দীপিকা তখন আমার সঙ্গে ছিল


প্রকাশিত: ০৬:৫৬ এএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৫

সেদিনই দীপিকার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। এই মফস্বলে বাস করে অনেককিছুই আঁচ করা যায় না। গরম চায়ের ধোঁয়ার মতো ভাসা ভাসা কিছু কথা কানে আসে। কোনোটার আগা আছে, মাথা নেই। আবার কোনোটার আগা-মাথা একটু ঘুরিয়ে বললে অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই নেই। আমি মোবারক হোসেন বলেই কি এমন মনে হয়? অন্যরা যা দেখে, যেভাবে দেখে, অনুভব করে, আমি তা করি না। কোনো কাজ করার আগে `ভাবিয়া করিও কাজ` টাইপের প্রবাদ মস্তিষ্কের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দাপাদাপি করে। অন্যদের সে সমস্যা নেই। সে যাই হোক, কোনোকিছুতে অর্থ খোঁজা দোষের কিছু তো নয়! তবে সময় বদলেছে। এখন মানুষ কৃতকর্মের অর্থ খুঁজে না, অর্থকড়ি যেখানে আছে সেখানে ছুটে যায় কিংবা উড়ে আসে।

দীপিকা নামের একটা মেয়ে, ও হ্যাঁ ‘মেয়ে’ বলায় আবার আমার দিকে ধেয়ে আসবেন না, হয়তো আরো ভালো শব্দ বা বিশেষণ ব্যবহার করা যেত, কিন্তু আমার আবার শব্দসম্ভার সমৃদ্ধ নয়, তবুও সত্য বলতে বাধা নেই, চোখ মেলে দেখুন সবকিছুর পরও সে একজন মেয়ে; যা বলছিলাম, একটা মেয়ে প্রথমবারের মতো এদেশে আসছে, তাও দেশ দেখতে নয়, নিজেকে দেখাতে, তাতেই উন্মাদনার শেষ নেই। ঢাকা শহর নাকি দীপিকার বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে। তাকে একনজর দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ লোকের ঘুম-খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। শুনেছি পানির অভাবে তিস্তা নদী নাকি শুকিয়ে ধু ধু বালুচর। লাইফসাপোর্ট দেওয়ার মতো পানিও সেখানে নেই। যৌবন তো দূর অস্ত! দীপিকা আসাতে তার মতো না হোক, কিছু যৌবন যদি নদীটা ফিরে পেত তবে আমার মতো মোবারকদের খুশির সীমা থাকত না। সমস্যা হচ্ছে, যার ভাবনা সে ভাবে না। আমার মতো মোবারকের ভাবা, না-ভাবায় কিছু যায় আসে না।

আমি মোবারক, দীপিকার খবর নিয়ে আমার কাজ নেই। ওদেরকে আকাশের তারকা-নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়, আমি তো গোবুরে ফুলও না। পেপার-পত্রিকা তেমন পড়া হয় না। দেশ-বিদেশে কোথাও শান্তি নেই। এমনিতেই ব্যক্তিগত জ্বালা-যন্ত্রণায় অস্থির। বাইরের অশান্তি মনের মধ্যে টেনে এনে রাতের ঘুমটুকুও জলাঞ্জলি দিতে চাই না। দীপিকাকে আমি দেখিনি বললে ভুল হবে। সেদিন দোকান থেকে একটা গায়ে মাখার সাবান কিনেছিলাম। তার প্যাকেটে একটা মেয়ের ছবি দেওয়া ছিল। সাবানের মোড়কে ছেলেদের ছবি থাকবে না, রূপসী মেয়েদের ছবি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এত সাধারণ একটা মেয়ের ছবি কি ব্যাটারা ভুল করে দিল? আমার সন্দেহ হয়। আমাদের মহল্লার লিপি কি দেখতে এর চেয়ে কোনো অংশে মন্দ? এমনকি পাশের বাড়ির ডালিয়া! সেও তো রূপে-সৌন্দর্যে কম যায় না! অবশ্য এটাও ঠিক, লিপি-ডালিয়াদের ছবি তো আর সাবানের প্যাকেটে থাকবে না। বড়জোর আমার মতো মোবারকদের মানিব্যাগের কোণায় পড়ে থাকবে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো মোড়কের মেয়েটার নাম-পরিচয় জানা যেত। এরা আবার পণ্যের ভেতরের চেয়ে বাইরের খবর বেশি রাখে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে প্রশ্নটা করা ঠিক হবে না বলে চলে এসেছিলাম। পরে যখন জেনেছি, এই সেই দীপিকা, যার আগমন ছেলে-বুড়োদের মনের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে; তখন কিছুটা বিস্মিত হয়েছি বৈ-কী!

দীপিকা নামের হৃদয় কাঁপানো কোনো নায়িকার সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনা আমার মধ্যে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে কখনোই ভর করেনি। লিপিকে নিয়ে যতবার ভেবেছি, তাকে দেখে শিহরিত হয়েছি; এমনকি দূর থেকে ডালিয়াকে দেখে যতটুকু মুগ্ধ হয়েছি তার কোনোটাই ঘটেনি দীপিকার ক্ষেত্রে। লিপির হাত ধরার ইচ্ছা অতি কষ্টে সংবরণ করেছি। সাহসের অভাবে কখনো ডালিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো হয়নি। এ সবই আমার আক্ষেপ। হয়তো অক্ষমতাও। কিন্তু দীপিকাকে দেখা, চেনা, না-চেনার সঙ্গে ব্যর্থতা কিংবা আক্ষেপের সম্পর্ক নেই। আচ্ছা, এমন যদি হতো দীপিকা আমাদের মহল্লায়, আমাদের বাড়িতে বা আমার ঘরে এসে হাজির হতো তাহলে কি আমি একটা চান্স নিতাম না? কী জানি! যাকে ভালো করে চিনিই না, যার ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি এমনকি জগতটাও ভিন্ন তার সঙ্গে কতটুকুই বা ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়! বড়জোর হাই-হ্যালো...

-হাই! আমি দীপিকা।
-আমি মোবারক। মোবারক হোসেন। আপনার নাম কি শুধুই `দীপিকা`? আগে শ্রীমতি, পরে রানী, চ্যাটার্জি` এসব কিছু নেই?
-আছে, আমি দীপিকা পাড়ুকোন।
-দীপিকা পর্যন্ত তো ভালোই ছিল। পরের অংশটা কঠিন করে ফেললেন কেন? মনে রাখা দুষ্কর হয়ে যাবে। তারচেয়ে ভালো দীপিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকা।
-আমাকে কি আপনি চেনেন?
-আগে নামে চিনতাম। সেদিন দোকান থেকে কেনা সাবানের মোড়কে আপনার ছবি দেখলাম।
-আপনি তো খুব মজা করে কথা বলেন! আমার কোনো ছবি দেখেননি?
-দেখেছি তো! ওই যে বললাম, সাবানের মোড়কে।
-না, বলছিলাম কোনো মুভি দেখেননি?
-আমি সিনেমা-টিনেমা দেখে সময় নষ্ট করি না। তাছাড়া দুঃখের কাহিনি আমার সহ্য হয় না। আবেগ সংবরণ করতে পারিনা। চোখে পানি চলে আসে। তাছাড়া আপনি আবার হিন্দি ছবি করেন। হিন্দি ভাষার কুচ-বুচ কিছুই আমি বুঝি না। ভাষা না বুঝলে সিনেমা দেখে কী লাভ?
-আপনার কথা যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি। আমাকে দেখার ইচ্ছাও কি হয়নি?
-আপনি আমাদের দেশে আসবেন বলে কত সাজসজ্জা, কত আয়োজন! শুনেছি আপনাকে দেখতে চার-পাঁচ মাস আগে থেকে মানুষ অপেক্ষা করে আছে। এসব শুনেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া পাশের বাড়ির ডালিয়াকেই এখনো মন ভরে দেখতে পারিনি। আর আপনি থাকেন দূর দেশে! আচ্ছা, আপনাকে নিয়ে সব জায়গাতেই কি এমন মাতামাতি হয়?
-নতুন জায়গাতে এমন একটু-আধটু হয়। আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এবার অল্প সময়ের জন্য এসেছি। পরেরবার যখন আসব তখন সময় হাতে নিয়ে আসব।
-তার মানে আপনি বেশি দিন থাকবেন না?
-বেশিদিন কী বলছেন, একদিন কি কম? আমার ব্যস্ততা সম্পর্কে আপনি জানেন না। আমার শিডিউল মেলাতে খুব বেগ পেতে হয়।
-তাই বলে যারা আপনাকে দেখার জন্য এতদিন ধরে অধীর হয়ে আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না, তা কী করে হয়?
-ওরাও নিশ্চয় বাস্তবতাটা বুঝবে। তাছাড়া আমি তাদের সামনে যাচ্ছি। অনেক ভেবে-চিন্তে খাঁটি বাঙালি সাজে শাড়ি পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতেই তারা অনেক খুশি হবে।
-কয়েক মুহূর্তের জন্য আপনি শাড়ি পরবেন তাতে তারা খুশি হবে কেন? এমন তো নয় যে, আজ থেকে আপনি শাড়ি পরেই থাকবেন!
-এটাকেই বলে সেন্টিমেন্ট। ও আপনি বুঝবেন না। যেখানে যেতে হয়, তাদের সংস্কৃতি ধারণ করার চেষ্টা করতে হয়। তাহলে সহজেই সেখানকার মানুষের সঙ্গে মেশা যায়।
-মানুষের সঙ্গে মিশবেন কী! আপনি এসেছেন কয়েক ঘণ্টার জন্য। আচ্ছা, কেউ যদি আপনার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করে উত্তর দেবেন না?
-ভাবছি সেখানেও একটা চমক রাখব। আমি দর্শকের মাত্র একটা প্রশ্নের জবাব দেব।
-কী বলেন! বাকিরা অসন্তুষ্ট হবে না?
-সবাইকে কি একসঙ্গে সন্তুষ্ট করা যায়?
-তাহলে আমার সঙ্গে এত কথা বলছেন কেন? আমি তো আপনার সাক্ষাতের প্রতীক্ষায় ছিলাম না।
-আমিও কীভাবে এখানে এলাম বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গ পেয়ে আপনি কি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন না?
-আমি মোবারক হোসেন। আমার দৌড় বড়জোর লিপি আরেকটু বেশি হলে ডালিয়া পর্যন্ত। তারাই আমার সঙ্গে ভক্তি নিয়ে কথা বলে না। আপনি এতক্ষণ আমার সঙ্গে ছিলেন একথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
-আপনি বিশ্বাস করলেই আমি খুশি।
-লিপি অথবা ডালিয়া, যে কোনো একজনকে পেলে আমি আপনার চেয়েও খুশি হবো। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
-তারকাদের সঠিক সময়ে স্টেজে উঠতে নেই। যে যত বড় স্টার সে তত  বিলম্ব করে ওঠে।
-হা হা হা...! আপনার তাহলে স্টেজে ওঠারই দরকার নেই।

দীপিকার সঙ্গে কথা বলে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। সজাগ হলাম মুঠোফোনের রিংটোনে। বন্ধুর ফোন। ওপাশে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ-
-জানিস, দীপিকা এখন স্টেজে উঠছে।
-তুই কি জানিস দীপিকা এতক্ষণ কোথায় ছিল?
-ছিল হয়তো কোনো জরুরি কাজে। তারকাদের ব্যাপার কি আর সাধারণ মানুষ জানতে পারে?
-দীপিকা এতক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল!
হাওয়াভর্তি বেলুন হঠাৎ চুপসে গেলে যেমন হয়, আমার বন্ধুর অবস্থাও তেমন হলো। আমার কথা ওর মস্তিষ্ক গ্রহন করতে পারেনি। কণ্ঠে রাজ্যের অবিশ্বাস।
-কী যা-তা বলছিস? পাগল হয়ে গেলি নাকি!
-বিশ্বাস করা, না-করা তোর ব্যাপার। দীপিকার জন্য পাগল হওয়ার পর্যায়ে এখনো পৌঁছাইনি।

দীপিকা আমার সাহসের পারদ কতখানি বাড়িয়ে দিয়েছে পরদিন বুঝতে পারলাম। লিপির সামনে দাঁড়িয়ে মনের কথা গুছিয়ে বললাম। আমার কথা শুনে লিপি হেসেই খুন। ওর হাসিতে আমিও খুন হয়ে যাচ্ছিলাম। কষ্টে নিজেকে সামলালাম। লিপির হাসি আগে এভাবে খেয়াল করিনি। হাসলে কি ওকে দীপিকার মতো লাগে? বাড়ি ফেরার পথে ডালিয়ার সঙ্গে দেখা। ওর চোখে চোখ রেখে চমকে উঠি। ডালিয়ার চাহনি কি অবিকল দীপিকার মতো? ওদেরকে কি বলব আমি তাচ্ছিল্য করার মতো কেউ না। স্বয়ং দীপিকা আমার সঙ্গে মূল্যবান সময় কাটিয়েছে। দীপিকার সঙ্গে তাদেরও বেশ মিল আছে। নাকি ওরাও মোবারক হোসেনকে ‘পাগল’ অভিধা দিয়ে সরে পড়বে!

মেয়েরা সাধারণত একের সঙ্গে অন্যের তুলনা সহ্য করতে পারে না। সেলিব্রেটিদের কথা অবশ্য ভিন্ন। তারা সাধারণের কাতারে পড়ে না। তাদের অনুকরণ করে অনেকেই বর্তে যায়। দীপিকা অনেক বড় তারকা। তার কথা বললেও কি তেমনটা ঘটবে? অনুমান করা কঠিন। ঘটতেও পারে। লিপি-ডালিয়ার মন বোঝার ক্ষমতা স্রষ্টা মোবারক হোসেনকে দিয়ে পাঠায়নি।

এইচএন/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।