মণিপুরী ভাষা : সংগ্রহ সংরক্ষণ ও চর্চা


প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ১৪ জুন ২০১৭

ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে বাংলাদেশের মণিপুরীরা দুটি শাখায় বিভক্ত— মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ। দেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত সিলেট অঞ্চলে মণিপুরীদের বাস। বৃহত্তর সিলেটের চারটি জেলা সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার প্রায় এগারোটি উপজেলায় সুদীর্ঘকাল যাবৎ মণিপুরীরা নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে লালন করে দৈনন্দিন জীবনাচারে স্বীয় ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পালন করে আসছেন। মণিপুরী নৃত্য ও সংস্কৃতি তাদের গর্ব যা দেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। এক ধর্ম ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়েও মণিপুরীদের মধ্যে দুটো ভাষা বিদ্যমান। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা ইন্দো-আর্য শ্রেণীভুক্ত আর মণিপুরী মৈতৈ ভাষা তিব্বত-বর্মা শ্রেণীভুক্ত। দুটি আলাদা উৎস থেকে উৎপন্ন হলেও মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরী মৈতৈ ভাষা নিকটাত্মীয় এজন্য যে, পূর্বোক্ত ভাষা পরোক্ত ভাষা থেকে প্রচুর পরিমাণে শব্দসম্ভার নিগমবন্ধন বা আত্তীকরণ করেছে। Edward Tuit Dalton তাঁর Descriptive Ethnology of Bangal গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘The Valley (Manipur) was at first occupied by several tribes, the principal of which were named khumal, Angoms, Moirang and methei.’ মৈতৈরা পূর্বদিক থেকে এবং বিষ্ণুপ্রিয়ারা পশ্চিম দিক থেকে মণিপুরে প্রবেশ করে প্রাচীনকালে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করে। কাছাড়ের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে উপেন্দ্র চন্দ্র গুহ উল্লেখ করেন, ‘প্রাচীনকালে মণিপুর উপত্যকায় একটি বিস্তীর্ণ জলাভূমি ছিল। পার্বত্য নদীসমূহের আনিত পলি মাটি দ্বারা ক্রমে জলাভূমি ভরাট হতে থাকে। কালক্রমে এ ভূ-ভাগে পাঁচটি দ্বীপের উৎপত্তি হয়। অতি প্রাচীনকালে কামরূপ, কাছাড় ও ত্রিপুরা হতে মণিপুর ও ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত একটি বিশাল আর্যোপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলের প্রায় সর্বত্র যেখানে যেখানে সমুদ্র মানুষের বসতির জন্য একটু স্থান দিয়ে সরে গিয়েছে, তার সর্বত্রই আর্যগণ কর্তৃক অধ্যুষিত হয়েছিল।’

মহাভারত মহাকাব্য আদিপর্ব ২১৪ অধ্যায়ে আর্যশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন কলিঙ্গতীর্থ ও তত্রত্য পুণ্যতীর্থ অতিক্রম করে সুরম্য হর্ম্ম্যাবলী দর্শন করে তাপসগণ পরিশোভিত মহেন্দ্র পর্বত অতিক্রম করে সাগর উপকূলমার্গে মণিপুর গমনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। তথায় মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে দর্শন ও বিবাহ এবং পুত্র বভ্রুবাহনের কাহিনি ও বর্ণিত রয়েছে। বভ্রুবাহন দীর্ঘদিন মণিপুর রাজত্ব করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রাঙ্গদা গীতিনাট্যে অর্জ্জুন-চিত্রাঙ্গদার মণিপুর কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। বর্তমান মণিপুর মহাভারতোক্ত মণিপুর কি না- এ প্রশ্নে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে নানা মত পরিলক্ষিত হয়। বৃহৎবঙ্গ গ্রন্থকার দীনেশচন্দ্র সেন বর্তমান মণিপুরকে মহাভারতের মণিপুর বলে মত দেন। কালক্রমে পনেরশ’ খ্রিষ্টাব্দের পর মণিপুরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো একত্রীকরণ শুরু হয়। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি মানুষের নয়টি শাখায় বিভিন্ন কালে ভারতে এসেছে; এবং তাদের মিশ্রণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের অধিবাসীদের উদ্ভব ঘটেছে। এই মিশ্রণ ক্রিয়া কোথাও গভীরভাবে হয়েছে, কোথাও উপর উপর হয়েছে। আর্যভাষি জনগণ রক্তে ও সভ্যতায়, ধর্মে ও সংস্কৃতিতে যারা পাশাপাশি বাস করতে থাকে তাদের সঙ্গে মিশ্রিত হতে শুরু করে। এই মিশ্রীকরণ বা জাতীয় সমীকরণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে ও খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রকের পূর্বাহ্নেই এই সমীকরণ নিজ বিশিষ্ট পথে চালিত হয়। প্রাচীন ভারতীয় জাতি তখন কিছু পরিমাণে মোঙ্গোলের ও মিশ্রণের ফলে প্রথম নিজ বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করে। আর্যভাষী চিন্তানেতাদের মনীষা, তাঁদের উদারতা ও দূরদৃষ্টি, এই সাংস্কৃতিক মিলনকে একটি পরিপূর্ণ নবীন সংস্কৃতি গঠনের পথে চালিত করতে সমর্থ হয়।’ (সাংস্কৃতিকী ১ম খণ্ড) বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ ভাষাভাষি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি সহাবস্থান, পরবর্তীতে একই ধর্ম ও সমাজ সভ্যতার উত্থান তাদের মধ্যে এক অবিমিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। কীর্তন, রাসলীলা ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি নৃত্য তাল মান লয় একই ধারায় চালিত হয়। তাই মণিপুরী সংস্কৃতি বিভিন্ন স্বতন্ত্র জাতির নিজ নিজ বিশিষ্ট সংস্কৃতির সমন্বয়ের ফল। উভয় ভাষাই মণিপুরের মাটিতে সৃষ্টি হয়।

The Background of Assamese Culture গ্রন্থের লেখক বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ তাঁর মণিপুরী জাতির ইতিবৃত্ত নিবন্ধে বলেন, ‘কত যুগের কত মানুষের ধারা কত দিক হইতে আসিয়া মিশিয়া এক দেহে লীন হইয়া বর্তমান মণিপুরী জাতির সৃষ্টি করিয়াছে। তথাপি রহিয়া গিয়াছে দুইটি স্বতন্ত্র ধারা- মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া। আদিতম অধিবাসী ও কিরাত গোষ্ঠীর স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহের কনিকা ও অবহেলিত নয়।’

বাংলাদেশে (পাকিস্তান আমলে) প্রথম ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা আদিবাসী বিষয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেন আবদুস সাত্তার মহোদয়। ১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত ‘আরণ্য জনপদে’ গ্রন্থে তিনি ১৯টি জাতিসত্তার বিস্তৃৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। মণিপুরী জাতিসত্তা বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মণিপুরীরা দুই শাখায় বিভক্ত যথা বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ। এরা প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ একটা বীরের জাতি। বহু যুগের রক্তস্রোতের আবরণে তাদের স্বরূপ আচ্ছন্ন হয়ে আছে।’ (পৃ-২৯৭)। তিনি তাঁর গ্রন্থে সংগৃহীত ৬০টি শব্দমালাও সংযোজন করেছেন।

ইতিহাসের পথ পরিক্রমার বিভিন্ন সময়ে মণিপুরীরা (মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া) মণিপুরের বাহিরে কাছাড়, সিলেট, ত্রিপুরা, মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য মণিপুর-বর্মা যুদ্ধ, রাজ পরিবারসমূহের কলহ, ব্রিটিশ কর্তৃক এ রাজ্য দখল তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মণিপুরের বাহিরে ছড়িয়ে পড়া এসব মৈতৈ মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীগণ তাদের ভাষার পূর্ণরূপ নিয়ে বাহিরে এসে একসঙ্গে একই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। সিলেট অঞ্চলের সমগ্র মণিপুরী সমাজ ও একই সময়ে একই ঘটনা প্রবাহে, নিজস্ব ভাষার পূর্ণরূপ নিয়ে বসতি স্থাপনের পর তাদের পারিবারিক পর্যায়ে ও সমাজে স্ব স্ব ভাষা ব্যবহার করে আসছেন।

মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা
বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরীদের বৃহত্তম সম্প্রদায়ের ভাষা বলা চলে। ড. জি এ গ্রিয়ার্সন এ ভাষাকে Indo-Aryan Family এর Eastern Group (Eastern Language ) বা ভারতীয় আর্য শাখার পূর্বাঞ্চল ভাষার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ভারতীয় আর্য প্রশাখা থেকে ক্রমশ বিবর্তন ও পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা অহমিয়া, উড়িয়া ও বাংলা প্রমুখ মাগধীজাত ভাষাগুলোর সহোদরা স্থানীয়া। আবার চাকমা ভাষার সঙ্গেও নৈকট্য রয়েছে। কোন ভাষার যথার্থ পরিচয় ওই ভাষার মৌখিক বা কথ্যরূপের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। সুতরাং মুখের ভাষার প্রয়োজনীয় নিদর্শনসমূহের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তুলনার মধ্য দিয়ে একটি ভাষার যথার্থ বিশ্লেষণ বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটন সম্ভব। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন লোকগীতি হলো ‘বরণ ডাহানির এলা’ বা ‘বৃষ্টি আবাহনী সংগীত’।
‘খুমেলর মাটি হুকেইলো বরণ দিয়াছে দৌরাজা।’
অর্থাৎ খুমলের (প্রাচীন বিষ্ণুপ্রিয়াদের আবাসভূমি) মাটি অনাবৃষ্টিতে ফেটে চৌচির হয়ে গেল। বৃষ্টি দাও, হে বৃষ্টির দেবতা (ইন্দ্র)। খরার সময় রাত্রিকালে বৃদ্ধ মহিলারা মাঠে গানটি গেয়ে অভিনয় করে বৃষ্টি আবাহন করলে ইন্দ্র দেবতা তা শ্রবণ করেন এবং বৃষ্টিপাত হয় বলে বিশ্বাস রয়েছে। এখনও অনাবৃষ্টির সময় গ্রামের বৃদ্ধ মহিলারা গানটি গেয়ে থাকেন। আর একটি প্রাচীন সংগীত হলো ‘মাদৈ-সরালেল এলা বা মাদৈ-সরালেল’। রাজকন্যা মাদৈ এবং রাজা সরালেল সম্পর্কিত এ গানটি অনুমান ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের রচনা। মাদৈ সরালেল গানটি নিম্নরূপ-
‘মাদৈ গিদেই সালুইলী, বকচা বাধিয়া সালকরলা
কতিয়ৌ দূরেই ইলীতা,
টেঙারা সিঞ্চাঙ লালুইলী বাবারো মাটিয়ো না দেখলো
কতিয়ৌ দূরেই ইলীতা।’
মাদৈ, এক রাজকন্যাকে সরালেল (দেবতাদের রাজা) এর কাছে বিবাহ দেওয়া হয়। সে সরালেলের প্রাসাদের দিকে রওয়ানা দিল। কন্যার সঙ্গে যাবতীয় যৌতুকাদি জোগাড় করে বেঁধে দেওয়া হলো। মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অভিভাবক মাদৈকে সজ্জিত করে পাঠান। বাধা-বিঘ্ন কাটিয়ে জঙ্গলাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে সে চলে গেল। যেখান থেকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখছে শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম-গঞ্জ আর মা-বাবার আদর-সোহাগে জড়ানো বাবার ভিটেমাটি বাড়িটিকে কিন্তু চলার দূরত্ব গতি সেই শৈশব স্মৃতি বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখতে পেলো না না বাবার ঘরটি। সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

যেকোন ভাষার সবচেয়ে স্থায়ী রূপ হলো- সর্বনাম, ধাতুবিভক্তি ও ক্রিয়াবিভক্তি। এক ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দসম্ভার গ্রহণ করতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যয়ও গ্রহণ করতে পারে কিন্তু ক্রিয়াবিভক্তি, ধাতুবিভক্তি ও সর্বনামের ক্ষেত্রে নিজস্ব রূপ অপরিবর্তিত থেকে যায়।

রূপতত্ত্ব বা শব্দগঠন প্রণালির (Morphology) দিক থেকে-
ক. সর্বনাম : যেমন- তাঙি, তাঙরেনো, তাঙোরে, তাঙোরাঙ, তাঙোরাঙতো, তাঙোর, তাঙোরাঙ ইত্যাদি।
খ. ক্রিয়া-
বর্তমানকালেpresent

অতীত কালে
past

ভবিষ্যৎ
future

বচন
১. সন্বন্ধবাচক শব্দের পরে ‘গাছি’ শব্দ যোগ করে বহুবচন গঠিত হয়। যেমন- ইমাগাছি (মায়েরা), আপনাগাছি (আপনারা), খুড়াগাছি (চাচারা) ইত্যাদি।
২. জাতিবাচক শব্দ ‘গো’ প্রত্যয় বা ‘হান’ প্রত্যয় যোগ করে একবচন গঠিত হয়। যেমন- শৌগ (ছেলেটি), মানুগো (মানুষটি), ঘাটহান (নদীটি), পাতাহান (পাতা) ইত্যাদি।
৩. স্বল্পসংখ্যক শব্দে ‘গো’ বা ‘হানি’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বহুবচন গঠিত হয়। যেমন- মানুগি (অল্পসংখ্যক), ফুতিহানি (সামান্য কাপড়), পাতাহানি (কয়েকটি পাতা) ইত্যাদি।

ধ্বনিতত্ত্ব
মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার ধ্বনি সংগঠন বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে
১. ও ধ্বনি অন্য অঞ্চলে ঔ ধ্বনিরূপে স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়। যেমন-
ওহান (ওটা) - ঔহান
ওগো (ঐটি) - ঔগো, ইত্যাদি।

২. কোন কোন ক্ষেত্রে খ-ধ্বনি অন্য অঞ্চলে হ-ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। যেমন-
আখিগ - আহি (চক্ষু)
দেখুরি - দেহৌরি (দেখা যায়)
রাখাল - রাহাল (রাখাল বালক) ইত্যাদি।

৩. অ-ধ্বনি, অঞ্চলভেদে উ-ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন-
কই - কুই (কোথায়)
বইচা - বুইচা (ছোট মাছ)
ফরদানি - ফুরদানি (উড়া)
সেংকম - সেংকুম (দুধ) ইত্যাদি।

৪. ল-ধ্বনি অঞ্চল ভেদে ন-ধ্বনিতে পরিণত হয়। যেমন-
গুলি - গুনি (সামান্য)
নিঙোল - নিঙোন (কন্যা/মেয়ে)
চৌল - চৌন (চাল)
বেলি - বেনি (সূর্য)
মালক - মানক (মাতা) ইত্যাদি।

বাংলাদেশের মণিপুরী সমাজের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী প্রয়াত শ্রী দীননাথ সিংহ মহাশয় ১৯৮০ সালে এ ভাষার ইমার ঠার পত্রিকায় ‘মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাতত্ত্বর রূপ’ নামে একটি মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ওই প্রবন্ধে তিনি সংস্কৃত থেকে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় আগত শব্দসমূহ চিহ্নিত করেন। যেমন-
moni-word

অবিভক্ত ভারতবর্ষে উপভাষা সংকলন ও প্রাথমিক পর্যায়ে উপভাষা বিশ্লেষণে জর্জ এ গ্রিয়ার্সনের অবদান স্মরণীয়। তিনি কয়েকটি বৃহৎ খণ্ডে কয়েকটি ভাগে ভারতে প্রচলিত ভাষার নমুনা বিশ্লেষণসহ ভাষাসমূহের তুলনামূলক শব্দাবলি ও ভাষা পরিস্থিতি জরিপ করেন। তাঁর সম্পাদিত ও সংকলিত Linguistic Survey of India গ্রন্থে বিধৃত যীশু খ্রিষ্ট প্রোক্ত Parable of the Prodigal son অর্থাৎ অমিতব্যয়ী পুত্রের কাহিনির প্রথম কয়েকটি ছত্র মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।

বাংলা সাধু ভাষায়
এক ব্যক্তির দুইটি পুত্র ছিল। তন্মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্র পিতাকে কহিল- পিত: এ সম্পত্তির যে অংশ আমার হইবে, তাহা আমাকে দিন। তাহাতে তিনি আপন সম্পত্তি তাহাদের মধ্যে ভাগ (বণ্টন) করিয়া দিলেন।

মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষায়
মুনি আগোর পিতক দুগো আছিল। তাঙি দিয়োগো রাঙ্তো খুলা অগোই বাপোক্-অরাঙ মাতালো-বাবা, মি পেইতুউ বাগনর সারুক অতা দিয়া-দে। তাঙোর বাপোকে দোন্ (=ধন) অতা বাগিয়া (=ভাগিয়া) দিয়া-দিলো।

বিচারপতি মু. হাবিবুর রহমান বাংলাদেশে চালু আছে এমন কয়েকটি ভাষা নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের মাসে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ওই পত্রিকায় মৈতৈ মণিপুরী ভাষা বিষয়ে তিনি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। তিনি ড. কে পি সিংহের মত উদ্ধৃত করে নব্য ইন্দো-আর্য ভাষার উৎপত্তির কালে কিংবা তার ঠিক পরেই অর্থাৎ ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার উদ্ভব বলে উল্লেখ করেছেন।

চলবে-

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, তাজপুর ডিগ্রী কলেজ, সিলেট এবং মণিপুরী সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে পিএইচডি।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।