ফকির ইলিয়াসের স্বনির্বাচিত পাঁচটি কবিতা

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:১৩ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২২

সুতোর উপর ভর করা জীবন

১.
সমান্তরাল রেললাইনগুলো মিশে গিয়েছে একটি লৌহখণ্ডে,
মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল যে দুটি ছায়া, তারাও হারিয়ে গিয়েছে
একটি সমুদ্রে—আর ওই সমুদ্র থেকে একই বাষ্প উড়ে
ঢেকে দিচ্ছে গোটা পৃথিবীর আকাশ।

গভীর ঘুমে এখন পৃথিবীর সেই সুতো কাটা চাঁদের বুড়ি,
কেউই আর তাদের সদরে-অন্দরে সাজাতে পারছে না
রহস্যগল্প। এমনকি নক্ষত্র আর নিদ্রায় নিমজ্জিত যে দ্বৈত
রোমান্টিকতা, তা নিয়েও আর কেউ লিখছে না কবিতা।

প্রাণিকূল হয়ে উঠছে ক্রমশ কাব্যবিহীন, কথাচিত্রবিহীন।

২.
আরও অনেক রকমের উদাহরণ ডালায় সাজিয়ে পথে পথে
প্রদর্শন করতেন যে ফেরিওয়ালা, এসব বিক্রি করা কখনো
তার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি জানতেন, অশিক্ষিতদের কিছু না
কিছু শেখানো যায়। কিন্তু মূর্খদের কোনোদিনই শেখানো যায় না।

অথচ আমরা জানি, এই ধরণীকে প্রথম হাঁটতে শিখিয়েছিলেন
মেঘধাত্রী মা, একদিন তুমুল বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিতে দিতে
পড়েছিলেন সূচিমন্ত্র। ব্লেড ও বোল্ডার হাতে তুলে দিয়ে একান্তে
বলেছিলেন, ছুঁড়ে মারো হে পৃথ্বীসন্তান—যত দূর যায়!

সেদিন থেকেই মানুষের খাতায় যুক্ত হয়েছে উত্তোলনপর্বের ধ্যান।

৩.
যারা ভুলে যাচ্ছে ধ্যানমগ্ন দিনের কোরাস, তাদের দিকে আর
ফিরেও তাকাচ্ছে না কেউ। সময় সঞ্চয় করে নিজের জন্যই
নিজে জমিয়ে রাখছে শোক। মানবিক মহামারি অতিক্রম করা
যাবে না জেনেই, হেঁটে যাচ্ছে সুতোর উপর দিয়ে।

সুতো, ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় গহীন আকাশে। নীলান্তের অধিক আয়ু
হাতের মুঠোয় নিয়ে ঢেকে দিতে চায় বৃক্ষদের ক্ষত। তারপরও
ঋতুদের বুকে দাগ থেকে যায়। উজান আর ওজনের ঘেরাটোপে
কাঁপে সূর্য। চাঁদ বলে—আমাকে স্থান দাও, ঘুরে দাঁড়াতে চাই।

ঘুরে দাঁড়ালেই বশ্য হয়ে পড়ে সকল মহামারি। দ্রোহের প্রথম দ্রবণে।

****

সবুজ প্লাটিনাম

রংগুলো বদলে যাক। রূপগুলো বদলে যাক। রক্তগুলো!
......না বদলে যাওয়ার কথা আপাতত বলবো না।
রক্তে বাড়ুক সবুজের সম্ভার। বদলে যাক প্লাটিনামের
রং। আবার সবুজে ভরে উঠুক পৃথিবী, পথ ও প্রত্যয়।

কমে আসুক ছ’ফুট দূরত্বের পসরা। মানুষ, মানুষকে
জড়িয়ে ধরে বাঁচুক, বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরে বাঁচুক, পুষ্পকে
জড়িয়ে ধরে নিক ঘ্রাণ! হাত উঁচিয়ে দেখাক ঢেউগুলোকে।

সকল বিষাদ চুপ হয়ে যাক, একটি সুবোধ প্রজাপতির মতো।
সকল আগুনের জিহ্বা থেকে উৎসারিত হোক শান্তির লালা।

****

একটি অবহেলিত ভাষণের খসড়া

‘আমি বাদাম বিক্রি করে খাই। মাঝে মাঝে
বাদাম কিনে খাই অন্যের দোকান থেকে।
এই যে নদীগুলো দেখছ, তা আমার নিজস্ব তালুক।
তালুকদারি করি, কিন্তু খাজনা দিই না। দেহখাজনা-
দেবো বলে যেদিন হাতে তুলে নিয়েছিলাম বেহালা,
সেদিন থেকেই ঋণ প্রত্যাহারের আর্জি করেছি
মহাজনের কাছে। কিন্তু কিছুই মওকুফ হয়নি।
আমি নদী বিক্রি করে খাই, এবং মাঝে মাঝে
কিনে খাই নদীর জল।’
.......বলতে বলতে লোকটি নদীতে ঝাঁপ দেয়।
আমি ক্রমশ তার ডুবদৃশ্য দেখি।

****

দরদের দশ দশক

এই কবিতাটি কয়েক দশক পরেই লিখিত
হতে পারতো। অন্য কোনো মেঘজাতকের হাতে
নির্মিত হতে পারতো উড়ে চলার নতুন নিয়ম।
কিন্তু পৃথিবী পাঠ করেনি সেই মনোবিজ্ঞান।
জানতেও চায়নি;—
কার আগে কে জন্ম নেয় কিংবা কা’কে
রেখে কে মেনে নেয় মৃত্যু মহিমা।

দশ দশক ধরে যে আকাশ লিখে যাচ্ছিল
দরদভিত্তিক এই উপন্যাস, সে’ও জানে না
বৃষ্টির প্রকৃত অনুবাদক কে! বাষ্প-বৃষ্টি-রোদ মিলে
গ্রহের চারপাশে জন্ম নেয় যে বর্ষা, তাকে
কোন ঋতুই বা বলা যায়!

দরদী দশকগুলো এটাও জানে না,
কোন বিদ্যাধর্ম মেনে নিয়ে মানুষ
নিজ চোখের ভেতরেই চিরকাল ঘুমায়।

****

আমাকে যে স্পর্শ করে

আমাকে যে স্পর্শ করে হয়তো তার মৃত্যু হয়,
না হয় সে দূরে চলে যায়—
কখনো আগুনের নৌকোয় চড়ে পাড়ি দেয় নদী;
কখনো তীরে বসে কাঁদে। দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে
ভাঙে মাটির ঢেলা, বালিবিন্দু—
হাতে তুলে মুখে মেখে নেয়।

আমাকে যে স্পর্শ করে; সে আর কবিতা লিখতে
পারে না। বরং তার হাসিগুলো কাব্যানন্দে ছুঁয়ে
নেয় সূর্যের চূড়া। তার কান্নাগুলো গভীর রাতে
অপহরণ করে প্রাচীন চাঁদের ছায়া।
আর ছায়া হারানো মানুষেরা
ছাউনীবিহীন পৃথিবীর বন্দনা গাইতে গাইতে
দেশ ছেড়ে যায়।

আমাকে স্পর্শ করার পরই কিছু বৃক্ষের
সবগুলো পাতা ঝরে যায়। কয়েকগুচ্ছ
পাতাসুন্দরী নবজন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠে অন্য
লোকালয়ে। তা দেখার জন্য আমি চক্ষু
ধার করার
বিজ্ঞাপন দিই হাওয়া-মিডিয়ায়।
আমার কাছে কয়েকটি ভাঙা নক্ষত্রচূর্ণ
ফিরে আসে—ফেরত কুরিয়ার সার্ভিসে।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।