ভাইটা
সানজিদা সামরিন
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের আইসিইউর সামনে তখন কেটে যাচ্ছিল সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর। রাতটুকু কেবল আমার ছুটি ছিল হাসপাতাল থেকে। কিন্তু কে ঘুমাবে? আব্বু আইসিইউতে ভর্তি। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভেসেল ড্যামেজ হয়ে গেছে। বড় দুই ভাই টানা দণ্ডায়মান হাসপাতালের বারান্দায়, ব্যস্ত ছুটোছুটিতে। প্রচুর রক্ত দরকার। আব্বুর নাক-মুখ দিয়ে খণ্ড খণ্ড রক্ত বের হচ্ছে। হ্যাঁ, রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ ছিল বলে রক্ষা। শুভাকাঙ্ক্ষী ও তাদেরও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সিঁড়ির কাছে ভিড় জমিয়ে আছেন রক্তের ঋণী করতে।
আব্বুকে হাসপাতালে ভর্তির দ্বিতীয় দিন বিকেল বা সন্ধ্যায় দেখলাম ছোট একটা ছেলে, সদ্য টিনএজের জানালা ডিঙিয়েছে এমন। দাঁড়িয়ে আছে আমার ভাইদেরই সঙ্গে। আমি তাদের সামনেই সাদা বেঞ্চটায় বসে ছিলাম। কপালের সীমা থেকে একটু বড় কোঁকড়া চুলের শ্যামলা ছেলেটা একটা খয়েরি মতোন সোয়েটার পরে ছিল। শান্ত মুখটা উদগ্রীব বা মনযোগী চোখে তাকিয়ে সবার কথা শুনছিল। নানা কথা কানে আসতে বুঝলাম, চারুকলায় সদ্য ভর্তি হয়েছে সে। আমার চেয়ে বয়সে ঢের ছোট ছেলেটা সেই তখন থেকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে আমার বাবাকে রক্ত দেবে বলে। রাকিব ভাই নিয়ে এসেছেন তাকে।
আচ্ছা, রাকিব ভাইয়ের বিস্তর পরিচয় কি এখন দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ? স্বজন বলাই কি যথেষ্ট নয়? তিনি বললেন, ‘ও অনেক দিন ধরে রক্ত দিতে চাচ্ছে। কিন্তু যখনই কারো রক্ত লাগবে শুনে দৌড়ে যায়, পরে দেখা যায় আর দেওয়ার দরকার পরে না। এবার ও আমাকে বলেছে, ‘এবার আমি রক্ত দেবই ভাই। ও তো একেবারেই ফ্রেশ ব্লাড, এ জন্যই নিয়ে আসছি।’
আমি কথাগুলো শুনছিলাম। এর মাঝখানে আব্বুর জন্য একব্যাগ রক্ত নিয়ে যাওয়া হলো। তখন রাত। ছেলেটা তখনো দাঁড়িয়ে করিডোরে সবার সাথে, চুপচাপ। একবার বেঞ্চ খালি হওয়ার পর বসার সুযোগ পেলো। পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে ওর স্কেচ বুকটা বের করল। রাকিব ভাই কী কী যেন দেখিয়ে দিলেন ড্রইংয়ের। জানুয়ারির ওই শীতের রাতে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় হয়ে এলো আমার। ভাইরা রয়ে গেলেন।
পরদিন পৌনে ছয়টায় ঘুম ভাঙলো ছোটদার ফোনে। ‘তুমি যে ডোনারের কথা বলছিলে তাকে নিয়ে চলে এসো।’ তাড়াহুড়ো করে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। একটা ফোন দিলাম মাহতাবকে, অন্যটা ডোনারকে। তিন চারবার কল দিয়ে ওঠানো গেল ভদ্রলোককে। ওই কনকনে শীতে সিএনজিটাকে মনে হচ্ছিল একটা বদ্ধ বাক্স। আমরা তিনজন বসে। ডোনার, মাহতাব আর এরপর আমি। মাহতাব আমার হাত শক্ত করে চেপে বসে আছে। স্পর্শটা সান্ত্বনা ধরনের। ও কি বুঝেছিল, সেদিনই আমরা পিতৃহীন হতে যাচ্ছি? হয়তো আমিও বুঝেছিলাম, কিন্তু নিজেকে বোঝাতে চাইনি। হাসপাতালের গেটে মাহতাব নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি ওনাকে নিয়ে ওপরে যাও। আমি নিচেই আছি। রক্ত নেওয়া হলে জানিয়ো।’
আমি আর ডোনার উপরে গেলাম। বেঞ্চে বসেই ডোনারের তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে গেল। অনবরত ফোনে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন রক্ত লাগবে, কোনো ঝামেলা নাকি? আমার অফিস আছে।’
তাকে একটু বসতে বলে আমি বড় দাদাকে বললাম, ‘আব্বু কেমন আছে?’ বললেন, ‘আল্লাহ যদি চায় আব্বুকে আমরা পাবো।’ বড় দাদা এসে ডোনারের সঙ্গে কথা বললেন, ‘একটু সময় লাগবে ভাই। নিচে একজনের রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে। কতক্ষণ লাগবে আমি জানাচ্ছি।’ তখন ডোনার বললেন, ‘সাড়ে নয়টায় অফিস আছে।’ দাদা বললেন, ‘আপনার দেরী হলে অফিসে ঢুকে যেতে পারেন, সমস্যা নেই।’ উনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
এর কিছুক্ষণ পরই সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো আমার চেয়ে বয়সে ঢের ছোট সেই ছেলেটি। খয়েরি মতোন সোয়েটারের একটা হাতা কনুইয়ের ওপর থেকে নামাচ্ছে। ছোটদা বললেন, ‘ওকে বসতে দাও।’ আমি বেঞ্চের একপাশে সরে বসলাম। ওর হাতে মামের দুটো বোতল। একটায় পানি, অন্যটায় স্যালাইন ভর্তি। ছোটদা ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘এটা আমাদের ছোট ভাই। আব্বুর জন্য রক্ত দিয়েছে।’
ওকে আমরা কেউ চিনি না। শুভাকাঙ্ক্ষীর মাধ্যমে এসেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ কাটিয়ে দিয়েছে। ওর কি কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না! কখন যে কার কেন বা কীসে মায়া পড়ে যায় কে জানে।
আমি ওর হাত থেকে স্যালাইনের বোতলটা খুলে বললাম, ‘এটা খাও।’ দু’বার চুমুক দিয়ে বলল, ‘আবার পরে খাই?’ আমি মাথা কাত করে সায় দিলাম।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ও আব্বুর জন্য যে রক্ত দিয়েছিল রক্তের সেই ব্যাগটা আর প্রয়োজন হয়নি। নার্স কল করে বললেন, ‘নিচে কি এখনো রক্ত দিচ্ছে?’ আমি বললাম, ‘রক্ত নেওয়া হয়ে গেছে, নিয়ে আসবে।’ উনি বললেন, ‘না, না। রক্ত নিতে মানা করেন। রক্ত লাগবে না।’ মতিভ্রমের মতো আমি দাদাদের কাছে দৌড়ে এসে বললাম, ‘দাদা, সিস্টার বলেছে রক্ত লাগবে না।’ আমার ধারণা ছিল আব্বু সুস্থ হয়ে গেছেন!
বড় দাদার মুখ চুপসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে ফিরেও এলেন। শান্তভাবে ছোটদা আর আমাকে বললেন, ‘যাও ভেতরে। দেখে এসো আব্বুকে।’
আব্বুর বুকের ওপর একটা সবুজ কম্বল। ভেন্টিলেশন চলছে। নাকের নিচে সাদা গোফটা কি একটু লালচে দেখা যাচ্ছে? পাশে রাখা কার্টনের ওপর রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে। আব্বুকে কী ফর্সা লাগছে? বেডে ফেলে রাখা নিথর হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে দিলাম তর্জনী দিয়ে।
বরাবরের মতো সেবারও আর রক্ত কারো শরীরে পৌঁছল না টিনএজের জানালা ডিঙানো ছেলেটার। কী যেন নাম তোমার, আমার ছোট্ট ভাইটা?
এসইউ/জিকেএস