কবিতার সময় ও মনীষার দান : মননশীলতার অনন্য নিরীক্ষা


প্রকাশিত: ১২:৫২ পিএম, ০২ এপ্রিল ২০১৭

এদেশে লেখকদের বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। তারুণ্যে যে পরিচয় নেন পরে শুধু সেই পরিচয় নিয়েই থাকতে হয়। নাহলে সমূহ সর্বনাশ ঘটে যায়। তরুণ বয়সে যিনি গল্প বা উপন্যাস লিখবেন পরে তিনি যত ভালো কবিতাই লেখেন না কেন, তাকে গল্পকার এবং ঔপন্যাসিকের তকমা নিয়েই চলতে হয়। যিনি কবিতা লিখবেন তিনি কথাসাহিত্যে কবিতার চেয়ে ভালো সাফল্য দেখালেও তাকে কবিখ্যাতির বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। ছড়া লিখলে, প্রবন্ধ লিখলেও একই সমস্যা।

শুরুতে আমাদের এই সমস্যা ছিল না। বিখ্যাত কিছু বিষয় তাই বার বার মনে পড়ে যায় আমাদের। কাজী নজরুল ইসলাম আর তার বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যচর্চার শুরুর দিকটা ছিল বিপরীত। নজরুল ছোটগল্প দিয়ে আর শৈলজানন্দ কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতা লিখতেন। আমাদের দেশে বিভাগপূর্ব কাল থেকেই বহুমাত্রিকতার চর্চা ছিল। ফররুখ আহমদ কবিতায় এবং নাটকে মর্যাদাবান ছিলেন। শওকত ওসমানের কবিতা নিম্নমানের ছিল না। আহসান হাবীব কবিতায় এবং উপন্যাসে সম্মানজনক আসন পেয়েছিলেন। যদিও তাঁর উপন্যাস ছিল মোটে একটা; কিন্তু গণনায় ধরার মতো ছিল। আশরাফ সিদ্দিকী এবং মযহারুল ইসলামরা কবিতা এবং গবেষণায় সমতাবিধান করে চলেছেন। এর পরের ধাপে আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিনরা কবিতা এবং কথাসাহিত্যে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। সৈয়দ আলী আহসান ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান কবিতায় এবং প্রবন্ধসাহিত্যে সাফল্য লাভ করেছেন। কিন্তু আমাদের সংকীর্ণতা তখন থেকেই বোধ হয় দেখা দিতে শুরু করেছে। পরে দিনে দিনে তা এক ধরনের উন্নাসিকতায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা কাউকে একের অধিক ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতি দিতে রাজি হই না। সৈয়দ শামসুল হকের ক্ষেত্রে তো পঞ্চাশের বছরগুলোতে ছোটগল্প, ষাটের দশকের দিনগুলোতে কবিতা, সত্তরের দশকে উপন্যাস, আশির দশকে নাটক এবং নব্বই দশকে তাঁর প্রাবন্ধিক সত্তার বিকাশ হতে দেখি। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ হককে সৌভাগ্যবানই বলা যায়। তিনি সব্যসাচী হিসাবে বহুমাত্রিকতার মর্যাদা পেয়েছেন। আবার দুর্ভাগ্য দেখি ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। তিনি শুরুতে ছোটগল্প লিখেছেন। কিন্তু আমাদের কালের পাঠকেরা তাঁকে প্রাবন্ধিকের বেশি মর্যাদা দিতে অপারগ। তাঁর ছোটগল্পও পাঠকের সামনে আনা উচিত।

এর পরে আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং হুমায়ুন আজাদকে বহুমাত্রিকতায় দেখা গেলেও আমাদের সেই সংকীর্ণতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। আমরা তাদের একের অধিক বিষয়ে মর্যাদা দিতে রাজি হই না। এর পর থেকে পরিস্থিতি আরো কঠোর এবং কঠিন হতে শুরু করেছে। আমাদের সংকীর্ণতা বাড়তে বাড়তে নিজ নিজ বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি। তবে আমার বিশ্বাস, এই সাহিত্যবিচার পদ্ধতি এদেশে স্থায়ী হবে না। একদল তরুণের আবির্ভাব হবে, যারা বহুমাত্রিক প্রতিভা অনুসন্ধান করে বেড়াবেন। বিদেশে যেহেতু বহুমাত্রিকতার কদর আছে। তাঁরা বিদেশি সাহিত্যের পাঠক হলেও স্বদেশের সাহিত্যের অঙ্গনের হতাশাজনক শূন্যতার কারণে বহুমাত্রিক প্রতিভা অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাবেন এবং জাতির সামনে আবিষ্কর্তার মর্যাদা নেবেন। আর যদি তাঁরা বাংলা সাহিত্যের পাঠক হন, তাহলে চিরকালই রবীন্দ্রনাথকে স্ট্যান্ডার্ড ধরে সাহিত্য বিচার করবেন। এখনো এদেশে রবীন্দ্রনাথ উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মর্যাদায় আছেন, তখনো হয়তো থাকবেন।

আরো একটা বিষয়ে আমি আশাবাদী। সেটা হলো প্রকাশনার উন্নতি। আগেকার দিনের অনেক লেখক ভালো কাগজে নিজের একটা বই দেখে যেতে পারেননি। এখন প্রকাশনার সুবিধা, পুঁজি বিনিয়োগের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ও পরিবেশ এবং জনসংখ্যার সাথে সাথে পাঠক ও গবেষকের বৃদ্ধি পুরনো যুগের লেখকদের রচনাবলী, সাহিত্যসমগ্র, শ্রেষ্ঠসাহিত্য ইত্যাদি প্রকাশনার মাধ্যমে হারানো দিনের অনেক লেখকের রচনাবলী পাঠকের সামনে আসছে। এতে বৈচিত্র্যসন্ধানী তরুণ পাঠকরা বিচিত্র ধারার সাহিত্যের আস্বাদ লাভ করছেন। কাজেই আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।

২.
মোহাম্মদ নূরুল হক মূলত কবি এবং দশক না মানা একজন কবি। তিনি কবিতা লেখেন, পাশাপাশি প্রবন্ধও। তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থের নাম ‘সাহিত্যে দশকবিভাজন ও অন্যান্য’। তাঁর বেশকয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ বেরিয়েছে। সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’। এটি এবারের বইমেলায় প্রকাশিত। এখানে তিনি দশটি প্রবন্ধ মলাটবন্দি করেছেন। নাম প্রবন্ধটি একটি মুক্তগদ্য। বাকি নয়টি নয়জন কবির কবিতা নিয়ে লেখা। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, হেলাল হাফিজ, আবিদ আনোয়ার, হেনরী স্বপন এবং শামীম রেজার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রথমোক্ত কবি থেকে শেষোক্ত পর্যন্ত ব্যবধান প্রায় এক শতাব্দীর। এই এক শতাব্দীর কবিতা নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হক মননশীল আলোচনা করেছেন। কবিতার বিষয়বস্তু, স্বরূপ এবং ছন্দ নিয়ে বাক্যবিন্যাস করেছেন।

অনেক সাহসী উচ্চারণও করেছেন মোহম্মদ নূরুল হক। তিনি জীবনানন্দ দাশ রচনায় লিখেছেন, ‘তিনি অভিজ্ঞতা ও সারবত্তার কথা বললেও, নিজে অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনাকে দিয়েছেন বেশি গুরুত্ব। বলা যায় তাঁর কবিতার বিপুল অংশেই এই কল্পনার প্রাচুর্য রয়েছে।’

কথা তো সত্য। জীবনানন্দ তো হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছেন বা খেলা করেছেন পুঁথিগত জ্ঞান থেকে কল্পনার ফানুসে উড়ে। ঠিক আছে, টাইম মেশিন ছাড়া ইতিহাস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ অসম্ভব। কিন্তু তিনি যে মহাদেশ থেকে মহাদেশে ঘুরে বেড়ালেন এটা তিনি কেমন করে করলেন? তিনি তো বরিশাল, ঢাকা, কলকাতা আর দিল্লি ছাড়া আর কোনো শহরে বা নগর-মহানগরীতে যাননি। তাহলে তিনি কেমন করে মহাদেশ থেকে মহাদেশ ঘুরে বেড়ালেন। রবীন্দ্রনাথ আর অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ছিল বেশি। তাঁদের পক্ষে এ ধরনের কবিতা লেখা খুবই সম্ভব। এ ছাড়া সুধীন্দ্রনাথ বা বুদ্ধদেব বসুরও কিছু বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ কবিতাকল্পনার ভেতর দিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। সমকালে এই কাজটি সবচেয়ে বেশি করেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি কবিতা এবং কথাসাহিত্যে দেশ-বিদেশ-মহাদেশ সব ঘুরে বেড়িয়েছেন।

তবে জীবনানন্দ দাশের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও তার কবিতায় রসের ঘাটতি নেই। তিনি অভিজ্ঞতার জায়গা পূর্ণ করেছেন কল্পনা দিয়ে। আরেক জায়গায় নূরুল হক লিখেছেন, ‘জীবনানন্দ দাশের কবিতা মাদকতাপূর্ণ। তাঁর কবিতা মগজে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না, কিন্তু হৃদয়কে আলোড়িত করে।’

জীবনানন্দ দাশের কবিতা জনপ্রিয়তা লাভ করার আরেকটা বিষয় উল্লেখ করেছেন লেখক, ‘জীবনানন্দের কবিতায় ব্যক্তি তার নিজের আবেগ-অনুভূতির অকৃত্রিম প্রকাশ দেখতে পায়। কখনো কখনো মনে হয় এই অভিজ্ঞতা জীবনানন্দের নয়, তার (পাঠকের) নিজেরই।’

পরের প্রবন্ধ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। এখানে তিনি লিখেছেন, ‘সুধীন দত্ত কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে প্রজ্ঞার স্মারক করে তুলেছেন। চিন্তাশূন্য কল্পনাবিলাসিতার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে তাঁর কবিতা। সঙ্গতকারণে অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে তাঁর কবিতার রস আস্বাদন অনায়াসসাধ্য নয়।’

এ উক্তির সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করার সুযোগ রয়েছে। পাঠক আরো অন্য কারণে সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় হোঁচট খেতে পারেন। তা হলো শব্দভাণ্ডার। আভিধানিক শব্দমালা ব্যবহার করার কারণে তাঁর কবিতায় প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বুদ্ধদেব বসু এদিক লক্ষ্য করেই বলেছিলেন, ‘তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য নয় দুরূহ মাত্র।’ অপরিচিত শব্দকে ‘কঠিন’ বলার প্রবণতা একটা বাজে দিক। শব্দগুলোর অর্থ জেনে নিতে পারলে তখন সুধীনের কবিতা আনারসের মতোই সরস মনে হয়। কাঁটার ঝোপ পার হয়েই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। এক্ষেত্রে মাইকেলের প্রসঙ্গও এসে পড়ে। যিনি ‘মেঘনাদবধকাব্য’ রচনা শুরু করেছিলেন ‘গাইব মা বীররসে ভাসি মহাগীত’ বলে। কিন্তু তিনি বীর রসে মহাকাব্যটি লিখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তা সম্পন্ন হয়েছে করুণ রসে। মধুসূদনের এ কাব্যেও পাঠক প্রথমে লৌহকঠিন দ্বারে আঘাতপ্রাপ্ত হন অপরিচিত শব্দভাণ্ডারের কারণে। কিন্তু শব্দগুলো বুঝে নিলেই দেখা যায় মহাকাব্যটি শুরুই হয়েছে এক ভয়াবহ করুণ দৃশ্যের মধ্য দিয়ে। ‘সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি/ বীরবাহু চলি গেলা যমে যমপুরে।’

এখানে থেমে গেলেই পাঠক ব্যর্থ হবেন। এর পরের বর্ণনা সত্যি চোখ ফেটে পানি আসার মতো। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারাই তো কঠিন। সুধীনের কবিতায় স্পষ্ট দুটি ভাগ দেখা যায়। প্রথম দিকে কবিতায় তিনি প্রেম খুঁজে বেরিয়েছেন। আর পরের কবিতাগুলোর বিষয় বিধাতা অনুসন্ধান। সুধীনকে যারা নাস্তিক মনে করেন তারা ভালোভাবে তাঁর কবিতা বুঝেছেন বলে মনে হয় না। তিনি নিখিল নাস্তির পক্ষে। কিন্তু ঈশ্বরের অনস্তিত্বের পক্ষে নন। কারণ বেদান্ত দার্শনিকের সন্তান তিনি, পারিবারিক পরিবেশে ছিল সর্বদাই সনাতন ধর্মের ঈশ্বরের উপস্থিতি। দুই মহাযুদ্ধ, দেশি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির আঘাত, দেশভাগ, দাঙ্গা, ব্যক্তিগত জীবনে পেশাগত অনিশ্চয়তা, দাম্পত্য অশান্তি, সন্তানহীনতা এসব তাঁকে চরমভাবে হতাশ করেছে, কিন্তু তিনি পিতার পরিবারে প্রতিষ্ঠিত ঈশ্বরকে স্বচ্ছল পিতার মতো ভক্তি দিয়ে বরণ করে নিতে পারেননি। তাই সর্বদাই খুঁজে বেরিয়েছেন একটু শান্তি অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব। পাশ্চাত্যের দর্শন, ভারতীয় দর্শন, এমনকী মধ্যপ্রাচ্যের ওমর খৈয়ামের কবিতায়ও তিনি ঈশ্বর খুঁজে বেরিয়েছেন।

মোহাম্মদ নূরুল হক কবিতা আলোচনায় জীবনানন্দের চেয়ে সুধীন্দ্রনাথকে বেশি শব্দ-বাক্য উপহার দিয়েছেন। তিনি সুধীন্দ্রনাথের কবিতার অনেকগুলো প্রবণতা তুলে ধরেছেন। কিছু চরম সত্যও প্রকাশ করেছেন।

শামসুর রাহমান প্রবন্ধে যত কথা লিখেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাক্যগুলো এই: ‘শামসুর রাহমান জানতেন, কিভাবে দিনানুদিনের ঘটনাকে কবিতা করে তুলতে হয়। তাই তিনি কবিতার ভাষাকে করে তুলেছেন, শিক্ষিত বাঙালির মুখের ভাষার কাছাকাছি। এমনকি কখনো স্থানীয় ঢাকাবাসীর মুখের ভাষাও। তবে, প্রতিদিনের ঘটনার ভেতর থেকেও তিনি কবিতার রসদ কুড়িয়ে এনেছেন।’

কেউ কেউ বলেন, শামসুর রাহমান কলকাতার ভাষায় লিখে গেছেন। অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি সম্পূর্ণরূপে ঢাকার ভাষায় লিখেছেন। ঢাকা শহরকে মুঘলদের প্রতিষ্ঠিত শহর বলা হতো আগে। সর্বশেষ গবেষণায় প্রমাণ, ঢাকা তারচেয়েও পুরনো শহর। সুলতানি আমলেও ঢাকা শহরের অস্তিত্ব ছিল। বিষয়টা নিয়ে তর্ক করার কিছু নাই। একেবারে সোজা বিষয়, মুঘলরা কি নতুন একটা নগর প্রতিষ্ঠা করে এখানে আঞ্চলিক রাজধানী করেছিল, নাকি প্রতিষ্ঠিত এই শহরটা কেন্দ্র করে প্রশাসনিক আদালত ইত্যাদি স্থাপন করেছিল। শহরটা আগেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই শহরের ভাষায় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি-তুর্কি শব্দের ব্যবহার ছিল হিন্দু-মুসলমান সবার মুখের ভাষায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় সে প্রবণতা উল্লেখ করার মতো। নূরুল হক এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত না লিখেও সংক্ষেপে জানিয়েছেন ঢাকার স্থানীয় অধিবাসীদের মুখের ভাষার কথা বলেছেন। তবে শামসুর রাহমানের কবিতার রাজনৈতিক দিকটাই নূরুল হক বেশি আলোকিত দেখেছেন এবং আলোচিত করে তুলেছেন।

আল মাহমুদের কবিতা আলোচনার আগে গ্রন্থের নামপ্রবন্ধটিতে মোহাম্মদ নূরুল হক ‘বাকচাতুর্য’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন। যা আল মাহমুদের কবিতার আলোচনা পড়ার সময় ভুলে থাকা যায় না। আল মাহমুদের কবিতায় যদি বাকচাতুর্য বড় একটা বিষয় হয়, তাহলে নূরুল হকের আলোচনা বা প্রশংসা কি কৃত্রিম হয়ে যায় না? তবে আল মাহমুদের কবিতার গভীর সুরটা তিনি কোথাও ঠিক ধরতে পেরেছেন। যদিও ‘ঠিক সুর’ বলে নিরপেক্ষ কিছু নেই। আল মাহমুদের কবিতা কেমন করে কবিতা হয়ে ওঠে, কীসের সমবায়ে তা হয়ে ওঠে তা প্রাবন্ধিক সুষ্ঠুভাবে আলোচনা করেছেন।

মহাদেব সাহার কবিতা নিয়ে প্রাবন্ধিক যা লিখেছেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি জ্বলজ্বলে বাক্য, ‘তীব্র ভাবাবেগের প্রাচুর্যের ভেতর মহাদেব সাহা নিজেকে করে তুলেছেন বৃহত্তর রসপিপাসুর আরাধ্য।’ মোহাম্মদ নূরুল হকের মতে, মহাদেব সাহা প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, দ্রোহের কবি— শেষ পর্যন্ত মানবতার কবি। অনেকগুলো কবিতার নাম উল্লেখ করে মন্তব্য এবং কিছু কবিতার বিচার এবং কিছু বিশ্লেষণ করে তিনি মহাদেব সাহার কবিতা সম্পর্কে কিছু নতুন ধারণা প্রদান করেন। কিছু পুরনো ধারণাকে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করেন।

বাংলাদেশে যে কয়েকজন তরুণ কবি কবিতার পাঠক এবং পাঠক নয় কিন্তু কবিতার শ্রোতাকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছেন তার মধ্যে হেলাল হাফিজ অন্যতম প্রধান। আর বলা যায় বাকি থাকেন মাত্র একজন, তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। সমকালীন কাব্যরসামোদি পাঠক এবং আবৃত্তির মাধ্যমে শ্রোতৃমণ্ডলীকে আবিষ্ট করে রাখতেন হেলাল হাফিজ। তাঁর কবিতা নিয়ে মননশীল আলোচনা খুব কমই হয়েছে। মোহাম্মদ নূরুল হক সে জায়গাটা পূরণ করেছেন। শুধু পূরণই না। শতাব্দীর কবিতার মহাস্রোতে তার পথটিও তিনি স্পষ্টভাবে শনাক্ত করেছেন। ‘হেলাল হাফিজ কবি— বাইরে দ্রোহের, অন্তরে প্রেমের। তাঁর কবিতায় বিষয়বৈচিত্রের চেয়ে নির্বাচিত অনুষঙ্গের প্রাধান্যই লক্ষণীয়।’ এটি প্রাবন্ধিকের একটি শনাক্তিকরণ উক্তি ও বিচারবচন। তিনি হেলাল হাফিজের ছন্দ নিয়েও আলোচনা করে দেখিয়েছেন তাঁর ছন্দ ব্যবহারের সাফল্যের সোনালি রেখাগুলো।

আবিদ আনোয়ার একটু কম আলোচিত কবি হলেও তাঁর কবিতার নিজস্বতা তুলে ধরেছেন মোহাম্মদ নূরুল হক। লিখেছেন, ‘কবিতা আবিদ আনোয়ারের কাছে কেবল আবেগ প্রকাশের মাধ্যম নয়, প্রজ্ঞা ও মনীষারও স্বাক্ষর। তিনি আধুনিক মানুষের জীবনযাত্রাকে অবলোকন করেছেন গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে। উপস্থিতকালের নিষ্ঠুরতা, গতি ও পোশাকি আচরণ তাকে ব্যথিত করেছে সত্য, বিমর্ষ করতে পারেনি। তিনি কল্পনা, পর্যবেক্ষণ, চিন্তা ও মনীষার মিথস্ক্রিয়ায় আধুনিক জীবনের বহুরৈখিক চিত্র এঁকেছেন।’ কবিতা বিচার ও বিশ্লেষণ করে প্রাবন্ধিক তার ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

হেনরী স্বপনের কবিতা আমাদের কালের বেশি কাছাকাছি। কিন্তু কাব্যভাষায় তিনি যেন অনেকটা দূরতর। প্রচলিত শব্দই তিনি নতুনভাবে ব্যবহার করেন, নতুন অর্থ প্রদান করেন। যে কারণে প্রথমবার পড়ে তাঁর কবিতা অনেকেই বুঝতে পারেন না। জীবনানন্দও সহজ-সরল এবং দৈনন্দিন শব্দে কবিতা রচনা করেছেন। কিন্তু এই সহজ শব্দগুলোর লুকানো অর্থ বের করে আনতে প্রথম দিকে পাঠকের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো। সত্যি বলতে কী, রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিক কবিদের কবিতা বুঝতে শুধু কবিতাই যথেষ্ট নয়। তাদের সম্পর্কে যত বেশি আলোচনা-সমালোচনা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ ধরনের গদ্য পাঠ করা যায় ততই সহজ হয়ে আসে তাদের কবিতা।

সমকালীন কবিতা সম্পর্কেও এই কথা প্রযোজ্য যখন হেনরী স্বপনের কবিতার বই হাতে আসে। নূরুল হকের মতে, ‘হেনরী স্বপন জীবন, সংসারকে দেখেছেন কখনো-কখনো দার্শনিকের চোখে। তখনই নিজেকে যেন কিছু সমাজ থেকে আলাদা করে দূরে স্থাপন করেছেন।’

বাঙালিদের মধ্যে বেশিরভাগ কবিই স্বভাবকবি। শামসুর রাহমান যখন লেখেন, ‘যদি বাঁচি হাজার বছর লিখব।’ তখন বোঝা যায় এই স্বভাব সহজে যাবে না। বুদ্ধদেব বসু সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নতুন প্রবণতার আবহে বলেছেন, ‘স্বভাব কবি নন, স্বাভাবিক কবি।’ আধুনিকদের মধ্যে প্রধান একটি প্রবণতা এই স্বভাবকবিত্ব ঘুচিয়ে নতুন ধরনের কবিতা লেখা। এ কারণে কবিতা অনেক সময় হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য। হেনরী স্বপনের কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণ হিসাবে এটিকে চিহ্নিত করেছেন প্রাবন্ধিক।

সবশেষে আলোচিত কবিতা শামীম রেজার। তাঁর কবিতা নিয়ে প্রাবন্ধিকের মন্তব্য, ‘শামীম রেজা সামাজিক দায় এড়িয়ে স্বপ্রেমে মগ্ন থাকেননি। সামষ্টিক দায় ও প্রেমে খুঁজেছেন আত্মপরিচয়। কারণ, মানুষ যেমন বিচ্ছিন্ন নয় তেমনি সাহিত্য বিচ্ছিন্ন নয়।’

শামীম রেজা সমকালীন শক্তিমান কবি। ‘অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন ও লোকজীবনের যূথবদ্ধ আয়োজনে শামীম রেজা স্বতঃস্ফূর্ত। নদী তাঁর প্রিয় অনুষঙ্গ, নারী প্রিয় সঙ্গ-প্রসঙ্গ। এই দুইয়ের মিথস্ক্রিয়ায় তিনি এঁকেছেন নদীতীরবর্তী জনজীবনের চিত্র; রঙ ছড়িয়ে দিয়েছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সামষ্টিক জীবনেও।’

শামীম রেজার কবিতায় নারী যেমন অনুষঙ্গ তেমনই ইতিহাস ও ভূগোলও বিশেষ স্থান করে আছে। পূর্ববর্তী বক্তব্য-চিত্রকল্পের সঙ্গে পরবর্তী বক্তব্য-চিত্রকল্পের যোগসূত্র স্থাপন করার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক। কিন্তু বিষয়টি প্রাবন্ধিকের মনে সায় পায়নি। তবে শামীম রেজার কবিতা গ্যালারিতে অবস্থিত ভাস্কর্যের মতো নানা দিক ঘুরে ঘুরে দেখেছেন মোহাম্মদ নূরুল হক। আর নিজের দেখাই স্থান পেয়েছে তাঁর রচনায়।

মোহাম্মদ নূরুল হকের এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো সমালোচনামূলক হলেও নিজের কথা প্রকাশ করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছেন। বইটি প্রকাশ করেছে প্লাটফর্ম প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। মূল্য রাখা হয়েছে ২৪০ টাকা।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।