দ্বিতীয় প্রেম


প্রকাশিত: ১২:৪০ পিএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬

গভীর রাত। খুব গভীর। পৃথিবীজুড়ে গোরস্থানের নীরবতা। আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেলে কিশোরী বধূ। পাশে শুয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল স্বামীর শরীরজুড়ে সহস্র প্রেমচিহ্ন। জানালার এক হাত দূর থেকে উঁকি মারে ইউকেলিপটাস জাতীয় কোনো এক গাছ। বাতাসের সঙ্গে সন্ধি করে ভাটফুলের গন্ধ। পৃথিবী এই প্রেমিক-প্রেমিকাকে উপহার দেয় সেই ঘ্রাণ।

স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে নতুন স্বপ্নের নেশায়। বধূর চোখে ঘুম নেই। জানালা দিয়ে বার বার তার চোখ পড়ে চাঁদের কলঙ্গের উপর। ভয় পেয়ে মুহূর্তেই দাঁড়ায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। খুব ভালোভাবে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখে নেয় তার মুখে অতীতের কোনো স্মৃতি থেকে গেছে কিনা। না, কোথাও কোনো চিহ্ন মাত্রও নেই। কিন্তু কোথায় যেন একটা অষ্পষ্ট দীনতা রয়ে গেছে। এই চোখেই সে তাকিয়ে থেকেছিল অন্য দুটি সুন্দর চোখের দিকে।

বধূর ভাবনাগুলো এলিয়ে পড়ে অতীতের বিছানায়। না না, কী সব মনে আসছে তার? সে তো অনেক দিন আগের কথা। আঁধারে মিলিয়ে যাওয়া কথা। তবে আজ কেন তা আবার? শোভনের দেয়া ডেস্ক ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়। বেশ বাসী হয়ে আছে এটি। তবে ফেলতে ইচ্ছে হয় না মন থেকে। কালো সংখ্যার উপর লাল বৃত্তের আন্ডার লাইন করা তারিখেই তো সুখের জলে চোখ দুটো ভরে গিয়েছিল সুষমার।

এই দিনেই তো প্রেমের দৃষ্টিকে প্রথম শব্দে রূপ দিয়েছিল। জড়তামাখা কণ্ঠে কী যেন বলছিল শোভন? ‘সুষমা, আমি, আমি মানে আমি তোমাকে...।’ কী যে আনন্দ হয়েছিল সেদিন সুষমার। বাড়ি ফিরে অকারণে তার চোখে বার বার জল আসছিল। সেই অসময়ে হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়েছিল ছোট মামা। ছোট মামা অবাক হয়ে একগাল হেসে বলেছিল, ‘কিরে, এই অসময়ে কাঁদছিস কেন? পোলাও-কোরমা খেয়ে তোর প্রিয় কুকুরের নাকি লোম উঠে গিয়েছে, এ জন্য কাঁদছিস বুঝি?’ এই বলে মামার কী হাসি। সুষমাকে এই নিয়ে কম লজ্জা ভোগ করতে হয়নি।

নাহ, এসব পুরোনো কথা কেন মনে পড়ছে সুষমার। সে তো এ সব কিছু ভুলে যেতে চায়। নতুন সংসারকে সে আপন করে নিয়েছে। নিয়েছে পল্লবকেও।

পল্লব খুব গোছানো, সংসারী ও সভ্য মানুষ। সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণে তৃপ্ত শিশুর মতো ভালোবাসার এক চিলতে হাসি লেগেই থাকে। শোভন ছিল পল্লবের ঠিক উল্টো। সব কিছুতেই স্বর্ণলতার মত একটা এলোমেলো এলোমেলো ভাব। সারাদিন শুধু উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া ওর মাথায় কিলবিল কিলবিল করতো। কাউকে অপেক্ষাতে রেখে কখনো আধাঘণ্টা কিংবা এক ঘণ্টা পরে আসেনি এমন নজির ওর ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। রাস্তা-ঘাটে অদ্ভুত সব কাজ-কর্ম করে বেড়াতো। কিন্তু ওর পাগলামো হাসির মধ্যে যন্ত্রণা মুছে দেয়ার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল। আচরণে সবসময় ছেলেমানুষি একটা ভাব ফুটে উঠতো।

এ সব ছেলেমানুষির জন্যই সুষমা তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। বেশ কাটছিল দিনগুলো। ক্যালেন্ডারের প্রায় তারিখই আনন্দ আর রোমাঞ্চের সাক্ষী হিসেবে গোল গোল বৃত্তে ভরে গিয়েছিল।

সুষমা ধীরে ধীরে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। হয়তো চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। এই পরিবেশে চা-টা অনেক যৌক্তিক। বেডরুমের পাশের বাকানো বারান্দায় বেতের টেবিলটার উপর ধূমায়িত কাপটা রাখে। সেই সঙ্গে বিলাসী আয়েশে চেনা এই রাত্রিকে খুব কাছ থেকে দেখতে থাকে।

একতলা বাড়িটির গেটের সামনে দিয়ে যাওয়া এক মাতাল সুষমাদের কলিং বেল টিপে দিয়ে যায়। পরক্ষণে সুষমাকে দেখে লজ্জায় বোকার মত হেসে হেসে চলে যায় ভীষণ অন্ধকারে ধাক্কা খেতে খেতে। কিছুদূর যেতেই চাঁদের আলোয় পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

শোভন যেদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে প্রথম মদ খেয়েছিল; সেদিনটার কথা সুষমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সুষমার সামনে অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে সে কিছুই বলতে পারছিল না। যেন একটা ভীষণ অপরাধবোধ শোভনকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। সুষমার বিশ্বাসে সামান্য আচড় পড়ুক তা সে কোনদিন চায়নি। সুষমা সেদিন শোভনকে কড়া করে বকে দিয়েছিল। তারপর কাছে গিয়ে শোভনের হাত দুটো ধরে দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। একটা হাসি দিয়েই সুষমা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি তোমাকে মাফ করলাম। এই প্রথমবারের মত ও শেষ বারের মত। এরপর এমন কিছু করলে ফল খুব খারাপ হবে। হাসির এতোগুলো অর্থ বুঝতে শোভনের একমুহূর্ত সময় লেগেছিল মাত্র।

এখন মদ নিয়ে সুষমার কোনো মাথাব্যথা নেই। পল্লব প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে সামান্য মদ খায়। কিন্তু তার তেমনভাবে কোনো নেশা নেই।

সুষমা অতীত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে বর্তমান থেকে দূরে যেতে থাকে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে সদর ঘাটের দৃশ্য। লঞ্চের কালো ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যাচ্ছে গভীর জলের সন্ধানে। হাওয়ায় উড়ছে সুষমার নীল ওড়না। তার একটি হাত শক্ত করে ধরে আছে শোভনের বামহাত। শোভন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে নদী ও আকাশের মিলনস্থানে। মুখে আনন্দের ঘনঘটা। চোখের কোথাও কোনো দুঃখ নেই। না পাওয়া কিছু নেই আর তার। আজ যেন পেয়েছে সব কিছু। সুষমার শ্যাম্পুকরা কোমল চুলগুলো উড়ছে। মুখে ছড়িয়ে পড়েছে সুখের স্বপ্নের অলীক মায়া।

দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত। যেন যুগের পর যুগ ধরে তারা এই স্বপ্নের মধ্যে জড়িয়ে আছে। রাস্তায় লোকজনের ভিড় কমে আসছে। শীতের সন্ধ্যা থেকে লোকজন যেন ঘরে ফিরতে চাচ্ছে। ঘরে ফিরতে চাচ্ছে না শুধু দুটি মানুষ। সুষমা আর শোভন। সুষমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। যখন নাইট গার্ডের কর্কশ বাঁশির আওয়াজ তাকে মগ্ন থেকে চকিত করে। ময়ূর পদ্ভ্রজে সে ছুটে যায় বেডরুমে।

গভীর ঘুমে তলিয়েও কত মিষ্টি করে হাসছে পল্লব। নিশ্চয়ই কোনো সুন্দর স্বপ্ন দেখছে। পল্লব একদিন বলেছিল, তার জীবনের সুন্দর জিনিসগুলোর অধিকাংশ সুষমাই দখল করে আছে। কে জানে, হয়তো পল্লব সুষমাকে নিয়ে স্বপ্নে কোনো মধুর সময় কাটাচ্ছে।

সুষমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর পল্লবের মাথায় আস্তে আস্তে তার কোমল হাতটি বুলিয়ে দেয়। সুষমা গত কয়েক ঘণ্টার আবৃত্তি করা সব অতীত স্মৃতি ভুলে গিয়ে বর্তমানকে বুকে চেপে ধরে। তখন নিজের অজান্তেই শব্দ করে কেঁদে ওঠে। এক অযাচিত অপরাধবোধ তাকে যেন গলা টিপে খুন করতে চাইছে। সব দোষ তার। তার জীবনের প্রতিটি ঘটনার জন্য একমাত্র সে-ই দায়ী।

শোভন ছিল অগ্নির মত পবিত্র। শিশুর মত নিষ্পাপ। সুষমাই বেইমানী করেছিল সেদিন। যদিও এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সত্যিই কী কোনো উপায় ছিল না? সে প্রতিনিয়ত নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করে এসেছে। কিন্তু আজ রাতে যেন কি হল সুষমার। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না।

পল্লব জেগে উঠে অবাক হয়ে চেয়ে আছে সুষমার দিকে। সুষমার কোনো খেয়াল নেই। তার কান্নার মধ্যে না পাওয়ার অদ্ভুত যন্ত্রণা দেখতে পায় পল্লব। মনে হয়, সুষমা তিন বছরের বিবাহিত জীবনের অপূর্ণতার জন্য আজ কাঁদছে। পল্লব ভাবতে থাকে, সে কি তাহলে কোনোভাবে সুষমাকে কষ্টে রেখেছে। সুষমাকে কি পল্লব ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে পারেনি? নিশ্চয়ই পল্লবের কোনো ভুলের জন্যই ওর অতৃপ্ত হৃদয় কাঁদছে। অন্য কোনো কারণ তো থাকতেই পারে না। পল্লব জানে সুষমার জীবনে আর কারো ছায়া নেই। কিন্তু এই জানার কতটা শক্তি আছে সেটা পল্লব কখনোই অনুধাবন করতে পারেনি। চেষ্টাও করেনি কখনো। হয়তো সুষমার কষ্টগুলো পল্লব বুঝতে পারেনি। এই ভেবে পল্লব নিজের সত্তার কাছে ক্রমেই ছোট হতে থাকে। ছোট হতে থাকে নিজের চিন্তার কাছেও।

পল্লব আলতো করে সুষমার কাঁধে হাত রাখে। মুখ ফিরিয়ে সুষমা পল্লবের দিকে তাকায়। অবুঝ শিশুর মত তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। পল্লবের চোখেও জল এসে যায়। সুষমার কিসের কষ্ট, যা সে জানে না। পল্লবও সুষমাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। যেন ভালোবাসা দিয়ে ওর কান্না বন্ধ করতে চায় চিরদিনের জন্য।

সকালের চায়ের টেবিলে সুষমা স্বাভাবিকভাবে পল্লবকে চা, পাউরুটি আর কলা খেতে দেয়। মুখোমুখি বসে বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাটা আবার মনে করিয়ে দেয় পল্লবকে। পল্লব ভালোবাসার আশ্চর্য দৃষ্টিতে সুষমার দিকে তাকায়। এই চার চোখের মিলনে সুষমার নরম গাল লাল হয়ে যায়। পল্লব সেখানে ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিয়ে অফিসের দিকে রওয়ানা হয়।

সকালের বাস্তবতা আর ব্যস্ততার রোদ সহজেই মানুষের আবেগকে শুকিয়ে দেয়। সুষমার চেহারার কোনো অংশেই এখন শোভন নেই। সে এখন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়বে বিকেলে পল্লবের সামনে আরো সুন্দর করে নিজেকে উপস্থাপন করার নতুন নতুন চিন্তায়।

সকালের নিষ্ঠুর আলোয় শোভনের মুখ যেন পৃথিবীর কোথাও নেই। সে হারিয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। মধ্যরাতের মাতালের মত শোভন যদি হোচট খেয়ে পড়ে যায়, পৃথিবীর কোনো সুষমা তাকে হাত ধরে তুলবে না। তার দৃষ্টি আর প্রসারিত হবে না আকাশ আর নদীর সন্ধিস্থলে। তার চোখে থাকবে না আকাশের সদ্য ফোঁটা সৌন্দর্য। বাস্তবতার কুঠারে সে ছিন্নভিন্ন হবে প্রতিটি সূর্যোদয়ে। পৃথিবীর এই সুন্দর সকালগুলো যেন শোভনদের জন্য নয়। তাদের দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয় কিশোরী বধূর অতৃপ্ত বাসনার পরবর্তী সময়ের জন্য।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।