বিগত আলো, সোনালি

খান মুহাম্মদ রুমেল
খান মুহাম্মদ রুমেল খান মুহাম্মদ রুমেল , লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রকাশিত: ০৪:২০ পিএম, ১৫ জুলাই ২০২১

তারপর কী খবর তোমার? ওড়নাটা গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করে অনু। উত্তরে চোখ নাচিয়ে একটু হাসে আবির।

দীর্ঘ বারো বছর পর দুজনের দেখা। বিশ বছরের পরিচয় তাদের—একসময় গভীর বন্ধুত্ব ছিল। বারো বছরের না দেখায় সর্ম্পকটি এখন কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—আমরা কেউই জানি না। বারো বছর পর কেন তাদের দেখা করার কথা মনে হলো—সেটিও এক রহস্য বটে। যাক! এত সব গভীর প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে বরং আজকের দিনটির গল্প আপনাদের বলার চেষ্টা করি।

আগস্ট মাসের দুপুর—তীব্র গরমে অস্থির অবস্থা। তেমন এক দুপুরে আমরা আবিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি শহরের একটি শপিংমলের সামনে। সেটি কোন শহর এ গল্পের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও অনুই যে তাকে এখানে দাঁড়াতে বলেছিল—তথ্যটি জানানো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অনুকে আসতে দেখি আমরা—হলুদের ওপর সাদার ছোপ ছোপ জামা পরা অনুর চোখে সানগ্লাস। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে চোখ তুলেই আবিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনু। হাসি বিনিময় হয় দুজনের। তারপর কোনো কথা হয় কি-না দুজনের, দূর থেকে বোঝা যায় না। তবে পাশাপাশি হেঁটে দুজন শপিংমলে ঢুকে যায়। নিচতলার নিত্যপণ্যের সুপার শপটাকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে থাকে দুজন। নিরিবিলি এক খাবারের দোকানে বসে তারা। অনু কি একটু মুটিয়ে গেছে? গলার কাছে ভাঁজ! আবির তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। কানের পাশের চুলগুলো সব রুপালি!
‘তারপর কী খবর তোমার?’

কথা শুরু করে অনুই। আবিরের একটু লজ্জা লজ্জা লাগে! বুঝতে পারে না সে। এমন তো হওয়ার কথা নয়। অনুর কাছেও লজ্জা পেতে হবে এমন দিন আসবে কখনো—কে ভেবেছিল আগে? বারো বছর কি খুব বেশি সময়? নিজেকেই মনে মনে প্রশ্ন করে আবির। উত্তর মেলে না কোনো। তবে আমরা যারা এ গল্পের পাঠক; তারা জানি বারো বছরে এ দেশে, এ শহরে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। বদলে গেছে অনু এবং আবিরও। উড়নচণ্ডি আবিরের কাঁধে এখন দায়িত্ব। সেসবের কিছুই পূরণ করতে না পেরে কেবল খাবি খায়। শুরুর দিকের আড়ষ্টতা অনেকটাই কেটে গেছে আবিরের। প্রথম দিকে কথা হয় পুরোনো বন্ধুদের নিয়ে। কে কোথায় আছে। কারো সঙ্গে যোগাযোগ আছে কি-না ইত্যাদি। পরের ধাপে অফিসের কথা। কলিগদের মধ্যে কার কেমন আচরণ, কে কীভাবে কথা বলে—তাই নকল করার চেষ্টা করে আবির। আর অনেক কাল আগের মতো মুখে সেই স্মিত হাসি নিয়ে চুপচাপ শোনে অনু।

‘জানো, একসময় আমি তোমাদের বাসার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করতাম, তোমাকে দেখার আশায়।’ আলটপকা বলে বসে আবির।
‘কী বলো! তুমি আমাদের বাসা চিনতে না-কি?’
‘বাসা চিনতাম না। তবে একবার বলেছিলে কোন গলিতে তোমাদের বাসা। সেই গলিতে গিয়ে হাঁটাহাটি করতাম।’
‘বাসায় এলে না কেন?’
‘যাহ, তা হয় না-কি?’
‘কেন হয় না? বন্ধুরা আমাদের বাসায় আসতো তো!’
আর কোনো কথা বলে না আবির। তবে আমরা জানি, সে ফিরে গেছে অনেক অনেক আগের এক জোছনা ধোয়া রাতে। রাতের বাসে চট্টগ্রাম যাচ্ছে আবির। বিকেলটা কেটেছে অনুর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে। সন্ধ্যা পেরিয়ে উঠে বসেছে বাসে। ভেতরের সুনসান নীরবতার মধ্যেও ধাবমান বাসের প্রবল গতিতে এগিয়ে চলার শো শো শব্দ। শহর ছেড়ে বেরোবার আগে ট্রাফিক জ্যামে আটকে থেকে বিরক্ত বাসটা হাইওয়েতে উঠে এগিয়ে চলেছে রক্তচক্ষু ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো। ক্লান্ত আবির মনে করার চেষ্টা করে আড্ডাময় বিকেলটার কথা। হঠাৎই অনুর জন্য মন কেমন করতে থাকে। অনুকে ছেড়ে থাকাটা অসম্ভব মনে থাকে। মনে মনে পণ করে আবির, এবার ঢাকায় ফিরে যেভাবেই হোক অনুকে বলতে হবে—অনু তোমাকে ভালোবাসি। একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরে এক ধরনের স্বস্তি বোধ করে আবির।

তবে আজ এ শীতাতপ রেস্টুরেন্টে বসে এসব কথা বলা হয় না অনুকে। এ সময়টাতে আমরা দেখতে পাই—অনুর হাতটা টেবিলের ওপর রাখা আড়াআড়ি। আবির মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে আছে অনুর পাঁচটি সোনালি আঙুলের দিকে। অনুর হাতে একটি আংটি। অনুর হাতটা ধরতে খুব ইচ্ছে করে আবিরের। কিন্তু আজ এত বছর পরেও সাহস করে উঠতে পারে না। বিশ বছর আগের মতো একই দ্বিধা! একই সংশয়।

আবির আবার ফিরে যায় পুরোনো সময়ে। সে সময়টি কি রঙিন? রঙিন কিংবা ধূসর যা-ই হোক—সময়টি যে স্মৃতিময়, আবিরের বারবার ফিরে যাওয়া দেখে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না আমাদের। শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে একবার ঘুরতে গিয়েছিল অনু আর আবির। নৌকায় ওঠার সময় অনুর হাতটা তখন ধরেছিল ক্ষণিকের জন্য। এখন আবির মনে মনে চাচ্ছিল অনু হাতটা ধরতে দিক। অথবা অনু নিজেই আগ বাড়িয়ে তার হাতটা ধরুক। তা কি আর হয় না-কি? বিশ বছর আগেও হয়নি। আজও হয় না।

প্রসঙ্গ পাল্টায় অনু। চিন্তায় ছেদ পড়ে আবিরের।
‘কী খাবে?’
‘বলো, তোমার যা ইচ্ছে।’
একটা পিৎজা অর্ডার করে অনু। কোনো ড্রিংকস নেয় না। আবির একটা কোক। খুব ঝাল খেতে পছন্দ করে। কড়া ঝাল খেতে গিয়ে মাঝে মাঝে কেমন চোখ দিয়ে পানি পড়ে—তা-ও খেতে ভালো লাগে। হাসতে হাসতে বলতে থাকে। আর আবির দেখে হাসলে অনুর গালে কেমন গভীর টোল পড়ে! একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে অনুর গালের টোল। অনু কি জানে, হাসলে ওর গালে টোল পড়ে! আর তখন তাকে খুব সুন্দর দেখায়? খাওয়া হয় অল্প। আড্ডা বেশি। আর এসবে কেটে যায় চার ঘণ্টা! এবার উঠতে চায় অনু। আবিরও দেখে সময় গড়িয়েছে অনেকটা। তবুও অনুকে ছাড়তে মন চায় না।
‘আর বিশ মিনিট বসো।’
‘আচ্ছা! বসলাম। তুমি একেবারে মিনু আপুর মতো।’
‘কী রকম?’
‘মিনু আপুও তোমার মতো চলে যাওয়ার সময় হলেই বলে আরেকটু বসো!’
‘ওহ! তাই!’
আবার স্মৃতিকাতর হয় আবির। আগে যখন তাদের দেখা হতো—অনু এমনই বাঁধা ধরা সময় নিয়ে আসতো। আর আবির শুধু নানা ছুতোয় তাকে আটকে রাখতে চাইতো। বেশিরভাগ সময়ই শুনতো না। কিন্তু আজকে শান্ত মেয়ের মতো বসে থাকে। ভালো লাগে আবিরের। এক সময় এ বিশ মিনিট আধা ঘণ্টা পেরিয়ে পৌনে এক ঘণ্টায় ঠেকে। উঠতেই হয়।

বাইরে শেষ দুপুর বিকেলের দিকে যাত্রা করেছে। তবে রোদের তেজ এবং গরম, দুটোই এখনো তীব্র। রিকশায় উঠে বসে অনু। মাস্কটা পরে নিতেই হুডটা তুলে দেয় রিকশাওয়ালা। একটু দূরে দাঁড়ানো আবিরের ইচ্ছা করে—ছুটে গিয়ে অনুকে একটা কিছু বলতে। কিন্তু কী বলবে, সেটি ঠিক করে ওঠার আগেই চলে যায় অনুর রিকশাটা।

হাঁটতে শুরু করে আবির। কোথায় যাওয়া যায় এই না দুপুর না বিকেল সময়টায়। একবার মনে হয় পার্কে গিয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ। আবার মনে হয় চলে যাই বাসায়। হয় না দুটোর কোনোটাই। হাঁটছে আবির। ভাবছে আবির।

অনুর জন্য মন কেমন করছে। বিশ বছর আগে অনু যখন চলে যেত; তখনো এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতো সব। অনুর বিদায়ে মন খারাপ করা অনুভূতিটা এখনো টিকে আছে দেখে একধরনের ভালো লাগা কাজ করে আবিরের। না পাওয়ার হাহাকারটাও তো এক ধরনের ভালো লাগা।

হঠাৎ স্বপ্নে পায় আবিরকে। শহরের রাজপথটাকে মনে হয় জোছনার নদী। থৈ থৈ জোছনায় হাঁটছে সে। আর মনে মনে কল্পনা করে অনু তাকে কথা দিয়েছে—আসছে পূর্ণিমায় আমি তোমার হবো! জোছনা স্নানে ভিজে ভিজে আমরা যাত্রা করবো এমন এক গন্তব্যে, যেখানে মনের কথা বলতে না পারার দ্বিধা থাকবে না। প্রিয় অনু অন্য কারো হয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না। অনু মিশে থাকবে আবিরের সকাল-রাতে। ঘন কুয়াশা ভোরে দুজন ভিজবে শিশিরের জলে। আকাশ কালো করা এক আষাঢ় বিকেলে কাদামাটির পথে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে গেলে দুজন পরস্পরকে আগলে নেবে পরম মমতায়! অনুর পাঁচটি সোনালি আঙুল নির্ভরতার চিহ্ন হয়ে ছুঁয়ে থাকবে চিরকাল। যখন ইচ্ছা চাইলেই স্পর্শ করা যাবে অনুর গালের টোল। মন চাইলেই চিৎকার করা করে যাবে—অনু তোমাকে ভালোবাসি!

তবে রিকশা করে ফেরার পথে কিংবা বাসায় গিয়ে অনু কী ভাবে—আমরা জানতে পারি না তার কিছুই। কারণ অনু বরাবরই খুব চাপা।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।