গারো নৃ-গোষ্ঠীর প্রণয় উপাখ্যান রে-রে
হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মপুত্র বঙ্গোপসাগরের দিকে সমতল ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব দিকে প্রবেশের মুহূর্তে একদিকে বগুড়া জেলা অন্যদিকে ময়মনসিংহের উপর দিয়ে প্রবাহিত। তার একটি শাখা বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে বগুড়ার বাঙালি নদী ও করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে সিরাজগঞ্জের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে যমুনা নাম ধারণ করে অপর শাখাটি ময়মনসিংহের উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
যমুনার পূর্বতীর ধরে প্লেসটোসেনিক যুগে সৃষ্ট মধুপুরের অরণ্যভূমি থেকে উত্তরে গারো পাহাড় পূর্বদিকে সিলেট জেলার পশ্চিমে বিস্তৃত হাওড় অঞ্চল ও সুরমা কুশিয়ারা নদীর পূর্ব তীরের নিন্মভূমি ময়মনসিংহ নামে প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত। এই জেলা একই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এবং নৃতাত্ত্বিক কৌতূহল উদ্রেককারী ভৌগোলিক এলাকা। এতে রয়েছে ছোট ছোট টিলা সীমাহীন জলরাশি আর লাল মাটি বিশিষ্ট বিস্তীর্ণ প্রান্তর। বৈচিত্র্যপূর্ণ এর প্রাকৃতিক গড়ন। নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত ছাই বর্ণের বেলে দোআঁশ মাটি ও লাল বর্ণের এঁটেল মাটি দ্বারা এর মৃত্তিকা গঠিত। নদী বিল ঝিল হাওড় জলজ প্রাণির জন্য যেমন স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ সৃজন করেছে তেমনি বিচিত্র বৃক্ষ শোভিত মধুপুরের গড় সহস্র বছর ধরে বন্যপ্রাণী ও মানুষের জন্য সৃজন করেছে বসবাস উপযোগী পরিবেশ। প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য এখানকার অধিবাসীদের জীবনে আনন্দ আর সুরের ঐকতান সৃষ্টি করেছে।
অরণ্যসঙ্কুল নাতি উচ্চ গারো পাহাড়ে টিয়া, ঘুঘু হরিয়াল ও বনমোরগের সুমধুর ডাকে মুখর হয়ে ওঠে। লাল-মাটির অরণ্যতুল্য বনে শাল্মলী বৃক্ষের সারি পাখ-পাখালি আর জীব-জন্তুর নিরাপদ আবাস রচনা করে। ঘন-বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে অন্ধকারে জোনাকি রচনা করে আলোর ঝর্নাধারা। এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থা অধিবাসীদের মধ্যে সৃষ্টি করে বিচিত্র আলিম্পনা। জারি, সারি, আর বাউল ভাটিয়ালির সুর জনজীবনকে অন্য জীবনের মাধুর্য দেয়। ব্রহ্মপুত্র, সোমেশ্বরী, কংস নদীর খরস্রোতে পা ধুয়ে কখনো মৎস্য শিকার করে ঘরে ফেরে গারো নারী পুরুষ। পাহাড়ের ঋজুতা সমতলের কোমল নরম পরিবেশের স্পষ্ট প্রভাব সে জীবনের প্রাত্যহিক ক্রিয়া-কর্মের মধ্যে নিত্য বহমান। প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা এসব মানুষের মনে দৈনন্দিনতার কুটিলতা নেই।
প্রতারিত ও বঞ্চিত জীবনের ভার বইতে বইতে গুটিয়ে গেছে নিজেদের মধ্যে। কখনো বা বিসর্জন দিয়েছে আত্মপরিচয়, নাম, গোত্র এমনকি ধর্ম বিশ্বাস পর্যন্ত। অধিকার বঞ্চিত এসব নৃ-গোষ্ঠী বর্ণহীন বলেই তাদের জীবনের সুমহান বাণী লিপিবদ্ধ হয়নি। তাইতো তারা আজ বিলুপ্তির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভাষাহীন (লিখিত বর্ণমালা না থাকা) হলেও নিসর্গকেন্দ্রিক জীবনে তাদের উৎসব, নৃত্য, গীতি নাট্য, গীতিকা, পালা, পার্বণ, লেটু, ঘাটু, নানা রকম ক্রীড়া কসরৎ ইত্যাদি গড়ে ওঠে জুমকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ঘন-গম্ভীর শালবনের পাতায় পাতায় ঠোঁটের স্নিগ্ধ স্পর্শ বুলিয়ে শিশু রোদের কণা ছড়িয়ে পড়তো জুমচাষে নিরতা গারো রমণীর বাদামী অথবা শ্যামলা কালো গ্রীবার পরে। শ্রমক্লান্ত স্বেদসিক্ত, প্রাকৃত সুন্দরী তার বাঁশের গিটের মতোন’ ছোট ছোট চোখে সেই সদাহাস্য রৌদ্রকণার দিকে তাকিয়ে সংযুক্ত দুই কর কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানাতো তার ফসলের দেবতা সালজংকে’।
প্রকৃতপক্ষে গারো নৃ-গোষ্ঠী একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। প্রায় প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর মত এদেরও রয়েছে নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য সংবলিত স্বতন্দ্র পরিচয়। এছাড়া রয়েছে লোকজ সংস্কার, উপকথা, লোককথা, কৃত্যমূলক গীত ও গেয় আখ্যানপালার সুবিশাল সম্ভার। কিন্তু অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর মত এই নৃ- গোষ্ঠীরও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সামগ্রিক রূপটি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ বাঙালিদের নিকট অপরিজ্ঞাত থেকে গেছে। এর রয়েছে নানাবিধ কারণ। তবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমাদের অন্বিষ্ট গারোদের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি বিশেষ ক্ষেত্র, রে-রে নাট্যপালা’। এর আগে গারো নৃ-গোষ্ঠী সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে অভিবাসনকারী বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম গারো নৃ-গোষ্ঠী। ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরের গভীর অরণ্য, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দী, শেরপুর, নখলা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা এবং বাংলাদেশ অংশের গারো পাহাড়ের টিলায় এই নৃ-গোষ্ঠী ঐতিহাসিক কাল থেকেই বসবাস করে আসছে। মঙ্গোলয়েড মহাজাতির নৃ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে বিদ্যমান। অনেকে অবশ্য মনে করেন এরা মঙ্গোলয়েড মহাজাতির একটি শাখা Bodo-এর অন্তর্ভুক্ত। গারোদের বিশ্বাস খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সাল থেকেই তারা উল্লেখিত অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।
গারো নৃ-গোষ্ঠী একটি স্বতন্দ্র ধর্ম মতে বিশ্বাসী। তাদের সৃষ্টিতত্ত্বের আলোকেই গড়ে ওঠেছে এই ধর্ম বিশ্বাস। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন গারো সংস্কৃতির বীজমন্ত্র তাদের ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত। প্রকৃতি পূজক বা পাথর পূজক সাংসারেক গারো সংস্কৃতিতে তাই কৃত্য বা Ritual অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আর কৃত্য বা Ritual হচ্ছে নাট্যের প্রাণকোষ।
গারোদের নাট্যপালা রে-রে’ আলোচনার পূর্বে জাতিগত থিয়েটার বা Ethnic Theatre সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। নৃ-গোষ্ঠী নাট্য বিষয়ে আধুনিক গবেষক এবং নাট্যকলার অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান মনে করেন, কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর যে সকল পৌরাণিক উপকথা, সংস্কার, লোকাচার, ও আত্মিক বিশ্বাসের অভিজ্ঞান সেই জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কৃত্য বা উৎসবে সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় বিভিন্ন নৃত্য-গীত ও নাট্যমূলক শিল্পরীতিরূপে প্রচলিত তাই এক কথায় নৃ-গোষ্ঠী নাট্য বা Ethnic Theatre’ অন্যকথায় কোনো পালা বা নাট্যকাহিনীর সঙ্গে যুক্ত কৃত্য যখন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক-নৃতাত্ত্বিক পরিচয়কে একান্তভাবে উদ্ভাসিত করে তখন তাকে জাতিগত থিয়েটার বা Ethnic Theatre বলা যায়’।
গারোদের জাতিগত বিশ্বাসের অভিজ্ঞান হচ্ছে-সৃষ্টির আদি অবস্থায় বিশ্বজগৎ বলতে কিছুই ছিল না। এই পৃথিবীর চারদিকে তখন নিঃসীম কালো ঘোর অন্ধকার ও অসীম জলরাশিতে পরিপূর্ণ ছিল। চারদিকে কেবল পানি আর পানি ছাড়া কোথাও আলো, ভূমি, প্রাণী বা গাছপালার কোন অত্বিস্ত ছিল না। এই অবস্থায় তাতারা-রাবুগা’ (গারোদের সৃষ্টিকর্তার নাম) পৃথিবী সৃষ্টি করার কথা চিন্তা করলেন। তার এই জাগ্রত ইচ্ছাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য তিনি তার সহকারী দেবতা নস্তু-নপান্তু’কে মনোনীত করলেন। নস্তু-নপান্তু একজন স্ত্রী লোকের বেশে তার সহকর্মী মাচির সহায়তায় পৃথিবী সৃষ্টির কাজে মনোনিবেশ করলেন।
এদের সৃষ্টিতত্ত্বের ইতিহাস আরও বিস্তৃত এবং ব্যাপক। সৃষ্টিতত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা লাভের পর সংস্কৃতিবান এই জাতির নৃত্য-গীত-নাট্যের পরিচয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। গারো নৃ-গোষ্ঠীর রয়েছে সমৃদ্ধ পুরাণ। এ সকল পুরাণ কথার বাঁকে বাঁকে প্রাত্যহিকতার নানান প্রতিক‚ লতার মধ্য দিয়েও গড়ে ওঠেছে নানান উপকথা। মাতৃতান্ত্রিক গারো নৃ-গোষ্ঠীর সামাজিক জীবনে রয়েছে মাহারী’ ও উত্তরাধিকার (নকনা) নির্বাচনের সুকঠিন নিয়ম। Cross Cousin Marriage Syestem’ এর নিগড়ে পিষ্ট গারো নারী-পুরুষের প্রেম পরিণয়ের ভিত্তিতে সৃষ্ট বেশকিছু পালার সন্ধান মেলে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ওয়ানগাল্লা, চিরিং, ফদিনি, কান্দোদোলং প্রভৃতি। এরমধ্যে ওয়ানগাল্লা উৎসবের নানান পর্যায়ে বিচিত্র নামের মোট পঁয়তাল্লিশ থেকে ছাপ্পান্ন প্রকার নৃত্যের প্রচলন রয়েছে। তারমধ্যে রে-রে’ এক প্রকার নৃত্য-নাট্য। এই সকল নৃত্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঙ্গীতের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কোথাও কেবলমাত্র আদিম অভিনয়। এতদ্ব্যতীত রয়েছে নাট্যিক সংলাপভিত্তিক নৃত্য-গীত ও অভিনয়। গারো নৃগোষ্ঠীর বিভিন্ন গোত্রের অন্যতম দোয়াল’ এবং ব্রাক’ গোত্রের মধ্যে প্রেম, বিরহ, মিলনভিত্তিক রে-রে’ নৃত্যগীত প্রচলিত। ওয়ানগাল্লায় সালজং, সোআৎসা, খ্রাং, রংদিকমিত্তে, নক্নিমিত্তের পূজা সম্পন্ন হলে খামাল (কামাল) ও নক্মার নৃত্যের পর প্রচুর মদ্যপান করে সকল গারো পূজারী। (তবে গারোরা নেশাখোর মদ্যপ জাতি নয়। এরা নিছক নেশা করার জন্য মদ পান করে না। মদপান এদের দৈবশক্তি লাভের উপাচার।) প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করার ফলে এক সময় তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আরম্ভ হয় রে-রে’ নৃত্য-গীত। রে-রে মূলত অবিবাহিত নারী-পুরুষের নৃত্য-গীত। বিবাহিত অল্পবয়স্করাও এতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এর নৃত্য-গীতের মৌল উদ্দেশ্য গারো যুবক যুবতীদের মধ্যে প্রণয় সংঘটন।
রে-রে সংলাপভিত্তিক নৃত্য। তাৎক্ষণিকভাবে মুখে মুখে রচিত হয় সংলাপের ভাষা। সংলাপগুলো ব্যক্তি নির্ভর এবং একই সঙ্গে ব্যক্তির সৃজন ক্ষমতা নির্ভরও। এ নৃত্যে নারী-পুরুষ প্রথমে দুই ভিন্ন সারিতে দাঁড়ায়। যখন নাচ শুরু হয় দু’টো সারি একত্রে মিলে। একসারিতে তারা এমনভাবে অবস্থান করে যাতে একজন নারীর পেছনে একজন পুরুষ অনায়াসেই দাঁড়াতে পারে। এতে নৃত্যরতরা জোড়ায় জোড়ায় আলাদা হবার সুযোগ পায়। নৃত্যের পর্যায়ক্রমে কখনও বা তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রতিদলে থাকে একজন করে মূল গায়ক। বাকিরা পালন করে দোহারের ভূমিকা। প্রথম পক্ষের মূল গায়েন বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নৃত্য সহকারে সঙ্গীতের মাধ্যমে তার প্রতিপক্ষকে প্রশ্ন করে। দোহারগণ হারা...রা’ ধ্বণিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। একই প্রক্রিয়ায় অপরপক্ষের মূলগায়েন প্রথম পক্ষের প্রশ্নের উত্তর দেয়। এভাবেই পুরো একটি রে-রে’ নৃত্যগীত পরিবেশিত হয়। এতে বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোন মুদ্রার ব্যবহার নেই। যুবক-যুবতীরা কখনও দুইহাত কোমরের কাছে নিয়ে এসে কব্জি বাঁকিয়ে আনমিত অবস্থায় কোমরে ন্যস্ত করে এবং কোমর দোলায়। বাদ্যযন্ত্রের তালে চলে স্টেপিং। কখনও একহাত ভাঁজ করা অবস্থায় উপরে ওঠে যায় প্রায় মাথার কাছাকাছি। অন্যহাত বেঁকে আসে বুকের কাছে। কখনও হাতগুলো পাখির ডানার মত দুলতে থাকে। আবার কখনও নৃত্যরতরা দুইহাত কাঁধের উপরে কান সমানউচ্চতায় রেখে নৃত্য করে। কখনও নৃত্যরত নারী-পুরুষ পরস্পর পরস্পরের দিকে মস্তক হেলিয়ে নৃত্য করে। মুখ চলে আসে মুখের কাছে। চোখ নিবদ্ধ হয় চোখে। আর তখনই মন বিনিময়ের মাহেন্দ্রক্ষণ। মন দেয়া-নেয়ারপালা সংলাপের মাধ্যমে কি প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় তার নমুনা দেখা যাক।-
পুরুষ (মূল গায়ক) ও ............ : খাউই সাৎনা রে এ’ আ
মাংশা মান্না লাউয়া না (২)
ওয়াল জামেং গিছা নিন
জাংগি মারা কাউয়ানা।
দোহার : হারা ... রা হারা .... রা (২)
নারী (মূল গায়ক) : ও ...... ওয়াল জাসেং গিছা নিন
জাংগি মারা কাউয়ানা (২)
চিংঙেই রে রে মান্না’ খা
রন’ জা মাইছা নাংস না।
দোহার : হারা........ রা..... হারা ...... রা (২) ]
ভাষাগত দুর্বোধ্যতার কারণে গারো ভাষায় সংলাপ আর দীর্ঘায়িত না করে বরং এর আধুনিক বাংলা অনুবাদ কেমন দেখা যাক।-
পুরুষ : ও......... খা উই হিচতাম গিয়া আমি
পাইলাম এক রাউগ্যা মাছ
বিয়ান বেলার আগেই পাতলাম
কাউয়ার লাগি জাংগি গাছ
নারী : ও ..... বিয়ান বেলার আগেই পাতছ
কাউয়ার লাগি জাংগি খান
আমার জানা রে-রে গুলান
কিয়ের লাইগ্যা বিলাইতাম।
পুরষ : ও .... রে-রে গাওনের লাইগা আইছ
এমুন ভাগ্য দিল কে
আরও কাছে আইও না
রেগে গাইবাম তোর লগে।
নারী : ও .... কাছে আমি যাইতাম না
তুমি বড়ই বেহায়া
রে-রে গাওনের সাধ থাকলে
চাইও না আর ট্যাগাইয়া।
পুরুষ : ও..... ও সুন্দরী যুবতী লো
লওনা আমার সাথে
মন রংগে গাই রে-রে
তাল বেতাল সুরেতে।
নারী : ও... তাল বেতাল সুরেতে গাইবা তুমি রে-রে গান
কার কাছে কইয়া যাইবা
মনের গোপন কথা খান।
পুরুষ : ও.... পাওডা বুঝি হইল লেংড়া
উইঠ্যা মঠ গড় টিলা
রে-রে গাইতাম আইয়া দেহি
মনটা হইছে পাগিলা
নারী : ও..... মন হইছে পাগল গো
গাইতে আইয়া রে-রে
বউডা তুমার দেইখ্যা আইলাম
কান্দে দুর্গাপুরে।
পুরুষ :ও.... বউরে আমার দেইখ্যা আইছ
কান্দে দুর্গাপুর
সুন্দরী গো
তারে ছাইড়া দিয়া আমি
বিয়া করবাম তোরে।
নারী : ও..... আর কেমনে কইবাম সই
নির্লজ্জ এই বেহায়ারে
এইখানেই শেষ করলাম
আমার রে-রে পালারে
আলোচ্য রে- রে সঙ্গীতটিতে সুস্পষ্ট একটি কাহিনী রয়েছে। নাটকীয়তায়পূর্ণ সে কাহিনীতে বিদ্যমান ঘটনার পূর্বে সংঘটিত কিছু ঘটনার আভাস। কাহিনী বিন্যাস করলে দেখা যায়- রে-রে নৃত্য শুরু হয়েছে। যুবক নৃত্যরত সঙ্গিনীকে জানায় যে, সে প্রথম দর্শনেই মেয়েটির রূপে মুগ্ধ হয়েছে। তার এই আকুতি সে জানায় ছন্দে-সুরে রূপকের আশ্রয়ে, খা উই হিচতাম গিয়া আমি / পাইলাম এক রাউগ্যা মাছ /বিয়ান বেলার আগেই পাতলাম /কাউয়ার লাগি জাংগি গাছ’। এখানে রাউগ্যা মাছ’ আদিবাসীর অন্যতম Sex simble কাউয়া শব্দটি রূপসী যুবতীর রূপক। প্রেমজ ফাঁদ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে জাংগি গাছ’ শব্দটি। এভাবে কথোপকথনের মাধ্যমে নৃত্য-গীতের অন্তরালে ভানভণিতার আশ্রয়ে চলে গারো যুবক-যুবতীর মন দেয়া নেয়া। এটি তাদের সামাজিক রীতি। রীতিটি এমই যে মন দেয়া নেয়ার মতো একান্ত ব্যক্তিগত অবেগটিও প্রকাশ করতে হয় প্রকাশ্যে। এ পালার নারী চরিত্রটি বড়– চণ্ডিদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা চরিত্রের অনুরূপ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে প্রেমার্ত কৃষ্ণ রাধাকে প্রেম প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রাধা নানা অজুহাতে তা প্রত্যাখ্যান করলেও সেটি আসলে তার বাইরের রূপ। মনে মনে সে আসলে কৃষ্ণকেই লালন করে। অনুরূপ রে-রে পালার নারী চরিত্রটি প্রেমজ পুরুষ বিবাহিত জেনেও তার প্রেম প্রস্তাবে সাড়া দেয়।
গারোদের আরও অনেক রে-রে পালা রয়েছে। সেগুলোর কাহিনীতে ভিন্নতা থাকলেও সবগুলোর লক্ষ প্রণয় সংঘটন এবং বিষয়বস্তু প্রেম’।
সংস্কৃতির অবক্ষয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তেও গারো নৃ-গোষ্ঠী বিলুপ্তির করাল গ্রাস থেকে এই চমকপ্রদ শিল্প নিদর্শনটি আজ অবধি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। আর বস্তু সর্বস্ব জীবনের নানান সঙ্কটে মন্ময় এই শিল্পরীতিটি অস্তিত্বের মর্মমূলে কোমল স্পর্শ বুলায় বলেই হয়তো এটিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে গারোরা।
তথ্যঋণ
এক. লুৎফর রহমান, নৃ-গোষ্ঠী নাট্য গারো, বাংলা একাডেমি।
দুই. সেলিম আল দীন, একটি মারমা রূপকথা, বাংলা একাডেমি।
তিন. আফসার আহমদ, নৃ-গোষ্ঠী নাট্যের শিল্পরীতি: উপাদান ও গবেষণা পদ্ধতি, থিয়েটার স্টাডিজ সংখ্যা-৯, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ জাবি, সম্পাদক-সেলিম আল দীন।
এইচআর/পিআর