ইয়াকুব খান শিশিরের তিনটি অণুগল্প
যুদ্ধের আগে ও পরে
‘কেরামত মিয়া, নিজের জায়গা নিজেই ঠিক কইরা রাখলাম। দেখো, দেখো। মা-বাপও এইখানেই আছেন।’ নিজের বাঁধিয়ে রাখা কবরটা দেখিয়ে বলেন হাজী মো. হাসমত আলী চৌধুরী। চোখে-মুখে তৃপ্তির হাসি।
তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আগে ঘটল সেই ঘটনা। একাত্তরের জুন মাসের সন্ধ্যায় হাজী সাহেবের বাড়ি দাউ দাউ আগুনে জ্বলে উঠল। শোনা গেল, হানাদারবাহিনী কাজটা করেছিল। হাজী সাহেবের দুই ছেলে তখন মুক্তি’তে। বাড়ির সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
স্ত্রী ও দুই মেয়ে। সাথে হাজী মো. হাসমত আলী চৌধুরীও। কারো চিহ্ন নেই। পুরো বাড়ি ছাইয়ের পাহাড়।
মিয়া কেরামতের বয়স এখন পঁয়ষট্টি। বিয়াল্লিশ বছর আগের সেদিনের কথা মনে পড়ে তার। সারি সারি বাঁধানো কবর। মরহুম মো. আকবর আলী চৌধুরীর কবর। তার বামপাশে মরহুমা আয়শা চৌধুরীর কবর। আয়শা চৌধুরীর পাশের টাইলস বাঁধানো কবর। মরহুম হাসমত আলী চৌধুরী, জন্ম : ১৯৪৭ ইং, মৃত্যু : ...
কেউ শায়িত নেই, তবুও প্রতিদিন কবরে এসে কবরটা মোছেন, আশপাশে গজিয়ে ওঠা ঘাস উপড়ে ফেলেন মিয়া কেরামত।
****
আঁধার ধাঁধা
বুড়িকে দেখেই ডাটার ডগা খিলখিলিয়ে ওঠে। খুশিতে নেচে নেচে মাথা দোলায়। বুড়ি স্নেহে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বুড়ির মনেও আনন্দ। চোখের সামনেই কেমন লকলকিয়ে বড় হয়ে উঠেছে, কেমন নাদুশ-নুদুশ, তরতাজা।
চারদিক থেকে কেমন ফিসফিস আওয়াজ কানে আসে। বুড়ি তাকায়, নাহ, কেউ নেই। আবারও সেই ফিসফিসানি! বুড়ি কান খাড়া করে।
- বুড়ি বাড়ি যাও, ডাটার ভাগ্য তোমার না।
আছিরন বেওয়া এখন ছিষট্টি বছরে। শরীরে তেমন শক্তি না থাকলেও বসে থাকতে পারেন না তিনি। তাই বাড়ির ঢালুতে নিচু জমিটায় কিছু ডাটার বীজ ছিটিয়েছিল। দেখতে দেখতে ডাটা এখন হাটু অব্দি। দু’একের মধ্যেই খাওয়া যাবে। কিন্তু... বুড়ির ঘোর তখনও কাটেনি।
এমন সময় নাতনি তুসি এসে ডাকে।
তুসির ডাকে ডাটা ক্ষেত থেকে উঠে আসে বুড়ি। নাতনির হাত ধরে এগিয়ে যায় বাড়ির ভেতর। মা’র জন্য অপেক্ষা করছিলেন আলিমুদ্দিন।
: মা, দ্যাশের অবস্থা ভালা না, অহনই আমাগো গেরাম ছাড়তে হইবো।
: কই যাবি?
: ওপারে, ভারতে। সবাই ভারতে যাইতাছে। চলো, আমরাও যাই।
: তরা যা, আমি যামু না। এই সব রাইখা আমি কোই যামু?
: তুমি আমাগো সবাইরে মারতে চাও? তুসিরেও?
তুসির কথায় বুড়ির পা আর চলে না। তুসিকে জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। আঁচলে চোখ মোছে।
গন্তব্য কোথায় বুড়ি জানে না, তবুও সবার সাথে হাটতে শুরু করে। মন পড়ে থাকে বাড়িতে, ডাটাক্ষেতে।
শরণার্থী শিবিরের পাশে এক ফালি জমি। সেই জমিতে বুড়ি আবারও ডাটা লাগায়।
ডাটা আস্তে আস্তে বেশ বড় হয়ে উঠেছে। ডাটা ক্ষেতে বাতাস খেলে যায়। বুড়িকে দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে, লুটোপুটি খায়। বুড়ি ডাটা ক্ষেতের পাশেই বসে থাকেন। তুসির উঁকুন বাছেন। তাদের পাশে এসে বসেন ঢাকার সুরাইয়া। কবিতা পড়েন, গল্প করেন।
সেদিন সুরাইয়া শোনায়- ‘স্রষ্টা যদি মত নিত মোর- আসতাম না প্রাণান্তেও, এই ধরাতে এসে আবার যাবার ইচ্ছা নেই মোটেও।’ বুড়ি তন্ময় হয়ে শোনেন।
যুদ্ধ থেমে গেছে। দেশে ফেরার পালা। ডাটা ক্ষেত পড়ে থাকে। অশ্রুসিক্ত বুড়িও গন্তব্য পথে।
বুড়ির কানে বাজে সুরাইয়ার কবিতা আবৃত্তি- ‘এই যে জীবন আসা-যাওয়া, আঁধার ধাঁধার জট কেবল।’
****
বয়স হলে
পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। নাম জানা নেই, জানার উপায়ও ছিল না। লম্বা-ফর্সা, সুন্দরী মনে হলো মেয়েটিকে। সম্ভবত নব্যবিবাহিতা।
অনেকদিন হয় চশমাটা সমস্যা করছে আব্দুল আলীর। দূরের কিছু ভালো করে নজরে আসে না। বারান্দায় বসে পত্রিকা দেখতে দেখতে চোখ পড়ে পাশের বাড়ির ছাঁদে। কে যেন কাপড় নেড়ে দিচ্ছে। মনে হলো, ওই মেয়েটি। এবার বিরক্ত হয় নিজের উপর ভালো না দেখার জন্য। উঠে এসে মার্কেটে যাওয়ার জন্যে কাপড় পরতে থাকে। কাপড় পরতে পরতেই গিন্নির কাছে টাকা চায়-
- কিছু টাকা দাওতো।
- এখন টাকা দিয়ে কী হবে শুনি? আর ভরদুপুরেইবা তুমি কোথায় যাও?
- চশমাটা পাল্টানো দরকার। দূরের কিছুই দেখি না।
- পড়ছিলে পেপার, ওইখানে আবার দূরের কী দেখবে? পেপার কি কেউ দূর থেকে পড়ে? কাছের দেখতে পাও না?
- পাইতো, বেশ দেখি, কিন্তু দূরের কিছুই দেখি না ভালো করে। চশমাটা না বদলালে যে আর চলে না।
- দূরের কিছু দেখতে হবে না, বয়স হলে সবারই এমন হয়, কাছেরটাই দেখ। যাও গোছলে যাও। ভাত দিচ্ছি। বলেই গিন্নি চলে যায়।
আব্দুল আলীর আর মার্কেটে যাওয়া হয় না। গায়ের জামা খুলতে খুলতে জানালা দিয়ে পাশের বাড়ির দিকে তাকায়। সব ঝাপসা।
আব্দুল আলী কাউকেই বোঝাতে পারে না, কাছের তো দেখছিই, বয়স হলে যে দূরেরটা দেখতে মন চায়।
এসইউ/আরআইপি