ড. তপন বাগচীর সাক্ষাৎকার- দ্বিতীয় পর্ব

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:০৭ পিএম, ২৮ মে ২০২০

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রুবেল আনছারের সহযোগিতায় সমকালের আলোচিত এই সাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক সাবরিনা আফরিন সিলভী—

সাবরিনা আফরিন সিলভী: প্রথম পর্বের শেষে যখন ২য় পর্ব শুরু হলো, তখন আবার প্রথম পর্বের কাহিনির পুনরাবৃত্তি করা হলো কেন?
তপন বাগচী: সোজা কথায় ‘খেই’ ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। পাঠক যেন নতুন পর্বে গিয়ে প্রথম পর্বের কাহিনি ভুলে না যান, তার জন্য। আগে যা ঘটেছে তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য এটি একটি কৌশল হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। তবে এতসব ভেবে লিখিনি। আপনার মতো কৌতূহলী পাঠকের প্রশ্নে। তার জবাব দিতে গিয়ে কথাগুলো মনে এলো, তাই এই যুক্তি দাঁড় করালাম। আশা করি এতেই পিপাসা মিটবে।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: শিশুতোষ গল্প হিসেবে গল্পের শেষে শব্দার্থ বা টিকা দেওয়া জরুরি ছিল কী?
তপন বাগচী: মনে রাখতে হবে আমি শ্রেণিপাঠ্য বা বিদ্যালয়পাঠ্য বই লিখতে বসিনি। ওসব বইয়ে গল্পের শেষে শব্দার্থ বা টীকা-টীপ্পনী দিতে হয় শিশুদের মনঃধকরণের জন্য। সেই দায়িত্ব পালন করেন পাঠ্যবইয়ের সংকলক ও সম্পাদকবৃন্দ। তারা অতি যত্নে কাজটি করেন। আমার কোনো গল্প যদি শ্রেণিপাঠ্য হয়ে ওঠে, তখন ওরকম সম্পাদিত হয়ে পাঠ্যপুস্তকে ছাপা হবে। আমি যখন গল্প লিখেছি, তখন মাথায় রেখেছি এর পাঠকেরা কতগুলো শব্দ নিজেরাই বুঝতে পারবে, কতগুলো শব্দ অভিধান খুলে কিংবা অভিভাবককে জিজ্ঞেস করে শিখে নিতে পারবে। অযথা কোনো ভারি ও দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগের চেষ্টা করিনি। এই বয়সে কিছু নতুন শব্দ তো শিখতে হবে তাকে। তাই এই সুযোগটুকু রাখা। নিজেই খুঁজে নিক কিছু শব্দের অর্থ!

jagonews24

সাবরিনা আফরিন সিলভী: ইন্টারনেট বা উত্তাল প্রযুক্তির যুগে শিশুদের বিনোদনের জন্য লোকগল্পের এই প্রচলন কতটা ফলপ্রসূ?
তপন বাগচী: ইন্টারনেট বা উত্তাল প্রযুক্তির যুগে শিশুদের বিনোদনের জন্য তো কিছু পাঠ্যবিষয় ঠিক করতে হবে। ইন্টারনেট তো এখানে মাধ্যম। বই, নাটক, চলচ্চিত্র, সংবাদপত্র, সাময়িকপত্রের মতো ইন্টারনেটও একটা মাধ্যম মাত্র। তার ভেতরে তো টেক্সট থাকতে হবে। সেই টেক্সট কী? সেই টেক্সট তো গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, নকশা, কার্টুন এইসব। যখন চলচ্চিত্র এলো, প্রচলিত গল্প-উপন্যাসের চিত্রায়ন শুরু হলো। বলা হলো, এখন সবাই চলচ্চিত্র দেখবে, বই পড়বে না। কিন্তু কীসের চলচ্চিত্রায়ন হবে, কাহিনি তো লাগবে! তাই সাহিত্যের প্রয়োজন তো ফুরায়নি। ইন্টারনেটের প্রবল প্রতাপে হয়তো ছাপা পত্রিকা বা ছাপা বইয়ের চাহিদা কমবে, কিন্তু পত্রিকা বা বইয়ের যে আধেয়, অর্থাৎ লিটারেচারের চাহিদা তো কমবে না। তাই শিশুতোষ গল্পের আবেদন ফুরাবে না। এখন কথা উঠতে পারে, লোকজ গল্পের আবেদন আগের মতো থাকবে কি-না। সেক্ষেত্রে আমার কথা হলো, লোকগল্পের আবেদন ফুরানোর সুযোগ নেই। লোকগল্প তো লোকমানসে তৈরি হয়, লোকপরম্পায় বাহিত হয়, লোকসমাজে প্রচারিত হয়। কিছু গল্প হারিয়ে যায়, কিছু গল্প কালের ধোপে টিকে যায়। আমরা তো সেই টিকে যাওয়া গল্পগুলোই পাচ্ছি। আমার যে বইটি হাতে নিয়ে প্রশ্ন করছেন, এর প্রতিটি গল্পই আমাদের লোকসমাজে প্রচলিত। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শোনা এই গল্পগুলো আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। আমি নিজের মতো করে ছোটদের উপযোগী করে নতুন করে লিখেছি। এই সব গল্পের তো মৃত্যু নেই। এইসব গল্পের ফলপ্রসূতা প্রমাণিত।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: ইন্টারনেট/ইউটিউব/গেমস বনাম ফোকলোর যুগ হিসেবে আপনি কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন এবং কেন?
তপন বাগচী: ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভিডিও গেমস আগে ছিল না, প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে অনেকটা সাম্প্রতিক সময়ে এর জন্ম। এর নতুন নতুন সংস্করণ তৈরি হবে নতুন নতুন সুবিধার জন্য। কিন্তু ফোকলোরের জন্ম মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। মানুষ যতদিন থাকবে ফোকলোর থাকবে। ফোকলোরের রূপ বদল হয়। নাগরিক সমাজে ফোকলোরের জন্ম হচ্ছে। ফোকলোর তো চিরপুরাতন হয়েও চিরনতুনের রূপ ধারণ করে থাকে। সমাজে যে জ্ঞান টিকে থাকে, সেটিই তো ফোকলোর। ফোকলোরের ধারণা থেকেই তো নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে। এই ধরুন মানুষ পাথরে পাথর ঘঁষে আগুন জ্বালাতে শিখল। এটা ফোকলোর। কিন্তু মানুষ এখন ছোট বাক্সে কাঠি ঠুকে নিরাপদে আগুন জ্বালায়। এখন গ্যাসলাইটারও আছে। সেই ঘর্ষণে আগুন জ্বালানোর জ্ঞানই তো নতুন প্রযুক্তি নির্মাণে সহায়ক হয়েছে। তাই ফোকলোরকেই আমি সকল জ্ঞানের শুরুতে রাখতে চাই।

jagonews24

সাবরিনা আফরিন সিলভী: সাহিত্যের কোন ক্ষেত্রে কাজ করে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
তপন বাগচী:
কোনো একটি মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলে তো আর অন্য মাধ্যমে কাজ করতে যেতাম না। শুরুতে সকলেরই তো কবিতা লিখে সাহিত্যযাত্রা শুরু হয়! তো আমারও হয়েছিল। আমি যদি কবিতাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম, তবে কি আর ছড়া লিখতে যেতাম? কিংবা গান লিখতে যেতাম? খুব কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কবিতা-ছড়া-গানের অন্তর্গত পার্থক্য আমি জানি। তিনটিই ভিন্ন মাধ্যম। তো এর থেকে অনেক দূরে প্রবন্ধ বা গবেষণাসাহিত্য। সেই মাধ্যমেই আমি বিচরণ করেছি এবং কিছু স্বীকৃতিও জুটেছে। সেই প্রবন্ধ কি কেবল সাহিত্য নিয়ে? না, আমি স্থানীয় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনী এবং ফোকলোর গবেষণাতেও মনোনিবেশ করেছি। এর সবই গদ্যসাহিত্যের অন্তর্গত হলেও প্রকরণগত পার্থক্য রয়েছে। শিশুদের জন্য ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছি। সেটিও আলাদা। একটা উপন্যাস ও কিছু গল্প লিখেছিলাম। তার মানে কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিছু চাষাবাদ করেছি। ছাত্রজীবনে একটি নাটক লিখেছিলাম। সম্প্রতি একটি নাটক লিখছি। আরও কিছু নাটক লেখার ভাবনা মাথায় রয়েছে। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই আমি বিচরণ করেছি। সফলতা-বিফলতার হিসাব পরে করা যাবে। ধরে নিতে পারেন, কোনো ক্ষেত্রেই আমার স্বাচ্ছন্দ্য নেই বলে এই ক্ষেত্র পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। আবার উল্টো করে বলা যায়, সব শাখাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি বলেই সাদা খাতায় দাগ কাটার ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছি। তবে গোপনে বলে রাখি, কবিতা লিখতে পারলে যে আনন্দ হয়, অন্তরের ভেতর যে শিহরণ জাগে, তা অন্য কোনো মাধ্যমে আমি পাই না। তাই বারবার ছড়া লেখার ছলে, গান লেখার ছলে কিংবা শিশুতোষ গল্পের সংলাপ রচনার ছলে আমি কবিতার কাছে ফিরে আসি।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: শিশুসাহিত্য লেখার রসদ কীভাবে সংগ্রহ করেন?
তপন বাগচী: লেখার রসদ সংগ্রহ করতে তেমন কোনো পরিকল্পনা করতে হয় বলে আমার জানা নেই। এই ধরুন, রাস্তা বানাতে হলে পাশ থেকে খাল কেটে মাটি আনতে হয়। এটা রাস্তা বানানোর রসদ। তারপর ইটের ভাটা থেকে ইট, ফ্যাক্টরি থেকে সিমেন্ট ও পিচ আর কোনো বালুমহাল থেকে বালু আনতে হয়। এসব রসদ আনতে হয় পরিকল্পনামাফিক। কিন্তু লেখার রসদ আসে অনুভব থেকে, বিদ্যাবুদ্ধি থেকে, পর্যবেক্ষণ থেকে। চারদিকে তাকালেই তো কত রসদ হা করে চেয়ে থাকতে দেখি! শুধু দেখার চোখ থাকতে হয়, গ্রহণের মন থাকতে হয়। আর আমি মানুষ পাঠ করি। বিশেষত শিশুদের মতিগতি পাঠ করেও পাওয়া যায় অনেক রসদ। প্রকৃতি পাঠ করেও পেয়ে যাই মহার্ঘ্য রসদ। সেখান থেকে বিবেচনা করি, কোনটি শিশুদের লাগবে, আর কোনটি লাগবে না। তারপর বিবেচনা করি প্রকাশের মাধ্যম কী হবে? ছড়া না-কি গল্প? এভাবে মনের ভেতর থেকেই তাড়না অনুভব করি। একসময় লেখাটি আঙুলের ডগায় চলে আসে।

jagonews24

সাবরিনা আফরিন সিলভী: শিশুসাহিত্যিক জীবনে কোন কোন প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে?
তপন বাগচী:
আমার লেখার গতি বহুমুখী বলে আমাকে সকলেই তালিকার বাইরে রাখতে চায়। ছড়াকারদের তালিকায় বাদ রাখে কবিতা লিখি বলে। কবিদের তালিকায় বাদ দিতে চায় প্রবন্ধ লিখি বলে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এসব প্রতিবন্ধকতা আমি টপকে গিয়েছি অপেক্ষা আর নিষ্ঠার মাধ্যমে। এখন সকল মাধ্যমেই আমার ডাক পড়ে। আর যারা তালিকা বানাতেন, তাঁরাই দেখি ভেসে গেছেন সাহিত্যের বেনোজলে।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: নতুন শিশুসাহিত্যিকদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
তপন বাগচী: শিশুরা পাঠক হিসেবে অনেক সংবেদনশীল। তাদের মনের মতো না হলে তারা সেই লেখকের অন্য লেখার প্রতিও দৃষ্টি মেলবে না। শিশুদের নিয়ে লিখতে গেলে শিশুদের মতো উদার হতে হয়। শিশুদের মন বোঝার মতো কঠিন সাধনা করতে হয়। আর তার আগে পড়ে নিতে হবে শিশুসাহিত্যের সেরা রচনাগুলো। সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুনির্মল বসু, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই, এখলাসউদ্দিন আহমেদ, ফয়েজ আহমেদ, সুকুমার বড়ুয়া, আখতার হুসেন, কাইজার চৌধুরী, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন, লুৎফর রহমান রিটন, ফারুক নওয়াজ, সুজন বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম, রাশেদ রউফের লেখাগুলো পড়ে নিতে হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদীন, সেলিনা হোসেন, সুব্রত বড়ুয়া, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, তপন চক্রবর্তী প্রমুখের শিশুতোষ রচনাগুলো পড়ে আসতে হবে। তারপর নিজের মতো করে লেখার কথা ভাবা যাবে। আর সাহিত্যের প্রকরণগত কিছু কৌশলও আয়ত্ত করতে হয়। যেমন ছড়া লিখতে গেলে ছন্দটা জানতে হবে। ছন্দ জানার বই পড়ার পাশাপাশি নিজের লেখায় তার প্রয়োগ ঘটানোর সাধনা করতে হবে। সাহিত্যের আড্ডায় গেলেও দৃষ্টি ও শ্রুতি প্রসারিত হয়। আর অগ্রজ কোনো লেখকের সান্নিধ্যও নিজের পথ খুঁজে নিতে সহায়ক হতে পারে। তবে পাঠ আর অনুশীলনের বিকল্প নেই।

চলবে...

এসইউ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।