আমি কান পেতে রই : প্রথম পর্ব


প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ০৬ জুন ২০১৭

এক.
উত্তরা বারো নম্বর সেক্টরের তিন নম্বর রোডের দুটো বাড়ি পরেই এভারগ্রিন ওল্ডহোম। ঠিক বনেদি কায়দায় অনেকটা পুরনো বিদেশি বাড়ির ঢঙে সাজানো হয়েছে ওল্ডহোমটি। পুরো বাড়ি পাচিল দিয়ে ঘেরা। উঁচু পাচিলের চারপাশে বড় বড় নারিকেল গাছ। একটা শানবাঁধানো ছোট্ট পুকুরও আছে। সব মিলিয়ে বারোটা ফ্ল্যাট। একেক ফ্ল্যাটে একজন করে থাকেন। খুব ছিমছাম পরিবেশ। বাড়ির ভেতরটা বেশ শান্ত আর সৌম মনে হলো হাসানের। হাসান আগে কখনও আসেনি। আগে এরকম চিন্তার প্রয়োজনও পড়েনি। কিন্তু দ্রুত ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা ওর জীবনেও যে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে! তাই বাবাকে ওল্ডহোমে রাখা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই তার।

এতক্ষণ পর হাসান অফিস রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। অফিসের ম্যানেজার কার্তিক বাবু কথামতো তাকে রিসিভ করে ভেতরে নিয়ে আসেন। কার্তিক বাবুর বয়স পঞ্চাশ। চুলগুলো সব পাকা। পাঞ্জাবি-পাজামায় তার চেহারা সাধুর মতো লাগছে। কার্তিক বাবুর পানের নেশা আছে। পকেট থেকে ছোট্ট একটা পিতলের বাক্স বের করে আনেন। তারপর পান মুখে দিতে দিতে বলেন, ‘বৃদ্ধ মানুষ আমাদের কাছে শিশুর মতো। আমরা সেভাবেই খুব কেয়ারফুলি ডিল করি। আপনার বাবা যতই ঝামেলা করুক; আমরা সামলে নেব। আমাদের উপর ছেড়ে দেন।’
হাসান খানিকটা ইতস্তত। কার্তিক বাবুর দিকে তাকিয়ে অনেকটা অসহায় ভঙ্গিতে বলে, ‘আমার বাবা আসলে ঝামেলার লোক নয়। একটু রাগী কিন্তু অসম্ভব ভালো মানুষ। উনি একবার কনভিন্সড হয়ে এখানে আসলেই হবে।’
কার্তিক বাবুর কৌতূহল বাড়ে। ‘আপনি সবকিছু একটু খুলে বলবেন? আপনার বাবা কী এখানে আসতে কনভিন্সড না?’
‘না, মানে বাবাকে এখনও বলিনি। সিদ্ধান্তটা কেবল নিয়েছি তো! আগে বুঝতে পারিনি এতো তাড়াতাড়ি কানাডার ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র পেয়ে যাবো। বাবাও এখন ঢাকায় নেই। গ্রামের বাড়িতে গেছেন আমার বাসার ড্রাইভারের সাথে। বলতে পারেন- হি ইজ নাউ পাসিং লাস্ট ফিউ ফ্রি ডেজ অ্যালোন! ঢাকায় ফিরলেই নিয়ে আসবো।’
‘কিন্তু বলছিলেন যে তিনি কনভিন্সড না!’
হাসান আবার ইতস্তত হয়ে তাকায়। হেসে বলে, ‘আগের দিনের মানুষ তো! এসব জায়গায় হয়তো থাকতে চাইবেন না। গ্রামে বেশ জমিজমা আছে। নিজেদের লোকজন আছে। কিন্তু কারো প্রতি দায়িত্ব দিয়ে আমি ঠিক সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। তাছাড়া গ্রামের জমিজমা সব বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই সবকিছু মিলিয়ে বড় একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি।’
কার্তিক বাবু হাসানের কথা শুনে হাসেন। কাছে এসে খুব শান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের কোনো তাড়াহুড়ো নেই স্যার। যখন উনি রেডি হবেন; তখনই না হয় নিয়ে আসবেন! তবে যারা রাগী, একগুয়ে, বদমেজাজি; তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সিলিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। দেখবেন দু’দিন থাকলেই রাগ একদম পানি!’
হাসান মাথা নড়ে। বিষয়টা জানে সে। দু’জন তরুণী আয়া রাখা আছে এখানে। বয়স্ক এবং রাগী টাইপের ক্লায়েন্টদের ঠান্ডা করে তারা। অনেক সময় প্রয়োজন হলে ফিজিক্যাল রিলেশনেও যায়। এতে বেশ ভালো রেজাল্ট পায় কর্তৃপক্ষ। এগুলো অবশ্য বিজনেস সিক্রেট। একদিন এই ওল্ডহোমের মালিক রতন বড়ুয়া বলেছিলেন তাকে। হাসানের মন কী রকম বিষণ্নতায় পেয়ে বসে। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো লাগতো। হাসান হুট করে বাইরে বেরিয়ে আসে! পেছন পেছন কার্তিক বাবুও আসেন। মিন মিন করে বলেন, ‘স্যার, চিন্তা করবেন না। রতন স্যারও আপনার কথা বলে রেখেছেন। আপনার বাবার জন্য ভালো রুমের ব্যবস্থা হবে। টিভি আছে, ওয়াইফাই আছে। চাইলে আপনি বিদেশ থেকেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে পারবেন। সার্বক্ষণিক ট্রেইন্ড আয়া আছে। সব ধরনের যত্নআত্তি করতে পারবে তারা। আপনি স্যার খুব রিলাক্সড থাকবেন।’ হাসান জোরে জোরে সিগারেট টানতে থাকে।

দুই.
ওল্ডহোম থেকে ফিরে হাসান সরাসরি অফিসে ঢোকে। বিজনেস ফার্ম। জীবনের প্রথম চাকরি। তাও প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে। অফিসটা ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই মনটা হু-হু করে। অফিসের পিয়ন মতিন মিয়া যেন দ্রুত গতিতে চা নিয়ে ঢোকে আজ। হাতে পানির বোতল। তার মুখ হাসি হাসি। ‘স্যার খবর পাইছেন?’
হাসান খানিকটা চিন্তিত। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলেন, ‘কি হয়েছে মতিন মিয়া?’
‘স্যারের তো প্রমোশন হইছে। স্যার চিঠি পান নাই?’
হাসান হাসে। অনেকদিন ধরেই প্রমোশনটা ঝুলে ছিল। সিনিয়র ম্যানেজার থেকে জেনারেল ম্যানেজার। আহ, এই প্রমোশনটা ঘিরে কি না কতো স্বপ্ন ছিল তার। সাউথ কোরিয়ায় পোস্টিং। ফ্যামিলি সেটেলমেন্ট। বাচ্চার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি, রিমির সাউথ কোরিয়াতে নিজের ব্যবসা- কতই না পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু হুট করে কানাডার ভিসাটা ওর সব পরিকল্পনা ওলোট-পালোট করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে অবশ্য রিমি। এই তো কানাডাতে স্থায়ীভাবে ভিসা পেয়েছে শুনে সারারাত ঘুমুলো না। গত সাতদিন ধরে তার লিস্ট চলছে। টুকটাক শপিং চলছে। কানাডায় আত্মীয়-স্বজন ও চেনা-পরিচিত বন্ধুদের লিস্ট হচ্ছে। রিমি কালকে উৎসাহের সাথে বললো, ‘এই শোনো, এখন কানাডায় শীত না?’
হাসান মাথা নাড়ে। রিমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠার ভান করে বলে, ‘এই দেখ, এই নীল রেইন কোটটা আজ কিনেছি।’ খুবই বাজে দেখতে। কিন্তু হাসান মুখ হাসি হাসি করে বলে, ‘অপূর্ব!’

ওর সাত বছরের ছেলে শোভন তার ক্লাসের বন্ধুদের জন্য মন খারাপ করে বসে আছে। ওর দুই বন্ধু রাশেদ আর আবিরের জন্য তার মন খারাপ সারাদিন! ছেলেটার জন্য হাসানেরও মন কেমন করে। আজ সকালে বাসার সামনের কাকের বাসাটা দেখিয়ে বলল, ‘বাবা ওই কালো কাকটা আমাদের সাথে অতো দূরে যেতে পারবে না? তাই না?’
শোভনের কথা শুনে হাসানের বুকের ভেতরটা হু-হু করে। কালো নিরীহ কাকটার জন্য ওরও কষ্ট হতে থাকে। মনে মনে হেসে বলে, ‘উই উইল মিস ইউ কালো কাক।’

হাসানের কলিগ জামান রুমে ঢোকে। কলিগ হলেও সে হাসানের ক্লাসমেট। একসাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্ট থেকে পাস করে একসাথেই জয়েন করেছে এ অফিসে। বলা যায়, হাসানের একমাত্র প্রফেশনাল বন্ধু। তার মুখ হাসি হাসি। ‘কংগ্রাচুলেট দোস্ত। তুমি তো ফাটায়া দিলা!’
হাসান সিরিয়াস হয়ে তাকায়। একটা সিগারেট ধরায়। হেসে বলে, ‘কিন্তু দোস্ত, দিস ইজ টু লেট। আমাকে তো ম্যানেজমেন্টকে আসল ঘটনা জানাতে হবে।’
জামান হেসে বলে, ‘একবার ডিসিশনটা রিভিউ করলে হতো না?’
‘না দোস্ত। রিমির ইচ্ছে নেই। তাছাড়া কানাডার নিউ ইমিগ্রেশন ল’ বেশ কড়া। এখন পার্মানেন্ট রেসিডেন্স পেতে হলে আগে গিয়ে বেশ খানিকটা সময় থাকতে হবে। আমি বেশ সিরিয়াস।’
‘কিন্তু দোস্ত, ওইখানে তুমি চাইলেই পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়া বুড়িগঙ্গা দেখতে পারবা? দিলু মামার আলুর সিঙ্গারা পাইবা? শিল্পকলার প্রোগ্রাম? বেইলি রোডের নাটক? এই যে অদ্ভুত ঢাকা শহর। প্রতিদিন হাজারো রকম যন্ত্রণা তারপরও কি অপরিসীম ভালো লাগা! কত বন্ধু-বান্ধব, বইমেলা, একুশে ফেব্রুয়ারি, বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা- সব মিস করবা! ভাইবা দেখ দোস্ত। ওখানে রবীন্দ্রনাথ নাই, নজরুল নাই, জীবনানন্দ নাই। সবচেয়ে বড়ো কথা, নিজের বৃদ্ধ বাবাকে দেখার কেউ নেই।’
‘কেন ওল্ডহোম?’ জামান হো-হো করে হেসে ওঠে।
‘ওল্ড হোম ইজ স্টিল নট রিকগনাইজড অ্যাজ এ বেস্ট শেল্টার ফর ওল্ড ম্যান, বন্ধু। তাছাড়া সরকারের একটা নতুন আইন হয়েছে। অনেক ঝামেলা। এরচেয়ে গ্রামে নিজের বাড়িতে, নিজের লোকজনের ভেতর তারা অনেক কমফোরট্যাবল। আগে বল- যদি যেতে চাস তো সিরিয়াসলি প্ল্যানগুলো ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে।’
হাসান সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘দোস্ত, আমি নিশ্চিত যাচ্ছি। তুই হেল্প কর।’
একটু আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে জামান।

তিন.
বাসায় এসেই হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে পড়ে যায় হাসান আর জামান। রিমির দুলাভাই আর আপা এসেছে। তাদের দুই ছেলে অমি আর টমিও এসেছে। তারা ড্রইং রুমে হাই ভলিউমে কার্টুন দেখছে। বসার রুমে বসে ভাষণের স্টাইলে কথা বলছেন দুলাভাই কবির সাহেব। সেই ভাষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো রিমি আর তার বোন। দুলাভাই বললেন, ‘কোনো চিন্তা করবা না। কাইলকে আসবে ফার্নিচারওয়ালা সমীর মিয়া। আগে থেকে কেউ ফিসফাস করবা না। একবারে যা দাম হয়, তাই দিয়া নিয়া যাবে সমীর। জেনুইন লোক। পরশু আসবে ইলেকট্রনিক সামগ্রী ক্রেতা ইস্কান্দার আলি। টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, টেলিফোন- এইসব কিনবে সে। তারপর বাসা ফাঁকা হয়া গেলে তোমরা সবাই আমার উত্তরার বাসায় মুভ করবা। সেখান থেকে সরাসরি এয়ারপোর্ট। কি ঠিক আছে? বাসার মালিকরে ইনফর্ম করছো?’
‘জ্বি না।’
‘এইটা তো সবচেয়ে আসল কাজ। তাড়াতাড়ি কথা বলো।’
‘জ্বি বলবো দুলাভাই।’
‘ওইখানে গিয়া কোথায় উঠবা? কার ওখানে থাকবা, তা ঠিক করো। তার সাথে যোগাযোগ করো। দ্বিতীয় সারির আর একটা লিস্ট কইরা রাইখো।’
‘জ্বি রাখবো।’
‘এরপর একটা বড় কাজ হইলো শপিং। কিছু গরম কাপড় সস্তায় কিনতে হবে।’
‘জ্বি কিনবো।’
‘বুড়া মিয়ারে কই রাখবা?’
‘বুড়া মিয়া মানে?’
‘আরে তোমার বাবা! একটা বৃদ্ধাশ্রমে কথা বলো। আমারে গার্জিয়ানশিপ দিয়া যাইও। টাইট দিয়া দিমুনে!’
হাসান খানিকটা ইতস্তত হয়ে তাকায়। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে, ‘কালকে আমি আর জামান গ্রামে যাবো। দু’দিনের জন্য। দেখি বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু একটা করা যায় কি না!’
‘ও আচ্ছা। তোমার ব্যাংক ব্যালেন্সের কী অবস্থা?’
‘আছে মোটামুটি।’
‘সব তুইলা ডলার কইরা ফেলো। তোমার তো দেখি কোন প্রস্তুতিই নাই।’
‘না। অসুবিধা হবে না।’
রিমির বড়বোন মুক্তা আপা এতক্ষণ পর মুখ খোলেন, ‘আচ্ছা বিয়েতে তোরা তো ভালোই গয়না পেয়েছিলি। এগুলো পারলে বিক্রি করে ক্যাশ করে ফেল। বিদেশ-বিভূঁইয়ের ব্যাপার। নগদ টাকা পয়সার দরকার হতে পারে।’
রিমি মাথা নাড়ে। এতক্ষণে ড্রয়িং রুম থেকে প্রচণ্ড শব্দ ভেসে আসে। শোভন চিৎকার করছে। ‘টিভি বন্ধ করো। টিভি বন্ধ করো।’ বাকি দু’জন চিৎকার করছে- ‘না, না। আমরা কার্টুন দেখবো। কার্টুন দেখবো।’ মুক্তা আপা কথা বন্ধ করে ভীষণ কৌতূহল নিয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসে।
জামানকে দেখে রিমি রীতিমত বিমোহিত। ‘জামান ভাই, আপনি অনেকদিন পরে এলেন। ভাবিকে নিয়ে আসতেন?’
‘ও আসবে ভাবি! দেখি খুব শিগগিরই নিয়ে আসবো।’
‘আচ্ছা।’
রিমি মিষ্টি করে হাসে। জামান মনে মনে হাসে, রিমি ভাবিকে বেশ ফুরফুরে লাগছে আজ। গুনগুন করে কিচেনের দিকে পা বাড়ায় রিমি। বাচ্চাদের ফাইটিং শুরু হয়েছে। জিটিএ সান্ড্রাস গেম। শোভন একটা বন্দুক নিয়ে ছুটছে। তার সামনে ওরা দু’ভাই, এরই মধ্যে কে যেন লাফ দিয়ে ড্রয়িং রুমে ছোট্ট গ্লাস টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে গেছে। ভয়াবহ ব্যাপার। সেই দৃশ্য আগ্রহ নিয়ে দেখছে রিমি। হাসানের মেজাজ খারাপ তবু হাসি হাসি মুখে ওদেরকে থামায় সে। ‘এই বাবুরা এসব করে না। ছি! বাবুরা, এদিকে এসো।’ হাসানের কথা ওরা কোন আমলেই নিচ্ছে না।
দুলাভাই এতো হৈ-হল্লার মধ্যেও খুব স্বাভাবিকভাবে ফোনে কথা বলা শুরু করেছেন।

চার.
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছেন সোলায়মান মিয়া। ফজরের নামাজ পড়েছেন। ভোরবেলা বাড়ির উঠোনে হাঁটা তার বহুদিনের অভ্যাস। সোলায়মান মিয়ার বাড়ির চারিদিকে রয়েছে আরো কয়েকটি ঘর। তার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনেরা ঘিরে থাকে তাকে। বাড়ির মুরুব্বি বলে সমাজে এখনো প্রয়োজনীয় সে। লোকজন এই বয়সেও খাতির-যত্ন করে। বিচার-আচারে ডাকে। সোলায়মান মিয়ার ইদানিং দুনিয়ার বিষয়ে আর তেমন আগ্রহ নেই। তিনি বরং অবাক হয়ে সবুজ গাছের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বর বন্দনা করেন। মনে মনে বলেন, ‘আহা, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কী সৃষ্টি! একই গাছ দেখতে সবুজ আর ওর কাঠ থেকেই হয় আগুন। আবার এই যে চোখ মেললেই হাজার হাজার পাখ-পাখালি, কিন্তু কখনও শোনা যায়নি তাদের খাবারের অভাব হয়েছে। কী চমৎকার সৃষ্টি রহস্য আল্লাহ পাকের!’

তিনি হাঁটতে হাঁটতেই দোয়া পড়তে থাকেন- ‘ফাবিয়াই-ই আলা ই রাব্বিকু মা তুকাজ্জীবান- বলো তুমি তোমার প্রভুর কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে’? সোলায়মান মিয়ার সাথে বছরখানেক ধরে থাকেন ইব্রাহিম মিয়া। বছরখানেক হলো মালয়েশিয়া থেকে ফেরত এসেছে সে। বড়ো আশা করে জমিজমা বিক্রি করে, টাকা পয়সা ধার করে মালয়েশিয়ায় রাবার বাগানে শ্রমিকের কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলো। কপাল খারাপ! তাকে ফিরে আসতে হয়েছে। সোলায়মান মিয়ার দূরসম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে সে। সেই থেকে সে এখানে থাকে। মাথায় সামান্য সমস্যা দেখা যাচ্ছে তার ইদানিং। তবু সে-ই খুব বিশ্বস্ত হাতে সোলায়মান মিয়ার দেখাশোনা করে। অন্যজন আমজাদ আলী। সোলায়মান মিয়ার বাড়িতে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। বাড়ির বাজার থেকে রান্না-বান্না সবই সে করে। তাছাড়া কেউ না কেউ বাসায় তাকে সঙ্গ দেয় সবসময়ই। এখন যেমন হাসানের ড্রাইভার বেলাল মিয়া আছে এখানে। অবশ্য আমজাদই রোজ সকালে তাকে নিয়ে যায় বেড়াতে। আজ তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে। তাতে কোন সমস্যা নেই। সোলায়মান মিয়া টের পেলেন তার লুঙ্গির কোচড়ে রাখা মোবাইল ফোনটা বাজছে। বেশ অবাক হয়ে ফোন তুললেন তিনি, ‘হ্যালো, কে?’
‘আব্বা, আমি হাসান। আমরা রওয়ানা দিচ্ছি।’
সোলায়মান মিয়ার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। আহা আমার ছেলেটা কতো বছর পর গ্রামে আসছে! মনে হয় মাইক লাগিয়ে আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে সে এই আনন্দের কথা সবাইকে জানায়। সোলায়মান মিয়া হাসেন, ‘বাপজানের সাথে বউ মা আর নাতি কি আসতেছে?’
‘না বাবা, আমি আসছি জামানকে নিয়ে। শোভনের আবার পরীক্ষা তো!’
সোলায়মান মিয়ার আনন্দ ধরে না। শেষ কবে ছেলেটা এ বাড়িতে এসেছে মনে করতে পারেন না। আসলে যতবার দরকার হয়েছে ততবার সে নিজেই ঢাকায় গিয়েছে। হাসানের আসতে হয়নি। এখন তার বয়স বেড়েছে। ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে কষ্ট হয়। তবু আজকের সকালটা কী রকম প্রিয় হয়ে উঠলো সোলায়মান মিয়ার। মনে মনে আবার পড়লো সে, ‘ফাবিয়াই-ই আলা ই রাব্বিকু মা তুকাজ্জীবান!’

খবর এসেছে ড্রাইভার বেলাল মিয়ার কাছেও। আমজাদ আলীও খবরটা শুনে আনন্দিত। সোলায়মান মিয়া আমজাদের কাছে এসে বললেন, ‘বাজার থেকে দুই-চারটা দেশি মুরগা আনিস। হরির বাড়ি থেকে দুইটা দেশি হাঁস কিনিস। পারলে বাজার থেইকা টাটকা কোরাল কিনিস।’
আমজাদ মাথা নাড়ে। ড্রাইভার বেলাল মিয়া বলে, ‘স্যারের চিংড়ি মাছ খুব প্রিয়। আমারও।’
সোলায়মান মিয়া তার কথা শুনে হাসেন। ফিসফিস করে বলেন, ‘ঠিক আছে, বেলালের জন্য পাইলে কিছু বড়ো চিংড়িও আনিস।’

চলবে-

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।