মহা-কম্পন
কিছু না হতে এমনিতেই বুক কেঁপে ওঠা তার ছোটবেলার অভ্যেস। সেখানে ভূমিকম্প হলে কী হবে? সেটা তো সহজেই কল্পনা করা যায়। আমরা তাই ধরে নিতে পারি, কবি আমির শাহজাহানের সেদিনের ভূমিকম্প পরবর্তী মনের অবস্থা।
কিন্তু সবকিছু কি আর ধারণার উপর চলে? সেদিন সারা ঢাকা নাচিয়ে দেওয়া ভূমিকম্পের দিনও কবি আমির শাহজাহানের যে বুক কাঁপলো না; এটা তাই অকল্পনীয় কোন ব্যাপার নয়। বরং সেদিনের কম্পনই যে কবি সাহেবকে বিরহের কবি, প্রেমের কবি করে তুললো এটাই সত্য।
চলুন আমরা না হয় সেদিনের আসল ঘটনাটা জানি।
কবি আমির শাহজাহানকে সেদিন হাওয়া খেতে দেখা যায় পল্টনের এনএসসি টাওয়ারের সামনের ওই রাস্তাটায়। নানা যানে ভরা রাস্তা পেরিয়ে কী মনে করে যেন একটা জুতোর দোকানে ঢুকছিলেন তিনি। ঢোকার মুখেই ব্যস্তসমস্ত একঝাঁক কর্পোরেট মানুষ তার চোখে পড়ে। যারা হুড়োহুড়ি করে উপর থেকে নিচে নামছেন।
‘সামথিং ইজ রং’- বলে কবি সাহেবের মনটা তখন একটু কেঁপে উঠলো কি? উঠেছিল বটে; তবে সেটি ওই খানিক মুহূর্তের জন্যই। দলবেঁধে ছুটে চলাদের মধ্যে কর্পোরেট এক তরুণী কিংবা মহিলা এমন একজনের দিকে নজর পড়তেই জাগতিক সব চিন্তা তার মাথা থেকে উড়ে যায়। মহিলার নাক ঘেমে আছে, চোখে-মুখে রাজ্যের আতঙ্ক (ভূকম্পন আতঙ্ক)। অথচ কী সুন্দরই না তাকে লাগছে! আড়াল থেকে সেই সৌন্দর্যে অন্য কেউ ডুব দিয়েছে কি? কবি সাহেব আড়চোখে দেখার চেষ্টা করেন।
মফস্বল থেকে বছর পাঁচেক আগে কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পাড়ি দেওয়া আমির শাহজাহান তার সেই সৌন্দর্যে হারিয়ে গেলেন। কবি মন ভাবে, এই নারী যখন প্রেয়সী হয়ে কোনো এক ভাগ্যবান পুরুষের বুকে মাথা রাখেন, তখনো কি তার নাকে-মুখে ও রকম জল জমে? কবি আমির শাহজাহান পল্টনের সেই জুতোর দোকনের সামনে দাঁড়িয়েই মনে মনে জনৈক নারীর নাক-মুখের জল শুষে নেন।
সেখানে শেষ হলেই হতো। কিন্তু শেষ হয়েও হলো না যে শেষ! ঠিক ওই মুহূর্তে তার মনে পড়ে নিজের প্রথম প্রেমের কথা, জুইকে যে তিনি আজও ভুলতে পারেননি।
এই জুইয়ের প্রেমে ছ্যাকা খেয়েই আসলে আমির শাহজাহানের ঢাকায় আসা। আপনি-আমি জানি, তিনি কবি হবেন- অনেক পত্রিকায় কবিতা লিখবেন বলে এই শহরে পা রেখেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমনটাই বলেছেন। আসলে তা নয়, তিনি এসেছেন তার সাবেক প্রেমিকাকে ভুলতে। নির্জনে যাকে একদিন গোলাপ দিতে গিয়েও তার হাত কেঁপে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘ভূমিকম্প’ বলে দৌড় দিয়েছিলেন। ওই কম্পনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম তার সেদিনই হাওয়া হয়ে যায়।
এরপর? এরপর জুইকে একদিন তিনি আবিষ্কার করেন। তার চেয়েও দুই বছরের ছোট এক হ্যাংলার হাত ধরাধরি করে ঘুরছে জুই। এই দৃশ্য দেখার পরদিনই আমির শাহজাহান বাড়ি ছেড়েছিলেন। ভোর হয়েছিল তার বুড়িগঙ্গার পাড়ে।
‘বুড়িগঙ্গার কষ্ট’সহ আজ পর্যন্ত যত কবিতা তিনি লিখেছেন তার সবই আসলে বিরহগাথা। পত্রিকাওয়ালা তাকে একটু ভিন্ন টাইপের কবিতা লিখতে বললেও তিনি লিখতে পারেননি। বলেছেন, ‘ভেতর থেকে প্রেরণা পেলেই কেবল আমি লিখি। যা-ইচ্ছা লিখতে পারি না।’ পারবেন কী করে? তার মনটা যে বিরহে ভরা।
এই তো সেদিন, পল্টনে যখন ভূমিকম্পের কবলে পড়লেন। ঠিক সেদিন বাসায় ফিরে কবি সাহেব আয়োজন করে লিখতে বসলেন। শুরুতে অভ্যাসমতো খাতা-কাগজে একটু সেট হয়ে নিতে দুই লাইন লিখেও ফেললেন।
‘কেঁপে উঠলো ঢাকার বুঁক
আমায় দিয়ে গেল যেন প্রেম সুখ।’
এরপর সেদিন আমির শাহজাহান হারিয়ে যান কবিতায়। বিরহ নয়, প্রেমের কবি হয়ে ওঠেন তিনি। লিখে ফেলেন প্রেমের কবিতা।
সর্বশেষ খরব হলো- কবি আমির শাহজাহান ঘোষণা দিয়েছেন, আসছে তার ‘মহা-কম্পন’।
এসইউ/আরআইপি