মায়াবতী: পর্ব ২২
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
বিশ.
নিজের ঘরে ঢুকে টেবিলে বসল রিয়া।
ডায়েরিটা বের করল টেবিলের নিচের তাক থেকে। ডায়েরিটা এনে দিয়েছিল কুসুমকলি।
ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল আগে। মাঝে অভ্যেসটা চলে গিয়েছিল। আজ আবার কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে।
বাপিকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা হচ্ছে। বাপির সঙ্গে সংলাপের কয়েকটা বিষয় মনে দাগ কেটেছে। বাপি কম্পিউটার ব্যবহারের মডার্নাইজেশনের কুফলের কথা বলেছেন। অনলাইনের ক্রাইম প্রসঙ্গটা তুলেছে ও নিজে। বাপিকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিল।
বাজিয়েছে। তবে বাপির মনের পুরো খবর বোধ হয় জানা হয়নি।
আলাপের আড়ালে বোধ হয় আরও আলাপ আছে। সেই আলাপের গূঢ়তত্ত্ব খোলাসা হয়নি। নিজের শঙ্কা দিয়ে বিশ্লেষণ করছে পুরো ঘটনা। শঙ্কার পিঠে চড়ে উড়ালশঙ্কা আসে। উদ্বেগ আরও গাঢ় হয়।
ডায়েরিতে মন বসছে না। টেবিল থেকে ওঠে ও।
কুসুমকলিকে কল করতে ইচ্ছা করছে। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে অন করল সেট। এতক্ষণ বন্ধ ছিল। কুসুমের সেটও বন্ধ। বাধা পেল ও। কুসুমের সঙ্গে কথা বলা দরকার। বাধা পেলেও দমে গেল না। ল্যান্ডফোনের দিকে এগিয়ে গেল রিয়া। রিসিভার হাতে তুলে নিলো।
না। থাক। কী মনে করে রিসিভার রেখে দিলো আবার।
ঘরোয়া ক্যাজুয়াল ড্রেসে বের হলো ঘর থেকে।
দরজার বাইরে এসেও আবার ফিরে এলো বাসায়।
শেফালি খোলা দরজা লাগিয়ে দিচ্ছিল।
রিয়া বলল, আমি ওপরে যাচ্ছি। কুসুমের বাসায়। মামণিকে বোলো।
শেফালি বলল, কুসুম আম্মা তো এখন আসে না। আফনে, যাওনের দরকার কী?
শেফালির এই মাতব্বরি ভালো লাগল না রিয়ার। প্রশ্নটা মেজাজ খিঁচড়ে দিলো। তবুও সহজ থেকে ঠান্ডা স্বরে বলল, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
শেফালি পালটা বলল, আফা দায়িত্ব দিছে, আমারে কইছে, আপনার যত্ন-আত্তি করতে।
মাথা ঘুরিয়ে তাকাল রিয়া।
শেফালি একদম স্বাভাবিক। দায়িত্ব পেয়ে অধিকার ফলাতে চায়। অশিক্ষিত দরিদ্র মানুষটাকে দোষ দেওয়া যায় না।
আবারও ঠান্ডা গলায় বলল, সব বিষয়ে মাথা ঘামিয়ো না।
শেফালি দমে না গিয়ে পালটা বলল, কুসুম আম্মা তো আগে বেশি খোঁজ রাখত, অহন রাহে না। আহে না। বিষয়ডা খেয়াল রাখছি আমি।
এসব আমাদের নিজস্ব বিষয়। এসবে তোমার খেয়াল রাখার দরকার নেই। কথা শেষ করে রিয়া এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।
কুসুমকলিদের বাসায় দরজা বন্ধ।
কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে ও। একসঙ্গে পরপর দুবার চাপ দেয় রিয়া। দুবার চাপের অর্থ আমি রিয়া এসেছি। এই সিগন্যাল জানে কুসুম। সাধারণত ছুটে এসে সে দরজা খোলে। মুহূর্তের মাঝে দরজা খুলে যায়।
এখন সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দরজা খুলছে না।
দশ... নয়... আট... সাত... শূন্য। না কেউ দরজা খুলছে না। সাধারণত অপেক্ষা করার ধৈর্য একদম কম রিয়ার। অপেক্ষার প্রয়োজন হলে কাউন্টডাউন করতে থাকে। কাউন্টডাউন করলে অপেক্ষার টেনশন কমে যায়। মন সংখ্যার ওপর চড়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। অস্থিরতার লাগাম টেনে রাখার এটা একটা কৌশল। এই কৌশল পালনে অভ্যস্ত রিয়া।
নিজের কৌশলটা ফেল করেছে। দরজা খুলছে না কেউ। আবার কি কলিংবেলে চাপ দেবে, নাকি ফিরে যাবে?
না। ফিরে যাবে না। এটা হচ্ছে কুসুমদের বাসা। প্রাণের বান্ধবীর বাসা থেকে ফিরে যাবে কেন? নিজের ভেতর থেকে অধিকারবোধ তেড়ে আসে।
আবার কলিংবেলে চাপ দিলো ও। একবার চাপ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাখল।
বিশ্রী কাণ্ডটা ঘটিয়ে ফেলল রিয়া। বুঝতে পারে। বুঝেও লজ্জিত হলো না। শঙ্কিত হলো না। এটা হচ্ছে কুসুমের বাসা। এই বাসার সামনে এত ফর্মালিটির দরকার নেই।
দরজা খুলে গেছে। দরজার সামনে দঁড়িয়ে আছেন কুসুমের মামণি, সেলিনা জামান। মুখে অভ্যর্থনার স্বাভাবিক অভিব্যক্তি নেই। দরজা খুলে কিছুটা চমকালেন তিনি।
ওহ! তুমি? কুসুম তো বাসায় নেই।
ধাক্কা খেলো রিয়া। আন্টির আচরণে পরিবর্তন টের পেল। এর আগে এমন ছিলেন না। কুসুমের মতোই আদর করতেন তাকে। সহজ হয়ে রিয়া বলল, কুসুম নেই তো কী হয়েছে? আমি এসেছি। আসব?
সেলিনা জামান উচ্ছ্বসিত হলেন না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, এসো।
রিয়া ভেতরে ঢোকে। স্বতঃস্ফূর্ত হওয়ার চেষ্টা করে। স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারছে না। আন্টির আচরণে, কথায় উচ্ছ্বাস না-দেখে মন দমে গেল। তবু জানতে চাইল, কুসুম কোথায় গেছে, আন্টি?
মনে হয় টিচারের কাছে গেছে।
কোন টিচার, জানেন?
না। তা তো জানি না। তবে মনে হয় বুয়েটের কোনো টিচারের কাছে ও কেমিস্ট্রি পড়তে চাইছে।
বাসায় গিয়ে পড়বে? নাকি টিচার বাসায় আসবেন?
আমি চাইছি, বাসায় এসে পড়াক। রাস্তাঘাটের যা দুর্দশা। পথেই সময় চলে যায় বেশি।
জি আন্টি। আমিও টিউটরের বিষয়ে কুসুমের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলাম। আমি অবশ্য ইংরেজি পড়তে চেয়েছিলাম।
ওহ! তাহলে তুমি আলাদা টিচার দেখো। ও তো মনে হয় ইংরেজি পড়বে না। ওর বাপিই ওকে ইংরেজিটা দেখিয়ে দেন।
রিয়া বলল, আন্টি তাহলে আমি যাই। ও এলে বলবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।
সেলিনা জামান এই কথার কোনো সাড়া দিলেন না। বসতেও বললেন না।
উঠে এগিয়ে যাচ্ছে রিয়া।
কুসুমের মামণি, দরজার পাশে এগিয়ে এলেন। অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রশ্ন করে বসলেন, তুমি ভালো আছো? তোমার প্রবলেম মিটেছে?
চট করে একটা চাকু এসে ঘাঁই বসাল বুকে।
রিয়া মুখ তুলে তাকাল। কুসুমের মামণিকে চিনতে পারছে না। মনে হচ্ছে অচেনা কোনো মহিলা চাকু ছুড়ে দিয়েছে তার দিকে। প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। ভেতর থেকে কষ্ট গুমরে ওঠে। কোনোরকমে নিজেকে সামাল দিয়ে ম্লানমুখে জবাব দিলো, আপাতত মিটেছে।
আপাতত মিটেছে মানে কী? এখনো কি সমস্যায় ডুবে আছো?
‘ডুবে আছো’ প্রশ্নটি সত্যিই ডুবিয়ে দিলো রিয়াকে।
না ডুবে নেই। আরও বলতে যাচ্ছিল ‘ভেসে আছি’। কথা জিহ্বার মাথা থেকে নিজের ভেতর আবার টেনে নিলো। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কুসুমকলির মা। মায়ের সামনে অশোভন আবেগ দেখানো ঠিক না। বোঝে রিয়া।
সেলিনা জামান আবার বললেন, সাবধানে চোলো। বাইরে বেশি ঘোরাঘুরি করা ঠিক না। কুসুমকে বলেছি বাইরে কম যেতে। এটা বললেন না যে তোমার সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছি।
রিয়া বলল, আচ্ছা। সাবধানে চলব।
বাসার বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দরজা লক করে দিলেন সেলিনা জামান। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রিয়া। বন্ধ দরজার দিকে তাকাল ও। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। মনে হলো, পুরো জীবনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল খোলা দরজা, কুসুমকলির বাসার দরজা, প্রিয়তম বান্ধবীর দরজা। মলিনমুখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রিয়া।
মানুষ এত দ্রুত বদলে যেতে পারে?
না। সেলিনা জামানকে দোষ দিতে ইচ্ছা করছে না।
দোষী ও নিজে। নিজে এক বাজে মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। চারপাশের মানুষজন খারাপ ভাবছে ওকে। খারাপ মেয়ের সঙ্গে সেলিনা জামান কেন মিশতে দেবেন নিজের মেয়েকে? মিশতে না দেওয়াই তো যুক্তিসঙ্গত। পরিস্থিতির দায়ভার নিজের কাঁধে তুলে নিলো রিয়া। তুলে নিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না। বুক ভেঙে যাচ্ছে। চোখ ফেটে যাচ্ছে। কান্না ছুটে এলো ভেতর থেকে। চোখ ভিজে উঠল মুহূর্তের মাঝে।
সহজ হয়ে নিজেদের বাসার দিকে ফিরে আসে ও। আসতে আসতে ভাবে, এ কারণেই কি কুসুম তাকে অ্যাভয়েড করছে? তার সঙ্গে আলাপ না করে টিচারের খোঁজে গেছে? এ কারণেই কি কুসুম বদলে গেছে?
না। বিশ্বাস করতে পারছে না। কুসুমের মনে অন্যরকম আনন্দজোয়ার দেখা যায় ইদানীং। ওই জোয়ারের সঙ্গে সেলিনা জামানের কথার মিল নেই। আচরণের মিল নেই। নিশ্চয়ই সমস্যা অন্যখানে।
ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরে এলো ও।
শেফালি দেখল রিয়াকে।
সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, কাঁদেন ক্যা, আম্মা?
প্রশ্ন শুনে থমকে গেল ও। শেফালির চোখে ধরা পড়ে গেছে কান্না। জবাব না দিয়ে দ্রুত সে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলো।
কুসুমের ইতিবাচক উচ্ছ্বাসের কথা কল্পনায় ভাসিয়ে নিজেকে সহজ করে নিলো। একটুও দোষ দিলো না কুসুমকে। তবু অজানা অভিমানের বোঝায় বুক ভারী হয়ে থাকে। একটু পর আবার মন খারাপ হয়ে যায়। সেলিনা জামানের রোবটিক আচরণে মন ছোট হয়ে গেছে। কান্না আসছে। বদ্ধঘরে ও কাঁদল। একাকী কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমের মাঝে খুলে গেছে ওয়েবসাইট। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ নিউরনের কোটি কোটি কানেকশনের মধ্যে অনলাইন ট্রান্সমিশন সচল হয়ে গেছে।
একটা তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। তরুণীর দেহের উপরের অংশ অনাবৃত, একদম উদোম। উদোম শরীরের ওপরের অংশটি নিচের অংশ থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ঝকঝক করছে স্তনযুগল। কয়েক হাজার ভোল্টের আলোর বিস্ফোরণ ঘটছে। স্তনবৃন্ত থেকে লেজারবিমের মতো আলোকরশ্মি ছুটে ছুটে আসছে। লেজারবিমের পথ ধরে শূন্য থেকে ভেসে আসছে আরেকটা উদোম দেহের নিম্নাংশ। নারী দেহের গোপন সৌন্দর্যের উদোম উল্লাস ছড়িয়ে দিয়ে নিম্নাংশ তরুণীর প্রথম অংশের সঙ্গে লেগে গেছে। এক হয়ে গেছে। একদম উলঙ্গ এক রমণী ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যে।
রিয়া লজ্জায় মরে যেতে থাকে। নেমে আসতে বলল রমণীকে। রমণীটা নামছে না। ভেসে বেড়াচ্ছে। রিয়া এবার চিৎকার জুড়ে দেয়, নেমে এসো। এসো নেমে। রমণীটা শুনছে না সে ডাক... জোড়া দেহ নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে...
আকস্মিক এক বিকট শব্দের বিস্ফোরণ ঘটল।
রমণীটা উধাও হয়ে গেল। অনলাইনের কানেকশন ছুটে গেছে। রিয়ার চোখ খুলে গেছে। বুকে চাপ টের পাচ্ছে সে। চোখ থেকে ঘুম চলে গেছে। রুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ।
ওঠে ও। দরজা খুলে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে শেফালি। হাতে এক গ্লাস দুধ। বিস্কুট।
আফা খাইতে কইছে। নেন। রাইখ্যা গেলাম।
রিয়া বলল, নিয়ে যাও। এখন খাব না।
অসময়ে ঘুম ঠিক না। খান। নইলে আফা রাগ দেহাইব।
দেখাক। তুমি নিয়ে যাও। আমি খাব না।
না না। খাওন লাগব। এখন ঘুম যাওনের সময় না।
বলছি না, বিরক্ত করবে না।
শেফালি নাছোড়বান্দার মতো বলল, আম্মা, আমার কাজ আপনার যত্ন লওয়া। আমার কাজ আমারে করতে দেন। খান। ফেরত নিমু না। খাইয়া লন।
রিয়া অবাক হয়ে শেফালির দিকে তাকিয়ে রইল।
শেফালিও তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। সবাই তার ওপর মাতব্বরি করতে চায়। দাপট দেখাতে চায়। তবে ‘আম্মাজান’ শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দাপুটে ভাব নেই। আছে আদুরে ভাব। আদরের ছোঁয়া পেয়ে রিয়া সহজ হয়ে বলল, ঠিক আছে এখানে রেখে দাও।
গরম দুধ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। উড়ন্ত ধোঁয়ার দিকে নিথর চোখে তাকিয়ে থাকে রিয়া।
মনে মনে ভাবে, নিজে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। অন্যরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যরা তার জীবনে শেকল পরিয়ে দিচ্ছে। এমন বদলে যাচ্ছে কেন সব।
ওকে কি তাহলে সবাই সত্যি সত্যি দোষী ভাবে!
খারাপ মেয়ে ভাবে!
গুরুত্বহীন ভাবে!
শেফালি ফিরে গিয়ে পানি নিয়ে এসেছে। গ্লাসে পানি টলমল করছে। টলমলে পানির দিকে তাকিয়ে ও মনে করার চেষ্টা করল স্বপ্নটা। পুরোপুরি মনে করতে পারছে না।
শেফালির দিকে চোখ তুলে জানতে চায়, কুসুম এসেছিল?
না। আসে নাই।
মুনা ফোন করেনি?
না।
বাঁধন?
না।
রেজা মামা ফোন করেছিল?
শেফালি এবার চোখ তুলে তাকাল। গার্জেনের মতো ভাব করে বলল, কেউ এহন ফোন করে না। আপনিই খালি ফোন করতে চান। আর হোনেন আম্মা, মামা-টামার সঙ্গে মেলামেশা ভালা না। এই বয়সি মানুষরা হয় শয়তানের হাড্ডি। সুযোগ পাইলে সব কাইড়া নিব।
রিয়া রাগ করল না।
বিস্ময় নিয়ে শেফালির দিকে তাকাল। এমন চটাং চটাং কথা কীভাবে বলে শেফালি? এই অভিজ্ঞতাই-বা পেল কোত্থেকে?
তবে তার অভিজ্ঞতাকে ও অবজ্ঞা করল না।
কাজের বুয়া হলেও শেফালি নারী। মধ্যবয়সি নারী। নারী তার বয়সের অভিজ্ঞতার আলোয় কথা বলছে। বলুক। শুনলে দোষ কী?
রিয়া মনোযোগ দিয়ে শেফালির কথা শোনে।
শেফালি আবার বলছে, হোনেন আম্মা, আপনে আর উপরতলায় যায়েন না।
কেন? যাব না কেন?
হেদিন টাকিমাছের ভর্তা লইয়া গেলাম কুসুম আম্মার জন্য। ফিরত দিলো কুসুমের মা।
ফেরত দিলো কেন?
জানি না। ফিরত দিলো। দেহেন না ওই বাসা থাইকাও কিছু আসে না এ বাসায়। আগে আইত।
রিয়া অবাক হয়। শেফালির কথা বিশ্বাস করে। কুসুমের মায়ের আজকের আচরণের কারণে বিশ্বাসটা আরও গাঢ় হয়।
তাহলে সত্যি কি কুসুমের মা চান না, আমি ওই বাসায় যাই।
হ চান না। হ তাইনে কুসুম আম্মাকে ‘না’ করেছেন আফনার সঙ্গে মিশতে।
মনের সুতো আবার কেটে গেল।
মনের সুর আবার হারিয়ে গেল।
নিষ্প্রভ হয়ে যেতে লাগল ও। আলোহীন মনের ভেতর থেকেও ডাক এলো―কুসুম তারই বেস্ট ফ্রেন্ডের একজন। প্রাণের প্রাণ, জানের জান। কুসুম কখনোই বদলাবে না। এ বিশ্বাস রয়েছে ওর। বিশ্বাসী হাতে ফোন তুলে কুসুমকে রিং করল।
কল হচ্ছে। এক কলেই অ্যাটেন্ড করে প্রথমে চিৎকার দেয় কুসুম। অরিজিনাল চিৎকার, কুসুমের অরিজিনাল স্বর। মোবাইল ফোনে কুসুমের নির্মোহ আন্তরিকতা ঝরে পড়ল।
রিয়ার মন পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়।
মুহূর্তে কেটে গেল মনের কালো ধোঁয়া।
তুই কোথায়, কুসুম?
বুয়েট ক্যাম্পাসে এখন।
কেমিস্ট্রির টিচারের খোঁজে?
ওহ! মামণি বলেছে?
হুঁ।
টিচার কি ক্যাম্পাসে খুঁজে পাওয়া যায়?
না, যায় না। আন্টি বলল তো।
আরে, মিথ্যা বলেছি মাকে। একটু ঘুরতে বের হয়েছি।
মিথ্যা বলেছিস?
হ্যাঁ।
কেন? মিথ্যার প্রয়োজন হলো কেন?
পরে বলব তোকে।
চারুকলার বকুলতলায়ও তুই ছিলি না!
হ্যাঁ। ছিলাম না।
আমাকে এড়িয়ে চলছিস?
গাধা। তুই একটা গাধা। তোকে এড়িয়ে চলব কেন?
তো?
তো কী?
তোর আচরণ তো বদলে গেছে। আগের মতো নেই তুই!
বদলেছে। তোর জন্য বদলায়নি। তুই তোর জায়গাতেই আছিস।
সত্যি?
সত্যি।
থ্যাঙ্কস। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম।
কী কষ্ট?
ভাবছিলাম তুই আমাকে অ্যাভয়েড করছিস।
না। মোটেই অ্যাভয়েড করছি না। আচ্ছা ধর। একজনের সঙ্গে কথা বল।
কে? কার সঙ্গে কথা বলব?
বল আগে। বলেই ফোন দিলো সে মাহিনের হাতে। মাহিনের সঙ্গে বুয়েট ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ও।
হ্যালো, আমি মাহিন।
জি। আমি রিয়া। কুসুমের ফ্রেন্ড।
জানি। আমি আপনার কথা জানি।
জানেন?
হ্যাঁ। জানি। কুসুমের গল্পের অর্ধেকজুড়ে থাকেন আপনি।
আমার গল্প কুসুম আপনার সঙ্গে করে?
কথায় কথায় চলে আসে প্রসঙ্গ। এই আর কি।
আপনার সঙ্গে কুসুমের কথা হয়?
হয়। দেখাও হয়। এই যেমন এখন আমরা একসঙ্গে আছি। বুয়েটে আমাদের ক্যাম্পাসে ঘুরছি।
ওহ! আপনারা কি বেশ কদিন একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
হ্যাঁ। বেড়াচ্ছি। মাঝে মাঝে।
কুসুম আমাকে জানায়নি! অভিমান ঝরে পড়ল রিয়ার স্বরে।
আমি জানি, কেন জানায়নি।
কেন? জানায়নি কেন?
লজ্জায় জানাতে পারেনি। সংকোচে গুটিয়ে ছিল সে।
আমার সঙ্গে সংকোচ?
হ্যাঁ। সংকোচ। সংকোচ তো অ্যাভয়েডেন্স না।
আপনার সঙ্গে কি ওর অ্যাফেয়ার হয়ে গেছে? সরাসরি এবার জানতে চাইল রিয়া।
মাহিন হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে বলল, কী মনে হয় আপনার।
মনে হয় হয়েছে।
তাহলে ধরে নিন, অবশ্যই হয়েছে।
কনগ্র্যাচুলেশন!
ধন্যবাদ।
কুসুমকে কনগ্র্যাচুলেশন দিয়ে দিন।
দিলাম। কুসুম তোমাকেও কনগ্র্যাচুলেশন, রিয়ার পক্ষ থেকে।
কুসুম শুনেছে?
শুনেছে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
আবারও আপনাকে ধন্যবাদ।
লাইন কেটে দিলো রিয়া। কানে এখনো মাহিনের কণ্ঠ লেগে আছে। অভিমান কমে এলো। ঠিকই ধরেছিল ও। কুসুমের মামণির আচরণ বদলাতে পারে। কুসুমের আচরণ বদলায়নি। প্রেমে পড়েছে সে। লুকোতে গিয়ে একটু দূরে সরে গেছে। সংকোচে জড়িয়েছিল। জানাতে পারেনি ওকে। মুনাকেও না। কেউ হয়তো জানে না অ্যাফেয়ারের বিষয়টি। ও-ই সম্ভবত প্রথম জানল।
বুয়েটের পড়ুয়া মাহিন। মেধাবী ছাত্র। কুসুমও মেধাবী। দুই মেধাবীর ভালোবাসা জমে উঠুক। বিপর্যয় ওদের যেন না ছুঁতে পারে, মনে মনে তাই কামনা করল রিয়া।
একধরনের থ্রিল জড়ো হলো মনজুড়ে। থ্রিলটা তাকে রোমান্সের শীর্ষদেশে নিয়ে গেল।
কতজনের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। নিজেকে কতভাবে ট্যাকল করেছে ও।
অথচ একটিমাত্র ঘটনায় চারপাশের দেয়াল ধেয়ে আসছে তার দিকে, দেয়ালগুলো কিছুতেই সরাতে পারছে না ও।
এ মুহূর্তে মাহিনের সঙ্গে কথা চার দেয়ালের চাপ ঠেকিয়ে দিয়েছে। স্বস্তিতে হাসি ফোটে মুখে।
মুনাকে জানাতে হবে।
উল্লাস থেমে থাকল না। বাঁধনকে জানাতে হবে। কুসুম নিজে জানাতে পারেনি সংকোচে।
সংকোচের চাক ভেঙে দেবে রিয়া।
মুনাকে ফোন করে। মুনাও উল্লাসে ফেটে পড়ে।
বাঁধনকে ফোন করে। বাঁধনও লাফিয়ে ওঠে, চিৎকার জুড়ে দেয়।
রেজা মামাকেও ফোন করার ইচ্ছা হলো।
কেন ইচ্ছাটা ঝড়ের বেগে জেগে উঠল, জানে না রিয়া।
ইচ্ছাটা শাসন করতে পারল ও।
শেফালির কথা মনে হলো।
শেফালির কথার সঙ্গে একমত না। রেজা মামাকে ঘিরে খারাপ কোনো ধারণা মনে আসন পেল না। উড়ে গেল সব অশুভ কথার চাপ।
শাসিত ইচ্ছাটা আবার জাগিয়ে দিলো ওকে।
মামাকেও অবশেষে ফোন করে বসল।
রেজা মামা হাসল। হাসির মধ্য থেকে ছুটে এলো অন্যরকম একটা অনুভূতি।
অনুভূতিটা ছুঁয়ে গেল রিয়ার মন।
এ ছুঁয়ে যাওয়ার অর্থ জানা নেই রিয়ার।
চলবে...
এসইউ/জিকেএস