দূরের কান্না

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান
মুহাম্মদ ফরিদ হাসান মুহাম্মদ ফরিদ হাসান , কবি ও কথাসাহিত্যিক
প্রকাশিত: ০৮:৩৭ এএম, ১৮ জুলাই ২০১৭

হারিকেনটা নিইভা গেছে। এই ঘরে দশ বছর আগেও হারিকেন যেমন আদর-যত্নে আছিলো, এহনো আছে। থাকবো না, কী করবো? গ্রামের ঘরে ঘরে তহন বিদ্যুতের আলো খেলা করে। টিভির নাটক চলে, গায়করা গান গায়। আবুলগো ঘরে স্টার জলসা চলে। যাগো ঘরে টিভি আছে ডিস নাই; তারা আবুলের ঘরে আইয়া জলসা দেখে। আহে মহিলারা। কাম-কাইজ শেষ কইরা আহে, কাম-কাইজ ফালাইয়া রাইখাও আহে। মাঝেমধ্যে তাগো স্বামী তাগোরে বকে। বাপ-মা তুইলা গালাগাল দেয়। তবু তাগো হুশ হয় না। মহসিনগো দিঘির ঘাটলায় প্লেট মাজতে মাজতে তারা কাসুন্দি গায়। ঝিলিকের কী অইবো অহন? হে পারবো তো? টাপুরের লাইগা দিলে বড় কষ্ট লাগে। তাগো বলার ঢঙে মনে হয় সোয়ামীর কিংবা শাশুড়ির কিছু হইলেও অগো দিল এত আনচান করতো না। তারা হা-হুতাশ করে। মায়ের কথা কয়। এই মা তাগো আপন মা না। এই মা তাগো জলসার সিরিয়ালের মা। মুরব্বীরা কইতো, ‘এমন যুগ আইবো, বুছতাসো মিয়ারা এমন যুগ আইবো, মাইয়া মার কথা কইবো না। পোলায় কইবো না বাপের কথা। অথচ মিয়ারা দেখো, বাপ-মায় জন্ম দিছে—তাগো খোঁজ নেওনের সময় পোলাপাইনের অইবো না।’ হেই দিন আইয়া গেছে। কিয়ামতও আইয়া গেছে। ‘মুরব্বীগো ওয়াজ নসিয়তে আগে কাম হইলেও এহন আর কামে অয় না। কাম না হওনেরই কথা। যারা কয় তাগো মোহে হেই কথা উডা ঠিক না। বউ-ঝিরা মসজিদের ইমাম সাবগো নিয়ে খিলখিল হাসে। হায়রে মদনা! ও সাধু, এমনভাবে কথাটা তারা কয় যেন সাধু কী জিনিস তারা জানে। 

ও কই থুইয়া কই যাইতাছি। কইতে লইছিলাম হারিকেনের কথা। বুড়া হইছি। কথা আউলায়া যায়। ভিমরতি ধরে না এই যা। বয়স তো কম হইলো না। চোখেও কম দেহি। বকুলরে মাঝেমাঝে কই- রতনের মা, আবার আব্বাস মাস্টাররে কই— কই যাস্ হরিদাস! হারিকেন বিষয়ক ভাবনা পাঁচদিন আগেও ভাবনের কিছু আছিলো না। সমস্যা অইলো গিয়া কাইল থাইক্যা। হারিকেনডার তলাডা ফুডা হইয়া গেছে। তেল ছপছপ কইরা পড়ে। রাত অইলে কাম কি? খাওন-দাওন অইবো ক্যামনে? আন্দাইরা-গোন্দাইরা তো আর কিছু খাওন যায় না। তার উপর হইছি বুড়া। বাপ-দাদারা কইতো, ‘ছেঁড়া টেকার দাম নাই আর বুড়াগো দাম নাই।’ কী কথাবার্তা আছিলো তাগো। সত্য কথা কইতো। পাক্কা সত্য। বুড়া হওনের পর থেইকা দেহি কেউ দাম দেয় না। দুই বছর আগে যহন মাথার চুল সব সাদা হয় নাই, ভাতের মতো সাদা, তহন দোয়ানে গেলে মতিনরা উইঠা জায়গা দিতো। বিড়ি-সিগারেট খাইতো দূরে গিয়া। এহন সামনেই বিড়ি ধরায়। দাঁত-মুখ ভেটকাইয়া হাসে। মাঝেমইধ্যে ইচ্ছা হয়— কইষ্যা চটকানা লাগাই। ময়-মুরুব্বী মানস্ না। বাপ-মায় কিছু শিখায় নাই। খাস্ খা-খা? 

ও, হারিকেনের কথা কইতে লইছিলাম। ঘরে একা মানুষ। পোলা-মাইয়া নাই। বউডাও পাষাণ। আমারে একা রাইখ্যাই গেলো। জীবিত থাকতেও কোনো আক্কেল-জ্ঞান আছিলো না, মরতে গিয়াও আক্কল হইলো না। আমারে একা রাইখা কেমনে হে গেলো? আমিও একবার ভাবছিলাম মইরা যাই। কিন্তু আল্লায় তো বেকের কথা হুনে না। আর পাপ কম করি নাই জীবনে। আমার কথা আল্লায় হুনবো ক্যান? ঘরে জমানো টেকা-পয়সা আছে। এই দিয়া চলাফেরা। অহন সন্ধ্যাবেলায় কত কথাই মনে পড়ে। আইজ মনে হয় আমাবস্যা। চোখের সামনে হাত মেললে হাত দেখা যাইবো না। দিনটা গেলো, সোমবার ছিলো হাটবার, আমি ভুইল্যা গেছি হারিকেন যে ফুডা। নাইলে পান-খড় কিনতে হাটে গেলাম, হারিকেনডা ঠিক করাইতে নিলেও তো পারতাম। হারিকেন ভেজাইয়া কই আধ ঘণ্টা ফারাকে নিভ্যা গেলো কেন? ঢাললাম তেল। হায় আল্লাহ, কিছুক্ষণ পর চাইয়া দেহি বিছানা ভিইজা গেছে। তেলে জবজবে। কেরোসিনের গন্ধ পাইয়া মনে পড়লো হারিকেন তো নষ্ট। আইজ রাতটাই আন্ধারে থাকতে হইবো। খাওন খামু কেমনে? 

পাশের বাড়ির আলতাপীর মায় রাইন্ধা-বাইড়া দিয়া যায়। ঘরেই আলমারিতে আইজকার ভাত-তরকারি রাখা আছে। বইছা মাছ দিয়া কি দিয়া যেন রানছে। কিন্তু আন্দারি-গোন্দারি কি থুইয়া কি করি? আলতাপীর মায় শেষ পর্যন্ত আমারে খাওয়ায়। কইছিলাম না, কত পাপ করছি আমি। দুই চক্ষে আলতাপীর মারে দেখতে পারতাম নাকি? কির লাইগ্যা দেখতে পারতাম না, হেইডা অহন মনে নাই। দুইডা গরু অথবা দশটা ছাগলের গু দেখতে পারলেও তারে দেখতে পারতাম না। কল্পনাই করি নাই, হে কহনো আমার শেষ কাডালের সঙ্গী হইবো। অন্য কোনো ছেমড়ি হইলে আমি মরলে হয়তো আমার কবরেও জুতাপেটা করতো, আলতাপীর মায় বেবাক ভুইলা গিয়া আগুইয়া আইলো। ‘ভাইসাব, ভাবিসাবরে তো আল্লায় নিছে, কাইন্দা কি অইবো? সবুর করেন।’ সেদিন হইতেই আলতাপীর মার আমার প্রতি কী টান। মাঝেমইধ্যে কান্দন আইয়ে। এমন মানুষও আছেনি? ও ঈসা-মুসা নবী! এমন মানুষ এহনো আছেনি!

বুড়া বয়সে আন্ধার বড় ডর। আন্ধার দেখলেই মনে হয়, পলাইয়া কোনদিহে যেন আজরাইল গাপটি মাইরা বইয়া আছে। জানি মনের ডর। তবু ডর লাগে। যদি মইরা যাই! মনে মনে কই, অই আজরাইল, একটু পরে আইস। দম নিতে দে। আর কয়ডা দিন দেহি না দুনিয়াডা। আজরাইল হয়তো কথাগুলো হুনে। হে কী ভাবে কে জানে?

বউ থাকতে কইতো, আপনে না বড় গাওইন্যা হইতে পারতেন। গাওইন্যা মানে গায়ক। গলা আছিলো একখান। তহন তো তাগড়া বেডা আমি। চুল ঘাড় সমান। মুখে মুখে আউড়াইতাম বাউল গান। লালন সাঁই আর হাছন রাজা। ‘জাত গেলো জাত গেলো বলে...’ কত মাইয়া পাগল হইছে এই গানে। গোপনে তারা আইয়া কইতো, ‘কিছু বুঝি না। গানখানি হুনাইবেন একটু। আপনার কি দিল নাই। থাকলে...।’ বউডাও গানের ভক্ত আছিলো। তারপর যুগে যুগে কত কি বদলাইছে। ক্যাসেট, রেডিও, টিভি, সিডি আইলো... গানের কি আর দাম আছে? সস্তা জিনিস হইলো গান। কহন যে শেষ গান গাইছিলাম দরদ দিয়া আইজ মনে আহে না। মনের মধ্যে গান খুঁইজা বেড়াই। অহন একটা গান আহুক দেহি। আহুক, কোনো শ্রোতা নাই। কেউ নাই। আন্ধার করা ঘর আর আমি। আমরাই হুনলাম নিজেগো গান। ষাট না সত্তর তো পার হইলো। বেশিও হইতে পারে। খেয়ালে আহে না। এই গলায় এহন গান উঠলে মাইনসে কইবো— বুইড়ার ভিমরতি ধরছে। তবু গান খুঁইজা মরি। হয় মনে আইছে একখান। ‘কি ঘর বানাইমু আমি....।’ তারপরও ঘর বানাইছি। নিজের গলায় নিজের গান হুনি। সুর বড় অচেনা ঠেকে। সময়ের বড়ই মারপ্যাঁচ। কই থাইক্যা কই রাইখ্যা যায় ঠিক নাই। 

একটা কাহিনি মনে পইড়া গেলো। যৌবন কালের কাহিনি। পুব পাড়ার বাদলের বইন, বুলবুলি নাম, বেবাকে হেরে ডাকতো ‘ভুলি’ কইয়া। কী সোন্দর তার চোখ, চুলগুলা মনে হইতো পানখ সাপ, দেখলেই বুকে ধক ধক শব্দ পাইতাম। আর কি তার হাসি, বাঁশি বাজায় যেন! আমারে দেখলেই কইতো, ‘কি গাইয়াল উড়াল দিবা আমার লগে?’ বইলাই তাবৎ বাঁশি বাজাইয়া হাসতো। উড়াল দিবার শখ আছিলো মেলা। ক্যামনে দেই। আছিলাম গরিবের পোলা। ভুলি হইছে সর্দারগো মাইয়া। মাঝেমইধ্যে কইতে চাইতাম— ‘যামু, নিবি আমারে?’ কিন্তু কইতে পারতাম না। মাইয়া গোস্যা করতো। আমার সামনে আইতো না কয়েক দিন। হেয় জানতো তো মেলা তারে না দেখলে আমি মইরা যাই। একদিন হাট থাইক্যা আইয়া হুনি ‘ভুলি’র শাদি হইয়া গেছে কোন এক জমিদারের পোলার লগে। আর ভুলিরে দেহা হয় নাই। দেখলে কইতাম, ‘আমার লগে উড়াল দিবি?’ গল্পডা বুড়া বয়সে হাস্যকর। তবু মনে পড়ে। কি করমু? আন্ধার রাইতে শিয়ালগুলা ডাকাডাকি শুরু করছে। কত কিছুই মনে আহে। সব কথা বলা যায় না। 

হারিকেন নাই। ঘরের মধ্যে আমি ছাড়া কেউ নাই। একলা একলা লাগে। আলতাপীর মায় মনে হয় ঘুমাইয়া গেছে। রাইত কয়টা হইছে কে জানে? ঘুমও আহে না। বিছানা থেইকা উইঠা বাইরে দাঁড়াই। দরজা পার হইলে উঠান। হের পরে মনুর ঘর। তার পরে মজিদেরটা। হের পরে আলতাপীর মার। হে একটু আইলে ভালা হইতো। হারিকেনের একটা না একটা ব্যবস্থা করতো হে। ভাতগুলান খাইতে পারতাম। ক্ষুধাও কম নাই। ও মনু, মনু...। মনুগো ঘরে কেউ নাই। মনে হয় ছোড পোলাডাও নাই। থাকলে হৈয়াল দিতো। দূরে কোনহানে যেন কান্দাকান্দি হইতাছে। কারো অসুখ-বিমার লাগছে হয়তো। নয়তো কারও বাচ্চা অইবো। কথাবার্তা হোনা যায়। অস্পষ্ট ঠেহে সব। কানে কম হুনি পাঁচ বছর তো হইলো। বেশিও হইতে পারে। আম গাছটায় হেলান দিয়া দাঁড়াই। দাঁড়াইয়া থাকতে কষ্ট লাগে। অহন দেহি মজিদের পিড়ার কোল ঘেঁষে একটি টর্চলাইট হাঁটতে থাহে। তাকায়া দেহি বহুদূরে আলো জ্বলছে। ঠাওর হয় না। টর্চলাইট আইয়া গায়ে পড়ে। ‘ইদিস দাদায় না?’ বিনতে পারছি ও, মনুর বড় পোলা আবুয়ে। ‘মনা একটা কাম করতি পারবি?’ আবু ব্যস্ত হয়া কয়, ‘কন দাদা, কি করতে হইবো।’ ‘আলতাপীর মারে একটু কবি একটা কুপি নিয়া আইতো, আমার হারিকেনডা জ্বলে না। ভাত খাইতে পারি না। কবি?’ আবু কতক্ষণ দম ধরে থাহে। পোলাডা ভীষণ ত্যাড়া। কোনো কামের কথা কইলে কয় পারুম না। ‘কিরে আবু, কথা কস্ না যে?’

‘কি কমু চাচা? আপনে জানেন না আলতাপী বুর মা সন্ধ্যায় মইরা গেছে? একটু পর হেরে কবর দিবো। কবর করা হইয়া গেছে।’

‘কস্ কি আবু!’

‘আপনারে কেউ কয় নাই?’

আবু যেদিক দিয়া আইছিলো হেইদিক হন হন কইরা হাঁইটা যায় গিয়ে। আমি তবু কইতেই থাহি— কস্ কি আবু? কি কস্?

আলতাপীর মায়ের মুখখানা মনে করবার চেষ্টা করি। চোখ বুঝি। তার চেহারা চোক্ষে ভাসে না। দূরের কান্নার শব্দ আরো স্পষ্ট হোনা যায়...

বুক চিইড়া একটা দীর্ঘশ্বাস বাইর হয়। বড়ই ভালা আছিলো আলতাপীর মায়।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।