মানবিক বিশ্ব বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথ
পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী। তিনি ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালির মানসপটে চিরজাগরূক রবি ঠাকুর। তাঁর কবিতা, সাহিত্যকর্ম, জীবনদর্শন, সংগীত, চিন্তাচেতনা সবকিছুই আমাদের সত্যিকার বাঙালি হতে অনুপ্রেরণা দেয়, তিনি আমাদের সংস্কৃতি ও প্রেরণার উৎস। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিস্ময়কর প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কবিগুরু, গুরুদেব ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাশিল্পী, ছোট গল্পকার, সুরকার, চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। কবিগুরুই বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যলালিত দর্শন ও বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, যিনি প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
কবিগুরুর দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ স্বকীয় নান্দনিক ভাবনায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে বাংলার মাটি, নদী, জল, বাংলার আলো-বাতাস। কবিগুরুর ঐশ্বর্যমণ্ডিত সুবিশাল সাহিত্য ভান্ডারে প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, সৌন্দর্যদর্শন, চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ইতিহাসচেতনা, নন্দন, দর্শন, ভাব, ভাষা ও ছন্দের বহুমাত্রিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির প্রাণে, চিন্তায়, চেতনা, মননে- এককথায় সমগ্র সত্তাজুড়েই রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই প্রাসঙ্গিক, তিনি চির নতুনের কবি, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ও কালোত্তীর্ণ কবি। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যার রচনায় দুটি দেশের জাতীয় সংগীত। তাঁর রচিত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং ‘জনগণমন- অধিনায়ক জয় হে’ ভারতের জাতীয় সংগীত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন দার্শনিক কবি। কবিগুরুর দর্শন ছিল মানবমুক্তির দর্শন। তিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হৃদয়ের গহীনে লালন করেছেন মানব মুক্তির দর্শন। রবি ঠাকুর বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ ও বিশ্বমৈত্রীবোধ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
মানবতাবাদ একটি দার্শনিক মতবাদ যা মানুষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের মূলে রয়েছে মানবিকতা, মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তি। রবীন্দ্র দর্শনের একটি মৌলিক দিক হচ্ছে মনুষ্যত্ব, জাত-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসা এবং নিজেকে পরার্থে বিলিয়ে দেওয়া। মানুষকে বাদ দিয়ে বিশ্বজগৎ, পারলৌকিক জগৎ, সত্য, ধর্ম কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, ‘ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব- যেমন আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব। তেমনি মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা।’ তাই মূলত মানুষকে কেন্দ্র করেই রবীন্দ্রদর্শন।
১৯৩০-৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ (ভ্রমণপত্রাবলি), ‘কালের যাত্রা’ (নাটিকা), ‘পুনশ্চ’ (গদ্যকাব্য), ‘Religion of Man’ (অক্সফোর্ড হিবার্ট-বক্তৃতা), ‘মানুষের ধর্ম’ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতা) প্রভৃতি রচনায় মানবধর্মের জয়গান করেছেন এবং মানব-ঐক্যবোধ বিশ্বমানবতায় পৌঁছেছে।
তাঁর চিন্তা চেতনায় ছিল শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ, মুক্তচিন্তা ও মানব মুক্তির আশ্বাস। রবি ঠাকুরের ভাষায়, ‘মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে, সে মানুষ। আজকের দিনে এই কথা বলবার সময় এসেছে যে, মানুষ সর্বদেশের সর্বকালের। তার মধ্যে কোনো জাতীয়তা বা বর্ণভেদ নেই।’ শান্তি, সাম্য ও মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথের ছিল মানুষের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের অন্ধকার দূর করে আলোর পথে, জ্ঞানের পথে এবং কূপমণ্ডুকতা ও সংকীর্ণতা দূর করে সম্প্রীতির পথে চলার উৎসাহ দেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। তিনি সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা জুগিয়ে বাঙালি মননকে বিশ্বমানে অধিষ্ঠিত করেছেন।
বাঙালির বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, আন্দোলন সংগ্রাম এবং বাঙালি মুক্তির পথ প্রদর্শক রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, সংগীত ও বক্তৃতায় রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা, ধর্ম, স্বদেশ, মুক্তি প্রভৃতি নানা বিষয়ে সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। রবি ঠাকুরের কবিতা, গান, সাহিত্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি আমাদের সোনার বাংলাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। বাংলা কবিগুরুর মা, কবির সোনার বাংলা, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা, প্রতিটি বাঙালির সোনার বাংলা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রেরণার উৎস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংগীত, কবিতা, সাহিত্য প্রভৃতি নিষিদ্ধ করে। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানি দোসরদের বিরুদ্ধে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। বাঙালি চেতনাবোধে জাগ্রত হয়েই ১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসকচক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করা হয়েছে। সে সময় সব শ্রেণি-পেশা ও গণমানুষের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। একই বছর প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুনরূপে- বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখ উদযাপনের পথচলা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের সুদৃঢ় অবস্থানের কারণে পাকিস্তানিদের শোষণনীতি অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের প্ররোচিত করেছিল ভাষা, সংস্কৃতি ও শিল্প সাহিত্যের ঐক্যের ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করার জন্য। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা, মহামারি, শোক ও শঙ্কায় মানবতার কবি রবীন্দ্রনাথের লেখনী আজকের অস্থির-অশান্ত আবহে আমাদের জন্য ভরসার উৎস হতে পারে। সংঘাত-সাম্প্রদায়িকতা আর বৈষম্যের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ শান্তি-অসাম্প্রদায়িকতা আর সাম্যের দর্শন তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি।
২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা দেখতে পেয়েছি চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে। এ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বারবার তাদের রূপ পরিবর্তন করে। মৌলবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, রাজনৈতিক উস্কানি ও সাম্প্রদায়িকতার কালো থাবা দ্বারা বারবার এদেশের শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্নভাবে আঘাত এসেছে। স্বাধীনতার পূূর্ববর্তী সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী রবীন্দ্র সংগীতচর্চা ও পহেলা বৈশাখ পালন বন্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি ইতিহাস-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। আবারো সেই সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী ধর্মকে অপব্যবহার করে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাক্ষণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব ও সহিংসতা চালিয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। রুখে দিতে হবে সব সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদের বাঙালিত্ব, বাঙালি সংস্কৃতি ও মননশীলতা চর্চা করার পাশাপাশি রবীন্দ্রচর্চার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের রবীন্দ্র পাঠ অধ্যয়ন ও রবীন্দ্রচর্চার কোন বিকল্প নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যভাবনা, জীবনদর্শন, সৌন্দর্যদর্শন, সাম্য ও শান্তির বাণী, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমাজে প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্রচর্চাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে আমরা একটি মানবিক বিশ্ব গড়বো। শেষ করবো কবিগুরুর প্রার্থনায়—
‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে।’
লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জিকেএস