শূন্যতায় তুমি পূর্ণতা
চারতলা সিঁড়ি বেয়ে মিরাজের খুব ক্লান্ত লাগছে। অফিস থেকে বাসা পর্যন্ত আসতেও এতো ক্লান্ত লাগেনি, যতটা লেগেছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে। কয়েক মিনিট দরজার সামনে দাঁড়ানোর পর সে কলিং বেল চাপতে লাগল। কারো পায়ের শব্দ পেল না। মিরাজের মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। স্ত্রী দিয়াও কি ঘুমিয়ে পড়ল? মিরাজ ভাবতে থাকে।
আবার বেলে চাপ দিল। না, এবারও কোনো উত্তর নেই। ঘড়িতে তখন প্রায় এগারোটা বাজে। বেশি রাতও হয়নি। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মিরাজ কার যেন পায়ের আওয়াজ পেল। আম্মা নয়, দরজাটা দিয়াই খুলে দিল।
- অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো বুঝি? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, টেরই পাইনি। আম্মাও অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ। একটু আগে আমি অনেক বলে ঘুম পাড়ালাম।
- হয়েছে, আর বলতে হবে না। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম। তা আম্মা খেয়ে ঘুমিয়েছে তো?
- হ্যাঁ, তুমি দেরী করছো দেখে আম্মাকে ভাত খাওয়ানোর পর ওষুধ খাইয়েছি।
- তুমি খাওনি?
- আমার মাথা ব্যথা করছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।
মিরাজ হাত-মুখ ধুয়ে একাই খাবার টেবিলে বসল। তখন নিচু গলায় দিয়া বলল-
- মাথা ব্যথার জন্য তেমন কিছু রাঁধতে পারিনি। তুমি এসব খেতে পারবে না। একটু অপেক্ষা করো, আমি তোমার জন্য একটা ডিম ভাজি করে আনছি।
- না, তার আর দরকার নেই। এতো রাতে কষ্ট করবে কেন? আমি খেতে পারবো।
দিয়া কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল। মিরাজ জানে, দিয়া তার কথায় কান দেবে না। আট মাস হলো মিরাজ-দিয়ার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এখনো একজন আরেকজনের কাছে দুর্বোধ্যই রয়ে গেল। দিয়া খুবই শান্ত-চুপচাপ স্বভাবের। মিরাজও কম কীসে? নিজেকে যেন সে নিজেরই মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে।
- এই শুনছো, একটা শুকনো মরিচ ভেজে নিয়ে এসো।
- মরিচ মনে হয় নেই।
- তুমি রাতে খাবে না?
- নাহ, আমার খিদে নেই। তুমি খেয়ে কষ্ট করে খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে এসো। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।
মিরাজ শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে, এতো বড় রাতটা দিয়া না খেয়ে কাটাবে? ওকে ডেকে খেতে বলব? কিন্তু কেন যেন মিরাজ দিয়াকে ডাকতে গিয়েও পারল না। সারাদিন অফিসের ধকলের পর মিরাজ ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে দিয়া পাশ ফিরে চোখ বুজে রইল। দিয়ার কেন যেন ঘুম আসছে না। মিরাজ কি একটু জোর করে খাওয়ার কথা বলতে পারত না? সে কি আমাকে একটুও ভালোবাসে না? দিয়া এসব ভেবে ভেবে কাঁদতে লাগল।
****
আজ খুব ভোরেই মিরাজের ঘুম ভাঙে। এখন সাড়ে ছয়টা বাজে। জানালার পর্দাটা সরাতেই ভোরের নরম আলো জানালা গলে রুমে প্রবেশ করে। দিয়ার চুলে আলো এসে পড়ায় চুলগুলো চিকচিক করছে। মিরাজের খুব ইচ্ছে করছিল দিয়ার চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে সেখানে আলতো করে একটা চুমো আঁকতে। কিন্তু মিরাজ আর দিয়ার মাঝে কীসের যেন একটা দেয়াল। তৃতীয় একজন তাদের মাঝে বাধা হয়ে আছে। মিরাজ মনে হয় এই আট মাসে সেই দেয়াল ডিঙানোর চেষ্টাও করেনি। হঠাৎ দিয়ার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় মেরাজ।
- ছোট খালামণি ফোন করেছিলেন। তোমাকে নাকি ফোনে পাচ্ছেন না। আগামী শুক্রবার তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলেছেন।
- তুমি যাও। আমি তোমাকে সিএনজি ঠিক করে দেব।
- আমি কি একা যাব? শুক্রবার তো তুমি বাসায়ই থাক। তোমার সমস্যাটা কি বল?
- আরে, রাগ করছো কেন? ছয়দিন অফিস করে শুক্রবার কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না। এদিনটায় একটু শুয়ে বসে কাটাতে চাই।
- তুমি এতো অজুহাত কেন দেখাচ্ছ? বলে দিলেই তো পারো যে, আমার কোনো আত্মীয়ের বাসায় তুমি যেতে চাও না।
- তুমি ভুল বুঝছ। ঠিক আছে, তুমি খালামণিকে বলে দাও আমরা এর পরের শুক্রবার যাচ্ছি।
- তার আর কোনো দরকার হবে না। আমি না করে দিচ্ছি।
****
অফিস থেকে ফেরার পরই মিরাজ তার মায়ের ডাক শুনতে পেল-
- এ ঘরে আয় তো বাবা একটু।
- আম্মা, তোমার ওষুধ খাওয়া হয়েছে? প্রেসারের অবস্থা কেমন?
- আমি ভালোই আছি। বউমা দেখি আজ সারাদিন মুখ ভার করে বসে আছে। দরজা লাগিয়ে কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে রেখেছে। তুই কী বলেছিস?
- না, আমি তো তেমন কিছু বলিনি।
- দেখ বাবা, নতুন বউ। মেয়েটা খুবই লক্ষ্মী। ভালো ঘরের মেয়ে। ওকে নিয়ে একটু বেড়াতে যা। আমি বুড়ো মানুষ, সারাদিন শুয়ে থাকি। মেয়েটা একা বাসায় সময় কাটায়। তোর বাপ তো এমন ছিলেন না। কত শৌখিন মানুষ ছিলেন। তুই এমন গম্ভীর কেমন করে হলি? বউমাকে কি তোর পছন্দ হয়নি?
- আম্মা, কী যে বলো তুমি। পছন্দ হবে না কেন? দিয়া এসব শুনলে কষ্ট পাবে। আমি খুব হ্যাপি আম্মা।
- দেখ বাবা, মায়ের চোখকে ফাঁকি দিস না, আমি সবই বুঝি।
মিরাজ তার মাকে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। আসলেই সে কি এমন ছিল? এই চার বছরে সে কত বদলে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কতো স্বপ্নবিলাসীই না ছিল সে। কবিতা- প্রেম সব ছিল তার জীবনে। তার সব কিছুই ছিল একজনকে কেন্দ্র করে। তার নামটা আর মিরাজ উচ্চারণ করতে চায় না। সেই মানুষটা এক নিমিষেই মিরাজের সব স্বপ্ন ভেঙে আজ সুখেই আছে। থাকুক সে ভালো, মিরাজও তা-ই চায়।
****
হঠাৎ করেই বাসা থেকে আম্মার ফোন। ‘মিরাজ, বাবা তুই একটু বাসায় আসবি? বউয়ের জ্বরটা খুবই বেড়ে গেছে।’ মিরাজ আর এক মুহূর্তও দেরী না করে বাসায় আসে। এসেই দেখে মিরাজের মা দিয়ার মাথায় পানি ঢালছে।
- আম্মা জ্বরটা কখন থেকে?
- বিকাল থেকেই জ্বরটা ছিল। তুই টেনশন করবি বলে তোকে বলিনি। বাবা, জ্বরটা মেপে দেখতো কত?
- জ্বরতো অনেক। একশ’ তিন ডিগ্রি। তুমি ওর পাশে থেকো। আমি ডাক্তার ডেকে আনছি।
ডাক্তার দেখে ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়তে লাগল। আম্মা বারবার খাওয়ার তাগাদা দিতে লাগলেন।
- আম্মা, তুমি ভাত খেয়ে নাও। তোমার ওষুধ খেতে হবে। দিয়া এইমাত্র ঘুমোলো। ওর ঘুম ভাঙলেই আমি ওকে নিয়ে খেয়ে নেব।
- ঠিক আছে বাবা, তুই থাক বউমার কাছে।
মিরাজ দিয়ার মাথার পাশে বসে রইল। মিরাজ ভাবতে থাকে তাদের আট মাসের সংসার জীবনের কথা। এই আট মাসে দু’জনের শরীর মিশেছে দু’জনাতে বহুবার। কিন্তু হৃদয় কি মিশেছে কখনো? দিয়াকে মিরাজ ঠকাচ্ছে না তো? অথচ কী আশ্চর্যজনকভাবে দিয়া সব মেনে নিচ্ছে। মিরাজের সব অবজ্ঞা, অবহেলা দিয়া সহ্য করছে বিনাবাক্যে। এসব ভাবতেই দিয়ার জন্য মিরাজের মনে এক প্রবল মমত্ববোধ জেগে ওঠে। অনেকটা আনমনেই দিয়ার মাথার উপর পরম মমতায় হাত বোলাতে থাকে। এভাবে কেটে যায় অনেকক্ষণ। যখন মিরাজ তার হাতটা দিয়ার মাথা থেকে সরাতে চাইল; তখনই দিয়া মিরাজের হাতটা চেপে ধরল।
- কোথায় যাচ্ছ তুমি? তোমার হাতটা আমার মাথায় রাখবে?
- হুমম, রাখবো। আগে কিছু খেয়ে ওষুখ খেয়ে নাও। তারপর আমি সারারাত তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব।
- আমার তো ওষুধে জ্বর সারবে না। তুমি পাশে বসে থাকলে, আমার মাথায় তোমার হাতটা রাখলেই আমি ভালো হয়ে যাব।
- কি বলে পাগলী এসব?
- কেন তুমি এমন কর আমি সব জানি, বুঝি। আমি সেদিন কাপড় গোছাতে গিয়ে তোমার লেখা ডায়েরি, কবিতা সব পড়েছি। সেদিন এসব পড়ে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছি। তুমি তাকে অনেক ভালোবাসতে, তাই না? তোমার প্রতি সমস্ত ক্ষোভ, অভিমান আমি সেদিন থেকেই ভুলে গিয়েছি। যে এমন গভীরভাবে ভালোবাসতে জানে তার সাথে কি অভিমান করে থাকা যায়? আমি তোমাকে আর ভুল বুঝব না।
বলেই দিয়া কাঁদতে লাগল। দিয়ার তপ্ত নিশ্বাস মিরাজের বুকে বিঁধতে লাগল। দিয়া বলে উঠল, ‘তুমি আবার কবিতা লিখবে। আমার জন্য, আমাকে ভালোবেসে?’ মিরাজেরও তখন চোখে ঝরনাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে দিয়াকে বুকে টেনে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি আবার তোমাকে ভালোবেসে, শুধু তোমার জন্য কবিতা লিখবো।
এসইউ/জেআইএম