আমি কান পেতে রই : দ্বিতীয় পর্ব


প্রকাশিত: ১০:১৪ এএম, ০৭ জুন ২০১৭

পাঁচ.
গ্রামে পৌঁছতেই সন্ধ্যা নেমে গেলো! দুইধারের সবুজ গাছের সারি আর ছোট ছোট বিল পেরিয়ে হাসান যখন নিজেদের বাড়ির দিকে ফিরছিল; কী রকম নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছিলো সে বারবার। যেন শৈশবের সেই সবুজ মাঠ, ধানক্ষেত, টিয়াপাখির ঝাঁক। অবিরাম ঠিক সেই শৈশবের আকাশ দেখছিল সে মুগ্ধ হয়ে। জামান বললো, ‘এই অন্ধকারে কী দেখছিস?’
‘আমার শৈশব দেখছি দোস্ত। ছোটবেলায় এইসব রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি কত। ওই যে বলেশ্বর নদী, ওখানে সাঁতার কেটেছি। মাছ ধরেছি। এখানকার স্কুলে পড়েছি। অনেক স্মৃতি।’
‘কতো বছর পরে এলি?’
‘অনেককাল পরে। ঠিক মনে নেই। হাই স্কুল পাস করে ঢাকায় হোস্টেলে থেকে মানুষ হয়েছি। তার আগে পর্যন্ত এই গ্রাম মানে তালগাছিয়ায় থাকতাম আমরা। একটা অদ্ভুত ভালো লাগার মধ্যে কেটে যেত সারাটা সময়।’
‘আসলেই সেই দিনগুলি ছিলো সত্যি আনন্দের।’
মাথা নাড়ে হাসান।

ওরা যখন বাড়ি ফেরে তখন রাত। সোলায়মান মিয়া বাড়ির লোকজন নিয়ে উঠানের মুখে অপেক্ষা করছিলেন। আমজাদ হাতে একটা হ্যাজাক লাইট নিয়ে দাঁড়িয়েছে। ইব্রাহিম মিয়ার হাতে একটা বাঁশের লাঠি। ড্রাইভার বেলাল মিয়াও মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিলো। সবাই হাসানকে দেখেই উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। হাসান বিনীত ভঙ্গিতে সোলায়মান মিয়াকে জড়িয়ে ধরে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। বাড়ির মেয়েরাও মাথায় কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়েছে লাইন দিয়ে। হাসান আর জামান সেই ভিড় ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢোকে অন্যরকম এক আনন্দ নিয়ে।

অনেকটা জোড়-জবরদস্তি করেই মুক্তা আপা নিয়ে এসেছে রিমিকে নিউমার্কেটের এক গোল্ডের দোকানে। রিমির কাছে যেসব ব্যবহার্য গয়না আছে তা বিক্রি করার জন্য। রিমির মনটা কী রকম খুঁত খুঁত করে, ‘আপু হাসানকে না বলে এতো বড় একটা কাজ করা কি ঠিক হবে?’
‘অবশ্যই ঠিক হবে। তাছাড়া গয়নাগুলোতো তোর। এগুলো বিক্রি করে কিছু নগদ টাকা তো হাতে রাখতে হবে। তোদের পরিবারের জন্যই দরকার হবে। পরে আবার আয়-উপার্জন ঠিকঠাক হয়ে গেলে কিনে ফেললেই হবে।’
‘আপু তবুও আমার কীরকম যেন লাগছে। ওকে না বলে এতোগুলো গয়না বিক্রি করে দেবো?’
‘আরে তুই তো দেখি অনেক যন্ত্রণা করিস! যা করছি তোর ভালোর জন্য করছি। টুকটাক টাকা-পয়সার জন্য এখন আর ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।’
রিমি চুপ হয়ে থাকে। নিজের মায়ের পেটের বোনের কথা তো আর ফেলে দেওয়া যায় না! একজন ভদ্রলোক খুব গম্ভীরভাবে গয়নাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। ক্যালকুলেটরে হিসাব-নিকাশ করছেন। অনেকক্ষণ পর মাথা নেড়ে বললেন, ‘নাহ, একদম খাঁটি। ভালো।
‘কি?’
‘আপনার গয়নাগুলোর কথা হচ্ছে ম্যাডাম।’
রিমি আনমনে মাথা নাড়ে। ভদ্রলোক এবার ফিসফিস করে বললেন, ‘আপনার হিসেবে কয় ভরি?’
‘জ্বি, নয় ভরি।’
ভদ্রলোক দোকানের ভেতরে চলে গেলেন। মুক্তা আপা বিস্মিত দৃষ্টিতে হিসেব করছে। রিমির এখন আর খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে- অাপার কথা শুনে ভালোই হয়েছে। নগদ কিছু টাকা হাতে থাকলে ভালো।

ভদ্রলোক ফিরে এসেছেন। তার কণ্ঠ বেশ সহজ আর সাবলীল। ‘ম্যাডাম, আপনাকে আমরা সর্বোচ্চ চার লাখ দিতে পারবো।’
টাকার কথা শুনে বুকের ভেতরটা কীরকম করতে থাকে রিমির। তবু সে হেসে মাথা নাড়ে। মুক্তা আপা নির্বিকার চিত্তে টাকাগুলো তার নিজের ব্যাগে ঢোকায়।

ছয়.
হাসানের কানাডার ভিসা হওয়ার খবর শুনে বেশ হতাশ হলেন সোলায়মান মিয়া। হতাশ হলে তিনি দু’টো কাজ করেন। হয় খুব চুপচাপ হয়ে যান নয়তো অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করতে থাকেন। তিনি আজ দ্বিতীয় পথ বেছে নিয়েছেন। হাসান সত্যি বেশ ভয় পেয়ে গেলো। সবচেয়ে চেচামেচি করছে ওদের বাড়িতে থাকা ইব্রাহিম মিয়া। এমনিতে সে ভালো কিন্তু বিদেশ-বিভূঁইয়ের কথা শুনলেই মাথাটা কীরকম এলোমেলো হয়ে যায়।
‘এই যে ভাইজান, যারা বিদেশ যাইতাছেন, তারা বালের দেশে যাইতাছেন, অন্যের দেশে থার্ড ক্লাস নাগরিক হইয়া থাকেন। আপনাগো জিনিস ছোট। লজ্জা লাগে না? নিজের দেশ ফেইলা অন্যের দেশে যাইতে?’
ইব্রাহিমের মতো একটা অর্বাচীন, মূর্খ- শুধু এইভাবে কথা বলার সাহস পেলো সোলায়মান মিয়ার জন্য। তবু ধৈর্য ধরে চুপচাপ থাকে হাসান। সোলায়মান মিয়ার কাছে আসে। শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘বাবা ইব্রাহিম মিয়া এতো রিঅ্যাক্ট করছে কেন?’
‘ওর মাথায় সমস্যা বাবা। বিদেশের কথা শুনতে পারে না সে। অনেক অত্যাচার হইছে তার জীবনে। তাই কেউ বিদেশ যাইতে চাইলেই সে ওইরকম আচরণ করে। তুমি কিছু মনে নিও না বাবা।’
‘না বাবা। আমি কিছু মনে করি নাই।’
‘তাহলে আমার কথা শোনো বাবা মন দিয়া।’
‘জ্বি বাবা।’
‘আমার সবমিলিয়ে জমি ৩০ বিঘা। এই জমি শুধু বর্গা দিয়েই সারা বছর আমার ভালোই চলে যায়। তার উপর নিজের নার্সারি, ফলের বাগান, আলুর বাগান, সুপারির ব্যবসা তো আছেই। গ্রামের লোকজন আমারে মান্য করে। এসব ফালায়া আমি তো অন্য কোথাও যাবো না। তাছাড়া তোমার আম্মাজানও এই মাটিতে শুইয়া আছেন। আমি তোমারে একটা রিকোয়েস্ট করি।’
‘জ্বি বাবা বলেন।’
‘তুমি সিদ্ধান্ত বদলাও।’
হাসানকে খানিকটা বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে। তবু সে হেসে বলে, ‘এতো বড় একটা সুযোগ। আর তো আমার জীবনে না-ও আসতে পারে বাবা।’
‘এদেশে থাকলে এরচেয়েও বড় সুযোগ আসবে তোমার। নিজের দেশ ছাইড়া অন্য দেশে সেটল করা কোনো উত্তম কাজ না।’
‘তাহলে আমি কি করবো?’
‘যে চাকরিটা করছো তা মন দিয়ে করো। নিজের ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলো। টাকা লাগলে নাও। নিজে কিছু করার চেষ্টা করো। তোমার টাকার সমস্যা থাকলে আমি দেখবো।’
‘আসলে বাবা, রিমি নিজেই বাইরে যেতে চায়। ওখানে সেটেল হতে চায়। এই সুযোগটা না নিলে আমাদের সংসারে অশান্তি হবে বাবা।’
‘ঠিক না। তুমি নিজের বুদ্ধিতে চলতে শেখো। জীবন এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তোমাকেই উত্তীর্ণ হতে হবে।’
‘কিন্তু বাবা অনেকেই তো বিদেশে সেটল করছে।’
‘তাদের একেকজনের প্রেক্ষিত ভিন্ন। প্রত্যেকেরই বিদেশ থাকার পেছনে শক্ত লজিক আছে। আবার দেখবে এক সময় সফল হয়ে তারাও দেশেই ফিরে আসে। ক্যারিয়ারের মাঝপথে বিদেশ সেটল করাটা বোকামি। তুমি পারবে না। এনিয়ে আর আমি কথাও বলতে চাচ্ছি না।’

হাসান এবার সত্যি হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জামানের দিকে। জামান ফিসফিস করে বলে, আজকে আলোচনা বাদ দে। আরো দুটো দিন থাকি। দেখি পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। আমজাদ মিয়াকে দেখা গেলো গানের দল নিয়ে উঠোনে ঘোরাঘুরি করছে। জামান হেসে বলে, ‘তার চেয়ে চল দোস্ত, আজ রাতে গান শুনি।’ হাসান মাথা নাড়ে। তাকে বেশ বিরক্ত দেখাচ্ছে।

গানের অনুষ্ঠান শুরু করতে দাঁড়িয়েছে ইব্রাহিম মিয়া। তাকে এখন বেশ শান্ত স্বভাবের মনে হচ্ছে। ইব্রাহিম মিয়া চারপাশে তাকিয়ে সবাইকে সালামের ভঙ্গিতে অনুষ্ঠান শুরু করেছে। ‘ভাইসব, একটা দুঃখের অভিজ্ঞতার কথা দিয়া অনুষ্ঠান শুরু করি। মালয়েশিয়া নামের একটি দেশে জমিজমা বিক্রি কইরা দুর্গম এলাকায় শ্রমিকের কাজ নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু পশুর পালের সাথে যেরকম আচরণ করা হয়, ঠিক সেইরকম আচরণ করা হতো আমাদের উপর। নানা ধরনের নির্যাতন, মারধর করতো তারা। একদিন তো গাছের সাথে আমারে ঝুলাইয়া মারছে। অথচ ওই কোম্পানি বছরে তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করতো। একটা মানুষকে কী পরিমাণ কষ্ট তারা দিতে পারে তা চোখে না দেখলে আপনারা বিশ্বাস করবেন না। সেই কষ্ট আর কেউ পাক, আমি তা চাই না। আল্লাহকে বলি- এই ধরনের কষ্ট তুমি আর কাউকে দিও না। আসেন এইবার আমরা গান শুনি।’

অনেকের মতো এতক্ষণ গভীর মনোযোগের সাথে ইব্রাহিম মিয়ার বর্ণনা শুনছিলো হাসান। তার মনটাও খারাপ হয়েছে। কি আশ্চর্য, বিদেশ বিভূঁইয়ে যে এরকম ঘটনা ঘটে তা একবার মাথায়ও আসেনি তার! জামান হেসে বললো, ‘সবার কাজ যেমন এক নয়, সব দেশের প্যাটার্নও এক নয়। অন্তত কানাডার মতো অতো গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশে এসব ঝামেলা কম।’
হাসান হাসে। ‘তারপরও ভাগ্য বড় ফ্যাক্টর।’
‘রাইট হাসান। দেখা যাক, তোমার কপাল কি বলে।’
জামান অন্ধকারের মধ্যে সিগারেট জ্বালায়।

সাত.
সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। তাই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো রিমির। মনটাও ভালো নেই। হাসান জানিয়েছে, এখনও বাবার সাথে কিছুই সেটেল হয়নি ওর। সুতরাং তাকে আরো দুটো দিন থাকতে হবে তালগাছিয়ায়। এক ধরনের হতাশার মধ্যে পড়ে যায় সে। এদিকে সবকিছু ঠিক থাকলে মাসখানেকও বাংলাদেশে নেই তারা। সময় এতো দ্রুত চলে যায় যেন সে জুয়াবাজ এক ঘোড়া। রাহাতের কথা মনে পড়ে তার। রাহাত, জামান আর হাসান একইসাথে ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে একই ফার্মে ঢুকেছে। অথচ দু’বছর আগেই কোম্পানির অনারারি ডিরেক্টরশীপ পেয়েছে সে! স্ট্যাটাসের দিক থেকে হাসানের চেয়েও অনেক এগিয়ে সে।
ইউনিভার্সিটি জীবনে রিমির সাথে দুর্দান্ত বন্ধুত্ব ছিলো রাহাতের। সবাই জানতো, রিমির সাথেই রাহাতের বিয়ে হবে। কিন্তু মাঝপথে বিদেশে একটা ফেলোশিপ করতে যায় রাহাত। রিমির সাথে একটু লম্বা সময়ের জন্যই ছিন্ন হয়ে থাকে রাহাত। সেই ফাঁকে হাসানের সাথে সেটেল ম্যারেজের পাল্লায় পরে একরাতের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় রিমির। তারপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে।

রাহাত বাংলাদেশে ফিরে দেখে রিমি তার বন্ধুর বউ। অনেক তোলপাড় হতে পারতো পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু রাহাত এবং হাসান দু’জনেই সেই থেকে চুপ! তাই বলে সম্পর্কটাও আটকে থাকেনি রাহাত আর রিমির। দু’জনের মধ্যে সম্পর্কটা এখনো টিকে আছে ওদের। হাসান অবশ্য এসব নিয়ে অতো মাথা ঘামায় না। কোনো প্রেজুডিসও নেই তার। নিজের চাকরি আর ছেলের পড়াশোনা নিয়েই সে কনসার্ন বেশি। রিমি ফোন দেওয়ার আগেই ফোন করে রাহাত।
‘হাসানের প্রোমোশনের খবর শুনেছো নিশ্চয়ই।’
‘ও মাই গড! তাই নাকি? ওতো বলেনি কিছু। গ্রেট নিউজ।’
‘তারচেয়েও ভালো নিউজ তো আছে তোমার।’
‘কি?’
‘ওই যে কানাডা যাচ্ছ তোমরা। তা-ও তো জানালে না।’
‘ও... ও। হ্যাঁ, আসলে যেতে তো চাই। কিন্তু ওর বাবাটা রাজি হচ্ছে না।’
‘তুমি গিয়ে বোঝাতে?’
‘মনে হয় না উনি কারো কথা শুনবেন। বাদ দাও। তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করি রাহাত।’
‘বলো।’
‘অনেক তো হলো। এখন একটা বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী হও।’
‘সত্যি বলছো। তুমি সহ্য করতে পারবে?’
‘আমি সত্যি বলছি। যখন ভাবি তুমি এখনও একা আছো; তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না।’
‘ভালো বলেছো। তবে তুমিও এসব কিছুর জন্য দায়ী না।’
‘আমি জানি রাহাত। তোমার ওই হুট করে অসুস্থ হওয়া, পড়াশোনার ব্যস্ততা- এসবকে এখন আর ছোট কারণ বলে মনে হয় না।’
‘আমি জানি। কিন্তু তুমি হুট করে চলে যাচ্ছ, এটা আমি ভাবতেই পারছি না।’
‘আমিও না। কিন্তু বাস্তবতা যে বড় কঠিন রাহাত। আমি শুধু আমার ছেলের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এটা চেয়েছি।
‘আজ আসবে?’
‘কোথায়?’
‘আমার ফ্ল্যাটে।’
‘আসবো।’
‘থ্যাংক ইউ রিমি। দু’জনে আজ সারাদিন বৃষ্টি দেখবো। দু’জনকে ভালোবাসবো। মে বি টুডে উড বি দি লাস্ট ডেজ অফ আস।’
ফোনটা রেখে কীরকম বিষণ্ন হয়ে পড়ে রিমি। তার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। সে আস্তে আস্তে সারা শরীর বিছানায় এলিয়ে শুয়ে থাকে। অনেকক্ষণ।

অনেকদিন পর বৃষ্টি যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামটি। জামান সেই দুপুর থেকেই ঘুমুচ্ছে পাশের রুমে। চারিদিকে কীরকম অন্ধকার হয়ে এসেছে। জানালার ফাঁক গলে বৃষ্টির পানির একটা আলতো ছোঁয়া আসছে হাসানের গায়ে। হাসান বিছানায় গা এলিয়ে একা একা জানালার দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলো। বৃষ্টিগুলো কি ভীষণ দুরন্ত। এক লহমায় ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সব। ঠিক তখন জানালায় উঁকি মারে ইব্রাহিম মিয়া। হাসান কিছুটা চমকে ওঠে। ইব্রাহিমের মুখ হাসি হাসি। ‘ভাইজান, ভেতরে আসবো?’ তার হাতে একটা বাঁশের কঞ্চি।
‘হ্যাঁ, আসো।’
‘বৃষ্টি হয়া ভালো হইছে। মাথা ঠান্ডা। কিছু মনে করেননি তো? ছোটখাটো বেয়াদবি করে থাকতে পারি।’
‘না, কিছু মনে করি নাই।’
‘ভাইজান, একটা কথা বলবো।’
‘বলো।’
‘আপনি বিদেশ যাওয়া বাদ দেন।’
‘কেন?’
‘আপনার অনেক ক্ষতি হয়া গেছে। আরো হবে। সব শেষ হয়া যাবে।’
‘কি বলছো এসব ইব্রাহিম মিয়া?’
‘জ্বি ভাইজান, সত্যি বলতেছি- বৃষ্টি-বাদলার দিনে আপনাকে মিথ্যা বলি নাই।’
‘মানে?’
ইব্রাহিম মিয়া মাথা নিচু করে থাকে। হাসানের কীরকম একটা ভয় বুকের ভেতর আঁটসাঁট হয়ে থাকে। সে ইব্রাহিম মিয়ার কাছে এসে তার ঘাড়ে হাত দেয়। হেসে বলে, ‘কি সমস্যা? বলো আমাকে!’
ইব্রাহিম মিয়া আবারো নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। হাসানের কীরকম অস্বস্তি লাগা শুরু হয়। ইব্রাহিম মিয়া এবার নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টায়, ‘স্যার একটা প্রস্তাব। আমার মেয়ে নুরজাহান বেগম খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়। এই গান বোঝার মতো লোক নাই গ্রামে। তবু সে এই একই গান গায়। আপনাকে দেখলে সে খুব খুশি হবে। আপনি যদি তার গান শুনতেন।’
হাসান ঠিক কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। হেসে বলে, ‘ঠিক আছে। যাবো একসময় ইব্রাহিম মিয়া।’ তবু বুকের ভেতর ভয়টা থাকে। মগজের ভেতর ইব্রাহিম মিয়ার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে তার।

আট.
রিমি যখন রাহাতের ফ্ল্যাটে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা। শোভনকে স্কুল থেকে নামিয়ে বাসায় মুক্তা আপার কাছে দিয়েই তবে তাকে আসতে হয়েছে। রাহাত রিমিকে পেয়ে প্রায় উন্মত্ত। ‘এই, এতো দেরি করলে কেন? তোমার জন্য সারাদিন উজাড় করে বসে আছি।’
রিমি হাসে। ‘একটু ধৈর্য ধরো সোনা।’
‘না। আমি এতক্ষণ ওয়েট করতে পারবো না।’
রিমি সরাসরি চলে এলো ওর বিছানায়। রাহাত সেকেন্ডখানেক গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে থাকে রিমিকে। ‘আরে মশাই, এই প্রেম কতোদিন থাকে দেখবো!’
‘সারাজীবন থাকবে রিমি। প্রমিজ। শুধু একটা রিকোয়েস্ট রিমি।’
‘কি?’
‘আজীবন তুমি এমনই থেকো।’
‘থাকবো। সারাজীবন।’
‘কবে যাচ্ছ?’
‘জানি না। এই তো দিলে আবার হতাশ করে।’
‘কেন?’
‘ভিসা হয়েছে। কিন্তু হাসানের কোন কিছুই সেটেল না। ওর বাবা মোটেও রাজি না।’
‘ঠিকই আছে। তুমি গেলে আমি সত্যি তোমাকে খুব মিস করবো।’
‘যদি না যাই? তোমার সাথে থাকতে চাই?’
‘আমি একপায়ে রাজি।’
রাহাত আর বিন্দুমাত্র দেরি করে না। আবারও গভীর মমতায় রিমিকে জড়িয়ে ধরে।

বিকেলে পুরনো ফার্নিচার ক্রেতা সমীর মিয়া ও তার দলবল হাজির। তিনজন এসেছে। তিনজনই বেশ গাপ্পা-গোপ্পা চেহারার। একজন শুধু ফার্নিচার তুলছে আর ওজন দেখছে। দুলাভাই তাড়াহুড়া করছেন, ‘এই বাসার মালিক বলেন আর মালকিন বলেন- কেউই নাই। ফোনেও পাচ্ছি না তাদের। দু’জনেরই মোবাইল বন্ধ।’
সমীর মিয়া অবাক হয়ে বলেন, ‘মানে?’
‘ডোন্ট অরি ম্যান। তারা তাদের কাজ করছে। আপনি আপনার কাজ করেন।’
সমীর মিয়া মিষ্টি করে হাসেন। বাইরে ছোট্ট পিকআপ ভ্যান এসেছে দু’টো। ড্রাইভার দু’জন সিগারেট ধরিয়েছে। সমীর মিয়া জানালা দিয়ে উঁকি মারে একবার। তারপর আবার ফার্নিচারগুলো দেখতে থাকে সে।
গাপ্পা-গোপ্পা চেহারার একজন বলে উঠলো, ‘বহুত পুরানা মাল হ্যায়! সামাজ গিয়া না?’
‘হা।’
‘দাম তো একদমই পাবো না আমরা! সব শালা পুরনো কাঠের।’
‘তবু সব মিল্লা কতো, বইলা দাও।’
দুলাভাই আগ্রহ নিয়ে দাম শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। সমীর মিয়া এবার তাড়া দিলেন সবাইকে, ‘আরে ওয়েদার ড্যাম আছে। তাড়াতাড়ি মাল তুলো।’
মুহূর্তে মাল তোলা শুরু হয়েছে। দুলাভাই দুবার সমীর মিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করছেন, ‘আরে দাম কতো? কতো দিবেন সমীর ভাই?’
সমীর মিয়া রহস্যময় হাসি হাসেন। ‘ভালোই দাম পাবেন।’ তারপর পকেট থেকে একটা পাঁচশ’ টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘পঞ্চাশ দিলাম।’
দুলাভাই একটা হাসি দিয়ে টাকাটা হাতে নেন। এতক্ষণ পর হাসানের ছেলে শোভন ছুটে এলো। ‘আঙ্কেল, আমাদের জিনিসপত্র এরা নিয়ে যাচ্ছে কেন?’
‘তোমরা চলে যাচ্ছ তো।’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
‘কেন ক্যানাডা?’
‘না, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। এখনও কিছুই ফাইনাল হয়নি। প্লিজ আঙ্কেল, মালগুলো ফেরৎ দিতে বলেন।’
দুলাভাই উত্তর দিচ্ছেন না। বিড়বিড় করে বলছেন, ‘এই ছেলে দেখি মহা ত্যাদোর। ঝামেলা।’ তিনি বিব্রত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন।

সোলায়মান মিয়া গ্রামের কয়েকজন সুধীজনকে দাওয়াত করেছেন বাসায়। উদ্দেশ্য- ছেলের সাথে সাক্ষাত করিয়ে দেবেন সবাইকে। বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক এসেছেন। তারা বৈঠকখানায় চাদর বিছিয়ে বসেছেন। সোলায়মান মিয়ার কথা ভেসে আসছে। উচ্চমার্গীয় আলোচনা। ব্ল্যাকহোল বিষয়ে। তিনি বলছেন,
‘মহাবিশ্বের অন্যতম এক রহস্যময় বস্তু হল ব্ল্যাকহোল। মহাবিশ্বের কিছু স্থান আছে যা এমন শক্তিশালী মহাকর্ষ বল তৈরি করে যে, এটি তার কাছাকাছি চলে আসা যেকোন বস্তুকে একেবারে টেনে নিয়ে যায়। হোক তা কোন গ্রহ, ধুমকেতু বা স্পেসক্রাফট, তা-ই ব্ল্যাক হোল। পদার্থবিজ্ঞানী জন হুইলার প্রথম এর নাম দেন ব্ল্যাক হোল। কেন? কারণ ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ বল এতই বেশি যে, এর আকর্ষণ থেকে এমনকি আলোও (ফোটন) বের হয়ে আসতে পারে না। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার জেনারেল রিলেটিভিটি তত্ত্ব দিয়ে ধারণা করেন ব্ল্যাক হোল থাকা সম্ভব। আর ১৯৯৪ সালে এসে নভোচারিরা প্রমাণ করেন আসলেই ব্ল্যাক হোল আছে।’
এরকম একটা গুরুগম্ভীর আলোচনার ভেতর ঢোকে হাসান আর জামান। সবাইকে সালাম দিয়ে বসে পরে ওরা। সবাই এসে একে একে তার সাথে হাত মেলায়। হাসানের কীরকম সংকোচ লাগে। একজন বললেন, ‘বাবা আপনি হয়তো ভুলে গেছেন। আমি আপনার স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। আমি মজিদ মাস্টার। মনে পড়ে?’
হাসান কথা শুনে খানিকটা লজ্জিত হয়। মজিদ স্যারকে না চেনার কোনো কারণ নেই। মজিদ স্যার বলেন, ‘আমাদের গর্ব ছিলে তুমি। ছোটবেলায় একবার ইন্টার স্কুল গণিত কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিলে তুমি। মনে আছে?’

নিজের জীবনের এতো সামান্য অর্জনটুকু শুনেই মনটা কীরকম আনন্দে ভরে যায় হাসানের। সে-ও বিগলিত হয়ে তাকিয়ে থাকে মজিদ স্যারের দিকে। মজিদ স্যার বলেন, ‘অনেকদিন তো হলো ঢাকায় আছো। তোমাদের কাছে তাই গ্রামের ছেলেমেয়ের অনেক আশা! তোমরাই পারো আমাদের গ্রামটা বদলে দিতে।’ হাসান মাথা নাড়ে। মজিদ স্যার যেন একটু কাছে এসে বসলেন। বললেন, ‘বাবা, আমার কিন্তু কোনো সংসার ধর্ম নাই। বৃদ্ধ বয়সে কে আমার দায়িত্ব নেবে তা-ও জানি না। তবে নিজে একটা লাইব্রেরি করছি। আলোর মশাল জ্বালানোর চেষ্টা করতেছি! এই আশা নিয়া বাঁইচা আছি। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ, আমি আর একটু বৃদ্ধ হইলে আমারে বৃদ্ধাশ্রমে রাইখা দিও। খরচ কিন্তু সব তোমার।’ হাসান মাথা নাড়ে।
আরো দু’জন পাশে বসেছিলেন। একজন মসজিদের ইমাম। অন্যজন ডাক্তার, গ্রামে ফ্রি ক্লিনিক খুলেছেন। রমিজ কাকা হেসে বললেন, ‘বাবা, আমরাই তো আমাদের যার যার অবস্থান থেকে পারি গ্রামটাকে বদলে দিতে।’ ইমাম সাহেব সুর করে বললেন, ‘সুবহান আল্লাহ!’

সোলায়মান মিয়া চুপচাপ বসেছিলেন অনেকক্ষণ। আজ অনেককাল পরে অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ছে তার। সেই একাত্তর সালের স্বাধীনতা। তারপর নিজের দেশে ফিরে আসা। নিজেই কি কষ্ট করে পড়াশোনা শেষ করে অন্তত ডিগ্রিটা পাস করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি চাকরিতে ছিলেন তিনি আরো কিছুদিন। তারপর নিজেকে মুক্ত করে এই গ্রামের উন্নয়নে লেগে আছেন আজ পর্যন্ত। স্কুল করেছেন, মসজিদ বানিয়েছেন। গ্রামে বেশ ক’টি রাস্তা আর কালভার্ট করা হয়েছে। এখন তার শেষ ইচ্ছা বাকি জীবনটা আল্লাহর পথে নিয়োজিত করা। আর সে কারণেই তার পাশে সে চেয়েছিলো হাসানকে। কিন্তু হাসানের এভাবে বিদেশে গিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার ঝোঁক পছন্দ হয়নি সোলায়মান মিয়ার। তার মন খারাপ। সত্যি খুব খারাপ। আবার এদিকে একটা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলছিল। মাঝখান থেকে মাস্টার সব পণ্ড করে দিলো। মনে মনে রাগ করলো সোলায়মান মিয়া। আজ মহা বিস্ফোরণ তত্ত্ব বা মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করার ইচ্ছা ছিলো তার। সোলায়মান মিয়া হতাশ হয়ে বাইরে তাকান।

উঠানে ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে রান্না চাপিয়েছে আমজাদ মিয়া। খিচুড়ি আর খাসির মাংস। সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসছে। নারিকেলের দুধ দিয়ে দেশি মুরগির ডিম ভুনা করছে ইব্রাহীম মিয়া। তাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। দু’টো রাজঁহাসও রান্না হয়েছে মেহমানদের জন্য। ইব্রাহিম মিয়া গুনগুন করে গান ধরে, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর.../ সেথা এক পড়শি বসত করে’। সোলায়মান মিয়া খানিকটা বিরক্ত মুখে তার গান শুনতে থাকে।

চলবে-

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।