পাখি-পরিধি
মো. আরিফুল হাসান
শূন্যে উঠে যায় নিয়াজ। এক হাত, দুই হাত করে ছাব্বিশ হাত উপরে উঠে সে ঘুড়ির মতো ভাসতে থাকে। লোকেরা তাজ্জব হয়ে তার দিকে তাকায়। তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মাঠের আল থেকে, ইরি ধানের সারির ফাঁকে উবু হয়ে নিড়ানি দিতে দিতে, মাঠের মাঝখানের হিজল গাছটার ডালে উঠে, এমনকি তিন-চার কোঠা ক্ষেত দক্ষিণে কালু মিয়ার পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য নারী, বৃদ্ধ, শিশু ও যুবক-যুবতীরা মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দৃষ্টি উঁচু করে নিয়াজের দিকে তাকায়। মাঠের কৃষকের হাতের মুঠোয় নিড়ানির ঘাসগুলো থেকে জল-কাদা চুইয়ে পড়ে। এক সময় তাদের মুঠো শিথিল হয়ে পড়ে যায় কাস্তে ও আঁচড়া। লোকেদের তন্দ্রা ভাঙে না। নিয়াজও উপর থেকে নিচে নেমে আসে না।
লোকেরা তখন নিয়াজকে প্রশ্ন করে, অ নিয়াজ, তুমি এতো উপরে উঠলা ক্যামনে?
আমার ভেতর একটা পাখি হৃদয় বাস করে। দূর থেকে উত্তর দেয় নিয়াজ।
লোকেরা বলে, নিয়াজ, নিচে নেমে এসো।
নিয়াজ বলে, নামতে পারছি না।
তখন তারা নিয়াজকে নামাতে বড় বড় বাঁশ একত্র করে টাওয়ারের মতো একটা কিছু তৈরি করে। নিয়াজের সমান উচ্চতায় গিয়ে তাকে পেড়ে আনতে চায়। কিন্তু সাধারণ বাঁশের ভর নেওয়ার মতো অংশ ষোলো-সতেরো হাতের বেশি থাকে না। তাই তারা বাঁশের পরে বাঁশ জোড়া দিয়ে মিনার বানাতে চায়। কিন্তু বাঁশের এই জোড়া দেওয়া মিনারে কে চড়বে? সবারই জীবনের ভয় আছে। নিয়াজের ভাইকে প্রশ্ন করলে সে সোজাসুজি না বলে দেয়। তবু গ্রামের মুরব্বিরা নিয়াজের জন্য টান অনুভব করে এবং তাকে নামাতে তৎপর হয়।
কেউ বলে, মন্দবাগের বাঁশ আনলে হবে। ওগুলো লম্বায় তিরিশ-বত্রিশ হাত পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্ষাকালে জেলেরা মন্দবাগ থেকে বাঁশ এনে খালের পানিতে জাল পাতে। একে বলে খরো জাল। পুরো খালটি তখন মিহি সুতার মরণফাঁদে পরিণত হয় মাছের জন্য। কিন্তু এখন তো বর্ষাকাল নয়। মন্দবাগ থেকে বাঁশ কিনে নিয়ে আসবে কীভাবে? বর্ষায় ভাটার জলে বাঁশের ভেলা বেঁধে ভাসিয়ে দিলেই হলো। বাঁকে বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে বাঁশ এক সময় ঘাটে এসে ভিড়বে। কিন্তু এখন এই সাড়ে সাত মাইল দূরে মন্দবাগ বাজার থেকে বাঁশ কিনে আনাটা দুঃসাধ্য। তবু বাঁশ আনতে হবে; নিয়াজকে নামানো প্রয়োজন। কিন্তু এই গাড়ি-ঘোড়াহীন অজপাড়াগাঁ থেকে মন্দবাগ যেতেও তো দুই আড়াই ঘণ্টা সময়ের দরকার। এতক্ষণ কি নিয়াজ ঝুলে থাকবে? মুরব্বিরা দরদী কণ্ঠে ডাক দেয়, নিয়াজ, অ নিয়াজ!
নিয়াজ উপর থেকে জবাব দেয়, জি, বলেন?
তোমার এখন কেমন লাগছে?
অনেক ভালো।
আমরা তোমাকে নামাতে পারছি না।
দরকার নেই।
দরকার নেই মানে?
আমি পাখি হয়ে ভালো আছি।
লোকের বিস্ময় আরও জমে ওঠে। তারা তাগড়া তাগড়া যুবকদের মন্দবাগ পাঠায়। তারপর আবার ডাকে, নিয়াজ!
জি, বলেন।
আমরা তোমাকে নামানোর ব্যবস্থা করছি।
নিয়াজ কোনো উত্তর দেয় না। পাখির মতো হাত দুটোকে শূন্যে ভাসিয়ে রাখে। নিচের দিকে মাথা নিচু করে চায়। গ্রাম ভেঙে মানুষ জড়ো হয়েছে। সবাই দেখছে তাকে। বিষয়টি নিয়াজ একেবারে গুরুত্বহীন চোখে দেখে। তার মনে হয়, সে এমনিভাবে প্রতিদিন পাখি হয়ে ভেসে থাকে আর এমনি করেই প্রতিদিন লোকেরা তাকে দেখতে আসে।
নিয়াজ, নিয়াজ! লোকেরা আবার ডাকে।
নিয়াজ জবাব দেয়, হু।
তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
হু, জবাব দেয় নিয়াজ।
আমরা তোমাকে নামাতে মন্দবাগ থেকে বাঁশ আনতে পাঠিয়েছি।
নিয়াজ আবার কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। লোকেরা তখন আবার বলে।
আমাদের গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী যুবকদের পাঠিয়েছি। তারা ঝড়ের মতো যাবে আর উল্কার মতো ছুটে আসবে। নিয়াজ, অ নিয়াজ, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, বলুন।
এই কিছুক্ষণ, ধরো তোমার যুবক বন্ধুরা আসতে যে দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে; ততক্ষণ কি তুমি ঝুলে থাকতে পারবে? তোমার কোনো কষ্ট হবে কি?
না, কোনো কষ্ট হবে না।
তুমি কি খুব একাকিত্ব অনুভব করছো নিয়াজ?
নিয়াজ আবার চুপ করে থাকে। শূন্যে ভাসমান বাতাসের সাথে তার দীর্ঘশ্বাস হয়তো মিলিয়ে যায়। অথবা হয়তো তার ঠোঁটের কোণে কোনো গোপন হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে যায়, দূরত্ব ও বাড়ন্ত রোদের তেজে হয়তো তা দেখা যায় না।
নিয়াজ! গ্রামের লোকেরা ডাকে।
তুমি কি আমাদের চিনতে পারছো উপর থেকে? আমি মতলব চাচা।
নিয়াজ আবার চুপ করে থাকে। কালু মিয়ার পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রমণীরা চোখ মুছে কাঁদে। শিশুরা তাদের আঁচলে জড়িয়ে জড়িয়ে বিস্ময়মাখা চোখে দেখতে থাকে ঝুলন্ত নিয়াজকে।
এমন সময় হঠাৎ পুকুরের উত্তর পাড়ের পশ্চিম অংশ থেকে চিৎকার আসে, সাপ সাপ! রমণীরা যে যার মতো দৌড়ে জীবন নিয়ে পালায়। দুটো গোখরো বেরিয়ে এসেছে মোর্তার বনের আড়াল থেকে। শিশুরা চিৎকার করতে করতে তাদের মায়েদের পেছনে ছোটে। মাঠ থেকে কয়েকজন কৃষক পাজুন হাতে করে দৌড়ে আসে পুকুর পাড়ে। এসে দেখে সাপদ্বয় পাজুন দিয়ে মারার মতো নয়। তখন তারা চিৎকার করতে থাকে, চল, চল, চল চাই। তখন মাঠ থেকে আরও দুয়েকজন, হিজল গাছ থেকে চার-পাঁচজন যুবক নেমে নিজেদের বাড়ির দিকে দৌড়ায়। লৌহশলাকা নির্মিত তীক্ষ্ম ধারালো অস্ত্র ‘চল’ আনতে হবে। লোকের দৌড়াদৌড়িতে অর্ধেক মানুষ কমে যায়। যুবকরা যারা চল আনতে গ্রামের ভেতর গিয়েছিল, তারা এখনো ফেরেনি। পুকুরের পাড়ে সাপ দুটো ফোঁৎ ফোঁৎ ফণা তুলে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। মাঠের যে জায়গাটায় নিয়াজ ভেসে আছে তার নিচে এবং বিশ-ত্রিশ শতাংশজুড়ে এখনো জনাবিশেক মানুষ দাঁড়ানো। তারা মনে করে, যুবকরা চল নিয়ে ফিরে এলে সাপ দুটোকে তাদের দশ-বারো জনই হয়তো মেরে ফেলতে পারবে। কিন্তু তাদের নিয়াজকে ফেলে গেলে চলবে না। নিয়াজ ভাসছে আকাশে। মাটি থেকে ছাব্বিশ হাত উপরে পাখির ডানার মতো দুহাত শূন্যে বিছিয়ে। নিঃসঙ্গ, অসহায় নিয়াজ ভেসে আছে।
লোকেরা কপালের উপর হাত রেখে গ্রামের দিকে তাকায়। কী করছে যুবকরা এতক্ষণ? গ্রাম থেকে চল নিয়ে ফিরে আসতে বড়জোর দশ মিনিটের ব্যাপার? কিন্তু মিনিটটা যেন চলে না। তাদের মনে হতে থাকে মহাকাল ধরে তারা নিয়াজকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আর মহাকাল আগে যুবকরা ফিরে গেছে গ্রামে চল আনতে। তাদের আরও মনে হয়, এক মহাকাল ধরে সাপ দুটো মোর্তা বন থেকে বের হয়ে তাদের ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় গ্রামের ভেতর থেকে চিৎকার আসে, আগুন, আগুন। মাঠের মানুষ তরিতে সচকিত হয়ে দেখে গ্রামের উপর দিয়ে লেলিহান শিখা কালো ধোঁয়া ছেড়ে আকাশ ঢেকে দিচ্ছে। তখন তারা নিয়াজকে ফেলে গ্রামের দিকে ছোটে।
কতক্ষণ জানা নেই, নিয়াজ ভাসতে থাকে। আর ওদিকে পুড়তে থাকে গ্রামের কারো ঘর। গ্রামের মানুষ কলসি দিয়ে জল এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। বালতি মগ বদনা, যে যেটা দিয়ে পারছে জল এনে ছুঁড়ে মারছে আগুনের দিকে। এতোগুলো সম্মিলিত মানুষের প্রয়াস অতঃপর বিজয়ী হয়। মোট তিনটি খড়ের গাঁদাসহ নোয়াব আলীর রান্নাঘর পুড়েছে আগুনে। তবু সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, বড় কোনো ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই আগুন নেভানো গেছে। এরপর তাদের হঠাৎ খেয়াল হয় নিয়াজের কথা। তারা তাগড়া যুবকদের ফিরে আসার অপেক্ষা করে। কেউ কেউ বলে, নিয়াজকে এতক্ষণ একা ফেলে আসা কি ঠিক হলো। কেউ কেউ বলে, যারা মন্দবাগ গিয়েছিল তারাই বা এতক্ষণে ফিরে আসছে না কেন? ফিরে আসে অবশেষে যুবকরা। মন্দবাগ থেকে বাঁশ এনে হেইয়ো বলে গ্রামের পথে ফেলে। মুরব্বিরা বলে, আর রেখে লাভ নেই, মাঠের দিকে চলো। সবাই তখন হৈ হৈ করতে করতে মাঠের দিকে ছোটে। কিন্তু কোথায় নিয়াজ? সে যেখানে ভেসেছিল; সেখানে এখন শুধুই শূন্যতা। সবাই হায় হায় করে ওঠে। তখন দৃষ্টিশক্তি প্রখর কয়েকজন মানুষ দেখায়, দূরে, দূর থেকে দূরে, নীল আকাশের কাছে নিয়াজ যেন পাখি হয়ে ভেসে যাচ্ছে।
এসইউ/জিকেএস