মঞ্চকুসুমের ষাট


প্রকাশিত: ০৪:০৯ এএম, ২১ মার্চ ২০১৭

ষাট পূর্ণ করলেন মঞ্চকুসুম। বাংলা দেশের থিয়েটারে শিমূল ইউসুফ মঞ্চকুসুম অভিধায় খ্যাত। এদেশে মঞ্চনাটকের লতা যখন আলোর ভুবনে মাত্র বিকাশমান শিমূল ইউসুফ তখন কুঁড়ি হয়ে সঞ্চরমান ছিলেন। ঢাকা থিয়েটার তার মৃত্তিকা, রস, চেতনার অনুকূল জল-হাওয়া, পরিবেশ এবং আবশ্যকীয় পরিচর্যা দ্বারা তাঁকে করেছে পূর্ণবিকশিত মঞ্চকুসুম। শিল্পীর জীবন, শিল্পের জীবন অবিরল সংগ্রামের জীবন, সাধনা ও উপলব্ধির নিত্যভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে নতুনতর অভিজ্ঞতা ও ভিন্নতর উপলব্ধিতে উত্তরণ ঘটাবার নিরন্তর প্রয়াস। গণরুচি ও সৌন্দর্যবোধের বিচার শালায় নিত্য নিজকে নানা নতুনরূপে উপস্থাপন। ভারতীয় শিল্প পরিভাষায় অভিনয় শিল্প নয়, কলা। প্রাচীন শাস্ত্রকারগণের ব্যাখ্যায় যে-সকল সৃষ্টি কোনো শাস্ত্র অধ্যয়ন ব্যতিরেকেই দেখে দেখে আয়ত্ব করা যায় সে সবই কলা। যেমন নৃত্য, অভিনয়, কারুশিল্পীর যাবতীয় সৃষ্টি। এ কালে হয় কলার অর্থ সম্প্রসারণ ঘটেছে, নয়তো অভিনয় নিজগুণে শিল্পের স্তরে উন্নীত  হয়েছে কেননা ঊনিশ-বিশ শতকে গোটা বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে অভিনয় বিষয়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ অনেক তত্ত্ব।  সেগুলো অনুসৃতও হচ্ছে দেশে দেশে।

প্রাচীন ভারতেও আচার্য ভরত ও নন্দিকেশ্বর অভিনয় বিষয়ে নিজ নিজ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন বাংলায়ও অলিখিত অভিনয়তত্ত্বের অস্তিত্ব ছিলো। আজও তা ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের বিভিন্ন পরিবেশনায় অনুসরণ করা হয়। নৃত্য-সংগীত-কাব্যিক বর্ণনা কথা এবং বাদ্যযন্ত্রের তালে, ছন্দদোলায় তা বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ঐ নাট্যরীতিকে দ্বৈতাদ্বৈতবাদ আখ্যা দিয়েছেন, অভিনয়রীতিকে বলেছেন বর্ণনাত্মক অভিনয় রীতি। হাজার বছর ধরে প্রচলিত ও ব্যবহৃত শিল্প আঙ্গিক ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির আধিপত্য ও প্রবল চাপে নিরক্ষর লোকমানসের শিল্পরীতি হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিল। শ্রমবিভাজনের নিয়মে বিভাজিত আধুনিক শিল্পের অনেকগুলো আঙ্গিকের (সংগীত, নৃত্য-কাব্য, নাটক-আখ্যান, উপাখ্যান ইত্যাদির) উপস্থিতি লক্ষণীয়। শিমূল ইউসুফ শিল্পী হিসেবে কতটা উচ্চাঙ্গের তা বিচার করতে হলে উপরি-কথিত নাট্যরীতির নাটক পরিবেশনার রীতি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আবশ্যক।

ঢাকা থিয়েটার বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানী অভিযাত্রায় বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার নামক সংগঠনের আওতায় যে-কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করে শিমূল ইউসুফ সেই যজ্ঞাগ্নির ফসল। শিমূল একা নন, সেই যজ্ঞাগ্নির সৃষ্টি আরও অনেকে। তাঁর হয়ে ওঠাকে কোনো অবস্থায়ই তাই এককভাবে দেখবার অবকাশ নেই। এর সাথে যুক্ত সেলিম আল দীন শিল্পীসত্তার বিকাশ, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ নির্দেশকসত্তার বিকাশ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, হুমায়ুন ফরিদী, আফজাল হোসেন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সবর্ণা মুস্তাফা এবং আরও অনেকের অভিনয়শিল্পীসত্তার বিকাশের সম্পর্ক। শিমূল ইউসুফ সকলের মধ্যে শীর্ষস্পর্শী এ কারণে যে, তাঁর সকল প্রয়াস মঞ্চালোকে বর্ণিল, উজ্জ্বল, লোকচক্ষুর সম্মুখে দেদীপ্যমান। তিনি অভিনয় করেন নানা রঙের নানাগুণের, নানান বয়সের, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের, সমাজের ও সামাজিক অবস্থায় বসবাসকারী নারীর চরিত্রে। সে সব চরিত্রের দুঃখ-সুখের বেলোয়ারি কাঁদন-হাসনের আলো-ছায়ায় উদ্ভাসিত তাঁর অভিনেত্রী সত্তা। সেখানে নিয়ত ভাঙা-গড়ার লীলা, আছে আত্মাবিষ্কার, আত্মনির্মাণ ও আত্মপ্রকাশের আকাঙ্খা এবং উপায় উদ্ভাবনের সাধনা।

পরিপূর্ণ ও পরিণত শিল্পবোধ একজন অভিনয়শিল্পীর মূল পাথেয়। অভিনয় কলার উপর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, পৃথিবীর বিভিন্ন তাত্ত্বিকের অভিনয়তত্ত্বে বুৎপন্ন কিন্তু তিনি উন্নত শিল্পবোধের অধিকারী নন; অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার সফল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ নাট্যকারের টেক্সট পাঠ, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আখ্যানের অন্তর্গত চরিত্রের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অবস্থানটি যথার্থরূপে সনাক্ত করতে হয় একজন অভিনয়শিল্পীকে। আরও জানতে হয়, চরিত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার মানসিক  যোগ্যতা, সমাজসম্পর্ক এবং উৎপাদন সম্পর্কের ধরন ও পর্যায়টি। এখানে থামলেই চলে না নাটকটি কোন্ শিল্পমতবাদের অধীন, কোন্ আঙ্গিকের, রসগত বিচারে কোন্ রসের তাও উপলব্ধি করবার যোগ্যতা থাকা চাই অভিনয়শিল্পীর। শিমূল বিল্লাহ পরবর্তীকালে শিমূল ইউসুফ হন সৃজনশীল নির্দেশক নাসিরউদ্দীন ইউসুফের ঘনিষ্ট সাহচর্যে এসে। তাঁদের ব্যক্তি সম্পর্কের পরিণতি বাংলা দেশের থিয়েটারের জন্য পরম আশীর্বাদ হয়েছিল নিঃসন্দেহে।

নাসির উদ্দীন ইউসুফের প্রিয়তম বন্ধু এ কালের যুগস্রষ্টা নাট্যকার বাংলা নাটকের প্রকৃত মুক্তি দাতা নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকে তিনি অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন। এই দুই যুগন্ধর প্রতিভার সংশ্লেষ তাঁকে মঞ্চকুসুম হয়ে প্রস্ফুটিত করেছে যথাবিধি ও যথাসময়ে। তারও আগে তাঁকে শিল্পভুবনের পরকাষ্ঠা যে-সঙ্গীত তাতে দীক্ষা দান করেছিলেন অমর সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। জাগ্রত বাঙালি চৈতন্যের অন্যতম অকুতোভয় সৈনিক, দেশপ্রেমে উজ্জ্বল, দুঃসাহসী ব্যক্তিত্ব আলতাফ মাহমুদ নিহত হন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে। বড়বোন ঝিনু আপার স্বামী আলতাফ মাহমুদ পিতৃ স্নেহে শিমূল ইউসুফের শিল্পীসত্তাকে গড়ে দিয়েছেন। অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পী শিমূলের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ এক পূরণীয় ক্ষতির, অবিস্মরণীয় শোকস্থান, অনিরাময়যোগ্য সজীব ক্ষত; তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা স্পর্শকাতর বিষয়। শিমূলকে বুঝতে হলে তাঁর এই অকৃত্রিম আবেগের গভীরতা উপলব্ধি করা অবশ্যই জরুরি।

অতএব উপরি-বর্ণিত আলোচনার আলোকে যৌক্তিক কারণেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, শিমূল ইউসুফ অভিনেত্রীসত্তার উদ্ভাসনে তিন যুগস্রষ্টা শিল্পীর আলতাফ মাহমুদ (সুরস্রষ্টা), সেলিম আল দীন (বাংলা নাটকের স্রষ্টা এবং দ্বৈতাদ্বৈতবাদের স্রষ্টা), নাসিরউদ্দীন ইউসুফের (বাংলাদেশের আধুনিক থিয়েটারের ইতিহাসে সৃজনশীল নাট্যনির্দেশক যাঁর নাট্যনির্দেশনার বিভিন্ন স্তরকে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোদান করা যেতে পারে এবং তিনি দক্ষ চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিজ্ঞ কুশলী সংগঠক এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি) রয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আলতাফ  মাহমুদের নিকট শিক্ষালব্ধ সংগীতজ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে শিমূল সুরস্রষ্টা হয়ে ওঠেন থিয়েটারে সংগীতের ধরনটি আত্মস্থ করে।

ঢাকা থিয়েটারের নাটকে সংগীত আবহ সংগীত নয়, আরও কিছু; নাটকের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ণনা-কথা-নৃত্য-বাদ্য-সংগীত এই পঞ্চ উপাদানের অন্যতম উপাদান সংগীত। অন্য সকল উপাদানের সাথে সমগুরুত্বেই শুধু নয়, বরং অধিকতর গুরুত্বে বিচার্য সংগীত। আখ্যান, পরিবেশ পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয় সংগীতে। চরিত্রের সংলাপ ও তার মানসিক অবস্থা আবেগ, অনুভূতি, অনুরাগ, বিরহ, অভিপ্রায় ইত্যাদি বর্ণিত হয় সংগীতের মাধ্যমে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের আধুনিক মঞ্চরূপটি গড়ে ওঠে সেলিম আল দীনের হাতে তাত্ত্বিক কাঠামোটিও। মহাকাব্যিক আখ্যান বর্ণনার ধারায় এ রীতির আশ্রয়ে নাট্যকারগণ নাটক রচনা করেন। এক কালের সংগীত শিল্পী শিমূল বিল্লাহ সংগীতের সুর ও বিচিত্র রাগের বাঁধনে মঞ্চের অভিনয়কলাকে আপন দক্ষতায় বেঁধেছেন আঙ্গিক, বাচিক ও সাত্তিক অভিনয়ের ছাঁদে।

রঙ্গমঞ্চে অভিনয় নাটকে বর্ণিত কোনো সামাজিক মানুষের কিংবা পৌরাণিক ব্যক্তি বা স্বর্গীয় দেবদেবীর বিমূর্ত ব্যক্তিত্বকে তার স্বভাব অর্থাৎ দোষ-গুণ, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, সংস্কার, নীতি, নৈতিক আদর্শ, কর্ম ও কীর্তি ইত্যাদির আলোকে রঙ্গমঞ্চে দর্শকের সম্মুখে সুচারু রূপে উপস্থাপন। অভিনেতা এবং নাটকে উল্লিখিত ব্যক্তি ভিন্ন শরীর ও সত্তার দুই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। অভিনয়শিল্পীকে রঙ্গমঞ্চে অভিনেয় চরিত্রটিকে আপনার শরীর-ক্যানভাসে চিত্রিত করতে হয় সৃজনক্ষমতার সর্বাধিক প্রচেষ্টায়। চরিত্রটি বিমূর্ত বলেই অভিনেতার ধ্যানে তার যে-রূপটি মূর্ত হয় তাকেই তিনি হাব-ভাব-অভিব্যক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তার জন্যে প্রথমেই প্রয়োজন চরিত্রটিকে সর্বোতভাবে ব্যাখ্যা করা। তার অন্তর্নিহিত গতিটিকে আবিষ্কার করা।

এই গতি বাহ্যত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও অভ্যন্তরীণ বিবেচনায় তার আত্মার স্পন্দন, রক্তপ্রবাহের গতি, শ্বাসগতি, চরিত্রটির অস্তিত্বে বিদ্যমান বর্ণসমূহের গতি-প্রকৃতি,স্বপ্ন-কল্পনার গতি-প্রকৃতি ও বর্ণিকাভঙ্গ।  প্রত্যেকটি চরিত্রের অভ্যন্তরীণ গতির সাথে তার সামাজিক সত্তা ও সামাজিক চলনের যে-দ্বন্দ্ব  উপস্থিত হয় আখ্যানে নাট্যকার তার মধ্য দিয়েই তাঁর বক্তব্য বা অভিপ্রায় উপস্থাপন করেন। অভিনয় ঐতিহ্যবাহী নাট্যে তাই চরিত্রের ব্যাখ্যা। শিমূল ইউসুফ হাত হদাই নাটকে ব্যক্তি চুক্কনীকে উপস্থাপন করেন না সামাজিক পীড়ন-অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার অধিকার বঞ্চিত চুক্কনীর মর্মস্থিত পঞ্জিভূত বঞ্চনা, স্বপ্ন ভঙ্গের যাতনা, পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতি জাগ্রত ঘৃণার ব্যাখ্যা কার্য-কারণসূত্রে উপস্থাপন করেন। ফলে ব্যক্তি চুক্কনী নয়, স্বকালের তাবৎ বঞ্চিত নারী যেনো তাদের জীবনকথার সাজুয্য খুঁজে পায় তার মধ্যে, চুক্কনীর কথা হয়ে ওঠে তাদের সকলের কথা।

গায়েন, (অঞ্চল বিশেষে অন্য পরিভাষাও ব্যবহৃত) ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের প্রধান অভিনেতা, যিনি সমস্ত নাট্যের সকল চরিত্রের উপস্থাপক। তিনি পাশ্চাত্য অভিনেতার মতো চরিত্রকে তার ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনুপুঙ্খ উপস্থাপন করতে চাইলে একই মঞ্চে অভিন্ন মঞ্চ-সময়ে তার পক্ষে তা হতো অসম্ভব। তিনি প্রকৃত পক্ষে আখ্যানটিকে উপস্থাপন করেন চরিত্রকে নয়। ফলে আখ্যানস্থ সকল চরিত্রের আত্মিক ও সামাজিক অবস্থা, অবস্থানটিও  সেই সঙ্গে দর্শকের সম্মুখে মূর্ত হয়। স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক চরিত্রকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ব্যক্তিগত সকল প্রবণতাসমেত উপস্থাপন করা তার উদ্দেশ্যও নয়। ইউরোপীয় নাটকে চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বহির্দ্বন্দ্বে সৃষ্ট সংঘাতপূর্ণ ঘটনা বা ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আখ্যান উপস্থাপিত হয়, পক্ষান্তরে বাংলা নাটকে আখ্যানটাকেই চরিত্র উপস্থাপনার একমাত্র নিয়ামক জ্ঞান করা হয়। আমাদের বিবেচনায় শিমূল ইউসুফ বিশুদ্ধ অভিনেত্রী হলে বনপাংশুল, প্রাচ্য কিংবা  বিনোদিনী নাটকে তাঁকে অন্যভাবে আবিষ্কার করতে হতো। সুকীর জীবন মান্দাই সম্প্রদায়ের জীবনচর্চা, ধর্মবিশ্বাস কৃত্যের যূপকাষ্ঠে এবং বাঙালি, মান্দাই সম্প্রদায়ের স্বার্থের বিরোধ ভূমিতে কিভাবে বিনষ্ট হলো তার ইতিবৃত্ত বেদনা ও সহমর্মিতার শীর্ষস্পর্শ করে শিমূল ইউসুফের উপস্থাপনায়।

একইভাবে শিমূল ইউসুফ আখ্যানের ব্যাখ্যাতা হিসেবে  সেলিম আল দীনের উল্টা পুরাণ, প্রাচ্য জীবনদর্শনের প্রতিনিধি প্রাচ্য নাটকের কেন্দ্রে পৌঁছে যান। ফলে চরিত্র সয়ফর, নোলক, কিংবা খলনায়ক জিতু মাতব্বর বা ভবিষ্যতে তার স্থলাভিষিক্ত হবে যে-আইজল তাদের সকলকে ছাপিয়ে ওঠে নাটকের দর্শন প্রাচ্য দর্শনের সারাৎসার। শিমূল ইউসুফ সমগ্র নাটকের উপস্থাপক অভিনেতা ভাবে, আবেগে, নৃত্যে, সঙ্গীতে, রস ব্যঞ্জনায় সমগ্র নাটকটিকে ঈর্ষণীয় পরিণতি দান করেন। একটি জটিল আখ্যান তাঁর উপস্থাপনায় সাধারণেরও বোধগম্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বিনোদিনী এবং তাঁর অভিনীত বিপরীতধর্মী বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অধিকারী ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের আত্মার জীবন্তছবি সর্বসম্মুখে মূর্ত করেন অবলীলায়।

প্রত্যেকটি চরিত্র অভিনেত্রীর অস্তিত্বের এক একটি প্রতিফলন হিসেবে মঞ্চভূমিতে দর্শকের দৃষ্টি জুড়ে থাকে। মঞ্চে চরিত্রের ব্যাখ্যা তাই লেখক সৃষ্ট চরিত্র নয়, নাট্যকার সৃষ্ট চরিত্রটি অভিনয়শিল্পীর জীবনবোধ, সামাজিক চেতনা, পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিতে যে-রূপে মূর্ত হয় সেই রূপে উপস্থাপন, সেই বিশেষ রূপটিকে উপস্থাপন। অভিনয় শিল্পীর এ এক দুর্লভ সৃজন ক্ষমতা। শিমূল ইউসুফ শুধু অভিনয় শিল্পী হলে তিনি অন্য দশজন অভিনেত্রীর মতোই চরিত্র রূপায়ণের চিন্তায়ই নিমগ্ন থাকতেন। আশৈশব শিল্পের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে থাকা শিমূল অল্পে তুষ্ট নন, তাই তিনি বরাবর বঙ্গ জনপদের শিল্প-নন্দনতত্ত্বের মূলে পৌঁছতে অনুসন্ধিৎসু।

সঙ্গীতপ্রবণ বাঙালি মানসের সৃষ্টি প্রাচীন ও মধ্যযুগের তাবৎ শিল্পের কাঠামোতে সঙ্গীতের গতিভঙ্গী রক্ষিত। কাব্যিক বর্ণনা সমৃদ্ধ বিশেষ ধরনের আখ্যান, নিজস্ব ধারার নৃত্য, কথা (চরিত্রের উক্তি, প্রত্যুক্তি), নানান রাগের সুরে বাঁধা সংগীত এবং নানান বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে ঐকতান সৃষ্টির উপযোগী ঐতিহ্যবাহী বাংলার নাট্যের বিচিত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিক, এ সকল আঙ্গিকের বিশিষ্টতা, স্বাতন্ত্র্যকে তাত্ত্বিকভাবে উপলব্ধি করতে ও আয়ত্ব করতে প্রয়াসী ছিলেন। নাট্য আঙ্গিকের মতো ঐতিহ্যবাহী বাংলা অভিনয়রীতিটিও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হাজার বছর ধরে পরম্পরাক্রমে তাকে চলমান রেখেছেন আমাদের লোকগায়েন অভিনেতৃবর্গ।

যতদূর জানি, উপরি-কথিত আঙ্গিকের বাংলা নাটকের ধারক, বাহক বাংলার লোকগায়েনগণ তাই তাঁর কাছে নমস্য। তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে সমৃদ্ধ শিমূল ইউসুফ তাই একাধারে, অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, পোশাক পরিকল্পনা শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফ শিল্পী এবং সফল নাট্যনির্দেশক। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের আঙ্গিক ও অভিনয় রীতিকে আধুনিক নাগরিক থিয়েটারে শিক্ষিত পরিশিলিত শিল্পরুচি সম্পন্ন দর্শকের সম্মুখে পৌঁছে দেয়ার সংগ্রামে তিনি অন্যতম অগ্রণী। তাঁর পরিণত শিল্পজ্ঞান, অভিজ্ঞতা আরও সোনার ফসল ফলাবে আমাদের মঞ্চের ইতিহাসে ষাট বছর পূর্তির দিনে এটাই একমাত্র প্রত্যাশা। শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে শিমূল ইউসুফের নিরোগ কর্মময় জীবন প্রত্যাশা করছি।

১৬, মার্চ’২০১৭
অরুণা পল্লী,
লেখক : অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।