ছোট চাচুর চেন্নাই যাত্রা

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৩০ এএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কলকাতা পৌঁছানোর পরই ছোট চাচু টের পেলেন ঘটনাটা। বাস থেকে নামার পর সোজা চলে গিয়েছিলেন মির্জা গালিব স্ট্রিটে। সেখানে তাঁর বন্ধু থাকার জন্য হোটেল ভাড়া করে রেখেছিলেন।
সন্ধ্যার দিকে, ভাবলেন, নিউমার্কেট থেকে ঘুরে আসবেন। হাঁটতে হাঁটতেই তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন নিউমার্কেটে।
সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ পেছন থেকে এক লোক ঠাস করে পিঠে একটি চড় বসিয়ে দিলেন। ছোট চাচু ঘুরে তাকাতেই তিনি বললেন, “আরে মুকিত যে। কবে এলে কলকাতায়”?
ছোট চাচু অবাক। তাঁকে তিনি চেনেন না। অথচ চাচুর নাম ধরে ডাকছেন। চাচু কিছুটা ভয়ও পেলেন।
বললেন, “আজই এসেছি”।
“কোথায় উঠেছ?”

চাচু বললেন, সত্যি বলবেন না, মিথ্যা বলবেন। হোটেলের নাম বললে যদি হোটেলে গিয়ে ওঠেন। তিনি বললেন,“ওই কাছেই”।
“ও বুঝেছি। মির্জা গালিব স্ট্রীটে” ইরেশানে।’
চাচু আরও অবাক, কোথায় উঠেছেন সেটাও তিনি জানেন।
লোকটাকে চাচু এক বিন্দুও চিনছেন না। কোথাও দেখেছেন বলেও মনে হচ্ছে না। অথচ তিনি দিব্যি কথা বলে যাচ্ছেন।
দাদু বলেছিলেন তুই যদি ইন্টারমিডিয়েট ভালো রেজাল্ট করতে পারিস, তাহলে তোকে যে কোন জায়গায় একা বেড়াতে যেতে দেব।
ছোট চাচু সত্যি ভালো রেজাল্ট করলেন। আর যায় কোথায় । চাচু বললেন“কলকাতা যাব”।
দাদু বললেন কোলকাতা কেন? দেশের ভেতর কোথাও যা, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি বা অন্য কোথাও?
ছোট চাচু বললেন, “তুমিই তো বলেছিলে” যে কোন জায়গায়।
দাদুর সাথে তর্কে জিতে গেলেন ছোট চাচু।
তারপর কলকাতা।

লোকটি দুটো কমলা কিনে ছোট চাচুর হাতে একটি দিয়ে বললেন “ভিটামিন সি, খাও।”
কমলা হাতে নিয়ে ছোট চাচু ভাবেন, লোকটির হাত থেকে কীভাবে বাঁচা যায়।
ছোট চাচু বললেন, “আমার ভীষণ তাড়া আছে। হোটেলে ফিরে যেতে হবে।”

লোকটা হাসেন। বলেন “ভয় পাওয়ার কিছু নেই মুকিত । আমি আসলে বাজিয়ে দেখলাম।”

ছোট চাচু প্রশ্ন করেন, “বাজিয়ে দেখলাম, মানে?”
লোকটি জবাব দেন, “আমি তোমার পরিচিত কেউ নই, তোমার নাম যে মুকিত তাও জানতাম না, মজা করার জন্য বলেছি, মুকিত। ” তা-ই ঠিক হয়ে গেল। ”

ছোট চাচু বললেন“কিন্তু আপনি হোটেলের নাম কি করে জানলেন?”
ওটাও আসলে মিলে গেছে। বাংলাদেশ থেকে যারা আসে, তারা ঐ হোটেলেই বেশিরভাগ সময়ে ওঠে।
“আমি বাংলাদেশের এটা আপনাকে কে বলল?”
“তুমি কথা বলছ, এতে যে কেউ বুঝতে পারবে তুমি এখানকার পাবলিক নও”।
লোকটার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ছোট চাচু সোজা হোটেলে চলে আসেন। হোটেলের রিসিপশনে চাবি নিতে গিয়ে তিনি ভড়কে যান। রিসিপশনের লোকটি বললেন“আপনাকে একজন খুঁজতে এসেছিল। আপনাকে একটি উপহার দিয়ে গেছে।”
আবার অবাক হওয়ার পালা। শুধু অবাক নয়, ভয় পাওয়ারও পালা। হোটেলের রুমে গিয়ে প্যাকেটটি খুলে ফেলেন চাচু। ভেতরে একটি বই ভবঘুরে শাস্ত্র। লেখক সাংকৃত্যায়ন।

বইয়ের ভিতরের পাতায় লেখা, মুকিত অনেক ভালবাসা।
তোমার ভারত যাত্রা শুরু হোক। - রমেশ পাল।
বইটি আজই কেনা। কলেজ স্ট্রীটের একটি বইয়ের দোকানের সিল রয়েছে। সেখানে তারিখও আছে।
কে এই রমেশ পাল? ছোট চাচুর প্রশ্ন।
নিউমার্কেটে যার সঙ্গে দেখা হলো সেই লোকটি নন তো?
রাতে খাওয়ার পর শুয়ে পড়েন ছোট চাচু। কিন্তু কোনক্রমেই তার ঘুম আসছিলো না। বারবার শুধু নিউমার্কেটের সেই লোকটির কথা মনে করেছিল। নানা কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। মাঝেমধ্যেই তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ভোর ছয়টার দিকে হোটেলের বয়ের ডাকাডাকিতে ছোট চাচুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। লোকটি বললেন, “আপনার ট্রেন কিন্তু আটটায়। ট্যাক্সি ডেকে দেব?”
ছোট চাচু ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়েন। আজ তিনি হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে চেন্নাই যাচ্ছেন। ঢাকা থেকেই ট্রেনের টিকেট কিনে রেখেছিল।

দাদু বলেছিলেন, “চেন্নাই যাবি কেন?”
“ঘুরতে যাব। যেকোনো জায়গায় যেতে পারি”
দাদু বলেছিলেন “দর্শনীয় স্থান হলে ভালো হয় না?”
ছোট চাচু গুরুগম্ভীরভাবে বলেছিলেন, চোখ থাকলে সবই দর্শনীয় স্থান হয়ে ওঠে।
কথা শুনে দাদু হাসতে হাসতে খুন, বলিস কিরে তুই দেখি অনেক বড় হয়ে গেছিস।
প্রচন্ড ভীড় হাওড়া স্টেশনে। গিজগিজ করছে লোকজন। প্ল্যাটফর্মে নোটিশ বোর্ড টানানো। সেখানে ছোট চাচু দেখছিলেন তাঁর ট্রেনের নম্বর। হঠাৎ একটি লোক এসে তাঁর কাঁধে হাত রাখেন।
ঘুরে দাড়াতেই দেখেন, তারই বয়সী একটি ছেলে। বলে তুমি নটরডেমে পড়ো না?
ছোট চাচু ঘাড় নাড়িয়ে বলেন জি।
কিন্তু তার মনে পড়ে গতকাল নিউমার্কেটের সব ঘটনা। ভাবেন সে রকম কিছু না তো। পাশের একটি লোককে দেখিয়ে বলে, “আমার বাবা। বাবাকে নিয়ে ভেলোরে যাচ্ছি চিকিৎসার জন্য”।
ছোট চাচু বলেন“আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না” ।
ছেলেটি হাসে“তুমি আমার সাথে আপনি করে কথা বলছো কেন? ”
আমিও তো ধানমন্ডি বয়েজ এ পড়তাম
ছোট চাচা কিছুই মনে করতে পারেন না।
ছেলেটি বলে তুমি কোথায় যাচ্ছ ?

ছোট চাচু বলেন চেন্নাই। এ কথা বলেই তিনি সেখান থেকে কেটে পড়েন।
ছোট চাচুর কেটে পড়া দেখে ওরা দুজনে অবাক হয়। ছেলেটির বাবা বললেন“সত্যিই কি ছেলেটাকে তুই চিনিস”
“অবশ্যই চিনি আব্বু। খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু এভাবে এড়িয়ে গেল কেন বুঝতে পারলাম না”
হাওড়া থেকে ট্রেন দেড় দিনের জার্নি চেন্নাই। সেই দীর্ঘ জার্নিটাকেই বেছে নিয়েছেন ছোট চাচু।
চাচুর সিটটা পড়েছে জানালার ধারে। নানা ধরনের মানুষ। একমাত্র হিন্দি ভাষাটাই তার পরিচিত। আশেপাশে বাংলায় কেউ কথা বলছে না। ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। তাঁর মনে হলো, ভিন্ন এক জগতে ঢুকে পড়েছেন তিনি।
একা জার্নি অসাধারণ। কেউ তাঁকে উপদেশ দিবে না। কেউ তাকে বলবে না এটা করো না। ওটা কোরো না।
ট্রেনটা যখন বিহার পার হলো, তখনই ছোট চাচু দেখতে পেলেন সেই লোকটাকে। নিউমার্কেটে যার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
পাশের সিটেই তিনি বসেছেন। ছোট চাচুকে দেখে বললেন “আমি কি তোমার পাশে এসে বসতে পারি। ”
অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও চাচু বললেন জি বসুন।
লোকটা কাছে বসলেন। বললেন, “আমার নামও কিন্তু মুকিত”।
ছোট চাচু বললেন হাতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
“তার মানে?”

ছোট চাচু বললেন তার মানে হচ্ছে আপনার কথা সত্যি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
তার মানে আমি মিথ্যা বলেছি?
ছোট চাচু বললেন “হতে পারে আবার নাও হতে পারে”
লোকটি একটু রেগে গিয়ে বললেন “তুমি কিন্তু বাকা করে কথা বলছ।”
চাচু বললেন,“আপনি আমার পিছু লেগেছেন কেন?” বলুন তো?
লোকটা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন“আমি তোমার পেছনে লেগেছি মানে। আমি যাচ্ছি চেন্নাই শংকরানেত্রালয়ে চিকিৎসা করাতে।” আর তুমি বলেছ, আমি তোমার পিছনে লেগেছি।
কী হয়েছে আপনার চোখে।
লোকটা বললেন, “আমি সবকিছুই ডাবল দেখি।”
ছোট চাচু মহাত্মা গান্ধীর ছবিওয়ালা দুই টাকার একটি নোট বের করে বললেন“এখানে কয়টা নোট বলুন তো? ”
লোকটি বললেন, তোমার হাতে দুই টাকার দুটি নোট।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলছে না। বাইরের অন্ধকার নেমে এসেছে। মনে হলো ট্রেনটা থেমেছে।
লোকটা বললেন “এখানে ইঞ্জিন চেঞ্জ হবে। ট্রেনে উঠবে নতুন চালক। নামবে নাকি একটু” ।
ছোট চাচু নামার কথা শুনেই ভয় পেয়ে গেলেন। “না ঠিক আছে আপনি নামুন” ।
মুহূর্তেই লোকটি নেমে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু তার আসার নাম নেই। আধা ঘন্টা পরেও এলেন না। ট্রেন চলছে চেন্নাইয়ের দিকে। সারা রাত তাকে দেখা গেল না। ভোর হলো । ছোট চাচ্চু কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন। তিনি কাকে দেখছেন, কী দেখছেন, স্বপ্ন দেখছেন না তো।

না স্বপ্ন নয়। পরের দিন দুপুরের দিকে “করমন্ডল এক্সপ্রেস” চেন্নাই ষ্টেশনে গিয়ে থামলো। কলকাতা হোটেল থেকেই যেনে নিয়েছিলেন কোথায় উঠলে ভালো হয়। চাচু একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলেন চেপক স্টেডিয়ামের পাশে ওয়ালজা স্ট্রীটে। একটি ছোট হোটেলের রিসিপশনের সামনে দাঁড়াতেই তাঁকে অভিনন্দন জানালেন একজন। বললেন, “পাসপোর্ট প্লিজ”।

প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ছোট চাচু দেখেন পাসপোর্ট নেই। ব্যাগের ভেতরও নেই। কোথাও নেই। ছোট চাচুর বুক ধড়ফর করে উঠল। হঠাৎ হাসির শব্দ। ছোট চাচু দেখলে“দোতলার সিঁড়িতে সেই লোকটা দাঁড়িয়ে হাসছেন। বললেন মুকিত উপরে উঠে এসো।”

তার পকেটে হাত দিয়ে পাসপোর্ট বের করে বললেন, “এই দেখো তোমার পাসপোর্ট আমার হাতে। তোমার জন্য এক বেডের একটি রুম ভাড়া করে রেখেছি”।

ছোট চাচু সিঁড়ি দিয়ে উপড়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু সিড়ি যেন আর শেষ হয় না। তার পা অচল হয়ে যায়।

এইচআর/পিআর

রাতে খাওয়ার পর শুয়ে পড়েন ছোট চাচু। কিন্তু কোনক্রমেই তার ঘুম আসছিলো না। বারবার শুধু নিউমার্কেটের সেই লোকটির কথা মনে করেছিল

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।