স্বতন্ত্র স্বরের লেখক : কবিতায় গদ্যে


প্রকাশিত: ০৭:৪৫ এএম, ১২ জুন ২০১৭

একটি সাধারণ শব্দ তখনই অসাধারণ হয়ে ওঠে; যখন কবি তাকে কৌশলে এবং প্রকৌশলে তার সাধারণত্বকে বিশেষ মহিমা প্রদান করেন। এইসব বিশেষ মহিমাপ্রাপ্ত শব্দ সমষ্টি যখন অপরাপর অন্যান্য শব্দ সমবায়ের সঙ্গে বিশেষভাবে বিন্যস্ত হয় তখন তা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। কবিতা নামক যে প্রপঞ্চের জন্য এত সাধনা আমাদের তার অন্যতম প্রধান নিয়ামক এইসব প্রয়াস। কবি ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার ভেতরে ঢুকলে উপর্যুক্ত কথাগুলোই প্রথম নাড়া দেয়। কারণ সাধারণ আটপৌরে এবং বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলোই তিনি তার কবিতায় ব্যবহার্য করে তোলেন। কিন্তু কবিতা নামক কাঠামোর আদলে যা প্রদর্শিত হয় তা আর সাধারণ থাকে না। হয়ে ওঠে অন্য কিছু। বোধকরি কবিতার ভেতরে আমরা নিরন্তর এই অন্য কিছুই খুঁজে ফিরি। মোহাম্মদ নূরুল হকের কবিতার ভেতরে হামেশাই দেখা মেলে এই অন্য কিছু। যেমন-

‘নগরে নেমেছে বৃষ্টি- গতরে জোয়ার
এমন বাদল দিনে হায়
আকাশ আন্ধার করে মেঘ নামে কার?

মেঘে মেঘে চমকালে প্রেমের বিদ্যুৎ
কার খোঁজে সম্ভ্রান্ত সন্ধ্যায়;
অতুল প্রসাদ ধরে গান—
বধূ, এমন বাদলে তুমি কোথায়?

এমন বৃষ্টি মুখর বিরস নগরে
মজে বিরহের ধারাপাতে
প্রেমের কবিতা লেখে যদি চণ্ডীদাস
কার গতরের নদী ঢেউ তোলে রাতে!’
(এমন বাদলে : উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়)

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মাতাল নদীর প্রত্নবিহার’ ২০০৯ সালে প্রকাশের আগেই বাংলা কবিতায় এক স্বতন্ত্র স্বরের কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান কবি। কারণ তার দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং নিরীক্ষাকালেই ধৃত হয়ে যাচ্ছিল স্বতন্ত্র স্বরের স্মারকসমূহ। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের আগে প্রায় দেড় দশক এই কবি কবিতায় চালিয়েছেন নিরীক্ষা। রত থেকেছেন সাধনায়। চর্চায় থেকেছেন নিমগ্ন। পঠন পাঠনে থেকেছেন নিবিষ্ট। তারই ফল হিসেবে নতুন সময়ের নতুন কবিতা হিসেবে স্মারক-চিহ্নিত হয়েছে তার কবিতাগুলো:
ডালিম দানার মতো লাল-লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দী রাধিকার স্তন। আর—
সমস্ত আকাশ সেই শিক্ষিত মন্থন দৃশ্য দেখে
নাক্ষত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।

জ্বলন্ত সূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকেছি চণ্ডীদাস।
আয় রজকিনী ঘাটে—রসের দিঘিতে আমি ঢেউ।
নদী নদী জল এনে—আয় তৃষ্ণা মেটাবি দীঘির।
জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফণা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাশ প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করি—রাত খাই কালান্ধসন্ধ্যায়
বয়স্করাতের দীঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।

তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?
(স্রোতের নামতা : মাতাল নদীর প্রত্নবিহার)

মোহাম্মদ নূরুল হকের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘স্বরচিত চাঁদ’। প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘উপ-বিকল্প সম্পাদকীয়’ কাব্যগ্রন্থখানি। প্রকাশের ধারাবাহিকতা প্রমাণ দেয় কবিতার প্রতি তাঁর নিমগ্নতা এবং চর্চার ধারাবাহিকতার। এই অস্থির সময়ের বাস্তবতাঘাত যখন নির্মম, বৈষয়িক সমৃদ্ধির দিকে যখন অধিকাংশের তীব্র মনোযোগ তখন একজন কবির কবিতার প্রতি এমন গহীনতর নিমগ্নতা আমাদের আশাবাদী করে তোলে বৈকি।

মোহাম্মদ নূরুল হকের কবি পরিচয়টির সমান্তরালে চলে আসে আরো কয়েকটি পরিচয়। তারমধ্যে বিশেষ উজ্জ্বলতর হলো প্রাবন্ধিক পরিচয়টি। কাব্যচর্চার এহেন গভীর সাধনার ভেতরেই তিনি চর্চা করে চলেছেন গদ্যের এবং মোটাদাগে গদ্য নামীয় প্রপঞ্চের ভেতরে সাহিত্যের যতসব শাখা রয়েছে তার সবগুলো শাখাতেই তিনি আলো ফেলেছেন তাঁর নিজস্ব বীক্ষণের। কী কবিতায়, কী উপন্যাসে, কী ছোটগল্পে, কী প্রবন্ধে, কী ইতিহাস চর্চায়, কী লিটলম্যাগ চর্চায়। ভাবতে অবাক লাগে- তার এহেন সাহিত্য চর্চার বয়সেই তিনি ইতোমধ্যে জনক হয়েছেন ছয়টি প্রবন্ধগ্রন্থের। সাহিত্যের এমন কোনো কাঠামোগত এবং প্রকরণগত উপাদান নেই যে, সে অঞ্চল নিয়ে তিনি কাজ করেননি।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরের বছরই বের হয়ে যায় তার প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ। ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’ প্রকাশ হয় ২০১০ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের মতোই এই গ্রন্থটি প্রকাশের পর আলোচনায় উঠে আসে তার নাম। কারণ তরুণ লেখকদের গদ্যচর্চার দিকে খুব একটা ঝুঁকতে দেখা যায় না। সেখানে এ গ্রন্থটি সমন্বিত হয়েছে বিশটি প্রবন্ধের বন্ধনে। শুধু তাই নয়- বিষয় হিসেবে এখানে শুধু স্থান পেয়েছে কবিতা-ই। শুধু কবিতাবিষয়ক বিশটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে একটি গ্রন্থের জনক মোহাম্মদ নূরুল হক- এই উদাহরণটি যেকোন তরুণ প্রজন্মের কাছে বিশেষ উৎসাহ-উদ্দীপক হিসেবে বিবেচিত হবে।

ঠিক পরের বছর বের হয় ‘সমালোচকের দায়’ প্রবন্ধগ্রন্থটি। এখানে সমালোচক হিসেবে একজন লেখকের কী ধরনের দায়বদ্ধতা থাকা দরকার তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ২০১২ সালে বের হয় তার দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ ‘অহংকারের সীমানা ও অন্যান্য’ এবং ‘সমকালীন সাহিত্য চিন্তা’। ‘অহংকারের সীমানা ও অন্যান্য’ গ্রন্থটিতে ষোলোটি প্রবন্ধ রয়েছে। বিষয়ের দিক থেকে এ গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলো বিচিত্রমুখী। এখানে মৌলিক গদ্যের পাশাপাশি রয়েছে বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, মহাদেব সাহা, আবু হাসান শাহরিয়ার, আমিনুল ইসলাম, সেলিনা শেলী, রহমান হেনরীর কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ। রয়েছে লালসালুর ধর্মানুভূতি ও স্থানিক বিভ্রান্তি নিয়ে প্রবন্ধ, রয়েছে নাজিব ওয়াদুদের ছোটগল্প, আরজ আলী মাতুব্বরের মনীষা, কবির চৌধুরীর চিন্তাবিশ্ব, তপন বাগচীর গবেষণা এবং বাংলা সাহিত্যের ভাষার গত ষাট বছরের বিবর্তন নিয়ে প্রবন্ধ।

‘সমকালীন সাহিত্য চিন্তা’ গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলোও নানা বিষয়ে। এখানেও মৌলিক প্রবন্ধের পাশাপাশি রয়েছে কবিতা ও ছোটগল্প নিয়ে বিশ্লেষণী গদ্য। রয়েছে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার আত্মজাগরণীমূল্য নিয়ে ভিন্নরকম বিশ্লেষণী প্রবন্ধ। রয়েছে আল মাহমুদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নিয়ে প্রবন্ধ, রয়েছে রাহাত খানের গল্পের জীবনজিজ্ঞাসার অন্বেষণ। এ গ্রন্থের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ হলো ‘বিষাদ সিন্ধুর এজিদ ও লালসালুর মজিদের সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য’। সাহিত্যের চরিত্রের এমন তুলনামূলক পাঠের চর্চা আমাদের দেশে বিরল বললেই চলে।

২০১৩ সালে বের হয় তাঁর আরেক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সাহিত্যের রাজনীতি’। এরপর একটু বিরতি। ২০১৬ সালে বের হলো ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’ গ্রন্থটি। গ্রন্থটির বিশেষত্ব পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কবিতার সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ এবং বাঁকবিস্তারী কবিদের নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা। এতে যেমন কবিদের সামগ্রিক কবিতার বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে তেমনি পাশাপাশি উঠে এসেছে এ অঞ্চলের কবিতার ইতিহাসের বিবর্তনের ধারাবিবরণ। একইসঙ্গে সময় শাসিত চিহ্নগুলো এবং চিহ্নশাসিত সময়ের বাঁকগুলো তিনি নির্ধারণ করেছেন। একটি গদ্যে একটি গ্রন্থের একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবেও বইটি উল্লেখ্য।

আমাদের প্রবন্ধগুলোকে মোটামুটি দু’টি ভাগে ভাগ করা চলে। এক. একাডেমিয়। দুই. মুক্তগদ্য। একাডেমিয় গদ্যের ভেতরে শুধু একাডেমিই থাকে, প্রাণ থাকে না। থাকে তথ্যের সমাহার। তত্ত্বের উদাহরণ। অন্যদিকে মুক্তগদ্য তো মুক্তই। সে কারো ধার ধারে না। তাতে একটি রচনার প্রকৃত বিশ্লেষণ উঠে আসে না। মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট হলো তিনি একইসঙ্গে একাডেমির কাঠামো এবং মুক্তগদ্যের উদারতা প্রয়োগ করতে পারেন। ফলে তা হয়ে ওঠে প্রকৃত বিশ্লেষণী। হয়ে ওঠে প্রকৃত প্রতিচিত্র। বের হয়ে আসে লেখকের প্রকৃত সৃজনশীল মানস-কাঠামোর বিবরণ। বের হয়ে আসে লেখকের প্রকৃত অভিনিবেশ। একজন প্রকৃত প্রাবন্ধিকের প্রকৃত কাজ বোধ এটিই।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।