পুড়ে যায় দুক্ষুরবেলা

তাসলিমা আক্তার
তাসলিমা আক্তার তাসলিমা আক্তার , কবি, লেখক
প্রকাশিত: ০৬:০৬ এএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রতিকর্ম অন্তে উষ্ণ প্রস্রবণের পর থিতিয়ে পরা অঙ্গের মতই নেতানো একটা শিমুল গাছের নিচে বসে আছে জহির। জ্যৈষ্ঠের ঝিম ধরা শেষ দুপুর। রোদের দিকে তাকালে চোখ জ্বলে যায়। গাছের পাতারা ঝরে পড়েছে অথবা অত্যুজ্জ্বল আলোয় পুড়ে গেছে। সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মন থেকে সরাতে পারছেনা কিছুতে। মালেকার মুখ পড়ে। কালোটা মুখের আদলে সাথে মানিয়ে গেছে। যেনো রংটা কালো না হলে এই মুখের সাথে মিল হতোনা। কানের দুপাশ থেকে নেমে আসা কলাবেণী সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলার নিচ পর্যন্ত নেমে এসে ছোবল মারে বুকের উপর। কোন এক কালিসন্ধ্যায় পীর ফকিরের নাম মুখে নিয়ে মালেকার মাথা ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলো জহির। মালেকাকে দেয়া সে কথা রাখতে পারেনি সে। মেয়েরা সতীত্ব হারালে হয় সতীত্বহীন, ছেলেরা কি হয় কে জানে! আরো একবার কাঁদতে বসে জহির।

মাটির একটা উঁচু ঢিবির উপর মন্দির। মন্দিরটি কোনকালে জীবিত ছিলো। এখন মরা। বাকল উঠা বড় একটা বট গাছ মাথায় নিয়ে হেলে পরা মন্দিরটি টিকে আছে কায়ক্লেশে। মন্দিরের চারদিকে অসংখ্য গাছপালা। তবু একটা খাঁ খাঁ হা হুতাস। যতদুর চোখ যায় বিরান ভূমি। বীজন প্রান্তর। গ্রামের লোকজনের এদিকটায় খুব একটা যাওয়া আসা নেই। মন্দিরের পাঁচিল থেকে একটু দূরে পদ্মা নদীর একটা মরাটে শাখা। কোনকালে যৌবনবতী ছিলো এখন একেবারেই গেছে। শরীরে রক্ত নেই মাংস নেই, হাড্ডিসার।

হাটবারে হাটুরেরা মরা নদীর পার ধরে হাটে যায়। যাত্রাপথে কারো খুব চেপে গেলে নদীর পারে কাজ সারে। জলে মিশে যায় জল। অপবিত্র হয় না। দূর গ্রাম থেকে হেটে আসা কোন ক্লান্ত মা হাঁটু গেড়ে বসে ছেলেকে স্তন পান করায়। বোরকার আড়াল রেখে নিজেও কিছু খেয়ে নেয়। তারপর তৃষ্ণা মেটায় মরা নদীর টলটলে জলে। অমাবস্যার রাতে দূর গ্রামের দুটি ছেলেমেয়ে কেউ চিনবেনা বলে এদিকে আসে। প্রেম তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পা চালিয়ে হাটে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষ। অন্ধকার ঘন হলে তাদের গলার স্বর গাঢ় হয়। চাঁপা স্বরে মেয়েটি কিছু বলে কিন্তু ছেলেটির নিঃশ্বাসের নিচে সে কথা চাপা পড়ে যায়। বাতাসে উত্তাপ বাড়ে। গাছের পাতারা স্থির হয়। মানুষের এসকল কাজের দূর থেকে সাক্ষী হয়ে থাকে একজন, শ্রীমতী রমারাণী।

মন্দিরে রমার আগমনের দিনক্ষণ কেউ ঠিক করে বলতে পারেনা। মন্দির প্রাচীরের বাইরে কেউ কখনো দেখেনি তাকে। বরং উপযাচক হয়ে মানুষই আসে তার কাছে। রমার পেটে ধন্বন্তরি বিদ্যা। কেউ আসে বাদকের ব্যথা উপশম করতে, কেউ আসে স্বামীধন বশীকরণে। আশপাশের দুচার গ্রামের মানুষেরা রমার কাছ থেকে তাবিজ কবচ নেয়। বিনিময়ে দু চার টাকা কিংবা চালটা সবজিটা উপহার পায়। হায়েজে দোষলাগা ঋতুমতী কিশোরীর তেরদিনেও ঋতুস্রাব বন্ধ হয় না। তাই মায়ের সাথে গেলো হাটবারের আগের দিন সকালে এসেছিলো রমার কাছে। দুধ শুষে নেয়া ব্লটিং পেপারের মত রক্তশুন্য ফ্যাকাশে মুখ কিশোরীর। মন্দিরের ভেতর থেকে পাটি এনে উঠোনে শুইয়ে দেয় রমা। বহুদুর থেকে হেটে আসার জন্য ক্লান্ত কিশোরী অজ্ঞান হয়ে পরেছিল সেদিন। তার ঈষৎ খোলা চোখ তাকিয়ে ছিলো দূর আকাশের দিকে।

কিশোরীর মায়ের চিৎকারে শিমুলের ডাল থেকে উড়ে গিয়েছিল কালো চিল। জনমানুষহীন প্রান্তরে মানুষের কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনি তুলে আছড়ে পড়েছিলো সেদিন। রমা শান্ত হাতে পানি ছিটিয়ে দিয়েছিল কিশোরীর ঈষৎ নিমীলিত চোখ দুটোয়। বিড়বিড় করে মন্ত্র আওরায়। চৈতালি হাওয়া এসে এলোমেলো করে দেয় চুড়ো খোপা করা রমার চুল। কানের পাশে চূর্ণ চুল উড়ে, যেনো বাতাসে উড়ে শিমুল তুলা। চোখ বন্ধ করা ঊর্ধ্বমুখি রমাকে মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয় রুপকথা থেকে উঠে এসেছে কোন গ্রিকদেবী। সতের মিনিট পরে নড়ে উঠেছিলো কিশোরী। চোখ খুলে মায়ের নাম উচ্চারণ করেছিলো সে। কিশোরীর মায়ের কৃতজ্ঞ চোখ আনত হয় রমার বুদ্ধিদীপ্ত হাসির নিচে। যুগে যুগে বুদ্ধিমান মানুষেরা এভাবেই দেবতা হয়েছে সাধারণের কাছে।

জহিরকে দু’দশ গ্রামের সবাই চিনে ছিঁচকে চোর হিসেবে। উপনাম জহিরচোরা। গ্রামের মানুষের টাকা পয়সা থেকে শুরু করে বিছানা বালিশও চুরি করে সে। তবে সবচে ভালো মওকা মিলে ট্রেন যাত্রীদের কাছ থেকে। পাড়া গা। আটটা বাজলেই রাত নিশুত। স্টেশন থেকে রেল লাইন ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলেই একটা পুল আছে। সেখানে উত পেতে থাকে জহির। ছোপ ছোপ অন্ধকারে মানুষের মুখ দেখা যায় না। শুধু একটা অবয়ব, একটা কায়া। সঙ্গে মেয়েমানুষ থাকলেতো কথাই নেই। জহিরের সেদিন ঈদ লেগে যায়। মেয়েমানুষের সাথে থাকে চকচকে সোনা। গলায় হাতে কানে সোনালী ঝিলিক। জহির মনের আনন্দে একটা একটা করে গুনে নেয়। সাথে থাকা পুরুষটির পকেট থেকে টাকার ব্যাগ। কপালের দোষ দিতে দিতে মানুষগুলো চলে যায়। জহির তখন ঠোঁটে শীষ তোলে। পকেট হাতড়ে বের করে ছোট কাগজের পুড়িয়া। অভ্যস্ত হাতে ধীরে সুস্থে সিগারেটের সাথে মিশাল দিয়ে টানতে থাকে। প্রথম টানে মাথাটা ঝিম মেরে উঠে। সাথে সাথে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সুখানুভূতি। ফাঁকাটে মাথায় মালেকার মুখ মনে পড়ে। ঠোঁট গোল করে জহির শীষ বাজাতে থাকে, ওরে নীল দরিয়া।

জহির যখন রমার আঙ্গিনায় এসে পৌঁছায় সূর্য ততক্ষণে ঠিক মাথার উপর। চৈত্রের সূর্য থেকে আগুন চুইয়ে পড়ছে। ঘামে জহিরের জামা ভিজে গায়ের সাথে সেটে থাকে। কিন্তু রমার এখানে এক অদ্ভুত শীতলতা বিরাজ করছে। মনে হয় যেন শেষ নভেম্বর। আয়েশি ডালপালা মেলে গাছগুলো আদুরে আদুরে দুলছে। দুলুনিতে কেমন একটা মায়া। মন্দিরের চারপাশ ঘিরে রেখেছে কত জাতের গাছ, হিসেব নেই।

এতক্ষণের উত্তপ্ত ভাবটা আর থাকেনা জহিরের। পকেটে একজোড়া সোনার কানের দুল। সোনার জিনিসে রমার অসীম দুর্বলতা। জহির কিছু পেলেই প্রথমে আসে রমার কাছে দেখাতে। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। রমার চোখ তখন সোনার মতই চকচক করে। দাম দিতে পারলে রাখে। না দিতে পারলে ফেরত দেয়। দাওয়ার কাছে এসে গলা খাঁকারি দেয় জহির,
-দিদি, কনে গেলে। কানের জিনিস আনিছি একজোড়া। সিকি ডিজাইন! এক ফিলিমে শিরিদেবীর কানে দেখিলাম এইদুলজোড়া। তোমাক ঝা মানাবিনা। সি আর বলছি কি!
-দাওয়ায় বইসো জহির, এ্যাই আসতিসি

কুয়োতলার দিক থেকে শব্দটা আসে। কুয়োতলার পাশে স্নানের জন্য চট দিয়ে কিছুটা জায়গা আড়াল করা। এখানে রমা একা থাকে। কিন্তু যখন তখন আশীর্বাদ নিতে আসা রোগীর আনাগোনা। তাই স্নানের জায়গাটা নিজের মত করে একটু আলাদা করে নিয়েছে সে। মন্দিরের দাওয়ায় বসে জহির একটা কামিনী গাছের পাশে। রাতভর কামিনী ফুলের সুগন্ধের পর দিনের বেলাতেও একটা চনমনা সুবাস। বুক পকেটে হাত দেয় জহির। জিনিসটার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। রমাকে সে পছন্দ করে। জহির তাকে অনেকটা নিজের দিদির মতই মনে করে। কেমন একটা মায়া! একলা একজন মানুষ। আপনার বলতে কেউ নেই। জন মানুষহীন এক মন্দিরে একা জীবন কাটায়।

সাদা একটা থান পরে কুয়োতলা থেকে উঠে আসছে রমা। পীঠের উপর ভিজে চুল। চুল থেকে ঝরে পরছে ফোটা ফোটা জল। মুখের উপর জলের চিহ্ন। শান্ত একটা মূর্তি। রমার শরীরে তেমন খাঁজ ভাঁজ নেই। একহারা গড়ন। কিছুটা মোটার ধাঁচ। বয়স ঠিক বোঝা না গেলেও ত্রিশ পেড়িয়েছে বেশ আগে, তা বোঝা যায়। রমা যতই এগিয়ে আসে জহির টের পায় সাদা থানের নিচে রমার শরীরের উর্ধ্বাংশে কাঁচুলি জাতীয় কোন বস্ত্রখন্ড নেই। সূর্যের আলোটা ঠিক বুকের উপর পড়েছে। জহির সেদিকে একবার চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। অমোঘ আকর্ষণে আবার তাকায়। আবার, আবার। রমা দূর থেকে আওয়াজ করে হাসে। হাসির শব্দটা আজ অন্যরকম মনে হয় জহিরের। বুকের ভেতর অচেনা যন্ত্রণা। গলা খাকারি দিয়ে জহির গলার শ্লেষ্মা পরিস্কার করে।

-ও দিদি, এই দেখনা দুলজোড়া ঝা সুন্দরনা! যার কানেত্থিকি নিইলাম, সি বিটিটা ছিল এক্কেবারে সাদা ফকফকা। রাত্তিরির আন্দাইরেও তারার মতন জ্বলতিছিলো কিরাম!

জহির আর কোন কথা খুঁজে পায়না। রমা আজ কোন কথা বলেনা। জহিরকে পাশ কাটিয়ে মন্দিরের ঘরের দিকে চলে যায়। যাবার সময় জহিরের গায়ে ফেলে যায় সদ্য স্নান করা চুল থেকে চুঁইয়ে পড়া কফোটা জল। শীতল জল জহিরকে উত্তপ্ত করে। জহিরের পঁচিশ বছরের জীবনে এ যাবতকালে কোন নারী স্পর্শ নেই তেমন করে। কেমন যেন এক রকম অস্থির লাগতে থাকে জহিরের। রমা আধ্যাত্মিক গুণ সম্পন্ন মানুষ। কোন পুরুষ তাকে ছুঁতে না পারারই কথা। কিন্তু রমার ঠোঁটে আজ কেমন এক রকম বিজাতীয় হাসি! যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবী মেনকা কিংবা রম্ভা। মন্দিরের চারপাশে ঘোর নেমে আসে। মিসমিসে কালো রঙ্গয়ের একটা দাঁড়কাক মাথার উপর দিয়ে ডানামেলে উড়ে যায়। মাথার ভেতরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকে। আকাশের দিকে তাকায় জহির। কিছুক্ষণ আগে ঝলমলে রোদ ছিলো এখন খানিকটা অন্ধকার। আকাশে কোন মেঘ নেই। তবে কি আজ গ্রহণের দিন! পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। মন্দিরের ভেতর থেকে শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় রমার আহ্বান ভেসে আসে খানিক পর, যে আহ্বান উপেক্ষা করার ক্ষমতা ঈশ্বর কাউকে দেননিঃ

-ভেতরে আইসো জহির

তারপর পাতা ঝরা নেংটো গাছটার নিচে বসে হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করতে থাকে জহির,

“ওরে খোদা, আমার এ কি হইলোরে!”

এইচআর/আইআই

‘কোন পুরুষ তাকে ছুঁতে না পারারই কথা। কিন্তু রমার ঠোঁটে আজ কেমন এক রকম বিজাতীয় হাসি!’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।