কাল বাবার বিয়ে
সানজিদা সামরিন
বাড়িভর্তি লোকজন। পা ফেলার উপায় নেই। উপরতলার পশ্চিমের ঘরখানায় দেয়ালে শেষবারের মতো আকাশি রঙের পরত দেওয়া হচ্ছে। আনা হয়েছে নতুন খাট। বাড়ির মেয়েরা এক হয়ে সন্দেশ আর পিঠা বানানোয় ব্যস্ত। নানা রকমের পিসি আর কাকিমার ছেলেপুলেরা সারাবাড়ি আর উঠোনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, করছে হইহুল্লোড়। বসার ঘরটা যেন আর বসার ঘর নেই। সোফা থেকে মেঝে অবধি ছড়িয়ে আছে নতুন জামা-কাপড়, শাড়ি, মিষ্টি, ফল আরও কত কী! দাদুমণি রান্নাঘর থেকে তাড়া দিচ্ছেন, ‘ওরে, সব এক জায়গায় বসে রইলে চলবে? ক’জন মিলে ডালা সাজাতে বসে যা না!’ সন্ধ্যেবেলায়ই কনের বাড়ি তত্ত্ব যাবে। যাবে বস্ত্রালঙ্কার! কাল আমার বাবার বিয়ে। শুনে খুব অবাক লাগছে না? নিজের বাবার বুঝি আবার বিয়ে হয়?
সে অনেকদিন আগের কথা, খুব দাঁতে ব্যথা হলো। বাবার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার দেখিয়ে এক জায়গায় খেতে বসলাম। সঙ্গে বাবার এক কলিগও ছিলেন। তিনি বাবাকে বলে উঠলেন, ‘তূর্ণা তো আপনার কাছেই মানুষ হলো, না?’ বাবা প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বললেন, ‘হু। ও যখন খুব ছোট্ট ছিল। একদম এইটুকু; তখন কিচ্ছু খেতো না। সারাদিন কাঁদতো। কেউ থামাতে পারতো না। শুধু আমি কোলে নিয়ে ঝুপ করে একটা ঝাঁকি দিলেই চুপ হয়ে যেত। ঘুমিয়ে পড়তো।’
আসলে কেবল ওইটুকু বয়সেই নয়, আমার জন্য অনেক বড় হওয়ার পরও বাবা রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেননি। কারণ আমার দীর্ঘদিন ঘুমের সমস্যা ছিল। প্রায় সারারাত ধরেই এটা-সেটা করে আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতেন তিনি। আসলে মাঝে মাঝে খুব অপরাধবোধ হয়, এত বড় সংসার, অফিস, নিজের ব্যবসা সামলে বাবা কতটা ক্লান্ত। তার ওপর আমার মতো একটা বাড়তি চাপও বাবাকে নিতে হয়েছে। বাড়তি চাপ বলছি, কারণ সন্তানতুল্যকে সন্তানই মনে করেছেন তিনি। যেটা না করলেও পারতেন। আমাকে বড় করা, আমার পড়াশোনা, ইচ্ছে, ভালো লাগার দেখাশোনা থেকে শুরু করে আমার কোন দায়িত্বটি তিনি পালন করেননি? হয়তো সবাই বলবে, এ আর এমন কী! সব বাবাই তো তাই করেন! ব্যতিক্রম তো কিছু নয়!
কিন্তু এত বড় পরিবারের দায়িত্ব একা মাথায় না তুলে নিজেকে নিয়েও তো ভাবতে পারতেন তিনি। এতদিনে তো পারতেন নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে। নিজের সুখটাকেই দেখতে। ভালোর ক্ষতি যেটা হয়েছে, তা হলো দিনকে দিন আমি বাবার প্রতি অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। পেটে কথা-ই আর জমাতে পারলাম না এক পর্যায়ে। বাবাকে না বলা অবধি শান্তি নেই। কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তও নিতে পারতাম না একা একা। বাবাকেই মনে হতে ঈশ্বর। তিনি যা বলবেন, তা-ই ঠিক যেন। তা-ই যেন পরম সত্য। কিন্তু একটা পর্যায়ে, বলা ভালো বড্ড দেরীতেই বোধগম্য হলো যে- আমার এই নির্ভরশীলতা, এই ভরসা আসলে বাবার জন্য বাড়তি চাপ। বাবার শরীরটাও বুঝি অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছে আমার জীবনের নানা উত্থান-পতনের রেশ টানতে টানতে। বয়সও তো বেড়েছে।
বাবার শুভাকাঙ্ক্ষীরা অবশ্য আমায় বারবার রয়ে-সয়ে বুঝিয়েছেন, ‘মামণি বড় হয়েছো। নিজের দায়িত্ব নাও। নিজের সবকিছু বুঝে নাও। বাবাকে আর চাপ দিও না।’ কিন্তু স্বার্থপরের মতো কেন যে বুঝিনি, আমি বাবার সন্তানতুল্য হলেও আদতে সন্তান নই। জানি না। অবশ্য যেদিন দেখলাম বাবার এক চোখ টকটকে লাল। ব্লাড প্রেশার এই প্রথম বেড়েছে; সেদিন থেকেই সাবধান হলাম। পণ করলাম, যতদিন বাঁচবো দূরত্ব রেখে হলেও বাবাকে সুখীই দেখবো। আর এর মধ্যে যখনই খবর পেলাম বাবার বিয়ে হবে; তখন এতই খুশি হলাম চোখের জলই ধরে রাখতে পারছিলাম না! খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। এতদিন পর হলেও বাবা নিজেকে নিয়ে ভাবার ফুরসত পেয়েছেন। কিন্তু কেন যেন আমি চোখ তুলে তাকাতে পারছি না তার দিকে। একটা ভারি পর্দা নেমে আসে, যখনই বাবার সামনে দাঁড়াই। একটা অপরাধবোধ কাজ করে। যেন সবার আঙুল আমার দিকেই- ‘তূর্ণা, তুমিই বাবার অসুস্থতার জন্য দায়ী। আর কত চাপ নেবে তোমার বাবা?’ আমার কানে কেবল এ কথাগুলোই প্রতিধ্বনিত হয়।
প্রভা, রামিসা, ধ্রুব, মুন সবাই তত্ত্ব সাজানোর কাজে ব্যস্ত। আমি কেবল ঘরের এক কোণে বসে আছি। সন্ধ্যেবেলা সবাই যাবে কনের বাড়ি। মানে ‘হবু মা’র বাড়ি! আমি তখন কী করবো? আজ সারাদিন বাবাকে এড়িয়ে গেছি। ওই যে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। বাবার কি আবার ব্লাড প্রেশার হাই হবে আমাকে দেখেই, সমস্যায় জর্জরিত সন্তানতুল্য মেয়েটিকে দেখে?
মনে মনে ভেবে রেখেছি, কাল মাকে যখন বাবা নিয়ে আসবেন; তখন বাবা নতুন ঘরে ঢুকেই অবাক হবেন। বিছানায় নীল রঙের বেডশিট, মেঝেতে নীল কার্পেট, দেয়ালে বাবারই আঁকা নীল সব পেইন্টিং থাকবে। এত এত সাদা ফুল ছড়িয়ে দেব যে, বাবার পায়ে মেঝের ঠান্ডাই লাগবে না। নতুন প্রদীপ জ্বেলে দেব সারি সারি। বাবা ঘরে ঢুকেই বুঝে নেবেন- এ কাজ তূর্ণা ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। মেয়েটি একদম বড় হয়ে গেছে!
আমি জানি তো, নীল রং বাবার কত প্রিয়। আর কখনোই আমায় নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে দেবো না বাবাকে। শান্তির নীলে ভেসে চলুক বাবার জীবন তরী।
এসইউ/এমএস