পেত্নীর ঈদ

সাখাওয়াত হোসেন সুজন
সাখাওয়াত হোসেন সুজন সাখাওয়াত হোসেন সুজন
প্রকাশিত: ০৯:২২ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি এ সময় আচমকা সে পাশ দিয়ে চলে গেল। ওড়নার বাতাসটা গায়ে লাগলো- না ওড়নাটাই শরীর ছুঁয়ে গেল তা বোঝার উপায় নেই। একটা পারফিউমের ঘ্রাণ আমার মনে মাদকতা ছড়ালো।

দুই মিনিট নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম। ওড়নার ছোঁয়া পাওয়া সে কি শুধুই কল্পনা! কল্পনাই হতে পারে। অল্পকিছুদিনের মধ্যে খুচরো পাঁচ পয়সা দশ পয়সার মত ওড়নাও জাদুঘরে পাওয়া যাবে! যদিও এখন গলায় মাফলার কিংবা কেবলই শো-পিছ এর মত অতি পাতলা ওড়না ব্যবহার হচ্ছে। আর সেটা কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা ব্যবহারকারীরাই ভালো বলতে পারবেন। যদিও আমার মনে হয় সামনে তা বিলীনই হয়ে যাবে।

যাহোক ওই ওড়না ছুঁয়ে যাওয়াতেই যতখানি পুলক অনুভব করছি- সরাসরি বুক ছুঁয়ে গেলেও বোধকরি অতটা পুলক অনুভব করতাম না! মানুষের গোপন কিছু তৃষ্ণা থাকে যেগুলো যত অতৃপ্ত থেকে আর ধীরে ধীরে মেটানো যায় হৃদয় ততটাই আন্দোলিত হয়।

শরীরের শিহরণ একটা দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে শরীরেই নিবৃত রেখে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। রাত তখন ১১টা। বাসার নিচতলায় দারোয়ান আছে। আর কয়েকটা পরিবার বুঝি আছে। ঈদের ছুটিতে ঢাকার দৃশ্যই এটা। যদিও যে বাসায় থাকি সেখানে কতজন লোক থাকেন আর কে কি করেন এ খবর কোনোদিনই রাখা হয়নি, হয়ও না। কিন্তু বাসাটা প্রায় মানুষশূন্য, ঠিক যেন গোরস্থান। কোনো সাড়াশব্দ নেই। নির্জীব, নিষ্প্রাণ।

বাইরে গিয়ে সময় বেশ ব্যয় হলো। বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ। কেবল একটি দোকান খোলা পেলাম। হাসতে হাসতে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মানুষশূন্য অবস্থা একমাস হলে আপনাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

দোকানিও হেসে জবাব দিলেন, ‘মাল-ছামান নিয়া দ্যাশে যামু কোনো সমস্যা নাই। তয় সমস্যা হইবো বাড়িওয়ালাগো হেরাতো আর বাড়ি মাথায় লইয়া যাইতে পারবো না।’

হাসতে হাসতে বাসা ফিরলাম। ফিরেই ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ। এই জগত আমাকে আর একা রাখেনি। রাত একটা কি দেড়টা বাজে। এই মুহূর্তে দরজায় টোকা পড়লো। মেজাজটা খারাপ হলো- ব্যাটা দারোয়ান নির্ঘাত একটা বিড়ির জন্য এসেছে। সে জানে বিড়ি খাইনা তারপরও আসে! ওর জন্য বিড়িও এনেছিলাম, জানতাম স্বভাব বদলাবে না।

দরজা খুলে দেখি- কেউ নেই। দারোয়ান বোধহয় নিচে গেছে আবারো আসবে। কিন্তু দরজায় সেই ঘ্রাণটা পেলাম যেটা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পেয়েছিলাম! তাহলে কি মেয়েটা…

নাহ, মেয়েটাকে আবছা যতটা দেখেছি তাতে সুন্দরীই বলে মনে হয়েছে। আর কোনো সুন্দরী মেয়েকে যেহেতু নিজের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখিনি তাই ওসব আর ভাবলাম না। ভেবে কী লাভ!

ঘণ্টাখানেক পরে আবারো টোকা। বিরক্ত হয়ে এবার দরজা না খুলে বললাম, কে। তিনবার বলার পর এবার আওয়াজ এল, দরজাটা একটু খুলুন না প্লিজ।

মনে মনে খুশিই হলাম। তাহলে মেয়েটাই এসছে। দরজা খুলতেই মেয়েটির সেই পাতলা ওড়না চোখে পড়লো। চোখ প্রথম বুকের দিকে পড়লেও সংযম রক্ষা করে চিবুক হয়ে মুখের দিকে তাকালাম। চোখ সরছে না, জোৎস্নারাতে যেন চাঁদের আলো। সত্যিই কী সে রূপ।

মেয়েটি মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, মুখ হা করে দাঁড়িয়ে রইলেন যে! ভয় পেয়েছেন নাকি?

মনে মনে হাসলাম, একটা মেয়ে মানুষ দেখে মনে ভয় জাগার প্রশ্নই আসে না। জেগে ওঠে প্রেম। আলোড়িত হয় কামনার জগত।

মুখে বললাম, এত রাতে আপনি? মাঝে মাঝেই আপনাকে খেয়াল করি। তবে কখনো পরিচয় হয়নি। কি উপকার করতে পারি বলেন। রাততো অনেক হল।

মেয়েটি বললো, আপনি রাত করে চা খান। অনেক সুন্দর চায়ের ঘ্রাণ পাই। এককাপ চা খাওয়ান।

নিচের ফ্লাটে কয়েকজন কর্মজীবী মেয়ে থাকি। সবাই ঈদের ছুটিতে গেছে। একা একা বিরক্ত লাগছে। টিভি দেখা, ইন্টারনেটে পড়ে খাকা আর কত। তাই চলে এলাম আপনার কাছে। পুরুষ মানুষ নয়, একজন মানুষ ভেবে।

বললাম, ঈদে গেলেন না কেন?

যাওয়ার যে জায়গা নেই! আমার আপন বলতে কেউ নেই। এতিমখানায় বড় হয়েছি।জবাব দিল সে।

দুঃখিত আমি। দাঁড়িয়ে আর কথা না বলি। বসুন ড্রয়িংরুমে আমি চা নিয়ে আসি।

এই বলে রান্নাঘরে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এসে দেখি ড্রয়িংরুম ফাঁকা। দরজাও ফাঁকা। একটা অপরিচিত মেয়ে এসেছে তাই ইচ্ছে করেই দরজা লাগাইনি। দারোয়ান ব্যাটা এলে উল্টোটাই ভাবতো!

যাহোক চলে গেছে তো গেছে। কিন্তু না, রুমে ঢুকে দেখি আমার পড়ার টেবিলের সামনে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলাম- কি ব্যাপার, আপনি ভূতের মত অদৃশ্য হয়ে গেলেন আবার এখানে এলেন। এটাতো আমার বেডরুম।

দেখুন বাজে কথা বলবেন না! আমি কি দেখতে ভুতের মত নাকি। একেবারে ডানাকাটা পরীর মত! আর বেডরুম হয়েছে তো কি। রাতে আপনার রুমে এসেছি বলেইতো আর আপনি যাচ্ছেতাই করবেন না। বেশ রাগ হয়েই কথাগুলো বললো সে।

আমি হেসে তার হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে বললাম, সেটা ঠিক, তবে পুরুষ মানুষতো নিজের ওপরই নিজের বিশ্বাস নেই। তার উপর আবার মানুষ যৌনতাকেই নিজের সর্বোচ্চ সুখলাভের উপায় মনে করে কিনা!

যাহোক এতক্ষণেও আমরা কেউ কারো নাম জানলাম না। আমি ধ্রুব আপনার নামটাই জানা হল না।

আমি নীলিমা।

নাহ, আপনার নাম নীলিমা হতে পারে না। নীলিমা কোনো পেত্নীর নাম হতে পারে না।

মেয়েটির চোখ লাল লাল করে বললো, আমি পেত্নী না, পরী। কত্তবার বলবো আপনাকে!

তার রাগটা ভীষণ ভালো লেগে গেল। রাগার সাথে সাথে মুখটাও লাল হয়ে গেল। মুখে এক অপূর্ব আভা তৈরি হল। পুরুষ মানুষের মন বলে কথা!

মেয়েটি বললো, মন চাইছে ঘাড় মটকে আপনাকে মেরে ফেলি।

মেজাজটা খিটখিটে হল। বললাম, রাত সাড়ে তিনটা বাজে। এই মুহূর্তে আর আপনার সাথে ঝগড়া করবো না। ঘাড় মটকালে যান অন্য কারো মটকান। আমার হাতে কিছু কাজ আছে। ঈদের এই তিনদিন দম ফেলারও ফুরসত নেই।

মেয়েটি নরম হয়ে বললো, আপনার ঈদ হয়তবা এবার ব্যস্ততায় কাটছে পরিবারের কাছে যেতে পারেননি। আমার ঈদতো প্রতিবারই এভাবেই কাটে। নিজে কিছু রান্না করে খেয়ে আর একটু সেজেগুজে সময় পার করি। এভাবেই জীবনের সময়গুলো পার করেছি।

পার করেছি মানে আরো পার করুন। কিন্তু এখন যান রাত অনেক হয়ে এলো। কাজটা শেষ করে আবার ঘুমাতে হবে। আর আপনার সাথে ‘সহবাস’ করতে আমার ভালো লাগছে না। আমিও রাগত স্বরেই বললাম।

মেয়েটি বললো, ‘সহবাস’ মানে?

আরে বাংলা বোঝেন না। যান তো ভাই। পরে কথা হবে। এই বলে কম্পিউটারের দিকে তাকালাম। বসেই থাকলো। একটু পরেই তাকিয়ে দেখি নেই!

অভদ্র মেয়ে, অশালীন আচরণ করলে চিৎকার করে নির্ঘাত পুরো মহল্লা জড়ো করতে পারতো কিন্তু যাওয়ার আগে এতটুকু শব্দ বলে গেলো না- ‘আসি’।

প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল। একটু পরেই শুয়ে পরলাম।

ঈদের আগে পরে তিনদিন ব্যস্ততায় কাটলো। ঈদের পরেই গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। ব্যস্ততার মাঝে আর তার কথা মনেও পড়েনি।

কয়েকদিন পরে ঢাকায় ফিরলাম। গেটেই দারোয়ান ধরলো। বোনাস না দিয়েই চলে গিয়েছিলাম! তাকে কিছু টাকা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম নীলিমার বান্ধবীদের কি খবর।

দারোয়ান বললো, আপনিও চেনেন তাদের?

ওরাতো আর তিনতালায় থাকে না। গতবছর নীলিমা আপা মারা যাওয়ার পরই ওরা সবাই বাসা ছেড়ে পাশের ওই বিল্ডিংটাতে উঠেছে।

নীলিমা মারা গেছে মানে?

দারোয়ানের কথায় বুঝলাম সে বুঝেছে আমি নীলিমার পরিচিত। তবে মৃত্যুর খবরটা জানিনা।

তার বর্ণনায় বুঝলাম- এই যে বাসার পাঁচতলায় আমি আজ ছয়মাস থাকি এর তিনতলায় থাকতো মেয়েটি। খুবই সুন্দর ছিল। পাশের একটা অ্যাপার্টমেন্ট মালিকের ছেলের সঙ্গে ভাবও হয়।

ছেলেটি যতটা সুদর্শন ততটাই বদ! মেয়েটার জীবন নষ্ট করে। এমনকি তার বন্ধুদের লালসার শিকারও করে। ওসব ভিডিও করে ইন্টারনেটেও ছাড়ে।

প্রতিবাদী মেয়েটি কোথাও প্রতিকার পায়না। শেষে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করে। মামলা অযামিনযোগ্য থাকায় ছেলেটি হাজতে যায়। কিন্তু পরে ঠিকই বেরিয়ে আসে। এর কিছুদিন পর পাশের একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে একটি মেয়ের টুকরো টুকরো লাশ মেলে। আইডি কার্ড থেকে শনাক্ত হয় ওটা নীলিমার লাশ। মামলাও পরে যায় ধামাচাপা।

কথাগুলো শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। সেদিনের সেই ভৌতিক কাহিনিটা আর দারোয়ানকে বলিনি। বুঝেছি একটি দুখী আত্মা ঘোরাঘুরি করছে।

বাসায় ফিরে অনলাইনে বসলাম। দেখি আমার একটা স্ট্যাটাসের নিচে শত শত গালিগালাজ! বাড়ি থেকে আসার পর ঢাকা ঢুকেই স্ট্যাটাসটা দিয়েছিলাম।

সেখানে লিখেছি, আবারো তোদের সঙ্গে ‘সহবাস’ হবে বন্ধু…।

অতগুলো মন্তব্য আমি জীবনে পাইনি! সেখানে আমার এক বড় ভাই লিখেছেন- আমার নাকি শব্দজ্ঞান নেই।

গ্রামের এক বন্ধু যাচ্ছেতাই লিখে বলেছে, শালা এবার আসিস তোকে ‘সহবাস’ বুঝাবো।

কয়েকজন মেয়ে লিখেছে, আপনি একটা ইয়ে…।

বাংলা শব্দের প্রয়োগিক জ্ঞান নিয়ে আমার নিজের উপর যথেষ্ট আস্থা আছে। অনেক বাঙালির ঘরে একটা অভিধানও খুঁজে পাওয়া না গেলেও আমার টেবিলে একটা অভিধান আছে। ‘সহবাস’ মানে একসাথে থাকা চলা-ফেরা এ জাতীয় কিছুই হবে।

তারপরও অভিধানটা বের করলাম। দেখে চরম লজ্জা পেলাম। সেখানে যেসব অর্থ পেলাম ততে আমার অর্থটাও ভুল না, বরং প্রথমদিকে তাই লেখা আছে। তবে নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্কও এটার একটা অর্থ। আমরা কেবল ওই অর্থটাই বুঝি। শব্দটাকে অশ্লীল অর্থেই ধরে নেই।

এইবার বুঝলাম কেন ওই শব্দ শুনে পেত্নী পর্যন্ত পালিয়েছে! আর আমার কাছেও ঘেঁষেনি। পেত্নীতো দূরের কথা যেই মেয়েটাকে পছন্দ করতাম তাকেওতো বলেছিলাম, তোমার সঙ্গে ‘সহবাস’ করতে পারাটা আমার জন্য সৌভাগ্যের। তাৎক্ষণিক কিছু না বললেও কিছুদিন পর সে জানিয়েছিল, আমার মতো লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা তার পক্ষে সম্ভব না।

এইচএন/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।