রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছানো


প্রকাশিত: ০৬:৫৮ পিএম, ০৫ আগস্ট ২০১৫

আমরা কয়জন নিজেরা নিজেদের কাছে পৌঁছাতে পারি? নিজের কাছে পৌঁছানো মানে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা আসলে জানি না যে সেখানে কী করে পৌঁছানো যায়। উপায় তো আছেই, উপায় থাকে। সেটাকে খুঁজে নিতে হয়, চিনে নিতে হয়। চাই আত্মজ্ঞান। এর জন্য সবচেয়ে সুন্দর করে আমরা যার কাছে সাহায্য পেতে পারি তিনি রবীন্দ্রনাথ। (কারণ তিনি নিজের কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যটা একেবারে শুরুতেই ঠিক করে নিয়েছিলেন। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি পড়লেই তা স্পষ্ট টের পাবেন যে কেউ। কারো কারো মতে এই কবিতাটাই তাঁর পুরো সাহিত্যজীবন ও সংগীতজীবনের ভূমিকা।)
 
সহসা আজি এ জগতের মুখ
       নূতন করিয়া দেখিনু কেন?
একটি পাখির আধখানি তান
       জগতের গান গাহিল যেন!
জগৎ দেখিতে হইব বাহির
       আজিকে করেছি মনে,
দেখিব না আর নিজেরি স্বপন
       বসিয়া গুহার কোণে।
আমি       ঢালিব করুণাধারা,
আমি       ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি       জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
       আকুল পাগল-পারা;
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া,
       দিব রে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব
হেসে খলখল গেয়ে কলকল
       তালে  তালে দিব তালি।
তটিনী হইয়া যাইব বহিয়া--
যাইব বহিয়া--যাইব বহিয়া--
হৃদয়ের কথা কহিয়া কহিয়া
       গাহিয়া গাহিয়া গান,
যত দেব প্রাণ       বহে যাবে প্রাণ
       ফুরাবে না আর প্রাণ।
এত কথা আছে       এত গান আছে
       এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে        এত সাধ আছে
       প্রাণ হয়ে আছে ভোর।

কিন্তু তাঁর কাছে কি পৌঁছানো সহজ কোনো ব্যাপার? অনেকে ভাবতেই পারেন স্রেফ তাঁর রচনাগুলি পড়া কি গান শোনা, বা তাঁর রচিত নাটকগুলি দেখার ভেতর দিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু আসলে কি তা-ই? অনেক প্রশ্ন আছে। তাঁর মৃত্যুর পরও তিনি আমাদের হাজার হাজার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন। কী করে তাঁকে পাবো- এটা তার প্রথম প্রশ্ন।

একজন মহাক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোর তো নানান উপায় আছে। প্রথম উপায় বিভিন্ন লোকের কাছে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া। তার কাজ এবং তার কাজের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ঘটানো। এরপর ধীরে ধীরে তার সবচেয়ে কাছের লোকটিকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করা। আমাদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের মতো মহাক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের সঙ্গেও এই পদ্ধতিতে এগুনো যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও তিনিই নিজেই আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়তাকারী। তিনি নিজেই আমাদের প্রত্যেকে, যারা তার দিকে এগুতে চাই, তাদের আপন করে নিতে পারেন। একবার আপন হয়ে উঠতে পারলে তার সঙ্গে আর আলাদা দিনক্ষণ ঠিক করে দেখা করবার দরকার পড়ে না। নিত্যই তার সঙ্গে আলাপ করা যায়। যখন যেখানে খুশি। কিন্তু এরজন্য নিশ্চয়ই একটু খাটতে হয়। সেই খাটনিটার উপায়গুলো আমরা দেখে নিতে চাই একই সঙ্গে দেখে নিতে চাই তার দিকে না পৌঁছনোর বিপত্তিগুলোকেও।

তার সম্পর্কে অসংখ্য বইপত্র আছে। সেই বইপত্রগুলোর ভেতরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লেখকদের রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথের দিকে এগুতে বিশেষ সহায়তা করবে নিশ্চয়ই। অবশ্য পাশাপাশি তার রচনাগুলোও পড়তে হবে। এক সময় ঝিনুক নামের একটি সংস্থা রবীন্দ্রনাথে রচনা একসাথে করে সাজিয়েছিল। তাতে তার সমস্ত কবিতা তিন খণ্ডে, গল্পগুলো একখণ্ডে পাওয়া যেত। এভাবে সাজানো ছিল তার উপন্যাস, প্রবন্ধাবলী, নাটক এবং অন্যান্য রচনাও। অনেকেই এভাবে আলাদা করে তার সবগুলো সমগ্র কবিতা, গল্পের সংকলন, বা উপন্যাস-সমগ্র, প্রবন্ধ সমগ্র, নাট্য সমগ্র সংগ্রহ করে তার দিকে এগুতে চান। তার দিকে এগুনোর জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় রবীন্দ্র-রচনাবলী পাঠ। কিন্তু তার সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে মূলত পাওয়া যায় তার কাজগুলোকে, ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথ তখনও কেমন একটা দূরত্বে অবস্থান করছেন। তাহলে ১৮ খণ্ড রচনাবলী পড়েও অচেনা রয়ে গেলেন তিনি?

রবীন্দ্রনাথ তো নিজের সম্পূর্ণ আত্মজীবনী লিখে যাননি। আত্মজীবনী লেখেননি তলস্তয়, দস্তয়েভস্কির মতো লেখকরা। কিন্তু তারা ডায়েরি লিখেছেন। চিঠিপত্রও কম লেখেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো এতজনকে এত চিঠি লিখেছেন কেউ? লিখেছেন হয়তো, সেই চিঠিপত্রেই আদতে রাখা আছে ব্যক্তি-রবীন্দ্রনাথ। এর পর আমরা যেতে পারি তার অনন্য দুই জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রশান্তকুমার পালের কাছে। এবং তারপর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে লেখা তার সমকালীন লেখক ও পরবর্তীকালের লেখকদের রচনার কাছে।

তারপরও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাকি থেকে যান। তার গান ও চিত্রকলার এর বাইরে থেকে যায়। থেকে যায় মানে আমরা এখনো এর কথা বলিনি। ফলে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক এবং চিঠিপত্র নিয়ে তৈরি তার রচনাবলীর সঙ্গে তাঁর সংগীত ও চিত্রকলা অভিনিবেশে সঙ্গে লক্ষ করার ভেতর দিয়ে কোনো একজন রবীন্দ্রনাথকে পেতে পারেন। পেতে পারেন তার নিজের মতো করে। বুঝে নিতে পারেন নিজের মতো করে। আসলে রবীন্দ্রনাথ বুঝে নিতে হয় আমাদের প্রত্যেকের নিজের মতো করে। সেই পারার আবার একটা শৃঙ্খলা আছে। সেটি হল তাঁর ধারাবাহিকতার শৃঙ্খলা। এবং তিনি যে সময় কোনো কবিতা লিখেছেন ঠিক সেসময তিনি আর কী করেছেন কোন গান লিখেছেন, লিখছিলেন কোন উপন্যাস বা গল্পের কতটুকু, ভাবছিলেন কোন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার কথা বা কোন নাটক লিখবার চিন্তা করছিলেন বা লিখছিলেন সেইসবই তাঁর চিঠিপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। তারপরও কি বাকি থেকে যায়? হ্যাঁ বাকি থেকে যায় সমকালীন ভারত ও বিশ্বের ঘটনাবলীর পাঠ। সেই সমকাল, দেশ এবং তার আশেপাশের নানান মানুষের কর্মকাণ্ডও সমানতালে নজর দিতে হয়। এরপরও কি শেষ? রবীন্দ্রনাথের  চেতনার অন্যতম যে আকর উপনিষদ- সেটিও আমাদের অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করা লাগে। সঙ্গে অবশ্যই ভারতবর্ষে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য।

তাঁর বেড়ে ওঠা যে জোড়সাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সেই ঠাকুর বাড়িতে তিনটি ধারার মিশ্রণ ঘটেছিল বলেই আমরা জেনেছি। ভারতীয়, ইরানি বা পার্সি এবং ইউরোপীয়। আবার অন্যদিকে তিনি ছিলেন বাংলাভাষী জনসমষ্ঠির মানুষ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিখাদ বাঙালি ছিলেন বলে মেনে নিতে পারাটা কঠিন। জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডকে রবীন্দ্রনাথ কোনো কালেই সমর্থন করেননি। আবার এ জায়গাটায় আমরা দ্বিধায়ও পড়ে যাই। যিনি জাতীয়তাবাদের সমর্থন করেননি তার বিভিন্ন রচনায় স্বদেশ প্রেম ও জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার কথাও কম বলা নেই। এমন দ্ব্যর্থকতা তার আরো আছে। বাংলা সাহিত্যেই কেবল নয়, বোধ করি সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের মতো এমন প্রতিনিয়ত দ্বিধায় দ্বন্দ্বে ফেলে দেওয়ার মতো কবি-লেখক-নাট্যকার-সংগীতকার-চিত্রকর আর একটিও নেই। যে ছলনাময় সৃষ্টির পথ ধরে তিনি এগিয়েছেন তাঁকেও যেন অনেকক্ষেত্রে পাল্টা ছলনা দিয়ে এর জবাব দিতে হয়েছে। এতে অনেকে অনেকবার তাকে ভুল বুঝেছেন, আবার এও তিনি জানেন অনায়সে ছলনা সইবার ক্ষমতা যার সেই পায় শান্তির অক্ষয় অধিকার।

(তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু ,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তা ` রে প্রবঞ্চিতে ,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার। )

কিন্তু তিনি কী অনায়াসে সয়েছেন সব? সারাজীবনব্যাপী তিনি যে শ্রম দিয়েছেন তার কোনো তুলনা মেলে না। সুধীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন তার নিজেকে সেই খাটিয়ে নেওয়ার কথা, তেমন করে নিজেকে খাটিয়ে নিতে পেরেছিলেন বলেই একজীবনে দুই জীবনের কাজ আদায় করা গেছে। আসলে আমরা দেখি দুই জীবন নয়, এ তো প্রায় পাঁচজীবনের কাজ, কেউ একে বাড়িয়ে দশ জীবনের কাজও বলতে পারেন, তাতেও আপত্তি করার সুযোগ নেই। তারপরও রবীন্দ্রনাথ আর্তনাদ করেছেন-
             ‘‘কিছুই তো হল না
     সেই সব- সেই সব- সেই হাহাকাররব
     সেই অশ্রু বারিধারা, হৃদয়বেদনা
     কিছুতেই মনের মাঝে শান্তি নাহি পাই,
     কিছুই না পাইলাম যাহা কিছু চাই।
ভালো তো গো বাসিলাম, ভালোবাসা পাইলাম,
এখনো তো ভালোবাসি- তবুও কী নাই”

এই হাহাকার ররে উলটো দিকে আছে অসীম শান্তি, সুখ, আনন্দে উন্মাতাল একজন মানুষের কথাও। আসলে জীবনের যেমন কোনো প্রকরণ নেই, কোনো সীমা নেই, সেই সীমাহীনতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নানান রূপে ও চেহারায় নিজেকে দিয়েছেন। নিয়েছেন বোধ করি তারও অধিক। আমরা সহজেই দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে-সংগীতের ভাণ্ডার খুলে যে তিনি এক বিশাল ভাণ্ডার পেয়েছিলেন, বলেই বোধ করি তার দ্বারা এতটা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, অথচ বাস্তবতা হল রবীন্দ্রনাথের আগে এক বঙ্কিম আর বিহারীলাল ছাড়া সৃজনশীলতার মাত্রায় তেমন কাউকেই পাই না। তাহলে রবীন্দ্রনাথ এত দিলেন কী করে? এর উত্তরও তার রচনাবলীর মধ্যে পাওয়া যাবে না। এই রহস্য স্রষ্টার রহস্যের মতোই অভেদ্য। কেবল আভাসটুকু পাওয়া যায় যে সারা বিশ্বের শিল্পসাহিত্যসংগতি আত্তীকৃত করে তিনি তার নিজের মতো করে সৃষ্টি করার পরিশ্রম করেছেন। তার সেই পরিশ্রমটাই আসলে ওই রহস্যের উত্তর।

আমরা তাকে বুঝবার জন্য একটু একটু করে এগুচ্ছিলাম। তার পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা থেকে স্বদেশ সমাজ হয়ে তার দ্ব্যর্থকতার দিকে গিয়েছিলাম। তার মতো বিচিত্রগামী মানুষকে ধরতে হলে আমাদেরও বিচিত্রগামী না হয়ে উপায় কী। বিশাল জাল পেতে তাকে ধরতে গেলে তিনি ক্ষুদ্র মাছের পোনার মতো হয়ে যান, আবার সূক্ষ জাল পেতে ধরতে গেলে তিনি বিশাল মাছের মতো সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যান। এমনই আকার বদলানো অলৌকিক অবয়ব তার। তিনি তলস্তয়-টমাস মানের মতো উপন্যাস লেখেননি, এলিয়টের মতো কবিতা লেখেননি; তার লেখায় আধুনিকতা খুঁজতে হলে কেউ কেউ গোয়েন্দা নামানোর কথা যারা বলেন, তারা ভিন্ন একটা পরিপ্রেক্ষিত থেকে কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথ যে রবীন্দ্রনাথের মতো আধুনিক সেটি খেয়াল না রাখার কারণে এই জাতীয় কথা ওঠে। আধুনিক গল্প উপন্যাসের প্রতিভূ ফ্রাঞ্জ কাফকা তাকে রিচার্ড হবগনারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বোর্হেস তাকে তীর্যকভাবে দেখেছেন। হিমেনেত দেখেছেন গভীর ভালোবেসে, লাতিন আমেরিকার অনেক লেখক-কবিকে নতুন দৃষ্টি ও কৃষ্টির স্বাদ এনে দিয়েছিল তার কবিতা। বিশ্বের বহুদেশে তার রচনা কত সংকটে ও সম্ভাবনায় কাজে এসেছে সেই অনুসন্ধান আমরা কী করেছি?

অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথায় রবীন্দ্রনাথের কারণেই বাংলাদেশের জন্ম হল। তার গভীর প্রেরণ নিয়ে বাঙালি তার আত্মপরিচয়ের ভূমি খুঁজে পেল। সেই আত্মপরিচয়ের মূলে আছে দুটো বিষয় এক ভাষা দুই তার দেশ। এই ভাষিক ও দৈশিক চেতনা তৈরি করতে তিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। আসলে তিনি পালন করেছেন বললে ঠিক হবে না। বাঙালি মুসলমান তাকে সেইভাবে গ্রহণ করেছে। তাও সমগ্র বাঙালি মুসলমান নয়, বাঙালি মুসলমানের যে অংশটা নিজেদের প্রধানত বাঙালি মনে করে সেই অংশটা।

বাঙালি মুসলামানদের সেই অংশটি তাকে নিজেদের জন্য এমনভাবে কাজে লাগিয়েছে যে তাকে গ্রহণবর্জনের দ্বিধার সমস্তটুকু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কেন কাজে লাগালো তার নিশ্চয়ই গভীরতর কারণ আছে। ভারতভাগের পর পাকিস্তানের অধীনে পড়া বাঙালিরা একেবারে শুরুতেই ঘা খায়। তারা পরিষ্কার বুঝতে পারে যে ধর্মের ভিত্তিতে তারা ৮০ শতাংশের বেশি সমর্থন দিয়ে ভারতভাগে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করছে যা ভারতের আর কোনো অঞ্চলের মুসলমানরা দেয়নি, সেই বাঙালি মুসলমান টের পায় কত বড় ধোঁকা ও ফাঁকির ভেতরে তারা পড়েছে। তারা যতটা মুসলমান তার চেয়েও তারা বাঙালি। এই বাঙালিত্বের মূল অবলম্বন বাংলাভাষা।

রফিক কায়সার তার  “তোমার  আকাশ তোমার বাতাস” প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের রবীন্দ্রনাথকে শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করার কারণটি সহজ ও সুন্দর করে ধরিয়ে দিয়েছেন। তার কথার সূত্র ধরে আমরা দেখি, বাঙালি মুসলমান  ধর্মীয় পরিচয়কে গৌণ করে ভাষিক পরিচয়কে যখন প্রধান করে তুলল, তখন রবীন্দ্রনাথ তার (বাঙালি মুসলমান) ঐতিহ্য ও অনুভবের সত্তা হিসেবে অনিবার্য হয়ে উঠলেন। তার  রচনার ভারতীয় প্রতীতি ও বোধকে বাদ দিয়ে গ্রহণ করা হল বাংলাভাষী কবিকে। রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন তার (বাঙালি মুসলমান)  আশ্রয়, নির্ভরতা এবং সকল বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ম ও সৃজনশীলতার চাবি।

তাই রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে আমাদের এই পরিপ্রেক্ষিতটাও জরুরি। সেই পরিপ্রেক্ষিতের কথা মনে রেখেই পবিত্র সরকার আমাদের জানান, যে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশ নতুন করে জন্ম দিয়েছে, বা তিনি যে দেশে নতুন করে জন্মগ্রহণ করলেন এই রবীন্দ্রনাথকে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা ঠিক ধরতে পারবে না। বাংলাদেশের জন্মের বীজমন্ত্রদাতা কবি, নিজেই ফের বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করছেনে- এ এক আশ্চর্য আদানপ্রদানের ঘটনা বলে তার মনে হয়েছে। ঠিক যেভাবে এখানে জীবনানন্দেরও নতুন জন্ম ঘটেছে। দেশপ্রেম স্বাদেশিকতার প্রতিভূ হয়ে জীবনানন্দের মতো নির্জনতা প্রিয় কবির কবিতা ব্যবহৃত হবে তা এক রকম অভাবিতই ছিল।

পবিত্র সরকার আরো জানান, কী করে রবীন্দ্রনাথ কোরিয়ার নবজন্মের মন্ত্রদাতা হয়ে উঠেছিলেন। তখন কোরিয়ার মহাদুর্দিন। এই সময় রবীন্দ্রনাথ জাপানে গিয়েছিলেন। সেখানে কোরীয় এক তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে তার দেশের জন্য কিছু একটা লিখে দিতে বলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে অল্প কয়েক ছত্রে যা লিখে দেন কোরীয় তরুণ সেই হস্তলিপিটি নিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। গিয়েই সেই কটি কথা  কোরিয়ার প্রধান প্রধান সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা এই যে, যে-কোরিয়া ছিল এশিয়া প্রদীপ, সেই প্রদীপের আলো অচিরেই ততটাই প্রদীপ্ত হয়ে উঠবে। তার এই বাণী কোরীয় জনগণকে এতটাই উজ্জীবিত করেছিল যে কোরিয়ার নতুন জন্মের সূচনা সেদিন থেকেই ঘটতে শুরু করে। চীনে ‘তাইগার’ নামে চেনা এই কবির কবিতা পড়ানো হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের নাজিক্যাম্পে বাচ্চারা তার ‘ডাকঘর’ নাটকটি করতে থাকে যখন তাদের মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। নাটকের মধ্যে দিয়ে বাচ্চাদের মৃত্যু জিনিসটা কী সেটি বোঝানোর চেষ্টা ছিল। আমেরিকায় এক লেখিকার ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডাইং’ বইয়ের মূল প্রেরণা হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা। এর রচয়িতা মৃত্যুপথযাত্রীদের স্বস্তিবিধানের কাজ করতেন। সেই মহিলার কাছে পবিত্র সরকার জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা এভাবে ব্যবহার করেছেন? মহিলা বলেছিলেন, মৃত্যু বিষয়ে বিশ্বের নানান ব্যক্তির, মহা মহা জনের লেখাপত্র তিনি পাঠ করতে গিয়ে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মৃত্যু বিষয়টি আর কেউ এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেননি, এ থেকে তার ধারণা হয় যে- কবি মৃত্যুকে এতটা গভীর করে বোঝেন, তিনি জীবনকেও ততটাই বোঝেন। তার সেই গভীর জীবনবোধকে বুঝতে পারাটাও তাকে বোঝার অন্যতম পথনির্দেশনা।

হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, প্রশ্ন করে করে রবীন্দ্রনাথকে বুঝে নেওয়ার কথা। ভক্তি বা নিন্দা কোনোটাই তার প্রকৃত চেহারাটকে বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। এই ভক্তির কারণে রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনেকের কাছ থেকেই দূরে অবস্থান করেন। তার গান না বুঝে কেবল ব্যাকরণ মেনে শেখার বিপদটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন ওয়াহিদুল হক। এরশাদের শাসনের প্রায় শেষ দিকে তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমরা যারা তার গান গাই, সেটি শেখার চেয়েও যদি আমরা তার গান বুঝতে শিখতাম তাহলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশের এই দশা হত না।

রবীন্দ্রনাথকে খণ্ডিত করে দেখাটাই তাকে বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপদ। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য তার রচনাবলী, তার চিঠিপত্র, তার গান, চিত্রকলা, এমন কি তার কথাবার্তা যারা ধারণ করে রেখেছেন ( তার কথাবার্তা নিয়েও সম্প্রতি কয়েকখণ্ড বই প্রকাশিত হয়েছে), সেসবের কাছেও যেতে হবে। গভীরভাবে পাঠ করা চাই তার জীবনী এবং তার শিল্পসাহিত্য সম্পর্কিত বইপত্রগুলো। নিতে হবে ভারতীয়, পার্সি ও ইউরোপীয় ঐহিত্যের পাঠ। বুঝে নিতে হবে বাঙালি বিষয়ে তার  উপলব্ধির ক্ষেত্রগুলোকে। এর সব থেকে একটি বিষয়ও আমাদের জানা না হয়ে পারে না যে প্রতিটি দিন তিনি কীভাবে ব্যবহার করতেন, তার দিনযাপনের শিল্পটা জানার ভেতর দিয়েও আদতে তাকে বোঝার অনেকটা সম্পন্ন করা যেতে পারে।

কিন্তু এইটুকু জানার জন্যও আমাদের বিরাট শ্রম না দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু মজার ব্যাপার হল তাকে বুঝতে গিয়ে আসলে আরো গভীরভাবে বোঝা হবে নিজেকে, প্রতি পলে পলে জীবনের বিস্ময় ও বিরাটত্বের সমানে আমরা না দাঁড়িয়ে পারব না। তাকে জানা মানে নিজেকেই আরো ভালো করে জানা। সেখান থেকেই তৈরি হয় নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর কাজটা। তাকে জানা মানে এই যে সময়টা আমরা পৃথিবীতে কাটাতে আসি সেই জীবনটাকে জানা। রবীন্দ্রনাথ পাঠ মানে একটা আস্তজীবন পাঠ। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, তিনি তো অনেক কিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু তার সবচেয়ে চেয়ে বড় কীর্তি হল কীভাবে বাঁচতে হবে সেটি দেখিয়ে দেওয়া। হাও টু লিভ- প্রশ্নটার উত্তরই হল রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম। সেটিই তার সবচেয়ে বড় কীর্তি।

মহাকবি ফেরদৌসীর শাহনামার হাত ধরে জেগে উঠেছিল ইরানী জাতীয়তাবাদ। তিনিই আসলে ইরানী জাতির আসল পিতা। ইরানকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একেবারে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তিনি শাহনামা লিখেছিলেন। বলেছিলেন, এই কাব্য লেখার ভেতর দিয়ে আমি ইরানীজাতিকে পুনরুজ্জীবিত করে গেলাম। তার সেই কাব্য আসলে বলে একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ার ভেতর দিয়ে কাউকে ইরানী হতে হয়। শাহনামা যে কত বড় একটি নৈতিকতা সম্পন্ন মহাকাব্য যারা এর স্বাদ নিয়েছেন তারা সেটি খুব ভালো করেই জানেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা ও জীবনও এক মহান নৈতিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের সমানে রয়েছে। সাহিত্যরচনার সঙ্গে যে যেকারো মহৎভাবে বাঁচাটাও জরুরি- এই সহজ বিষয়টি আমরা আর কবে শিখব?

বহু লোক আছেন যারা রবীন্দ্রনাথের লেখা-গান গুলেবেঁটে পান করেছেন, তাদের ভেতরেও সংকীর্ণতা কণা পরিমাণও দূর হয়নি। কারণ রবীন্দ্রনাথের ওই নৈতিকশক্তি, সাহস ও জেদী, একরোখ ব্যক্তিত্বটি এত কিছুর পরও তারা প্রকৃতভাবে বুঝতে পারেননি। তারই নানান ইতরতা দিয়ে ঘেরা থাকেন অসংখ্য রবীন্দ্রগবেষক, শিল্পী এবং পাঠক। এরা জ্ঞান জাহির করার জন্য, গবেষণার জন্য বিপুল সময় ও কালি নষ্ট করেন, নিজেকে জাহির করার জন্য কেবল কণ্ঠ দিয়ে গান করেন এবং চোখ দিয়ে পড়ে সময় কাটান মাত্র। রবীন্দ্রনাথের করুণাধারা একটা ফোঁটাও তাদের বোধিকে সিক্ত করে না।

সত্যিকারে অর্থে একটি প্রকৃত সৎ-সহৃদয় এবং অহমিকামুক্ত মন না নিয়ে যতই রবীন্দ্রনাথ পড়া হোক না কেন, তাতে তাকেও বোঝা যাবে না, হবে না নিজেরও কোনো সমুন্নতি। পবিত্রগ্রন্থ পাঠের আগে যে পবিত্র হতে হয়, জলে সমস্ত মলিনতা ধুয়েমুছে নিতে হয়, তা যে কেবল শরীরের মলিনতাই নয়, বোধবুদ্ধিরও সেই বোধি স্নান না হলে রবীন্দ্রনাথকে মহৎ বলে পূজা করা হবে, অন্তরের অন্তঃস্থলে তার রচনা প্রবেশ করার পথ পাবে না। অন্তরটাকে অহমিকার তেলে তৈলাক্ত করে রাখলে পরমবাণীর জল তাতে কীভাবেই বা মিশবে?

এইচআর/বিএ




পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।