মাধুরীলতা

সাখাওয়াত হোসেন সুজন
সাখাওয়াত হোসেন সুজন সাখাওয়াত হোসেন সুজন
প্রকাশিত: ০৬:৫৭ এএম, ১১ আগস্ট ২০১৫

মাধুরীলতা
সাখাওয়াত হোসেন সুজন

তুমি এখন আর সেই ছোট্ট মেয়েটি নেই। যাকে দেখলে স্কুল পড়ুয়া কোনো মেয়েই মনে হত। বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছিঁড়ে যখন জানতে পারলাম পড়াশুনা শেষ করে এখন গবেষণা করছ শিক্ষা নিয়ে তখন অবাক হয়ে যেতাম। ভাবতাম সবসময়ই দুর্বল দুর্বল দেখা যায় যাকে সে এত এগিয়ে!

আজ গুনে গুনে আটাশ বছর পর তোমার কাছে এলাম তোমার সাথে দুটো কথা বললাম। এতদিন ধরে যে আমাদের দেখা হয়নি তা নয় দেখাওতো হয়েছে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে। বিশেষ করে আমাদের সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তুমি আসতে প্রায় নিয়মিতই। বেশ কিছুদিন তা প্রায় আট বছর হবে তুমি আসতে না।

একনজর দেখতে মনটা কেমন যেন উসখুশ করত। একটানা আট বছর! ফেসবুকে জানলাম তুমি দেশের বাইরে উচ্চতর গবেষণা করছ। সাথে তোমার স্বামীও। অনলাইনেই জেনেছিলাম তিনি অনেক বড় একজন ইঞ্জিনিয়ার। যাহোক এখন তুমি নামের আগে ড. ব্যবহার করছ। ড. মাধুরীলতা। পৃথিবীতে মাধুরীলতা অনেকেই থাকবে হয়ত। তবে মাধুরীলতা কে সেটা আর কেউ জানে না আমাদের সংগঠনের লোকেরা ছাড়া। সেই সাহিত্যমনা সংগঠনের সাহিত্যপ্রেমী লোকগুলো যাদের সখ্য অনেক বেশি এবং সকলের কাছে ঈর্ষনীয়। তোমাকে মাধুরীলতা ছাড়া আর কোনো নাম না দেয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

তবে আরও বেশি দুঃখ পেলাম তোমাকে রোগী হিসেবে দেখে। কিন্তু মন্দের ভাল হল আজ তুমি বেশ অসুস্থ বিধায় আমার সাথে কথা বললে। আটাশটা বছর কথা হয়নি! কোন মান অভিমান প্রেম কিংবা ভালবাসার ছন্দপতনে আমাদের এরকম হয়েছিল তা বলতে পারব না। আমরাই দুজন দুজনার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছি কোনসে কারণে তা কেউই বলতে পারবে না। দলের সবাই ভাবত আমাদের কিছু একটা হবে হবে কিন্তু দিনের পর দিন কেটেছে, বছরের পর বছর চলে গেছে আমাদের মধ্যে কেবল কথা বন্ধ হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি।

কথা হয় না কেন? এমন এক প্রশ্নের জবাব দলের একজনকে একদিন দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমি কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাইনা শুধু তাই না, জড়ানোর চেষ্টাও করিনা। আর করবইবা কেন, আমি গ্রাম থেকে শহরে আসা একটা ছেলে আমার আর তোমার জীবনমান একেবারেই আলাদা। বিস্তর ব্যবধান দুজনের মিলটা শুধু একজায়গায় দুজনেই সাহিত্যপ্রেমী।
আজ তোমার সাথে আমিও কাঁদলাম হালকা হওয়ার জন্য। ওদের জন্য আগে কতবার কাঁদতে চেয়েছি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয় কিন্তু পারিনা পুরুষ মানুষ বিধায়। আজও যখন টিএসসিতে গিয়ে দোকানদারকে চা দিতে বলি তখন দুকাপ বরাবরই বেশি বলে ফেলি। গুনতেই হয় না চারজন থাকলে ছয়কাপ আর ছয়জন থাকলে আটকাপ দিতে বলি।
দুজন কম! বন্ধ হয়ে আসতে চায় আমার দম। ওরা আর কোনোদিন আসবে না চলে গেছে আড্ডার আসর জমিয়ে আড্ডার নেশায় সকলকে মত্ত করে। অনেকেই চলে গেছে তবে ওদের মত করে নয়। কারও বিয়ে হয়েছে ঢাকার বাইরে। কেউ আবার জীবিকার জন্য। আমি যতই বলি চায়ের দোকানদার রুবেল দুকাপ কমই দেয়। ওতো জানবেই আটাশ বছরের জানাশোনা।

ডাক্তার আপু সেসময় বাইরে ছিলেন। তিনি এলেন রুমে। তোমার আমার দুজনের চোখেই পানি দেখে বললেন বিষয়টা কি? আমিই বললাম মান্নাদের কফি হাউসের মত ধীরে ধীরে আমাদের কজন...আপু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ‘আমিই তোমাদের মধ্যে বয়সে বড় ছিলাম অথচ অল্প বয়সী দুজন ঝড়ে গেল অকালে।’পরিবেশ সামলাতে আমি বললাম, ‘আপু আটাশ বছরে আপনার চেহারায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর ওর (মাধুরীলতার) দেখুন চুল কেমন পেঁকেছে। আর আমারতো অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে। যাহোক এজন্য আপনার সাথেতো একটু পরামর্শ করতে পারি।’

আপু তার স্বভাবসুলভ সেই অসাধারণ হাসিটা হাসলেন। পৃথিবী বদলে গেছে বদলায়নি আপুর হাসিটার ধরন। তুমিও হাসলে তোমার মত করে। তুমি হাসলে মোটেই সুন্দর লাগে না, তবে হাসির ভঙ্গি করলে তোমাকে অসাধারণ লাগে। চমৎকার একটা মাধুর্য দেখা যায়। আপু আজ এরকম একটা প্রশ্ন করে এই বয়সে আমাকে বিপাকে ফেলে দেবে এমনটা কল্পনাও করিনি। প্রশ্নটা শুনে তুমিও অনেকটা চমকে উঠলে। ‘ও আর কি বলবে, বলবে সবাই মিলে ওর মত একটা নিরীহ মানুষকে আমরা বিপাকে ফেলেছি বরাবর ইত্যাদি ইত্যাদি।’ সবাই দরজার দিকে তাকালাম দেখি কেরানীগঞ্জ ওয়ালা রিপন ভাই সপরিবারে এসেছেন।

উঠে গিয়ে হাত মেলাতে গিয়ে আরও বিপাকে পড়লাম। ভাইয়া, ‘হাত ধরে বললেন, বলত ভাই আমরা কি দুজন মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছি?’ আপুর প্রশ্নটা ছিল এরকমই। তবে একই বললে ভুল হবে আরও উচ্চমান সম্পন্ন। ‘তুমি ওকে (মাধুরীলতাকে) ভালবেসেছিলে কি না? হ্যা অথবা না এ জবাব দেবে। ঘোরাবে না, প্যাঁচাবে না।’

আমার মধ্যে সেই লাজুকতা ফুটে উঠল যা একবিংশ শতাব্দীতে মেয়েদের মধ্যেও দেখা যায় না। আর তোমার তাকানোর ভঙ্গিটা দেখে মেজাজটা কিছুটা খারাপ হল, মুখ হা করে লাজুক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলে। আমি বললাম, ‘ওটা কোনো কালেই ভালবাসা ছিলনা ছিল ভাললাগা যার পরিণতি কোনোদিনই ভালবাসার দিকে যায় নি।’

পিনপতন নিঃস্তব্ধতা পুরো কক্ষেই। কেউ কথা বলছে না। ভাবীই মৌনতা ভঙ্গ করে বলল তোমার বউ কই? আমি বললাম, ‘সেই আমাকে বারডেমে নামিয়ে দিয়ে গেল। বাচ্চাদের জন্য কি যেন কিনবে। একটু পরেই হয়তবা আসবে।’ ‘ওর ( মাধুরীলতার) কথা কোনোদিন বলেছ ওকে?’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, জীবনের বাঁকে পথে প্রান্তরে কত সম্পদ এসেছিল সামনে কিছুই ধরে রাখতে পারিনি। আমিই অপাত্র। মূল্যবান কিছুই ধরে রাখতে পারিনা এবং পারিওনি। আর এসব কথা বলে সংসারে খুনসুটি থেকে বিপর্যস্ত ঝগড়ার দিকে যাওয়ার দরকার কি!

ভাবী বললেন, জীবন সে তো চলেই গেল। ক্ষণের ক্ষণিকসময়গুলো বেদনায় মলিন হয়ে যায়। পুরুষের করোটিতে তোমার নারীর মস্তিষ্ক। এত চাপা হয় মানুষ তাও আবার পুরুষ মানুষ। ডাক্তার আপু উচ্চস্বরে হেসে বললেন, পুরুষের করোটিতে স্ত্রীর মস্তিষ্ক! একথাটাতো আমি ভাবিওনি কখনও।

আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার দিকে তাকাচ্ছিলাম। ভাবলাম হয়তবা তোমার কষ্ট হচ্ছে। আপু ব্যাপারটা বুঝতে পারল সাথে সাথেই তোমোকে বলল, তুমি শুয়ে পড়। শুয়ে থাকলেই তুমি আরাম বোধ করবে। আর তুমিও শুয়েই পড়লে। স্পষ্ট অনুভব করলাম তোমার আরামবোধ হচ্ছে। আপু আমাকে বলল, জীবনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো এভাবেই পড়ে রয়। নিদারুণ লাগছে দুটি নদীর গতিপথ শেষে এক জায়গায় না মিলে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে গেছে।

রিপন ভাই বলল, এ বোধহয় কোনোদিন কারও হয়নি। আমি বললাম, আমি অনেকেরই হয়েছি কিন্তু অনেকেই আমার হয়নি। বেজে উঠল ফোন। দেখি সঙ্গী! মানে আমার স্ত্রী। এভাবেই সেভ করা। আর ওরটাতে আমার নম্বর সেভ করা সাথী বলে। রিসিভ করে ওকে রুম নম্বর বললাম। ও একটু পরেই চলে এল। ও এসে রুমে ঢোকার দুই মিনিটের মধ্যেই তোমার স্বামীও চলে এল। কি কাকতালীয়! আজ তুমি আমার স্ত্রীকে প্রথম দেখছ আর আমিও তোমার স্বামীকে প্রথম দেখলাম সামনা সামনি। আগে ছবিতে দেখেছিলাম।

আমি তাকিয়েছিলাম তোমার স্বামীর দিকে আর তুমিও তাকিয়েছিলে আমার স্ত্রীর দিকে। আর রুমের সবাই তাকিয়েছিল আমাদের দিকে। আমার স্ত্রী সোজা গিয়ে তোমার পাশে বসল আর তোমার প্রকৌশলী স্বামী আর কোনো জায়গা না পেয়ে কৌশলে আমার পাশেই বসল।

আমাদের সবার আলোচনার ধারা বদলে গেল সময়ের মত। অনেকক্ষণ কথা হল হয়তবা আরও কিছুক্ষণ হতে পারত। কিন্তু ডাক্তার আপু সবাইকে বললেন, সবার এখন চলে যাওয়া উচিত। রোগীর এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা ঠিকই বুঝলাম উনি কি চান! উনি চান না সেই বিষয়গুলো আবার আলোচনার প্রসঙ্গ হোক। আর আলোচনা না হওয়াই ভাল। আমরা সবাই বের হয়ে এলাম। সাবলীল ভঙ্গিতে চোখের ইশারায় তোমার কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমি। আর দেখা হবে অথবা হবে না কারণ তোমার অবস্থা খুব এটা ভাল না। সেদিন বাসায় ফিরে অনেকক্ষণ গম্ভীর থাকলাম। কিন্তু গম্ভীরতা ভাঙ্গল আমার জীবন সঙ্গীনি। তার কাছে আমি চিরদিন হার মেনেছি। ব্যালকোনিতে বসে ছিলাম। সন্ধ্যায় সে এসে এককাপ চা দিয়ে বলল, চলে যাওয়া সময় আর সেই সময়ে হয়ে যাওয়া টুকরো জীবনের গল্পগুলো নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। চা টা খেয়ে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আস, বলেই সে চলে গেল।

আমি তার পথের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। কৃতজ্ঞ হয়ে স্মরণ করলাম মা বাবার কথা। উনারা আমার অগোছালো জীবনটা গুছানোর জন্য উপযুক্ত একজনকেই আমার জীবন সঙ্গীনি হিসেবে বেছে দিয়েছেন। মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম ঠোঁট নাড়িয়ে, নামটি মাধুরীলতা মনে মনে থাক সে...

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।