।’
পুড়ো উপন্যাসজুড়ে ছিল ভাষাশৈলীর নিদর্শন। ভাষাশৈলীর প্রসঙ্গটি এবার আলোচনা করে নেওয়া যাক।
‘মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে কোনো নিষ্ঠুর ভাস্কর তীক্ষ্ণ বাটালি দিয়ে খোদাই করছে।’ অথবা পরের কয়েকটি লাইন দেখে নেওয়া যাক:
‘অমিয় টের পেত কেবল হাসনাহেনার কথা ভাবলেই অন্তঃপ্রবাহে বেজে উঠত সুখের স্যাক্সোফোন। তখন যেন তারা শয্যার সরোবরে যুগল হাঁস, ডুবসাঁতারে শুধু আনন্দের শামুক সংগ্রহ করতো।’ যখন কোনো অমিয় যুগলরা শুদ্ধ, বিশুদ্ধ থেকে চেতনায় ফিরতো অস্থির কামুকতার, তখনই কেবল এমন শয্যার সরোবরে কলকলিয়ে মহাকালের আনন্দযায়ী মগ্নে বিভোর রাখতো সতেজ প্রাণ।
উপর্যুক্ত বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং হৃদয় নিংড়ানো দরদ ছাড়া আলংকারিক ও শৈল্পিক বর্ণনা সম্ভব নয়।
‘শিরীষগাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে চাঁদ, বাঁকা চাঁদের দু’টো টুকরো জোড়া দিয়ে হয়েছে আস্ত একটা ঠোঁট। অমিয়র এমন দুঃখ দেখে সেই ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসি। সেই হাসি অপমানের, অবহেলার, সেই হাসি তাচ্ছিল্যের। তাচ্ছিলের তরল ত্বরায় সহস্র খোলা ছিদ্রে লাফিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে আসে অমিয়র চোখের জল।’
ভাষা তথা রচনাশৈলী বেশ মার্জিত এবং প্রাঞ্জল পাশাপাশি আর্কষণীয়ও বটে। ঔপন্যাসিক রিপন আহসান ঋতুর এর আগের গল্পের বই যাদুর নীল বেলুন পড়েছি। যেখানেও লেখক ভাষাশৈলীর বিষয়টা দারুণ ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। তবে তার পূর্বের লেখাগুলোকে ছাপিয়ে ভাষার নান্দনিকতা এবং শৈল্পিক অবয়ব আলোচ্য গল্পের মোড়কে মানুষ উপন্যাসে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এ উপন্যাসে লেখক অলংকার এবং উপমা প্রভূতভাবে প্রয়োগ করেছেন। দক্ষ হাতে নির্মাণ করেছেন অনন্য চিত্রসম্ভার। এবার তার আরও বিষয়ের নমুনা দেওয়া হচ্ছে:
‘কবিতার জন্ম হয় আনন্দ-বেদনায়। কবিতার জন্ম হয় কষ্টে, কবিতার জন্ম হয় প্রাপ্তিতে-মুক্তিতে। কবিতার জন্ম হয় সংকটে-সম্ভাবনায়, কবিতার জন্ম হয় অভিমানে। কবিতার জন্ম হয় জয়ে-পরাজয়ে। এমনকি কবিতার জন্ম হয় সব হারিয়েও। স্বপ্নের সন্ধানে যেমন কবিতার জন্ম হয়, তেমনি স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে কবিতার জন্ম। স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতেও কবিতার জন্ম, আবার স্বপ্ন প্রার্থনাতেও জন্ম হয় কবিতার এবং ‘জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্যশব্দ কবিতা’।’
কবিতা সৃষ্টির কথা, জন্মের কথা বলতে গিয়ে পাঠক অজান্তেই নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলবে অনাদিকাল হতে দেহভূমে পরিশুদ্ধ জল ছেটানোর ব্যঞ্জনা।
‘অনেক ভালো আছি আমরা বাংলাদেশে। স্বাধীন ভূখণ্ডে থাকার শান্তি স্বর্গের চেয়ে কোন অংশেই কম না। এ কারণে আমার কাছে স্বাধীন প্রতিটি দেশই ভূস্বর্গ।’
এখানে মূলত কাশ্মীরকে উদ্ধৃত করা হলেও যে জীবনের ভেতরে আছে সারাফের মতো চৌকষ, জনপ্রিয় এক ছাত্রনেতা। তিনিও প্রেয়সীর সান্নিধ্য ও মুখে হাসি দেখতে গিয়ে অকাতরে জীবন দিয়ে অমর হয়ে গেলেন দুনিয়ার সমস্ত ভালোবাসা-বাসি তরুণ-তরুণীদের মাঝে। তিনি স্বাধীনতা চেতনায় সবাইকে এক করতে গিয়ে যেমন সংগ্রামী কমরেডদের অনুপ্রাণিত করেছেন, তেমনই ডা. শাহনাজের সারা জীবনের অপুষ্পিত হাহাকার হয়েছেন।
‘মাঝে মাঝে অমিয়র খুব মনে হয় জীবনাকাশের নিকষ কালো পর্দাটার উপর যদি কেউ একজন শুভ্র পর্দা দিয়ে পরিবর্তন করে দিত। আর কেউ নীলকণ্ঠী হয়ে চুষে নিত তার ব্যক্তিগত সংকট! তাহলে তার সাথেই চলে সে যেত আদিগন্ত উৎসবে।’
আহা কি তৃপ্তিময় চাওয়া, ভাবলেই নিমিষে অন্তরকূল হিম হয়ে যায়। এখানে আরও একটি বিষয় আলোচনা হয়ে যাওয়া দরকার। সেটি হচ্ছে, লেখকের প্রকৃত দর্শন আসলে কী? তিনি নিঃসন্দেহে উদার হৃদয় এবং মুক্তচিন্তার মানুষ।
‘সুখ এবং সুখী মানুষদের নিয়ে আমাদের আলোচনা সবচেয়ে বেশি হয়, কিন্তু সুখী হওয়ার প্রারম্ভিক বিষয়ে আমরা কেউই নজর রাখতে চাই না। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা আসলে কাকে সুখ বা কাদের সুখী বলি? সুখ মূলত দু’ প্রকারের। একটি ব্যক্তিগত, আরেকটি সামাজিক। ব্যক্তিগত সুখ পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সেটা স্বার্থপরতা। আরেকটি সামাজিক বিবেক। সামাজিক বিবেকের কারণেই কিন্তু মানুষ অন্যায় করতে পারবে না। যার সামাজিক বিবেকের ভয় আছে, সে কখনো মিথ্যা বলে কোনো ফায়দা আদায় করার চেষ্টা করবে না। সুযোগ পেলেও কাউকে ঠকাবে না। এমনকি সরকারকেও না। কারণ সরকারকে ঠকানো মানে গোটা সমাজকেই ঠকানো।’
রাজনৈতিক এবং সামাজিক কপটতার মুখোশ তিনি তার নানা সময়ের সংলাপে এভাবেই তুলে ধরেছেন।
লেখক গ্রাম্যজীবনকে ধারণ করেছেন উপন্যাসের অনেক অংশে। তিনি বলতে চেয়েছেন, গ্রামের মানুষেরা সাধারণত তাদের কথাবার্তায় নিজস্ব আকার-ইঙ্গিতের মাধ্যমে অহরহ উপমাদি ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময় তা গ্রামীণ পটভূমির বিস্তৃত পরিসর নির্মাণে সহায়ক হয়ে থাকে। এ ছাড়া গ্রামীণ মানুষের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী লোকজ সব আচার-ব্যবহার। পল্লির চরিত্র চিত্রণে লেখক এসব ব্যবহার করেছেন। অনেক সময় তার উপন্যাসে কুশীলবদের সম্পর্ক উন্নয়নে রসবোধ সৃষ্টিতে এসব আলোকপাত করেছেন।
‘মাঠের জমি আর মানুষের শরীর কোনোদিন বন্ধ্যা হয় নারে পাগলা।’
‘রুপা এবার চোখ দু’টো ছোট করে ঠোঁট কামড়িয়ে দুষ্ঠুমিভরা চাহনি করে উত্তর দেয়, শুনেছি পুরুষমানুষের সব গোপন রোগ সারানোর ওস্তাদ ছিল সে। বাড়ি বাড়ি ঔষধ দিয়ে বেড়াত। ঔষধের নাম কী জানো, ‘রাতের ময়ূর’।
কথাসাহিত্যিক রিপন আহসান ঋতু একজন সচেতন কথাকার। সমাজের প্রতি একজন সাহিত্যিকের যে গভীর দায়িত্ববোধ থাকে, সে বিষয়টি দেখলাম তার মধ্যে প্রবল। এ দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি পুরোমাত্রায় সচেতন বলেই তার গল্পের মোড়কে মানুষ উপন্যাসটি পূর্ণ মনোযোগের দাবী রেখেছে। পড়েছিও নিমগ্ন ভাবেই। পুরো বইটি বিগত কালের ঐতিহ্য এবং সমকালের আবেগ উত্তেজনায় ভরপুর। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, লেখকের শৈশবের খেলাধুলা থেকে লেখাপড়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিচিত্র সামাজিক সম্পর্ক এবং জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভর করেই তার উপন্যাস পরিপক্কতা পেয়েছে। উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে কোনোরকম বাড়াবাড়ি নেই। বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, পাবর্ত্য অঞ্চল খাগড়াছড়ি এবং কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরজুড়ে এ উপন্যাসের বর্ণাঢ্য প্রেক্ষাপট। উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি কাব্যিক সুবাস পাওয়া গেছে।
কথাশৈলীতে অমিয়, ডা. শাহনাজ অথবা গাছপাগল আবদুল কাদেরসহ সবাই নিজের কথা বলতে গিয়ে যেন আমাদের সবার মনের কথাই বলেছেন নিপুণ দক্ষতায়। যাতে পাঠক পড়তে পড়তে নিজেকে ভেদ করে চলে যায় সেই স্বপ্নসম ব্ল্যাকহোলে। যেখান থেকে ফিরে এলে ফিরে পায় প্রাণপ্রাচুর্য ভরা মানবিক সৌন্দর্যবোধ। এগিয়ে যায় তরুণ সমাজ, এগিয়ে যায় রাষ্ট্রযন্ত্র।
একজন শব্দনির্মাতার বাক্য বুননে যে মুন্সিয়ানা পাওয়া গেলো, তাতে নিশ্চিত এর গভীরে প্রোথিত এক ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছি। জীবন দর্শন যা মুহূর্তের মধ্যে পাঠককে নিয়ে যাবে চোখ বন্ধ করা ঘোরে। এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস এবং তৃতীয় গ্রন্থ। লেখার পরতে পরতে জীবনযাপন ও সংকটের যে স্পষ্ট আবহ দর্পণে ভেসে উঠেছে তা অবিশ্বাস্য, কল্পনাতীত, অনেক বড় প্রাপ্তি। বই পড়ে বোঝার উপায় নেই, এটিই তার প্রথম উপন্যাস! কতোটা সচেতন হয়ে, জেনেশুনে সাহিত্যের আগুনে হাত পোড়াতে এসেছেন, তাতে প্রথম পদচারণায়ই সফল বলতে হয়। প্রকৃত মানুষের শরীরে যেমন সোঁদামাটির গন্ধ লেগে থাকে, তেমনই তরুণ কথাসাহিত্যিক রিপন আহসান ঋতুর লেখার প্রতিটি পরতে পরতে লেগে আছে বর্ণ, শব্দ, ভাষাশৈলীর বিমুগ্ধতা। আমরা সাহিত্যের পাঠকগণ এমনই তরুণ কথাযোদ্ধাদের প্রতীক্ষায় থাকি। শুভকামনা, বাংলা উপন্যাসে আপনি বিচরণ করুণ দীপ্তরাজ হর্ষের মতো মায়াবী ঘোর লাগিয়ে। ‘গল্পের মোড়কে মানুষ’ একটি উপন্যাস। ১২৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে শুদ্ধ প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন চারুপিন্ট। মুদ্রিত মূল্য ২৫০ টাকা।
এসইউ/জিকেএস