ইটচাপা ঘাস

ইশরাত জাহান ঊর্মি
ইশরাত জাহান ঊর্মি ইশরাত জাহান ঊর্মি
প্রকাশিত: ১১:৫৯ এএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

পাখির পরণে ছোট জিন্সের প্যান্ট আর বড় ঢোলা গেঞ্জি। চুল চূড়া করে বাঁধা। এই প্যান্টগুলোকে নাকি হট প্যান্ট বলে। বলিউডের নায়িকা দীপিকা পাড়ুকোন নাকি এই প্যান্টকে জনপ্রিয় করেছে। তা করুক। বিভাবরীর অস্বস্তি হয় পাখিকে এই পোশাকে দেখে। তার মধ্যবিত্তিয় চোখ ধাক্কা খায়। অফিসের কাজে বিদেশ গিয়ে এরকম পোশাক পরা টিনএজার মেয়ে দেখে অবশ্য তার কখনো অস্বস্তি হয়নি।

পাখি মানে সানজানা শ্রাবন্তীর একহাতে একটা জার্নাল ধরা আরেক হাতে কাটা চামচে সে সবজি খুঁটে খাচ্ছে। রাতের খাবার। খেতে খেতেই হঠাৎ গলা তোলে,
: মাছের কি হয়েছে? জন্ডিস নাকি? এইসব ঘোড়ার ডিম প্রত্যেকদিন রাঁধো...
সালমা কাছেই কাজ করছিল। সে একটু সচকিত হয়ে জোরে ধমক দ্যায়,
: চিল্লাইতেছ ক্যান? হলুদ কম ছিল তাই তরকারিতে রং হয় নাই। রাত দুপুরে চিল্লাবা না। খাও চুপচাপ।
: চারদিকে সব মুরুব্বী আর ধমকানী, ভাল্লাগে না!
বিড়বিড় করতে করতে পাখি খাওয়ায় মন দ্যায়।
সালমাই পাখিকে বড় করে তুলেছে। তাই ছোটবেলা থেকে তারে ধমকধামক কখনও দু-চারটে চড়-থাপ্পড়ও সালমা অনুমোদিতভাবেই দিয়ে থাকে। বিভাবরী কিছু বলে না। বা দেখেও না দেখার ভান করে। একলা বাচ্চা পালা বিরাট এক পাথর, সালমাই তো সেই পাথর হালকা করেছে তার। তবে পাখী যখন গলা তোলে বা বড়দের মতো কথা বলে ১৫ বছরের মেয়েকে গভীর মনোযোগে দেখে সে। একযুগ আগের বসন্তের সকালটার কথা মনে পড়ে। একটা বিশাল স্যুটকেস (বিভাবরীর বাপের বাড়ি থেকে বিয়েতে দেয়া) ভরা কাপড়-চোপড় আর টুকিটাকি এবং একহাতে পাথীর আঙুল ধরা-বিভাবরী স্বামীর সংসার ত্যাগ করেছিল। চার বছরের পাখী, মোটাসোটা, গায়ে গোলাপী আধময়লা একটা ফ্রক, তার হাতে একটা আধ খাওয়া আপেল আর একটা সফট টয়। খানিক পরপর সে আপেলে কামড় দিচ্ছিল আর ভালুকটার মুখেও আপেল ধরছিল। তখনও সে জানে না আগামী কয়েকটা বছর মায়ের সাথে লড়াই এ শামিল হতে হবে তাকে, তখনও সে জানে না বেশ একটা কঠিন সময় তাকে পার করতে হবে। পাখির দিকে তাকালেই সেই সকালটার কথা মনে পড়ে বিভাবরীর।

: মা শোন, আজ কোচিং-এ আয়ানকে কষে একটা থাপ্পড় মেরেছি।
পাখী ক্যাজুয়ালি বলে।
বিভাবরীর বুকটা ধক করে ওঠে। এই মেয়েকে নিয়ে কি করে সে!
: কি বললি তুই?
: ওই তো...
আবার ব্রেক কষে,
: সালমা বু তোমারে বলছি না আমারে ঠান্ডা পানি দিবা, গরম তো পড়ছে না কি?
বিভাবরী কোনদিকে মন দিতে পারে না, অধৈর্য গলায় বলে,
: কি হয়েছিল বল?
: থাপ্পড় মারছি। শুন তুমি এরকম করছো কেন? মা প্লিজ তুমি একটু অতিরিক্ত ভাবা বন্ধ করবা?
বিভাবরীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। সে ক্ষীণ গলায় বলে,
: এই মাস্তানির ফল কি হতে পারে তুই জানিস? কোচিং-এ এই কাণ্ড, টিচার কই ছিল?
পাখি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে আছে। মাছ বাছতে বাছতে বলে,
: ছিল কোথাও। আয়ানটা বাড়ছিল বেশি বুঝছো মা, ওড়না পড়ি না ক্যান, রোদসী কেন মোটা, রাইসা কেন বেশি শুকনা এইসব নিয়ে সারাক্ষণ টিজিং, ওরে আমি ডরাই বলো?

বিভাবরী কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারে না। এই মেয়েটা কি তার শাসনের বাইরে চলে গেল? সে কি মেয়ে ঠিকঠাক মতো বড় করতে পারল না? সেদিন ফোনে শাশুড়ি কতগুলো কথা শোনাল। মেয়ে বড় হচ্ছে, যেসব পোশাক-আশাক পরে বাইরে যায়, যেসব ভাষায় কথা বলে, পড়াশোনা শিকায় তোলে- সেসব কিছু নিয়ে তার আপত্তি, শঙ্কা। একগুঁয়েমি করে সংসার ছেড়েছে সে ঠিক আছে, কিন্তু তার বংশের বাতি যদি উচ্ছন্নে যায় তবে তো সেটা ছেড়ে দেয়ার মতো বিষয় নয়-ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভাবরী যে সবকিছু প্রতিবাদহীন শুনে যায় তা নয়। তবে এখন খুব ক্লান্তি লাগে, তাছাড়া ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে তার মুখে মুখে কথাও বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এই ভয়টা তো লাগেই। পাখীর জন্য প্রাক্তন স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কাছে যদি কথা শুনতে হয়। ভয়। কি যে ভয়। এতোকিছু পার হয়ে এসেছে বিভাবরী, নিজে আয় করেছে, সংসার চালিয়েছে, মেয়ে মানুষ করেছে, আত্মবিশ্বাস কত বেড়েছে, তবু মনের ভেতরের অদ্ভুত ভয় এর বীজটা উপড়ানো গেল না কিছুতেই। এখনও বুক কেমন ধকধক করে। পাখীর খাওয়া শেষ। সে ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে বলে,

: মা তোমারে যে এত বলি তুমি চিন্তা করা বন্ধ কর আর একটা বয়ফ্রেন্ড জোটাও, তারে নিয়ে একটু ভাবো টাবো এবং আমারে একটু নিঃশ্বাস নিতে দাও, কথা তো শুনো না, তুমি যে কবে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরবা আর আমারে লিটারেলি এতিম করবা সেইটাই খালি ভাবি...
পাখীর এই ধরনের কথার সাথে বিভাবরী অভ্যস্ত। কিন্তু লিটারেলি এতিম কথাটা শুনে এতক্ষণের ভয়, শঙ্কার বদলে একটা মায়ার চোরা স্রোত বয়ে যায় বুকের ভেতর দিয়ে। পাখিকে ছেড়ে সে কি মরতেও পারবে!

২.
এইসব সুমিতের আর ভালো লাগে না। আজ তার জ্বর। ভোররাতে সাততলার জানালা খুলে রাখলে এই প্রথম বর্ষায় এরকমই হওয়ার কথা। সুমিত একা থাকে। সাততলায় স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। বুয়া এসে রান্নাবান্না করে গেছে সকাল ১১টার মধ্যে। এখন চুপচাপ নির্জীব পড়ে থাকার কথা তার। কিন্তু বিভাবরী ফোন করে করে অস্থির করে তুলছে। তার মেয়ে পাখি কোচিং এ বের হয়েছে তারপর থেকে ফোন বন্ধ-এই তথ্য শুনে সে একটু ঠোঁটের কোণে হাসে। ফোনে সে বলেছে, ফোন বন্ধ তো কি করা...বলেছে। ...কিন্তু এইসব আর ভালো লাগে না। বাড়ি থেকে ফোন করে করে মা অস্থির করে তুলেছে, বিয়ে কর বিয়ে কর। মানব জীবনের এক ও অদ্বিতীয় লক্ষ্যই যেন বিয়ে করা। বিয়ে ছাড়া আর কিছু নাই। সুমিত তো কবিতা লিখতো, দুইটা শর্ট ফিল্মের আর্ট ডিরেক্টর এর কাজ করেছে। জীবনে কতকিছু করার আছে বলে মনে করতো কিন্তু এখন সবকিছু কেমন যেন বিস্বাদ লাগে। একটা প্রেমে পড়ে সবকিছু এরকম আলুনী হয়ে গেল! অথচ প্রেম না কি জীবনকে রঙিন করে! খুব বেশি বন্ধু-বান্ধব সুমিতের নেই, যারা আছে তারা বিরক্ত হয়, গালাগালি করে সুমিতকে। বলে, তোর এতো দরকার কি? তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়, ডিভোর্সি, অত বড় একটা মেয়ে আছে তার উপর সবসময় মুখ আমসী করে রাখে, দেখে মনে হয় সবসময় রেগে আছে, হাসে না কিছু না। তোর এই মহিলার জন্য হেঁদিয়ে মরতে হবে কেন?

সম্ভবত এতগুলো অসমতা আছে বলেই প্রেমটা এরকম গাড় হয়েছে। হয়েছে মানে সুমিতের দিক থেকে হয়েছে। বিভাবরীর দিক থেকে কিছু বুঝা যায় না। সারাক্ষণ টেন্সড। কিন্তু কোমল অথচ টানটান। সুমিত প্রায়শই ভাবে বিভাবরীর শরীরকেই সে ভালোবাসে আসলে? বিভাবরী তো কখনও শরীর শো করেনি তেমন, এক অফিসে এক প্রজেক্টে দুজন কাজ করে তারা। এনজিওর চাকরি। প্রায়ই একসাথে বাইরে যেতে হয়। রাতের জার্নি, একলা গাড়ি। সম্ভবত রাত মানুষকে আলাদা কিছু দ্যায়। এইরকম নীশিথ সব রাত আর বিভিন্ন নির্জন গেস্ট হাউজেই বিভাবরীকে আলাদা চোখে দেখেছে সুমিত। বিভাবরীর কোথাও একটা বেদনা আছে, একটা কিছু টেনশন আছে-সেই সবকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফিরেছে সে। ভালোও বেসেছে। কিন্তু রাতের ডিনার পর্যন্ত। ডিনার শেষে দরজায় কঠিন খিল এঁটে ঘুমিয়েছে বিভাবরী। সুমিত বিভাবরীকে ঠিক মেয়েমানুষ বা বস্তু রূপে দেখেনি, বিভাবরী কেন কোন মেয়েকেই নয়, তাই খিল আঁটা কিন্তু শরীরের তো আলাদা ভাষা আছে, পুরুষ শরীরের কত যন্ত্রণা কীভাবে কাকে বোঝায় সে। একটা সুস্থ স্বাভাবিক যৌনজীবন তো তার পাওয়াই উচিত। শুধু শরীর কেন, মন? এই যে এখন খুব ইচ্ছা করছে একটা হাত স্পর্শ করে থাকুক তার কপালটা। একটু মুখোরোচক কিছু বানিয়ে দিক। একটু গা মুছিয়ে ফ্যানের তলে শুইয়ে রাখুক মাথার কাছে বসে। আবার তারও ইচ্ছে করে বিভাবরীর সকল ঝামেলা আর বেদনার সাথী হবে সেই। কিন্তু বিভাবরী এইসব বোঝে না। না কি বুঝেও ভান করে?

এইজন্যই এসব কিছু আর ভালো লাগে না সুমিতের। জ্বরতপ্ত শরীরে একটু শীতল স্পর্শ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাবরী সারাটাক্ষণ নানান কিছু শেয়ার করে তার সাথে। সুমিত কি পারে কিছু শেয়ার করতে? এইবার চাকরিটা ছাড়তে হবে। এইসব আর ভালো লাগেনা সত্যিই। থাকুক বিভাবরী তার মতো করে, সুমিতের না পালিয়ে সম্ভবত আর উপায় নেই।

৩.
অফিসে দুইটা মিটিং ছিল। বিভাবরী মনোযোগ দিতে পারে না। সকাল থেকে পাখির সেল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। দশটা থেকে ক্লাস শুরু হয় বুধবার, বিভাবরী ১১টায় ফোন করে বন্ধ পেল ফোন। সালমাকে ফোন করে জানলো ঠিক সময়েই বেরিয়েছে। তাহলে ৪৫ মিনিটের ক্লাস শেষে ফোন না ধরার তো কোন কারণ নেই, উপরন্তু ফোন বন্ধ। বেশি ভাববে না ভেবেও অস্থির লাগতে থাকে তার। পাখির ক্লাসমেটকে থাপ্পড় মারার বিষয়টি মাথা থেকে সরাতে পারে না। সুমিত এর ডেস্ক খালি। সে নমঃ নমঃ করে মিটিং সারে। সহকর্মীকে নতুন প্রজেক্ট প্রপোজাল ইত্যাদি ইত্যাদি বুঝিয়ে দিয়ে সে সুমিতকে ফোন করে তার সেল ফোনে। সুমিত এর কণ্ঠ ক্লান্ত।
: হ্যাঁ বলো বিভা।
: তুমি কই? অফিসে আসো নাই কেন?
: শরীর ভালো না। জ্বর।
: আচ্ছা। তার মানে আজ আসবেই না?
: না মনে হয়। কিন্তু বিষয় কি? টেনশনে আছো মনে হচ্ছে।
: পাখি কে নিয়ে একটু কথা ছিল।
ওপাশে খানিক নীরবতা। বিভাবরী হ্যালো হ্যালো করে।
: হ্যাঁ বলো শুনছি।
: আসতে পারবা একটু?
কিছুটা অসহিষ্ণু বিভাবরী। ওপাশ থেকে ক্ষীণ হাসি।
: আমি জ্বরে কাতর হয়ে মরে যাচ্ছি বিভাবরী। আর তুমি আমারে এনেই ছাড়বা অফিসে?
বিভাবরীর কথা শোনার সময় নেই। বলে নর্থ এন্ড এ আসো, আমি বের হবো চারটার দিকে। সুমিত বোধহয় কিছু বলতে চাইছিল, বিভাবরীর শোনার সময় নেই। কিন্তু সুমিত ম্যাসেজ পাঠায়,
আসতে পারবো না আজ। উঠতে পারছি না বিছানা থেকে।
বিভাবরী একটু আগেই অফিস ছাড়ে। চারটা বাজে ঘড়িতে। স্টিল বন্ধ পাখীর ফোন। কি করা উচিত? থানায় যাবে? তার আগে কারো সাথে তো কথা বলা উচিত। সুমিত, সুমিত ছাড়া তো কারো মুখ মনে পড়ে না। কেমন যেন হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তার, বমি বমি লাগে। গাড়ি সে নিজেই চালায়। গুলশান ছেড়ে বনানী দিয়ে বের হয়ে সুমিতের বাসার দিকেই যাবে সে। ইউনাইটেড হাসপাতালের সামনে আসতেই ঝড় উঠে এলো। শুকনো পাতারা উড়ছে। এলোমেলো বাতাস। অন্ধকার হয় আছে চারদিক। গাড়ি টাড়ি বিশেষ নেই। মনে হচ্ছে গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাবে এমন বৃষ্টি আর বাতাস। কি হলো বিভাবরীর গাড়ি একপাশে থামিয়ে বসে রইল। এতো কান্না পাচ্ছে। পাখি জানলে বলতো,
তোমার এইসব নাকি কান্না আমার জাস্ট অসহ্য লাগে মা। সারাক্ষল এতো প্যাঁদাবা তো ডিভোর্স করলা ক্যান? হি ইজ নট আ ব্যাড ম্যান অলমোস্ট। তোমারে আমি বুঝতে পারি না মা। আয় রোজগার করো, এত্ত সুন্দর একটা মেয়ে আছে তোমার, জীবনটাকে উপভোগ করতে পারো না ক্যান বলোতো?

বিভাবরী নিজেও বুঝতে পারে না আসলেই তার সমস্যাটা কি। কেন সে জীবনটাকে এইরকম মরু শুষ্ক বানিয়ে রেখেছে। কেন শরীর জাগে না, মন কেন এতো সাড়াহীন থাকে। কি করে বলে, স্মার্ট মেয়ে পাখি তোরে নিয়ে, তোর ভালো-মন্দ, তোর প্রয়োজন-অপ্রয়োজন দেখেই তো কেটে গেল এতটা বছর...তোর যখন জ্বর হতো বা পেট খারাপ আর তোকে রেখে আসতে হতো অফিসে অথবা তুই স্কুলে, হঠাৎ শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি ওদিকে সালমা তখনও তোকে আনতে পৌঁছায়নি স্কুলে অথবা তোর স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং অথচ আমার অফিসে জরুরি মিটিং কি করে যাবো অথবা প্রতিদিন তোর খুব একলা লাগে ইচ্ছে করে বেড়াতে যেতে কিন্তু আমি পয়সা রোজগার করতে গিয়ে সেই সময় পাচ্ছি না অথবা আমার অফিস ট্যুর দেশের বাইরে আর তুই একা থাকবি বাড়িতে কীভাবে? কারে রেখে যাবো তোর কাছে-এইসব সামলাতে সামলাতে কিছুতেই আর প্রেম জেগে থাকে না, প্রেমে না তখন শুধু কারো কাঁধে নির্ভার একটা কাঁধ রাখতে ইচ্ছে করে, আমি তো বোকা নই, আমি জানি সুমিত কি চায়, কিন্তু জাগে না আর প্রেম। এতোগুলো বছর তো তোর প্রয়োজন মেটানোটাই ছিল আমার একমাত্র কাজ। সেই প্রয়োজনটাকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য সকল আয়োজন। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় ছিল না বা তার চেয়েও বড় কথা নিজেকে নিয়ে ভাবতেই চাইনি। সমাজ যে শিখিয়ে দিয়েছিল, ডিভোর্সি মেয়েদের অত আহ্লাদ করতে নেই, ডিভোর্সি মেয়ে মানে রয়েসয়ে চলা, দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চাইলে লক্ষবার ভাবা। দ্বিতীয় স্বামীও যে ভালো হবে সেই গ্যারান্টি তো কেউ দেয়নি অতএব ডিভোর্সি মেয়েদের অন্যদের চেয়ে অনেক বুঝেশুনে পা ফেলতে হয়। ডিভোর্স শেষঅব্দি মুক্তি কই বরং আরেকটি বৃত্তে বন্দি করে। নারীজন্ম মানেই বৃত্তের জীবন।

৪.
এই প্রথম বার সুমিতের বাসায় এলো বিভাবরী। বৃষ্টি থেমেছে ততক্ষণে কিন্তু আকাশ কালো হয়েই আছে। আবার যেকোন সময় নামবে বৃষ্টি। লিফট নেই। বিভাবরী ধীরে ধীরে উঠে এলো সাততলায়। তাড়া ছিল কিন্তু অবসন্নও লাগছে। দরজা খুলে সুমিত অবাক। বিভাবরী এসেছে! কেন! কোনদিন তো আসেনি। সে একটু সরে জায়গা করে দ্যায়।
: এসো। ঘরে সোফা টোফা নেই, কেউ আসে না তাই কেনা হয়নি। বসবে কোথায়?
বিভাবরী এদিক ওদিক তাকায়। বলে,
: বসা নিয়ে অত টেনশনের কি আছে? জ্বরের কি অবস্থা?
সুমিত হাসে। বলে,
: জ্বরটর নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, হঠাৎ আমার বাসায় কিজন্য তাই বলো। চিনতে পারলে ঠিকঠাক?
বিভাবরীও একটু হাসে বা হাসার ভঙ্গি করে, বলে,
: আমি ঢাকা শহরের অলিগলি চিনি। শোন পাখির ফোন বন্ধ। সকাল থেকে। সালমাও কিছু জানেনা। কি করবো বলো তো?

পুরোন টেনশন ফিরে এসেছে বিভাবরীর।। দীর্ঘ চার পাঁচ ঘণ্টা ফোন বন্ধ পাখির। এইবার তো ছদ্ম টেনশন বাদ দিয়ে সত্যিকারের টেনশনই হওয়ার কথা। বিভাবরী এবার কেঁদে ফেলে। পাঁচ বছরের ছোট একটা অনাত্মীয় ছেলের সামনে কাঁদতে তার লজ্জ্বা লাগে না। সুমিত একটু অস্থির হয়। একটু পাশ ঘেঁষে বসে বিভার। তারপর একটু দম নিয়েই বলে,
: বিভা কেঁদো না। এখন ফোন করো পাখিকে, পাবে। ও বাসায় গেছে।
বিভাবরী ঠিক বুঝতে পারে না পুরো কথাটা। বলে,
: মানে কি? তুমি কি করে জানো? ওর ফোন তো বন্ধ।
: না এখন বন্ধ নেই খোলা আছে। ও এসেছিল আমার বাসায়।
: মানে?
একটা শব্দই বলতে পারে বিভাবরী।
: এসেছিল তোমার মেয়ে। আমাকে বলতে নিষেধ করেছিল কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে না বলে পারলাম না।
: কেন এসেছিল?
চুপ করেই থাকে সুমিত। বিভার কেমন টেনশনটা অন্যদিকে মোড় নেয়। অধৈর্য হয়ে বলে,
: বলো না সুমিত।
সুমিত উঠে যায়। ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ অপশনে যায় তারপর বিভার হাতে ফোন দিয়ে বলে, পড়ো।
বিভার সবকিছু অদ্ভুত লাগতে থাকে। কি পড়বে? কিসের ম্যাসেজ? কে পাঠিয়েছে? ম্যাসেজ পড়ে সে। স্পষ্ট এবং শুদ্ধ বাংলায় পাখি- বিভাবরীর মেয়ে লিখেছে,

সুমিত আংকেল, তুমি মাকে জোর করে বলো। না হলে নিজে থেকে সে জীবনেও তোমার কাছে আসবে না। এই কথাটা বলতেই গিয়েছিলাম আজ। তুমি শুনতেই চাইলে না। মা আসলে ইটচাপা ঘাসের মতো হলুদ হয়ে আছে। আমি এবং এই স্যোসাইটি হলো সেই ইট। ইটটা তুমি জোর করে সরিয়ে নাও আংকেল। মায়ের জীবনটা বয়ে চলে যাচ্ছে। আমি তো তোমাকে বুঝতে পারি। তুমিও আরেক বোকা। কিছুই না বলে কাটিয়েই দেবে জীবন। তুমি প্লিজ বলো মাকে যে তাকে তুমি কীভাবে চাও। যদি এইটা না করো, আমি কিন্তু যা তা করে ফেলবো সুমিত আংকেল। আমাকে তো তোমরা চেনো। প্লিজ প্লিজ।

বিভাবরী চুপ করে বসে থাকে। সুমিত একটু উদ্বিগ্ন হয়। একটু লজ্জ্বাও করতে থাকে, বিভাবরী কি ভাবছে সে বুঝতে চেষ্টা করে। এই রকম মায়ের বিয়ে টাইপ সিনেমাটিক ম্যাসেজ সে আসলেই বিভাবরীকে দেখাতে চায়নি। কিন্তু কি যে হলো। বিভাবরী কি তার মুখ দেখাই বন্ধ করে দেবে এর পর? তাহলে সে মরেই যাবে। সে অপরাধী মুখ তোলে,
: আমি আসলে স্যরি বিভা, ও ছোট মানুষ কিছু মনে করো না।
বাইরে বোধহয় জোর বৃষ্টিটা নামে। বিভাবরী বলে,
: আসো তো তোমার জ্বরটা দেখি। কাছে আসো। অত দূরে বসে আছো কেন?

এইচআর/পিআর

বিভাবরীর বুকটা ধক করে ওঠে। এই মেয়েকে নিয়ে কি করে সে!

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।