আমার বাবা সেলিম আল দীন
শ্রেণিপাঠ্যে আমার মন ছিল কম। পাঠের চেয়ে অপাঠ্যে বরাবরই মন ছিল বেশি। পরীক্ষায় কি আসবের চেয়ে কি আসবে না, সে সবই পড়তাম অধীর আগ্রহ ভরে। এ স্বভাব আমার চিরকাল। অস্থিরতা সেও ছিল বরাবরই। হয়তো সে কারণেই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়া। বিজ্ঞান, ইংরেজি সাহিত্য, নাট্যতত্ত্ব। নাট্যতত্ত্ব পড়তে এসেই সেলিম আল দীনের সঙ্গে পরিচয় এমনও নয়। বরং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাব, কিন্তু বের হতে পারছি না। আমাকে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না, এমন একটি সংকট মুহূর্তে তিনি আমাকে রীতিমত তল থেকে টেনে তোলেন। মনে আছে, আমার লেখা একটি আবেদনপত্রে তিনি লিখেদিয়েছিলেন, শ্রেণি কক্ষে ২০০% উপস্থিতি রয়েছে আমার যাতে কর্তৃপক্ষ আমাকে পরীক্ষা দিতে দেয়। তার কাছে বিষয়টি খুব আনন্দের ও গর্বের ছিল যে, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি সাপ্তাহিক ২০০০ এ শিক্ষার্থী থাকাকালীনই সহকারী সম্পাদক হিসেবে চাকরি করি। ২০০০ এর সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী তার বন্ধু। শাহাদত চৌধুরী নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সেলিম আল দীন তিনজনে মিলে একজন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গে অতো দেখা হতো না, যতো দেখা হতো বাইরে। আমি যা না তাই হয়তো ভাবতেন আমাকে। করাতেও চাইতেন। আমরা কজন মিলে আফজাল হোসেনের মাত্রা’য় কদিন ধারাবাহিক নাটক লিখলাম তার সহকারী হিসেবে। কেন শুধু সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত, কেন গদ্য লিখি না, কেন কলাম লিখি না, তার অন্ত ছিল না রাগের, আমার উপর। তাবৎ বিষয়ে আমার কৌতূহল। তথ্যের রাক্ষুসে ক্ষুধা। সেও জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। খুব অবাক হয়েছিলাম ছাত্রজীবনে জয়নাল হাজারীই প্রথম তাকে বিদেশী সাহিত্যের বই দিয়েছিলেন পড়তে, এ কথা শুনে। খুব কবি হবার ইচ্ছে ছিল তার, আর নির্মলেন্দু গুণের নাট্যকার। একটা কাগজের ঠোঙা পড়ে থাকলেও সেটা পড়তেন। কী শিল্প, কী বিজ্ঞান, কী ধর্মতত্ব, কী দর্শন, কী রাজনীতি, কী শরীরবিদ্যা, কী যৌনতা, জানতেন না- এমন বিষয় নেই। রামায়ন, মহাভারত, ইলিয়াড, অডিসি, মেঘনাদবধ পড়তে বাধ্য করেছিলেন রীতিমতো। রাষ্ট্র ক্রমশ রাষ্ট্রহীনতার দিকে যাচ্ছে। জাতিসংঘ কেন রাষ্ট্রসংঘ নয়? গ্রামসি আর মেকিয়াভেলির তত্ত্ব নিয়ে তুমুল তর্ক। উত্তরাধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে সক্রেটিস বা প্লেটোর থিওরি, আলোচনা হতো না কি নিয়ে? পতিতাদের সিম্বল যে ‘পেনসিল হিল’ সেটাও জেনেছিলাম তারই কাছে। তাই তো, পর্ণ ভিডিওতে সবই তো খুলছে, কেবল পেনসিল হিল ছাড়া! অনেক পরে জেনেছিলাম আন্তনচেখভ চিকিৎসক ছিলেন। হাফিজ, হোমার, রবীন্দ্রনাথ, ফ্রয়েড, লালন। কাজল রেখা, কাঞ্চনকন্যা। গণহত্যার ইতিহাস। অপারেশন সার্চ লাইট। বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু। নতুনভাবে ও ভঙ্গিতে পরিচয় করিয়ে ছিলেন। বিশ্বসভ্যতার তাবৎ ইতিহাস, মানব আহরিত জ্ঞান সব এক আলোক সুরঙ্গের পথে নিয়ে এসে লিখেছিলেন নিমজ্জন। সেলিম আল দীনের জীবদ্দশায় সব শেষে নাটক। নিমজ্জনের প্রথম প্রদর্শনী তার সঙ্গে, তার পাশে বসেই দেখেছিলাম। নিঃসন্দেহে দুর্লভ অভিজ্ঞতা। এমন ভয়াবহ চিত্রকল্প, দৃশ্যকাব্যের মঞ্চ ভ্রমণ সেলিম ভিন্ন সম্ভবই নয় কারো পক্ষে, প্রাচ্যে কিংবা প্রাশ্চাত্যে। তাবৎ দুনিয়ার সভ্যতার ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস। আর অনিবার্য সম্মুখ বাস্তবতা, ফোররিয়েলিজমের দুর্বিষহ দুর্বিপাকের ঘোরে আজকের বাংলাদেশ, কেবল পারেন সেলিম আল দীনই তুলে আনতে।
নাটক শেষে পথে যেতে যেতে বেশ কবার জানতে চেয়েছেন, কেমন লাগলো? উত্তর দিতে পারিনি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলেছিলাম, আপনি মানুষ না। মানুষ এমন নাটক লিখতে পারে না। এটা তো নাটক না। নাটক বলছেন কেন? আশ্চর্য রকমের খুশি হয়েছিলেন। জড়িয়ে ধরেছিলেন। আসলেই নিমজ্জন নাটক না, আবার নাটক। দ্বৈতাদ্বৈতবাদের যে তত্ত্ব তার, এ তারই ফসল।
তাবৎ জ্ঞানী, গুনী, মেধাবী, চকচকে মানুষ তার চারধারে চিরকালই ঘুর্ণায়মান। আমি ছিলাম বরাবরই দূরে। তিনি দূর থেকে আমাকে কাছে ডেকেছিলেন, টেনে ছিলেন। সে এক গভীর টান। প্রতিদিনই কথা হতো। তার সহকারী স্বকৃত নোমানের অনেক কাজের একটি ছিল ক’দিন পর পর আমার মোবাইলে ফ্লেক্সি করে দেয়া। আমি যেন তাকে ফোন করি। প্রতিরাতে। ফোন তাকে আমি ফ্লেক্সি করে না দিলেও করতাম। কেন আমাকে যে কোন কিছু চাইবার আগে দিতেন। কেন আমাকে দেখবার জন্য ডেকে পাঠাতেন। কী আমার মন্দ লাগে, কী ভালো লাগে আমার, কীসে মন খারাপ হয়, ভালো হয় কিসে? কিছুই তার অজানা নয়। এমন তো কেউ নই আমি। যে আমি এমন তুচ্ছ, এমন তৃর্ণ, এমন মোটেও দুষ্প্রাপ্য নই, সে আমাকে, আমার প্রতি এত ভালোবাসা তার?
চমকে উঠেছিলাম তার আত্বজৈবনিক রচনা ‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’ বইটি হাতে নিয়ে। উৎসর্গ পত্রে লেখা পুত্রপ্রতিম জব্বার হোসেন। আমি? আমাকে উৎসর্গ? পুত্র নয়, তবুও পুত্রাধিক ভালোবাসা তার, আমার প্রতি। ‘ভাঙ্গা প্রেম অশেষ বিশেষ’ এই আবিষ্কার করি, তার মৃতপুত্র মঈনুল, যে বেঁচে থাকলে হয়তো আমার মতোই হতো! বইয়ের পাতায় চোখ, তবুও চোখ বইয়ে নেই। ভেতরে তুমুল নিঃশব্দ আর্তনাদ। ভাঙচুর, ভাঙচুর। ভেতরে আর্তনাদে আকাশ বিদীর্ণ হয়।
হায়! কোনোদিন একটি বারের জন্যও তাকে বাবা বলে ডাকা হলো না আমার!
এইচআর/আরআইপি