চন্দ্রাবতী : মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি


প্রকাশিত: ১১:০০ এএম, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কিশোরগঞ্জ মধ্যযুগের বাংলা সংস্কৃতির রাজধানী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর আর সমতলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন জনপদ কিশোরগঞ্জের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে শিল্প-সংস্কৃতির নানা নিদর্শন। মধ্যযুগের প্রখ্যাত ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতী তেমনি এক কিংবদন্তির নাম। তিনি ছিলেন মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহিলা কবি। মধ্যযুগে বাংলার প্রথম সার্থক মহিলা কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন বাবার মতো ভাসান কবি, গীতিকার আর রামায়ণের রচয়িতা। মৈমনসিংহ গীতিকার পরতে পরতে মিশে আছে কবি চন্দ্রাবতীর অমর কাব্য, প্রেম আর বিরহের উপাখ্যান।

কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাতুয়াইর গ্রাম। এক সময় নির্জন আর বন-জঙ্গলে ঘেরা অনেকটা দুর্গম পাতুয়াইর গ্রাম ছিল ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। এখন আর নদীর কোন চিহ্ন নেই। তবে পাথুয়াইর গ্রামেই মধ্যযুগের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির ও তার পূর্বপুরুষের বাড়ির স্মৃতি বয়ে চলছে আজো। কালের নীরব সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির আর ভগ্নপ্রায় কয়েকশ’ বছরের পুরনো বাড়ি। যার প্রতিটি ইটের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি।

মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা ও ভাসান কবি দ্বিজ বংশী দাস ও সুলোচনা দাসের মেয়ে চন্দ্রাবতীর জন্ম ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে। ময়মনসিংহ গীতিকার সংগ্রাহক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়ণ প্রকাশ করেন। ভাটি বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকা ও সুখ-দুঃখ নিয়ে চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণ, দস্যু কেনারামের পালা ও মলুয়া লোকপালা এখনও মানুষের মুখে মুখে। এখনও বৃহত্তর ময়মনসিংহে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে চন্দ্রাবতীর গীত। বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ চন্দ্রাবতীর পালা আর রামায়ণ।

Chandraboti
কবি চন্দ্রাবতীর অমর প্রেমের স্মৃতি মিশে আছে শিব মন্দিরকে ঘিরে। কিন্তু দীর্ঘদিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহাসিক স্মৃতি। মন্দিরকে ঘিরে একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং কবির স্মৃতি রক্ষায় একটি পাঠাগার গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন পর্যটক ও এলাকাবাসী।

অনিন্দ্যসুন্দরী চন্দ্রাবতীর প্রণয় ছিল শৈশবের বন্ধ ও খেলার সাথী পার্শ্ববর্তী করিমগঞ্জ উপজেলার সুন্ধা গ্রামের জয়ানন্দের সঙ্গে। প্রভাতে দুই বন্ধু মিলে পূজার ফুল তুলে আনতেন। দু’জনের শিশুকালে প্রেম এক সময় প্রণয়ের দিকে মোড় নিতে থাকে। স্থির হয় চন্দ্রার সঙ্গেই বিয়ে হবে জয়াননন্দের। প্রস্তুতি নেয়া হয় সেভাবেই। বিয়ের দিন-ক্ষণও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে ঘটে যায় সেই ট্র্যাজিক ঘটনা। চন্দ্রাবতীর প্রেমিক সুদর্শন যুবক জয়ানন্দ স্থানীয় কাজীর সুন্দরী মেয়ে আসমানির প্রেমে পড়ে যান। চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ওই মুসলমান যুবতীর প্রেমে পড়ে ধর্মান্তরিত হন জয়ানন্দ। বিয়ে করেন ওই যুবতীকে।

এ খবরে হৃদয় ভেঙে যায় চন্দ্রাবতীর। বাবা দ্বিজ বংশী দাসের নির্দেশে আজীবন কুমারী থাকা আর ফুলেশ্বরী নদীর তীরে মন্দির স্থাপন করে শিবপূজায় মন দেন চন্দ্রা। এভাবেই কাটতে থাকে সময়। এক সময় নিজের ভুল বুঝতে পেরে চন্দ্রাবতীর কাছে ছুটে আসে জয়ানন্দ। কিন্তু মন গলেনি চন্দ্রার।

অভিমানী চন্দ্রা আর মন্দিরের দরজা খোলেননি। অনেক ডাকাডাকির পর সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের কাঠের দরজায় চার লাইনের একটি আকুতিমূলক কাব্য লিখেন জয়ানন্দ। ‘শৈশব কালের সঙ্গী তুমি যৈবন কালের সাথী/ অপরাধ ক্ষমা করো তুমি চন্দ্রাবতী/ পাপিষ্ট জানিয়া মোরে না হৈলা সম্মত/ বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো।’ এরপর ব্যর্থ প্রেমিক জয়ানন্দ আত্মগ্লানি আর দহনে পুড়ে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।

Chandraboti
অনেকক্ষণ পর ধ্যান ভাঙে চন্দ্রাবতীর। বুঝতে পারেন জয়ানন্দের স্পর্শে মন্দির অপবিত্র হয়ে পড়েছে। তাই পবিত্র করার জন্য ফুলেশ্বরী নদীতে যান জল আনতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হৃদয়দহনে দগ্ধ হন তিনি। জয়ানন্দ আত্মহত্যা করেছেন জেনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন চন্দ্রাবতী। তবে কারো কারো মতে, নদী থেকে ফিরে এসে চন্দ্রাবতী মন্দিরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয় বলে ধারণা করা হয়।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার পাথুয়াইর গ্রামে কালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অষ্টকোণাকৃতির চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির। পাশেই রয়েছে আরো একটি মন্দির ও ভগ্নপ্রায় একটি দ্বিতল ভবন। বাড়িটি চন্দ্রাবতীর পূর্বপুরুষ জমিদার নীলকণ্ঠ রায়ের বলে ধারণা এলাকাবাসীর। দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন। কিন্তু মন্দিরের দৈন্যদশা দেখে হতাশ হন অনেকে। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি রক্ষার দাবি তাদের।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদ জানিয়েছেন, কবি চন্দ্রাবতীর মন্দির ও বাড়ি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় দখল হয়ে যাওয়া তাঁর পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির দখল হয়ে যাওয়া ভূমি উদ্ধার করা হবে। চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত মন্দিরকে ঘিরে একটি পাঠাগার স্থাপন ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগের কথা জানান এ সরকারি কর্মকর্তা।
 
বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিকে ধরে রাখতে তার অমর প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন চন্দ্রাবতী শিবমন্দির সংস্কার করে এখানে একটি সমৃদ্ধ পর্যটন কেন্দ্র ও পাঠাগার গড়ে তোলার দাবি এলাকাবাসীর।

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।