রাঁধুনি

সাখাওয়াত হোসেন সুজন
সাখাওয়াত হোসেন সুজন সাখাওয়াত হোসেন সুজন
প্রকাশিত: ১০:২৩ এএম, ২১ জুন ২০১৭

আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলা। অন্তরে রেস্তোরাঁয় বসে আছে সায়েম ও শিমু। পরস্পর একটু তাকানোর পর মায়াবী হাসি। শিমু অনেকটা স্বাভাবিক থাকলেও সায়েম কিছুটা স্নায়বিক দুর্বলতা অনুভব করছে। প্রকৃতি গ্রীষ্মেও রুদ্ররূপ ধারণ করেছে। দাবদাহের তীব্রতায় সবার অবস্থাই খারাপ। রাজধানীতে এত বেশি গরম কখনও কেউ অনুভব করেনি।

রেস্তোরাঁ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ভেতরের পরিবেশটা শীতল। তবুও ঘামছে সায়েম। শিমু অবাক হয়ে দেখছে তার কপাল দিয়ে ঘামঝরার দৃশ্য!
‘এভাবে ঘামছেন কেন? প্রথমবার দেখা হলেও আমরা তো অনেকদিন কথা বলেছি।’ বললো শিমু।
চোর যেমন ধরা পড়ার পরে পিটুনির ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে; সায়েমেরও ঠিক সেই দশা!

এখানে বিপাক অন্য জায়গায়। তাদের পরিচয় ফেসবুকে। দু’জন দু’জনকে বেশ চটপটেই ভেবেছিল! কিন্তু ভার্চুয়াল আর বাস্তব জগতে তারা ভিন্ন প্রকৃতির। সামনে বসে না থেকে যদি তারা পৃথিবীর দুই কোণে বসে চ্যাট করতো তাহলে হয়তোবা এতক্ষণে লিখে একে-অপরের ইনবক্স ভরিয়ে ফেলতো।

আগের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে শিমু আবারও বললো, ‘সায়েম ভাই?’
এবার কথা বললো সায়েম, ‘আপনার ভাই হওয়ার ইচ্ছে নেই। ইয়ে হতে চাই।’
হাসলো শিমু। হাসিতে গালে টোল পড়লো। সায়েমের মন উতলা হলো। টেবিলে রাখা পরিপাটি হাতটা ছুঁয়ে দেখতে মন চাইলো।
‘বাস্তবে আমাকে কেমন লাগলো?’ জানতে চাইলো শিমু। এমনিতে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। ঢাকার একটি প্রাইভেট মেডিকেলের ছাত্রী। ডাকার সঙ্গেই সায়েম তার সাড়া পেয়েছে তা না। দীর্ঘদিনের আলাপ-পরিচয়ের পর শিমুর মনে হয়েছে সায়েমের সঙ্গে অন্তত কথা বলা যেতে পারে- তাই সে এসেছে।
‘মেকাপের ছবির গায়ের বরণ আর বাস্তবে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও আপনি যথেষ্ট সুন্দরী। শরীরের গড়নও স্রষ্টা প্রদত্ত।’ বললো সায়েম।
‘গড়নটা ঠিক বুঝলাম না।’ বিস্ময় নিয়ে বললো শিমু।
‘বাংলায় বলেছি তো, তাই হয়তো বোঝেননি। ইংরেজিতে ওটাকে ফিগার বলে।’ বললো সায়েম।
শিমু চোখ-মুখ লাল করে বললো, ‘আপনার নজরও অন্যদের মত খারাপ! জেনে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।’
সায়েম হেসে বললো, ‘হবু ডাক্তার আপু ও হবু ইয়ে আপনার মনের ছবিতো আর দেখিনি। শরীরের ছবিটা দেখেই ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে আপনার রান্না করা খাবারের ছবি।’
রাগের ভঙ্গিমাটা মুখ থেকে উড়ে সেখানে দেখা গেল খুশি আর লজ্জার লালিমা। যেন একটি টকটকে লাল গোলাপ। সেদিকে তাকিয়ে ত্রিশ বছর ধরে বাঁধের মধ্যে থাকা ধৈর্যও যেন ছুটে যেতে চায় সায়েমের। সংবরণ করে বলল, ‘গল্প অনেক হলো। কী খাবেন বলেন।’
‘সকাল বেলা কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। কেবল চিকেন শর্মা খাই আর এককাপ চা।’ বললো শিমু।
‘আমি কিন্তু গরম গরম সিঙ্গারা খাবো।’ বলে হোটেল বয়ের কাছে অর্ডার দিল সায়েম। ইতোমধ্যে পানি দিয়ে দু’বার সে আশেপাশে এসে ঘুরে গেছে।

খাওয়ার সময় কেউ কোনো কথা বললো না। সায়েম কেবল লুকিয়ে লুকিয়ে শিমুর দিকে তাকালো। শিমু বিষয়টা বুঝেও না বোঝার ভান করলো। কেউ যখন ভালোবেসে দেখতে চায়, দেখুক না প্রাণভরে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে দু’জনে চোখাচোখি হলো। দু’জোড়া চোখ পরস্পরকে কী যেন ইশারা দিল। এমন সময় শিমু অবাক হলো! সায়েমের চোখে পানি!
‘আপনি কাঁদছেন না কি সায়েম ভাই? কান্নার মত তেমন কিছু তো হয়নি!’ বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞেস করলো শিমু।
টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে চোখ মুছলো সায়েম। বললো, ‘আবেগ পীড়া দিচ্ছে। এমনও তো হতে পারে এ দেখাই শেষ দেখা! দেখা করার পর আপনি আমার সম্পর্কে একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। আপনাকে না পেলে কষ্ট পাবো। জীবনসঙ্গী শূন্যতার থেকে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে!’
আবেগটা ছুঁতে পারলো না শিমুকে। তার প্রশ্ন- ‘আমাকে ভালো লাগার বিশেষ কোনো কারণ আছে না কি! আপনি তো আমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। আমিও আপনার সম্পর্কে জানি না। এতটা অসচেতন আমি হতে পারি না।’
‘মানে আপনি চলে যাবেন? আমরা আর কোনো সিদ্ধান্ত নেব না?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো সায়েম।
সেই টোল পড়া হাসিটা শিমুর মুখে। বললো, ‘আমি বাবাকে আপনার কথা বলবো। আপনার চাকরিটা তিনি হয়তোবা পছন্দ করবেন না। কিন্তু তাকে অনুরোধ করবো একজন ভালো ছেলে হিসেবে আপনার বিষয়টা যেন বিবেচনা করেন। ফেসবুকে কিছুটা ছেলেমানুষি করলেও বাস্তবে ওসব আমার দ্বারা হবে না। তবে এটা ঠিক পড়াশোনার কথা বলে আপনার থেকে বেশি সময় নেব না। যদি সংসার শুরুই করতে হয়; ছাত্রজীবনেই করবো। আশাকরি আপনাকে পাশে পাবো।’
এরপর শিমু উঠে চলে গেল। সায়েম মাথা নিচু করেই রইলো। তার গমনপথের দিকে তাকালোও না। কেবল বিল দিতে গিয়ে জানলো ম্যাডাম দিয়েছেন!

এরপর কেটে গেলো ছয় মাস। এ সপ্তাহটায় বেশ ধকল গেলো সায়েমের। বিয়ের সপ্তাহ বলে কথা। বিয়ের জন্য অনেক কাঠখড় পুড়েছে। কন্যাপক্ষ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তার খোঁজ-খবর নিয়েছে। সায়েমের বাবা বেঁচে নেই। গ্রামের বাড়িতে মা একা থাকেন। তাকে অনেক চেষ্টা করেও শহরে আনতে পারেনি সে। গ্রাম ছাড়তে রাজি নন মা। সরকারি ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার সায়েম উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান না হলেও সৎ। তাই দুই পরিবারের বিরাট ব্যবধান সত্ত্বেও মেয়ের বাবা জামাই হিসেবে তাকে পছন্দ করেছেন।

নতুন একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে সায়েম। সেখানেই আজ নববধূকে নিয়ে তার শহুরে সংসারযাত্রা শুরু। বউ হিসেবে আর কাউকে নয় শিমুকেই পেয়েছে সে। সন্ধ্যার পর পর ঘরে ফিরলো সায়েম, শিমুও বাইরে ছিল। ক্লাস করে বিকেলে ফিরেছে। বিয়ের সাতদিন পর বউ আর নতুন থাকে না। এ সাতদিন রান্নার কোনো জ্বালাতন না থাকলেও এখন তাকে রান্না করতে হবে। তার বেশ মনে আছে- সায়েম বলেছিল, ডাক্তার বউ নাকি স্বামীকে রান্না করে খাওয়ানোর সময় পায় না। জবাবে সে বলেছিল, আমার ম্যাডামেরা রান্না করে এসেই আমাদের ক্লাস নেন। কে বলেছে ডাক্তার বউ রান্না-বান্না পারে না?

কিচেনে আপন মনে রান্না করছিল শিমু। একা পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করলো না সায়েম। পেছন থেকে জড়িয়ে আদর করলো। শিমু বাধা দেয়নি। কেবল বললো, ‘তুমি একটু রুমে যাও না। আমি রান্নাটা শেষ করি।’
রান্নার ঘ্রাণ টের পাচ্ছে সায়েম। ‘ঠিক আছে, খাওয়ার পর তো পুরো রাত পরে আছে।’ বলে চলে যাচ্ছিল।
‘ও হ্যাঁ, কাল সকাল থেকে বুয়া আসবে। তোমার আর এত বেশি কষ্ট করতে হবে না। আমি কি এখন তোমাকে একটু সাহায্য করবো?’ বললো সায়েম।
‘তুমি সাহায্য না বিরক্ত করবে? এখন যাও?’ মুখে সেই মায়াবী হাসি শিমুর।
সায়েম তাকিয়ে রইলো। শিমু হাসতে হাসতে তাকে কিচেন থেকে বের করে দিল।

প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে রাতে খাওয়ার টেবিলে বসলো সায়েম। কিন্তু খাবারের দিকে তাকিয়ে তার চক্ষু চড়কগাছ। শিমুর শরীর মোটা তাই তার অল্প খেলেও চলে। তবে এত কম খাবার সায়েম খাবে কী করে!
‘ফ্রাইড রাইস উইথ চিকেন ফ্রাই। তুমি খাওয়া শুরু করো।’ বললো শিমু।
‘এত শুকনো খাবার। একটু ডাল, সাদাভাত আর ভর্তা করতে পারলে না শিমু।’ জানতে চাইলো সায়েম।
‘আমি তো দেশি খাবার খুব একটা রান্না করতে পারি না।’ বললো শিমু।

শুকনো খাবারই খেতে শুরু করলো সায়েম। মুখে কোনো কথা নেই। ভুলটা তারই হয়েছে। ভোজনবিলাসী বলে শিমু রান্না করা খাবারের যেসব ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিত সেগুলো তার ভালো লাগতো। আজকের এই মেন্যুটাও যদি সে পোস্ট দিত তাহলেও বোধ করি সুন্দর লাগতো! বাস্তুবে খেতে গিয়ে বুঝতে পারলো খাবারের স্বাদ! মনে হচ্ছে, শুকনো ঠনঠনে এক টুকরো রুটি খাচ্ছে। নিজের অনাগত দুর্দিনের কথা ভাবতে শুরু করলো।

এমন সময় গলায় যেন খাবার আটকে গেলো। অনবরত কাঁশতে শুরু করলো। শিমু ঝটপট পানি এগিয়ে দিলো। কাঁশি থেমে গেলে বললো, ‘কেমন লাগলো রান্না?’
মনের কথা গোপন রেখে সায়েম বললো, ‘বেশ হয়েছে। যে রান্না করা খাবারগুলোর ছবি দেখতাম। সেগুলো বাস্তবে দেখছি। সেই খাবার খেয়ে রাঁধুনিকে নিয়ে শুয়ে পড়ার সৌভাগ্য ক’জনের হয়।’
হাসলো শিমু। হেসে বললো, ‘বিয়ের আগে তো তোমাকে এমন দেখিনি। এখন মনে হয়- আমার শরীরের সঙ্গে যত লেপ্টে থাকতে পারো ততই আনন্দ পাও।’
‘তখন বৈধতার লাইসেন্স ছিল না। লাইসেন্স হওয়ার পরও গাড়ি চালাবো না- এ কেমন কথা!’ হাসতে হাসতে বললো সায়েম।
‘যাও, তুমি রুমে যাও। আমি সব গুছিয়ে আসছি।’ বললো শিমু।

তারপর থেকে তাদের ঘরকন্না শুরু। শিমু বেশ চটপটে। সকালে ক্লাস করতে যাওয়ার আগেই রান্না করে যায়। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার দু’টোরই ব্যবস্থা করে। বুয়া থাকায় তার খুব একটা পরিশ্রম হয় না। বুয়ার হাতের রান্নাটা ভালো হলেও সায়েমের কপালের শনির দশা কিছুটা কাটতো। সকাল-দুপুর যেমন তেমন হলেও রাতের খাবারটা তার ভালো চাই। তাই সে এখন প্রতিদিন ফোন দিয়ে জেনে নেয় শিমু কি রান্না করেছে। শিমু খুশি হলেও সায়েম করে অন্য কাজ! রাতে সে বাইরের হোটেল থেকে খেয়ে এসে বাসায় যা পায় তাই খায়।

বউয়ের হাতের সুস্বাদু রান্না করা যে খাবারের স্বপ্ন সে দেখেছিল তা স্বপ্নই থেকে যায়। যদিও রান্নার দিকটা বাদ দিলে শিমুর মত বউ পাওয়াটাকে ভাগ্য বলেই মেনে নিতে হবে। শিমু যে তাকে বিয়ে করেছে এটাও তার জন্য বড় পাওয়া। রান্নার কথাটা বললে হয়তোবা তাকে শুধরানো যেতো। কিন্তু রান্না নিয়ে শিমুর আজব পাগলামি আছে। একদিন আলু ভাজি করতে বলেছিল সায়েম; সেদিন শিমু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বানিয়েছিল। ছুটির দিনে একদিন ফ্রেশ আমের জুস খেতে চেয়েছিল; শিমু সেদিন ম্যাংগো পুডিং বানিয়ে এনেছিল। গরুর মাংস খেতে চাইলে চাপ বানায়। মুরগি খেতে চাইলে চিকেন রোস্ট করে। খাবারগুলো যে খুব একটা খারাপ হয়, তা নয়। কিন্তু মাছে-ভাতে বাঙালির মন ভরে না। মাছ-ভর্তার জায়গায় এখন ফ্রায়েড ফিশ দিয়ে ভাত খেতে হয় সায়েমকে।

আগে মেসের বুয়া যা রান্না করতো, তা-ই খেয়ে দিন কাটতো বেশ! তখন পেট ঠান্ডা থাকতো কিন্তু শরীর আরেকটা শরীরের সংস্পর্শ চাইতো! এখন শরীর তৃপ্ত হলেও উদরপূর্তি হয় না!

সেদিন বৃহস্পতিবার বলা চলে কর্মজীবীদের জন্য বউকে সময় দেওয়ার বিশেষ দিন। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলো সায়েম। শিমুর ক্লাস শেষে আরও কী যেন কাজ ছিল, তাই তার ফিরতে প্রায় ১০টা বেজে গেলো। এটা স্বাভাবিক পেশাগত জীবনে। চিকিৎসক স্ত্রীকে রাতেও বাইরে থাকতে হতে পারে! কিন্তু শিমু ফিরে দেখলো মহাদুর্যোগ। সায়েম বিছানায় নিঢল শুয়ে আছে। মনে হয় একেবারে নিস্তেজ। পুরো বিছানা মাখামাখি করেছে। কঠিন ডায়রিয়ায় অবচেতনে টয়লেট সারছে বিছানাতেই! শিমুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে। মুখ দিয়ে কথাও যেন আর আসছে না।

শিমু ঝটপট তাকে টেনে তুললো। তার পরনের পোশাকেও পায়খানা লেগে আছে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই তাকে হালকা পরিষ্কার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সায়েম হাঁটতেও পারছিল না। পথের মধ্যে কয়েকবার বমিও করলো। ডায়রিয়া রোগীদের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো নিতে চায় না। শিমু তাকে আইসিডিআরবিতে নিয়ে গেল। যেটা কলেরা হাসপাতাল নামে পরিচিত।

রাত একটার মধ্যেই সায়েমের চিকিৎসা শুরু হলো। শিমু এরই মধ্যে তার অপরিচ্ছন্ন পোশাকগুলো পাল্টে দিয়েছে। ব্যাগে অতিরিক্ত পোশাক নিয়ে এসেছিল। ডিউটি ডাক্তারকে নিজের পরিচয় দিয়ে তার বাথরুমে পোশাক বদলে সারারাত সায়েমের পাশে বসে থাকলো। ভোরের মধ্যে সায়েমের ডায়রিয়া কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলো। তার শরীরে স্যালাইন পুশ করা হলো। সেইসঙ্গে প্রত্যেক ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাবার স্যালাইনও দেওয়া হলো।

সকালে উঠে শিমু দেখলো অসংখ্য রোগীর মাঝে চেয়ারে বসা অবস্থায় সায়েমের পাশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে সে। সায়েমের চোখ খোলা।
‘তোমার শরীরটা এখন কেমন?’ বললো শিমু।
‘পায়খানাটা এখনও কন্ট্রোলে আসেনি। কিন্তু শরীরে শক্তি ফিরে পেয়েছি। তুমি না থাকলে কাল বুঝি মরেই যেতাম।’ বললো সায়েম।
‘ওসব কথা রাখো। তোমার অসুস্থতার খবর এখনও কাউকে দেইনি। আমি একঘণ্টার জন্য হলেও বাসায় যাই। পুরো বাসা নোংরা।’ বললো শিমু।
সায়েম মুখে কিছুটা হাসি আনার চেষ্টা করে বললো, ‘বাচ্চাদের মত পুরো ঘর নোংরা করেছি। তুমি যাও।’
শিমু ঝটপট রওয়ানা হলো। যেতে যেতে একবার ফিরে তাকালো সায়েমের দিকে। তার চোখে পানি। এরপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো।

পথে শাশুড়িকে ফোন দিলো, ‘মা আপনার ছেলে অসুস্থ। এক্ষুণি একটু ঢাকা রওয়ানা হোন।’ তার বাবা-মাকেও জানালো বিষয়টা।
বাসায় গিয়ে সব নোংরা কাপড় ভিজিয়ে ফেললো। বুয়া এসে দেখলো সে কাপড় ধুচ্ছে। বুয়াকে বললো, ‘আমাকে দু’টা রুটি বানিয়ে দাও আর কিছু লাগবে না। তুমি পুরো বাসা ধুয়েমুছে সাফ করো। আজ অনেক মেহমান আসবে। তোমার সাহেব বাইরে।’
সে জানে সত্যটা বললে বুয়া নাক সিটকাবে। কাপড়গুলো সব নিজে ধুয়ে শুকাতে দিল। ঝটপট গোসলটা সেরে হালকা খেয়ে বুয়াকে সন্ধ্যায় আসতে বলে বের হলো।
দিনে আর কোনোরকম বিশ্রামের ফুরসত পেল না। এরই মধ্যে তার বাবা-মাসহ সবাই এসে দেখে গেছে। রোগীর পাশে কেবল একজনের বেশি থাকা নিষেধ তাই চাইলেও তারা কেউ থাকতে পারেননি।

সন্ধ্যায় সায়েমের মা এলেন। সায়েমের অবস্থা কিছুটা উন্নত। শিমুর দিকে তাকিয়ে তিনি অবাক। ‘বউমা তোমার শরীর তো দেখি একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। রাত থেকে ঘুম-খাওয়া কিছুই ঠিকমত হয়নি বুঝি। তুমি এখন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। আমি আছি ওর সঙ্গে।’
‘আপনি এত দূর থেকে জার্নি করে এলেন!’ বললো শিমু।
সায়েম হেসে বললো, ‘তুমি বরং বাসাতেই যাও। মা থাকুক। চেহারার কী হাল বানিয়েছ? যে বউয়ের চেহারা দেখে মুগ্ধ হতাম; সে বউ যদি সকাল পর্যন্ত এখানে থাকে তাহলে কাল তার চেহারা দেখে আমিই ভয় পেয়ে যাবো।’
‘ঠিক আছে।’ বললো শিমু।
সায়েম বললো, ‘বুয়াকে ফোন দিয়ে বলো, যা রেঁধেছে তা নিয়ে যেতে। তাকে দু’দিনের ছুটি দাও। তুমি এখান থেকে সরাসরি তোমাদের বাসায় চলে যাও। বাইরে তো তোমার ছোটভাই শিমুল আছেই।’

নিজেকে পরিপাটি করে রাখা শিমু জীবনে কখনও এত পরিশ্রম করেনি। শরীরের কী অবস্থা তা সে নিজেও জানে। তারপরও স্বামীর পাশ থেকে সরতে মন চায় না। যাওয়ার পথে ফিরে তাকিয়ে দু’ফোটা অশ্রু ছেড়ে দিল। বিষয়টা এবার সায়েম কিংবা তার মা কারো নজর এড়ালো না।

টানা তিনদিন হাসপাতালে থাকতে হলো সায়েমকে। এরপর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে দু’দিন বিশ্রাম নিলো। একদিন সন্ধ্যায় শিমুর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই এলো সায়েমের খোঁজ নিতে। সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। এমন সময় শিমুর বাবা প্রশ্ন করলেন, ‘জামাইকে কী ছাইপাশ খাইয়েছিলি সেদিন, যে এমন ফুড পয়জনিং হলো?’
বাবার কথায় কাচুমাচু করলো শিমু। বললো, ‘ও তো সেদিন বাসায় ফিরে কিছুই খায়নি।’
‘জানি না বুঝি- তোর ওসব এক্সপেরিমেন্টাল রান্না সংসার জীবনেও শুরু করেছিস? ওগুলো খেয়ে কেউ টিকতে পারে? সব দোষ তোর মায়ের। মেয়েকে রান্নাঘরে পাঠাতেও তার আপত্তি। আর মেয়েও মাঝেমাঝে কী সব রাঁধে তাই দেখে খুশি!’ বললেন শিমুর বাবা।
শিমুর মা বললেন, ‘কী শুরু করলে তুমি? থামো, নতুন সংসার শুরু করেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
শিমু অনেক শক্ত। সব সহ্য করতে পারে কিন্তু তার রান্না সম্পর্কে কেউ কটু কথা বললে বেহাল দশা হয়। শব্দ নেই কিন্তু চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে।
‘এই দেখ, বউমা কাঁদছে। আহা, কান্নার কী হলো?’ বললো সায়েমের মা।
তার কান্না দেখে দূর থেকে মুচকি হাসতে শুরু করলো শিমুর ছোট বোন রিমু। ছোটভাই রিমনও হাসছে। তারা জানে একমাত্র রান্না সম্পর্কে কিছু বললে বড়আপু কান্নাকাটি করে!
সায়েম কথা বলে উঠলো, ‘আসলে বাবা, সেদিন রাতে হোটেলে খেয়েছিলাম তো। তাই বুঝি এমন হলো।’
রিমু বললো, ‘হোটেলে খেতে গেলেন কেনো দুলাভাই?’
‘আসলে সত্য বলতে কী- শিমু যা রান্না কারে তা খেয়ে আমার চলে না। আমি মাছ, মাংস, ডাল-ভর্তা এসব দেশি খাবার পছন্দ করি। ওসব ফ্রায়েড রাইস, চিকেন ফ্রাই আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ে আমার চলে না। তাই রাতে হোটেলে খেয়ে এসে বাসায় যা পাই- তাই খাই!’ আমতা আমতা করে বললো সায়েম।

কেউ আর সায়েমের দিকে তাকালো না। সবাই তাকালো শিমুর দিকে। চোখ থেকে পানি ঝরছে। নাকটাও লাল টকটকে হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে সে বললো, ‘তুমি এমন কথা বলতে পারলে। রান্না ভালো লাগে না। কী খেতে চাও আমাকে কখনও বলেছ। সবার সামনে স্বামী-স্ত্রীর প্রাইভেট কথা বলে দিলে। সাতদিন সংসার করে বিনিময়ে এই পেলাম! আমি কী তোমার ব্যক্তিগত কথা কাউকে বলেছি। তুমি যে প্রায়ই আন্ডারওয়্যার উল্টো করে পর- এটা কী আমি কাউকে বলে দিয়েছি।’ চোখের সঙ্গে নাক দিয়েও টপটপ পানি পড়ছে তার।
সবাই হেসে ফেললো। কেউ কেউ লজ্জায় মুখ লুকালো। রিমু একটা রুমাল এগিয়ে দিল শিমুকে। সে চোখ-মুখ মুছলো। স্ত্রীর শিশুসুলভ আচরণে সায়েম অবাক। না হাসতে পারে, না কিছু বলতে পারে।
সায়েমের মা বললো, ‘বুঝেছি। আর কাউকে কষ্ট দেব না। এখন থেকে আমি বউ-ছেলের সঙ্গেই থাকবো। বউমার পড়াশোনাও চলবে আর আমার থেকে রান্নাও শিখে নেবে। তার জানা সুন্দর রান্নাগুলো আমিও শিখে নেব।’
‘খুব ভালো সিদ্ধান্ত বেয়ান।’ বললেন শিমুর বাবা।
শিমু খুশি হয়ে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘কিন্তু মা আপনার ছেলে সবার সামনে আমার ইজ্জত নষ্ট করলো।’
রিমু বললো, ‘দুলাভাই কাজটা ঠিক করেনি রে আপু। এভাবে ইজ্জত নষ্ট করা ঠিক না!’
পুরো রুমে হাসির বন্যা।

গিন্নী এবার পাক্কা রাঁধুনি হবে- এটা ভাবতে সায়েমের কেমন যেন খুশি খুশি লাগছে। যদিও আজ রাতে শিমুর একান্ত তোপের মুখে পড়তেই হবে তাকে।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।