ধীরে বহ কন্যা


প্রকাশিত: ০৬:০৩ এএম, ৩০ জুলাই ২০১৬

-দাওয়ায় বইস্যা কে কান্দে?
-আমি অর্চনা আবাগি
-নাম অচীন লাগে। কি বিত্তান্ত, কোন গেরামে ঘর?
-আমার কুনু ঘর নাই খুড়া, জীবনের কুনু বিত্তান্ত নাই।
ভোরের প্রথম ভাগ। সুবহে সাদিক। আকাশে রক্তিম আলো ফুটবে কি ফুটবেনা সূর্য এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি। পাখিদেরও ঘুম ভাঙ্গেনি। মাটির আলপথ ধরে ধার্মিকেরা মসজিদ ঘড়ের দিকে যায়। শিশুকোলে গৃহী ঘুমায়। নিকানো উঠান থেকে ওম ওম গোবরের ঘ্রাণ। গ্রামের নাম মেহেন্দিগঞ্জ। অর্চনা এই গ্রামের নাম জানেনা। কাউকে চেনেনা। অচেনা গ্রামের এক গৃহকোণে বিলাপ করে কাঁদে শুধু। গতকালও তার ঘর ছিল। হোকনা বাজারের ঘর, তবু ঘরতো। পনের বছর বয়সে ঠাঁই পেয়েছিল সে এই ঘরে। তারপর সুখে দুঃখে, ভালোয় মন্দয় কতদিন কতগুলো বছর কেটে গেছে। ভৈরব বাজারের সতের নাম্বার ঘর। টিনের চালা দেওয়া পাকা ঘর। দেয়ালে সাটানো সব নায়িকার ছবি। রঙ্গীন সাদাকালো হরেক নায়িকার ছবি। মাঝখানে রাখা শাহরুখ খানের এই বড় একখান ফটো। সকাল বিকাল শাহরুখের গালে গলায় চুমা খায় অর্চনা। শরীরের ভেতর কেমন চিরবিরিয়ে উঠে।

সন্ধ্যা নামলে এই পল্লীর অচেনা রুপ। যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো মৃতপুরী। স্নো পাউডার সেন্টের গন্ধে ম ম করে। চনমনা চনমনা ভাব। ববি শান্তা আর অর্চনা এক বয়সী। ববি এসে বলে, ব্রার হুকটা লাগায়ে দেতো। ঝুলে পরা মাইয়ের বাটে ঠুনা মেরে অর্চনা বলে, আলো এই সকালেই শইল ঝুলাইলি কেম্নে! পুরুষ ধইরা রাখতে হয় মাইয়ের বাটে। খিলখিলিয়ে হাসে দুজনে। ঝুনু মাসি তাড়া দেয়, ছেনালী হাসি হাসিসনালো মাইয়ারা। খইদ্দের আসনের টাইম পার হয়, তরা অখনো কাপড় পড়া শেষ করলিনা। মাসির মুখ ঝামটায় হাসির শব্দ আরো বাড়ে। ঝুনু মাসির শরীরটা উত্তরের পাহাড়ের মত কিন্তু মনটা বেজায় ভালো। কালোর মাঝে এত রুপ! চুলগুলো মাথা ছাড়িয়ে পীঠ বেয়ে পানস সাপের মত কিলবিলিয়ে ঢেউ তুলে কোমরের কাছে নেমে এসে ছোঁবল হেনেছে। চোখদুটো ছিলা টানটান ধনুকের মত। থলথলে শরীরে মাংসের কোনো কমতি নেই। কিন্তু একসময় এই শরীর ছিল ধিকি ধিকি জ্বলা এক টুকরা অঙ্গার। কালো রুপের আগুনে কত পুরুষ যে পুড়ে মরেছে! সারারাত উজাগরের পরে অর্চনাদের সকালে ঘুম ভাঙ্গে দেরি করে। এগার বারোটার দিকে উঠে আলসেমিতে উঠানে নেমে আসে। রহমত চাচার দোকান থেকে চা পুরি আনায়। এ্যলুমিনিয়ামের মগের গলায় গলায় চা। চায়ে দুধের সর ভাসে। গরম গরম ডালপুরি চায়ে ভিজিয়ে খেতে খেতে মাসির সাথে সুখ দুঃখের কথা হয়।

-তর সইলডা কিমুনলো অর্চনা। রাইতে আর জ্বর আইছিলনি?
-সইল অখন ভালা। চুলের গুড়ায় কেন জানি বেদ্না করে। মাসি, কেউ যদি ছনু মুন্সির কাছে যায় তো তারে দিয়া আমার লাইজ্ঞ্যা একটা তাবিজ আনায়ো। চুলের বেনীতে বাইন্ধা রাখলে বেদ্না কমে।
-তাবিজে বেদনা কমে না তর মাতা। এগুলান বেক ভেলকিবাজি। পয়সা কামানের ধান্দা। তরে আমি ওষুধ আনায়ে দিমুনে অর্চনা। আজকাল খইদ্দার কেমুন পাস। তর হইল গিয়া এখন ভরা মৌসুম। সইল্যে জোয়ারের বান। ছিপ ফালাইলেই মাছে ঠোকর দিবো। যতদিন জোয়ানি ততদিন ইলিশ মাছ। রুপালী তুলতুলা ইলিশ মাছ। ভাটির গাঙ্গে কেউ নৌকা বায়নালো অর্চনা। ঝুনু মাসির এই কথাডা মনে রাখিস।

রাজার বেটায় যেদিন প্রথম এসেছিল, অর্চনার সেদিন ছিল রজঃস্নান। সাতদিন হায়েজের রেস্ট। দীর্ঘদিন বিরতি আর রজঃস্নানের পর অর্চনার শরীর টানে। সন্ধ্যায় মার্কারি লাইটের হলদেটে আলোয় আয়নার সামনে দাঁড়ায় সে। কাঁচা শরিষা ফুলের মত গায়ের রং। লম্বা হয়ে দাঁড়ালে কাঠের চৌকাঠে মাথা ঠেকে। বুকে আর নিতম্বে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মাংস। অর্চনা কেশবতী না। মাথায় চুলের কমতি আছে। চুলের রংটাও কালো না। লালচেটে। সুবাসি তেলে চুল চিটচিটে করে। সিথি কেঁটে হাতখোপা বাঁধে। কানের কাছে গুঁজে দেয় প্লাস্টিকের গোলাপ ফুল। লাল ফুলে সুবাস নেই কিন্তু রংয়ে উজালা করে অর্চনার ফর্সা মুখ। আজ সকালে মেহেদী লাগিয়েছিল হাতে পায়ে। গোলাপী শাড়ির ফাঁক গলে রুপ যেন উছলে উছলে পরছে। কাঠের দরোজায় টোকা পড়ে। অর্চনা আলগুছে খীল খোলে। সামনে দাঁড়ায়ে সাক্ষাৎ কার্তিক ভগবান। আহা, এই মানুষটির জন্যই কি অর্চনা এতদিন অপেক্ষা করেছিল?

-বাইরে দাড় করায়ে রাখবা। ঘরে আসতে বলবানা। মানুষটির কথা বলার ভংগিটি মায়াময়। অন্য কোনো পুরুষ এই কথা বলেনা, সকলে দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। পুরুষ খাটের উপর বসে।
-তোমার নাম কি কইন্যা
-নাম অর্চনা। আগে পিছে কিছু নাই। আপনেরে সন্দ করি আইজই পরথম দেখলাম এই অঞ্চলে?
-কথা ঠিকই বলছ অর্চনা। আমি ভিন গাও থেকে আসছি। বাণিজ্যে টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা চলতেছে। মন বড় উতলা। বান্ধবের কাছে শুনলাম এই পল্লীর কথা তাই একটু জিরাইতে আসলাম। কামাইল্যা দালাল বলল, এই বাজারে তুমি শ্রেষ্ট রূপবতী। কাছে আইসা দেখলাম সে কিছু মিছা বলেনাই। দূরে দাঁড়ায়ে কেন। কাছে এসে বস কইন্যা।

সেইযে শুরু তারপর প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসেছে সে অর্চনার ঘরে। কি এক ঘোরের মাঝে সকাল দুপুর কাটে অর্চনার। বিকেল হতেই স্বস্তি। স্নানের পর  বাহারি শাড়িগুলো বের করে বাছতে বসে। সাজের সময় ববি বলে,
-অখনতো আর সারুকের গালে চুমা খাইতে দেখিনা অর্চনা দেবীরে। রাজার বেটা কি সারুকের চাইতেও বেশি হইল?
-একথা কইসনা ববি। তার আসনের সময় হইলে আমার হাত পা হিম হয়ে যায়। যেন আমি আগে কখনো কারো সামনে গিয়া দাঁড়াই নাই। আর যখন সে সামনে আসে, আহারে অর্চনা পিন্ধনের কাপড় আর পিন্ধনে থাকেনা। খালি খুইল্যা পরতে চায়।

বাইরে অঝোর বৃষ্টি। থেকে থেকে বজ্রপাত হয়। পল্লীবিদ্যুতের নাকাল অবস্থা। এই থাকে এই নাই। এখন ঘরের ভিতর নিকশ অন্ধকার। অর্চনাকে বাতি জ্বালাতে দেয়নি আশফাক। বিজলীর আলোতে মায়াবী দুটি ছায়া হঠাৎ হঠাৎ চমকিত হয়। অর্চনার হাত নিজের হাতে নিয়ে আশফাক বলেছিল,
-অর্চনা, আমার লগে যাইবা তুমি?
-কই লয়া যাইবা আমারে
-তোমার এই জীবন ছাইড়া বহুদূর। সেখানে আমরা বসত গড়ব। ধানী জমি থাকবে। উঠানে শিশুরা খেলা করবে। তোমারে তারা মা বইল্যা ডাকবে। অর্চনার চোখ চিকচিক করে। অনাগত জীবনের স্বপ্ন দেখে। শিশুর বমিমাখা কাঁথার গন্ধ শুঁকে।

এই পল্লীর মেয়েদের বাইরে যাওয়া নিষেধ। তবু মাসির কাছে গিয়ে আবদার রাখে আশফাক, মাসি অর্চনারে লইয়া একরাইত বাইরে থাকতাম চাই। তুমি কইলে না কইরোনা। তুমার মেয়েরে যেমনে নিমু তেমনে আবার আইন্যা ফেরত দিমু। মাসি প্রথমে নিমরাজি ছিল। আশফাক মাসির হাতে গুঁজে দেয় কড়কড়া নোট। নোটের গন্ধে নেশা আছে। সেই নেশার কাছে ভালোবাসাও ম্লান হয়। মাসি রাজি হয় অর্চনাকে একরাতের জন্য ছেড়ে দিতে। কারো সন্দেহ যেন না বাড়ে তাই পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু সাথে নিতে পারেনা সে। চৌকাঠের বাহিরে পা দিতেই ফোস করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে।

দুই দিন দুই রাত নৌকা ভাসানের পর অর্চনা জানতে চায়, কতদিন নৌকায় জলে ভাসবো। ডাংগার মুখতো দেখিনা। রাত দশটায় খাবার আনতে গিয়ে আর ফেরেনি আশফাক। বাহিরে রাত ঘন হয়। কাছেই বসত ভিটার দুএক ঘরে টিমটিমে কুপির আলো দেখা যায়। কু পাখি কুম কুম ডাকে। অর্চনা মনে মনে দূর হ দূর হ বলে। কু পাখি দূর হয় না। অজানা শংকায় একলা কন্যার বুক কাঁপে। যদি আর ফিরে না আসে আশফাক? কিন্তু কেন আসবেনা, সে যে তারে কথা দিয়েছে। ছইয়ের নিচে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখে অর্চনা। বিরান আকাশ। চাঁদ নাই তারা নাই। শুধু নিঃসীম অন্ধকার। মাঝির কণ্ঠে উদ্বেগ। আম্মাজান আপনের সাথের তাইনে বোধকরি আর ফিরবনা। আপনে ফিরা যান। এই বয়সে কমতো দেখিনাইগো আম্মা।   

অর্চনা ডাংগায় পা রাখে। কোথায় যাবে কিছু জানেনা। ধানক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটে। পাকা ফসলের গন্ধ। এঁদো কাদায় পা পিছলায় আবার উঠে দাঁড়ায় সে। বসতিদের কাছাকাছি এসে একবার পিছন ফিরে তাকায়। পেছনে গহন অন্ধকার। মাঠের পরে প্রথম যে ঘরটি পেলো তার দাওয়ায় ধপ করে বসে পরে অর্চনা। ততক্ষণে আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। একটি রাতের ঘোরের পর অর্চনার স্বপ্নরা এখানে এসে শেষ হয়। পাশের গ্রামে মনে হয় রাতে কেউ মারা গিয়েছে। ফিকে অন্ধকারে অর্চনাকে পাশে রেখে শ্মশানের দিকে চলে যায় শব মিছিল, “বোল হরি, হরি বোল”।

।।দুই।।

পরির যখন জন্ম হয় তখন ভর দুপুর। যে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অর্চনা সেটা আবদুল্লাহ শেখের বাড়ি। আবদুল্লাহ শেখের স্ত্রী গত হয়েছে সাত বছর আগে। স্ত্রী কমলা বানু ছিল বাঁজা মেয়েমানুষ। সৌখিনদার আবদুল্লাহ সেখের আল্লাহ খোদায় অগাধ ভক্তি। গঞ্জে তার বিরাট মুকাম। কাপড়ের ব্যবসা। শাড়ি গামছা লুঙ্গী। বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসতী। বাণিজ্যে লক্ষ্মী ধরা দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ঘরের লক্ষ্মীকে ধরে রাখতে পারেনি। কলেরায় ধরা হলুদ শাড়ি পরা তাজা বৌটারে রিক্সা ভ্যানে করে জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে বৌয়ের হাত ধরে আবদুল্লাহ বলেছিল,
-কমলারে তুই ছাড়া এ দুইন্যাত আমার আর কেহ নাই। তুই আমারে একলা ফালায়ে চলে যাইসনারে বৌ। আবদুল্লাহর অনুনয় রাখেনি কমলা। ভ্যান থেকে নামানোর পর বুকের মধ্যে নল পেতে ডাক্তার সাহেব বলে দিল, মরা মানুষ নিয়া হাসপাতালে আসছেন কেনো?

অর্চনাকে সেইদিন সকালে দাওয়া থেকে ঘরে নিয়ে তার সব কথা শুনেছিল আবদুল্লাহ। সৌখিনদার মানুষদের দিল দরিয়া হয়। দরিয়ায় ঠাঁই পায় অর্চনা,
-সময় মত বিয়া সাদি কইরা ছেলেপিলে হইলে তুমার সমান আমার মেয়ে থাকত। মনে কর আজ থাইক্যা তুমি আমার মেয়ে। সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেছিল অর্চনা। জিজ্ঞেস করেছিল,  
-মুসলমানের ঘরে থাকতে হইলে কি মুসলমান হওয়া লাগব। আমি কলেমা গাইতে জানি।
-না আম্মা, তুমি তুমার ধর্ম পালন করবা, আমি আমার। খোদায় আর ভগবানে কোনোকালে কোনো বচসা নাই। ভেদাভেদ জন্ম দিছে অধার্মিকে। তুমি ডাকবা ভগবানরে আর আমি আল্লাহরে। দিন শেষে একই সৃষ্টকর্তার কাছেই নতজানু। ঈশ্বর নিরাকার। আকার প্রকার বিভেদ সকলই আমাদের সৃষ্টি।

সকাল থেকে কোমরে আর তলপেটে চাপ চাপ ব্যথা। চাচা গেছে গঞ্জে। একলা বাড়িতে থেকে অভ্যাস অর্চনার কিন্তু আজ কেমন ভয় ভয় করে। এ বাড়িতে ঠাঁই পাবার একমাসের মধ্যেই সে তার শরীরে অন্য কোনো জীবনের অস্তিত্ব টের পেয়েছিল। শরীরের ভেতর বেড়ে উঠে অন্য শরীর। রক্ত মাংস শেষ্মা খেয়ে বর্ধিত হয় মানব শিশু। সে বোঝেনা কোনো পাপ। শিশুর কোনো পাপ নেই। চাচার পায়ে পড়ে অর্চনা কেঁদে বলেছিল, এখন আমি কি করুম। আবদুল্লাহ শেখ দৃঢ় প্রত্যয়ে শিশুকে পৃথিবীতে তার মত করেই আসতে দেয়ার পক্ষপাতী ছিল। শরীরের ভেতর শিশুটি আট মাসের বেশি সময় নড়েচড়ে, বড় হয়। আজ আলোহীন জগত থেকে আলোর পৃথিবীতে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। অর্চনার সাথে গ্রামের বৌঝিয়েরা মিশেনা। পুকুরে পানি আনতে গেলে দূরে দূরে থাকে। পথে কারো দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তিনবার জিজ্ঞেস করলে এক কথার উত্তর দেয়।

অর্চনা বুজতে পারে আজই তার সেইদিন। একলা ঘরে পাগলের মত হাঁটতে থাকে সে। কিভাবে পাড়ি দিবে এই অচেনা পথ। ডাকলেও কেউ আসবে না। তীব্র ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়। মনে হয় হাজারটা ছুঁচালো লোহার শিক দিয়ে গুতোচ্ছে কেউ তলপেটে। চিৎকার করে কাঁদে অর্চনা। মা মাগো, আমারে কি জন্য জন্ম দিছিলা। আমি কোনোদিন সুখ কারে কয় বুঝি নাই। হুস হইছে পর থেকা দেখছি, সতের কিড়ায় খুইল্যা খাইছে আমার শরীল। একজনরে ভালোবাসছিলাম মাগো, সেও মানুষ না। কিড়া, পুরুষগুলা সব কিড়া। পঁচা হোক গলা হোক শরীল পাইলেই তাগো চলে। ভালোবাসা কি জিনিস তারা জানেনা। গাভীন গাইয়ের মত অসহায়ভাবে ছটফট করে। চোয়ালের কষায় ফেনা জমে উঠে। রক্তে ভেসে যায় মাটির মেঝে। শরীরের সব শক্তি এক করে শরীরের ভেতর থেকে বের করে আনে আরেক মানুষ।

রাতে বাড়ি ফিরে আবদুল্লাহ দেখে শিশুকোলে ঘুমিয়ে আছে অর্চনা। খুশিতে চিৎকার করে,
-কি তাজ্জব ব্যাপার! আমরার ঘরে আরেক অতিথি আসছে। আম্মা কুলের বাচ্চা কি ছেলে না মেয়ে।
-চাচা, জন্ম হয়েছে আরেক  আবাগির। তার জীবনও হয়তো কেটে যাবে আমার মতই দুঃখে দুঃখে। মেয়ে মানুষের জীবন পানিতে পানিতেই কাটে। জন্ম নেয় পানি থেকে, সারা জীবনভর চক্ষের পানিতে কাটায়ে এক সময় মৃত্যু।
মমতায় শিশুটিকে কোলে তুলে নেয় আবদুল্লাহ শেখ।
-মেয়ে মাসাল্লাহ পরির মত ফুটফুইট্টা। আমি আমার বইনের নাম রাখলাম পরি।

সকলের হাতে পাঁচ আঙুল। পরির বাম হাতে ছয় আঙুল। ছয় আংগুলে পরি বাড়িময় হেঁটে বেড়ায়। দেবশিশুর ফর্সা মুখের দিকে তাকিয়ে অর্চনা সেখানে কার আদল দেখতে পায়! পরি ঠিক দেখতে হয়েছে আশফাকের মত। গনগনে রোদের দুপুরে বাহিরে বন পুড়ে আর পরির দিকে তাকিয়ে অর্চনার মন পুড়ে। রমজান মাস। দিনগুলো দীর্ঘ। উনানের আগুনে অর্চনা ডালের বড়া ভাজে, বেগুনী বানায় ছোলা ভাজি করে। পরির যা পছন্দ উঠিয়ে খায়। তারপর আবার চলে যায়। পরিদের ঘড়ের পরেই খেলার মাঠ। এপাড়ার ওপাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলতে আসে। পরি তাদের বাড়ির সীমানা বেড়ার ঝাপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু একটু এগোয়। সে জানে তাকে কেউ খেলতে নেবেনা। এ গ্রামে পরি আর তার মা অন্য জাত। কি জাত তা শিশু পরি বুঝেনা শুধু বুঝে তারা অন্যদের চেয়ে আলাদা। একা একা পরিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বয়সি আমজাদ এগিয়ে আসে।
-তুমি আমরার লগে খেলবা?

-আমারে কেউ খেলাত নেয় না। আমি একলা একলা আমার মা’র লগে খেলি। মায় যখন রান্ধা করে আমি তুমাগো খেলা দেখি। নানাজান কইছে কেউ যদি আমার লগে না খেলতে চায় তাইলে যেন আমি একলাই খেলি। নানাজান আমারে পুতুল কিন্যা দিছে, তিনটা পুতুল। আমি অগো নাম রাখছি। যেইটা বাচ্চা পুতুল তার নাম রাখছি ময়না।
-আমি তুমার লগে খেলব, চল তুমার পুতুল দেখাইবা। পরি খুশি হয়ে আমজাদের হাত ধরে। বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসার জন্য হাত ধরে টানে। দৌড়াতে দৌড়াতে কাছে এসে থাকে আমজাদের বোন। বয়সে তার চেয়ে কিছু বড়। ছোঁ মেরে পরির হাত থেকে আমজাদের হাত ছাড়িয়ে নেয়। ঠাস করে আমজাদের গালে চড় মেরে বলে,
-জাউরা মাইয়ার লগে না খেলতে মানা করছি আমজাদ। কুনুদিনও অর লগে খেলবিনা। অর মায় আছিলো বেশ্যা বেডি। ভাসতে ভাসতে এই গেরামে আসছে। মায় কইছে পরির লগে খেললে আল্লায় গুনা দিব।

পরি এধরনের কথাবার্তার সাথে জন্ম থেকে পরিচিত। দৌড়ে এসে অর্চনার কোলে ঝাপিয়ে পরে। মেয়েকে বুকের সাথে চেঁপে ধরে গালে গলায় আদর করে। উনানের আগুনের আঁচ কমে এসেছে। একটা কাঠের চ্যালা নিয়ে চুলায় দেয়। শুকনো কাঠের চেলায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে।

পরির বয়স সাত। আবদুল্লাহ তাকে গঞ্জ থেকে  আদর্শলিপি আর ধারাপাতের বই এনে দিয়েছিল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পরিকে পড়তে বসায়। উঠানে পাটি পেতে বসে দুজনে। হ্যারিকেনের আলোয় পরি সুর করে পড়ে, তিন এক্কে তিন। তিন দুগুনে ছয়। তিন তিরিক্কা নয়।  পাঠে পরি দ্রুত আগায় আর আবদুল্লাহ শেখের চোখ চিকমিক করে।
-অর্চনা আম্মা, এই মেয়ে বড় হইলে জজ ব্যারিস্টার হইব। দেখছনি কত তাড়াতাড়ি পড়া মুখস্ত করে! আমি পড়া দিয়া কুল পাইনা পরি শেষ কইরা ফালায়। মাথার ব্রেন খুব ভালো। এই বছর পরিরে ইশকুলে ভর্তি কইরা দিমু। পরি বড় হইয়া এলেমদার হইব, বিরাট এলেমদার।

জানুয়ারি মাস। স্কুলে এখন ভর্তির সময়। গত রাতে অর্চনা একফোটাও ঘুমাতে পারেনি। অর্চনার জীবনে আনন্দময় ঘটনা খুব একটা নেই। সারাজীবন ধরে অপেক্ষা করেছে কোনো আনন্দের। আজ সেই দিন এসেছে। তার মেয়ে পরি স্কুলে যাবে। এরচেয়ে বড় ঘটনা তার জীবনে আর আসেনি। নিজে কখনো স্কুলে যেতে পারেনি। চোখের সামনে দেখতো ছেলেমেয়েরা বইখাতা কাখে নিয়ে গ্রামের পথ ঘরে স্কুলের দিকে যেত। আজ তার মেয়ে স্কুলে যাবে, তার পরি।

অনাগত ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে পরিকে পরিস্কার ফ্রক পরিয়ে স্কুলের পথে রওয়ানা দেয় আবদুল্লাহ শেখ। দেব দেবীর নাম করে পরির বুকে মাথায় ফু দিয়ে বাড়ির সীমানা বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে অপসৃয়মান পরিকে দেখে অর্চনা। মনে মনে মা সরস্বতীকে স্মরণ করে। তুমি আমার পরিরে দেইখ্য মা।

এনায়েতুল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচ গ্রামের একমাত্র স্কুল। দূর দুরান্ত থেকে বাচ্চারা পড়তে আসে। পরিকে নিয়ে মাস্টারের সামনে বসে আছে আবদুল্লাহ শেখ। বারবার পরির কানে ফিসফিসিয়ে বলে, মাস্টার যা যা জিজ্ঞেস করবে তার ঠিক ঠিক উত্তর দিবি কইলাম।
-নাম কি তোমার
-আমার নাম পরি, ভালো নাম অর্পণা রানি দেবী
-অর্পণা, কলমের ইংরেজি কি?
-পেন
-বানান কইরা বলো
-পি ই এন, পেন
-দুই এর ঘরের নামতা বলতে পারনি?
-দুই এক্কে দুই দুই দুগুনে চাইর তিন দুগুনে ছয়
-সকাল বানান বল দেখি অর্পণা
-দন্ত স ক আকার ল
মাস্টার সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে তাকায় আবদুল্লাহর দিকে। মেয়েরেতো ভালোই শিখাইছেন লাগে। আমি ভর্তি করে নিতাছি। ভর্তি ফর্ম টেনে তাতে লিখতে থাকে মাস্টার।
-নাম
-অর্পণা রানি দেবী
-বয়স
-সাত
-পিতার নাম
-পিতা নাই
-পিতা বেঁচে না থাকলেও নাম বলেন
-অর্পণার পিতা নাই। মাতার নাম লেখলে চলেনা মাস্টার?
-বাচ্চা আপনার কি হয় জনাব?
-আমার নাতনী। মানে আমার বাড়িতে জন্ম হইছে, বড় হইছে। তার মা আছে। মার নাম বলি মাস্টার সাহেব।
অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে মাস্টার তাকায় আবদুল্লাহর দিকে। আবদুল্লাহ শেখ ছটফট করে। মেশিনে আটকা পরা পশুর মত ছটফট করে। যে মানুষ অর্চনার পেটে পুরীষ ঢেলে চলে গিয়েছিল তার নামের কি প্রয়োজন। শুধুমাত্র পুরীষের অধিকারই কি পিতৃত্ব? যে মানুষ জঠরে রেখে বড় করে জন্ম দেয় তার পরিচয় কি কিছুনা? আবদুল্লাহর মনের অবস্থা হয়ত মাস্টার বুজতে পারে।
-আমরা সমাজ নিয়ে চলি জনাব। সমাজের নিয়ম কানুনের বাইরে যেতে পারিনা। ভর্তি ফর্মের প্রতিটা ঘর আমাকে ফিলাপ করতে হবে নিয়মানুযায়ী। এছাড়া ভর্তি করা যাবে না। স্কুলে আর দশটা বাচ্চার সাথে মিশতে পারবে না এই মেয়ে। সবাই ধিক ধিক করবে। তখন তার মন আরো খারাপ হবে। তারচে আমি পরামর্শ দেই, নাতনীরে বাড়িতে পড়ান। বড় হইলে প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়াইবেন। জগতে আলো আন্ধারি দুই জমজ বোন। তারা সবসময় একসাথেই চলে। অন্ধকার যেমন সত্য তার পাশে আলোও আছে। সকল কিছুকে মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হয়।

।।তিন।।
ছয় আঙ্গুলে পরি ধীরে ধীরে বড় হয়। পড়াশুনায় বড় হয়, মাথায় বড় হয় আর শরীরে বড় হয়। সবরী কলার মত গায়ের রং। ঠোঁটে মনে হয় পুঁই শাকের বিচি ঘসে রেখেছে। যত্নের শরীরে  কৈশোর আসি আসবো করছে। চামড়ার নিচে তেড়েফুরে উঠছে ডিগে শরীর। বুকের মাংস অসমান হতে শুরু করেছে। গলার থেকে নেমে গেলে মাংসের বাঁকটা এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। শরীরে বাড়লেও মনের দিক থেকে বাড়েনা পরি। এ নিয়ে অর্চনার দুঃচিন্তার শেষ নেই। রশীদ দর্জির ঘরে গিয়ে পরির জন্য বুকের সামনে কুঁচি দেয়া ফ্রক বানিয়ে আনে অর্চনা। তাতে করে কিছুটা ঢাকা পরে পরির কিশোরী দেহ। দুপুরে সূর্যের তাপ আর তীব্র আলো ঢলে পরলে ঘরের দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে মায়ে-ঝিয়ে। চুলে বিলি কেটে তেল লাগায় আর টুকটাক কথা বলে,
-শুনো পরি, তুমি অখন বড় হইতাছ। তোমারে অনেক নিয়ম কানুন মাইন্যা চলতে হইব। নতুন যেই জামা দুইটা সিলাই করায়ে আনছি রশীদ দর্জির ঘর থেকা অইগুলাই এখন থাইকা পরবা। আগের গুলা আর পরবা না।
-কেন মা, আমার হলুদ জামাডা-যেইডার মইদ্যে জড়ির লেইস দেয়া অইডা আমি ফালাইতে পারুম না। অইডা আমার অনেক পছন্দের।
-মাইয়া মাইনসের জীবনে পছন্দ বইল্যা কিছু নাই পরি। মাইয়া মাইনসের জীবনে আছে খালি বদল। তুমারে সবাই বলবে বদলায়া যাইতে, যদি নিজেরে বদলাইতে পার তুমারে সবাই ভালো বলবে নাইলে তুমি হইবা খারাপ মাইয়া। অখন পরি মা, আমার চোক্ষের দিকে চাইয়া কও তুমি কি ভালো মেয়ে হইবা নাকি খারাপ মেয়ে?
পরি মার কথার আগামাথা কিছু বোঝেনা, শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। মাথা চুলকে শিশুপরি হেসে বলে,
-মা আইজ দই বসাইবা? খুব হাতে পাতা দই খাইতে ইচ্ছা করে।

সকালে ঘুম থেকে উঠার পর সারাদিনে সাধারণত আর ঘুমায় না পরি। সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ হলে নানাজান গঞ্জে রওয়ানা দেয় আর পরি তার বই খাতা খুলে পড়তে বসে। পড়ার পাঠ শেষ হলে পুতুলের বাক্স পেট্রা নামিয়ে খেলায় মন দেয়। ইত্যবসরে পুতুলের সংসার বড় হয়েছে। ময়নার বিয়ে হয়েছে। তার আবার এক ছেলে এক মেয়ে। ছয়জনের ভাড়া ঘর সামলাতে ছোট পরিকে হিমসিম খেতে হয়। ময়নার ছেলেমেয়েগুলা হয়েছে বদের হাড্ডি। সারাদিন নিজেরা নিজেরা মারামারি লেগেই থাকে। বোনটি বড়, ভাইটা ছোট। হলে হবে কি, কোনো মান্যগন্য নাই। এইমাত্র চুল টেনে দৌড় দিল। তাকে ধরতে পিছুপিছু ছুটছে বোন। হঠাৎ খেলা থামিয়ে দেয় পরি। ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই শরীরটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। ঘুম পাচ্ছে। বুকে আর তলপেটে চিনচিনে ব্যথা। পুতুল টুতুল গুছিয়ে রেখে বাড়ির পেছনে চলে আসে পরি। ছাগলটা খুটার সাথে বাধা। গতবছর কোরবানির ঈদের সময় আবদুল্লাহ কিনে এনেছিল কোরবানি দেয়ার জন্য। কি সুন্দর গায়ের রং! সারা শরীর খয়েরী আর পেটের কাছে এই বড় সাদা বৃত্ত। দাড়ি নাড়িয়ে নাড়িয়ে পরির দিকে তাকাচ্ছিল। যখন শুনেছিল ঈদের দিন কেটে ফেলা হবে মরা কান্না জুড়ে দিয়েছিলো পরি। উপায়ন্তর না দেখে সেই বিকেলে আরেকটা ছাগল কিনে এনে এটা পরিকে দিয়ে শান্ত করা হয়েছিল। সেই থেকে ছাগল পরির বন্ধু। পরি ওর নাম রেখেছে পুটুলি। কলাগাছে থেকে কলাপাতা ছিড়ে সেটা খেতে দেয় পুটুলিকে। কলাপাতা পুটুলির বড় পছন্দের খাবার। মাথা ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে আরাম করে খায় পুটুলি। নাহ, ব্যথাটা আরো বাড়ছে। ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। আলসেমি লাগছে, ঘুম পাচ্ছে। পরি ঘড়ের দিকে পা বাড়ায়। দৌড়োতে গিয়ে থামে, রানের কাছটায় কেমন ভেজা ভেজা লাগে। পরি ফ্রক উঁচিয়ে রানের দিকে তাকায়। ক্ষীণ একটা রক্তের ধারা রান বেয়ে হাঁটুর দিকে নামছে। ভয়ে দৌড়ে অর্চনার কোলে এসে ঝাপিয়ে পড়ে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে,
-মা আমার কোথায় জানি কাইট্টা গেছে আমি জানিনা। আমি দেখি নাই। মাগো রক্তে আমার পাও ভাইস্যা যাইতাছে। আমি মনে হয় মইরা যাইতাছি মা।
-মাইয়া মানুষ এত সহজে মরেনা পরি, শান্ত হও।

তিনদিন ধরে সমানে মাইকে গান বাজছে। মেহেন্দিপুর গ্রামে বিয়ে মানেই সপ্তাহভর মাইকে সিনেমার গান বাজবে। গানের সাথে পরি সঙ্গত দেয়। এখন যে গানটা বাজছে এটা পরির অতিপ্রিয় একটা গান। ছাইয়া দিলমে আনারে, মুহে লেকে জানারে এ এ এ ছম ছমা ছম ছম। সকাল থেকে এ পর্যন্ত নয় বার বেজেছে এই গান।  মনোযোগ দিয়ে  শোনার ফলে গান পরির এখন প্রায় মুখস্ত। মনটা সকাল থেকে খুশি খুশি। যে বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে তারা নানাজানকে দাওয়াত করেছে। নানাজান বলেছে পরিকে সাথে নিয়ে বিয়ে খেতে যাবে। পরির জীবনে এমন আনন্দময় ঘটনা খুবই কম। আজ জুম্মাবার। নানাজান জুম্মার নামাজ শেষ করে ফিরে এলেই তারা দুজনে বিয়েতে যাবে। বিয়ের উপহার হিসাবে কেনা হয়েছে লালের উপরে জড়িপাড়ের একটা টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি। শাড়ি পরির পছন্দ হয়েছে। নিজের বিয়েতেও এরকম একটা শাড়ি নানাজানকে কিনে দিতে বলবে বলে স্থির করে পরি।

বিয়ে বাড়ি এত আনন্দময় হয়! যতটা ধারণা করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগে পরির। শাড়ির প্যাকেটটা দিতে নানাজান বাড়ির ভেতর দিকে যায় আর পরি একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকে। বসে বসে বাড়িভর্তি লোকজনের ব্যস্ততা দেখে। খোলা মাঠের উপর চাদোয়া টাংগিয়ে খাবার জায়গা করা হয়েছে। চাদোয়াটাও কি সুন্দর! সাদার গায়ে হরেক রকমের ফুল লতাপাতা আর ঠোঁটেঠোঁট মিলানো পাখির ছবি। চারিদিক থেকে ভালো খাবারের খুসবু ভেসে এসে পরির ক্ষিদেকে আরো বাড়িয়ে দেয়। নানাজানের মত বয়সি একজন মানুষ এসে পরির পাশের চেয়ারে বসে।
-তুমরার কুন বাড়ি, কার সাথে আসছ। আঙ্গুল তুলে পরি তাদের বাড়ির দিকে ইশারা করে। মানুষটি আবারো বলে,
-ছোট বাচ্চা মেয়ে তুমি একা একা এখানে বসে আছ। আইস, তুমি আমার কোলে আইসা বস মা। পরির কেমন অস্বস্তি হয়। তবু চেয়ারে বসা মানুষটির কোলের উপর বসে। মানুষটি পরিকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খায়। পরি কুকরে যায়। মানুষটির হাত পরির উরুর উপর। ধীরে ধীরে আঙ্গুলের চাপ বাড়ে। কিলবিল করা আঙ্গুলটি পরির হাফ প্যান্টের কাছে এসে চলে আসে। আঙ্গুল উরুসন্ধি স্পর্শ করে। পরি যত ছটফট করে আঙ্গুল তত চেপে বসে। নানাজানকে এদিকে আসতে দেখে পরি মানুষটির কোল ছেড়ে দৌড়োয়। এ এক নতুন ভয়। এই ভয়ের সাথে আগে কখনো পরিচয় ছিলনা পরির। তবে সে বুঝে বিষয়টা তার জন্য লজ্জার। বিষয়টা কাউকে বলা যাবেনা।    

চাদোয়ার নিচে একটা লম্বা টেবিলের চারধারে চেয়ার পাতা। নানাজানের সাথে একটা টেবিলে বসে পরি। টেবিলটিতে পাড়ার সব মুরুব্বী শ্রেণির পুরুষরা বসা। সকলেই নানাজানের বয়সী সকলের পোশাক আশাকে ধার্মিক বলে মনে হয়। সবাই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে। পরি খাবারের জন্য অপেক্ষা করে। টেবিলের একজনের হঠাৎ চোখ যায় পরির দিকে।
-আরে, আবদুল্লাহ শেখের সাথে ফুটফুইট্টা মেয়েটা কে?
-আমার নাতনী
-আপনের আবার নাতনী আসলো কই থাইক্কা? গোপনে ভিন গেরামে আরেকটা শাদী করছিলেন নাকি। হাসির শব্দ উচ্চকিত হয়।
-আরে নাহ, আমার পালিত কন্যা অর্চনার মেয়ে।
-অর্চনার মেয়ে? কি সর্বনাশ! আজ জুম্মাবার, মাত্র নামাজ শেষ করে আসলাম। একই টেবিলে এই মেয়ের সাথে আহার গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনেরা কি বলেন। আপনে অতিশয় ভালো মানুষ। আপনে আমাদের সাথেই থাকেন শুধু এই মেয়েকে অন্য কোনো টেবিলে বসায়ে দিয়ে আসেন আবদুল্লা শেখ।

পরির হাত ধরে গ্রামের আলপথ দিয়ে হাটে আব্দুল্লাহ শেখ।
-কিরে বেটি পেটে ক্ষুধা লাগছে?
-হু
-এইতো আমরা বারিত গিয়া আম্মাজানের হাতের রান্না করা গরম গরম ভাত খামু।
সূর্যের তাপ এই মধ্য দুপুরে প্রখর হয়েছে। চোখদুটো জ্বালা করে পরির। বিয়ে বাড়িতে যাবে বলে গঞ্জের বড় দোকান থেকে পুতির নকশি করা বাহারি জামা কিনে এনেছিল আবদুল্লাহ শেখ। সেই জামাতে এখন ভীষণ গরম লাগছে। গরমটা অসহ্য লাগছে। সবুজ ধানক্ষেতে সকালে বোধহয় মেশিন সেচের পানি দেয়া হয়েছে। ক্ষেতটা পানিতে কেমন চিপচিপে করছে। আলপথের পাশে একটা কুকুর আলসের মত বসে আছে। তার পিঠের উপর চড়ে বসেছে এক দাঁড়কাক। আবদুল্লাহ শেখের সেদিকে চোখ যায়। সেদিকে তাকিয়ে সে মুখে উচ্চারণ করে, জগৎ বড় আজব জায়গা। বড়ই আজব জায়গা।

 ।।চার।।
এসএসসি ফাইনালের আর মাত্র এক মাস বাকি। মনে হলেই পরির বুক কাঁপে। যৌবনটা পরির শরীরে এঁটে বসেছে। সাপের ফনার মত উরু উরু চুল। মায়ের মত কাঁচা সরিষা ফুলের গায়ের রং। চোখের উপর ভ্রূযুগল এসে মিলেছে একসাথে। চোখে কাজল পরতে হয় না। জন্ম কাজলপরা চোখ। পুঁই বীচির আবীর মাখা ঠোঁট। সতের বছরের পরি এখন ভরা যৌবনবতী। পরীক্ষার ভাবনায় ঘুম আহার সব গেছে। মাথাটাও সময় নেই অসময় নেই ঝিম ঝিম করে। নানাজানকে বলেছিল মাথা যন্ত্রণার কথা। নানাজান মাকে নিয়ে গঞ্জে ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছে। গঞ্জে যাওয়া আসা, এখন এতোটা সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না পরির। এই সময়ে পড়া কিছুটা এগিয়ে রাখা যায়। অর্চনা এসে তাড়া দেয়,
-কি-লো পরি, তরে লয়া ডাক্তরের কাছে যামু। তুই দেরি করছ কেন।
-মা, আমার যাইতে ইচ্ছা কওে না। এতদূর হাইট্টা যাইতে হইব। যাইতে আসতে কত সময় লাগব কও। তারচাইয়া ঘরে বইস্যা পড়া করি।
-মাথার বেদনায় কু কু করছ। আবাগী মাইয়া, ডাক্তরে দেইখ্যা অসুদ দিব। তর মাথার যন্ত্রণা দূর হইব। দেরি করিছনা। উঠ ল যাই।

গঞ্জে মানুষের ভীড়ে। খালের জলে টান ধরলে মাছে যেমন কিলবিলায় গঞ্জেও মানুষ তেমন কিলবিল করে। সব পুরুষ তার দিকে কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে। যেন চোখ দিয়ে গিলে গিলে খায়। দৌলতপুর গঞ্জে সপ্তাহে হাট বসে দুইদিন। বুধবার বরিবার। আজ হাটবার। হাটুরেরা পশরা সাজিয়ে বসেছে। ময়রার দোকানে গরম গরম জিলাপী ভাজা হচ্ছে। দূরে হাটের পশ্চিম দিকে নাগরদোলা বসিয়েছে। পরি অর্চনার শাড়ির খুঁট টেনে ধরে।
-মা, আমারে নাগরদোলায় চড়তে দিবা। কুনুদিন চড়ি নাই।
-আরে রাম! কি সব্বোনাশের কথা কয়। মাইয়া মাইনসের নাগরদোলায় চড়তে নাই। -চড়লে কি হয় মা। অ মা, যাইনা চড়িনা। অর্চনা হাত ধরে টেনে সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় পরিকে। কাঁচা বাজারের পাশ ঘেষে হারু মহাজনের গদি। তার পাশের দোকানটাই আব্দুল্লাহ শেখের। পরিকে দেখতে পেয়ে দোকান ছেড়ে নেমে আসে  সে। তিনজনে মিলে জুরান ডাক্তারের দোকানে যায়।

বাজারের ভিতরে দুই কামড়ার ডাক্তারখানা। সামনের দিকে কম্পাউন্ডারের বসার জায়গা আর ফার্মেসি। হরেক রকমের ওষুধের বোতলে ভর্তি কাঁচের শেলফ। রুমের সামনের দিকে কাঠের দু’টা বেঞ্চি বিছিয়ে রাখা আছে রোগীদের ওয়েটিংয়ের জন্য। ভেতরে আরেকটা রুম। সেখানে ডাক্তার সাহেব বসেন। রুমটিতে একটি পেসেন্ট বেড বসানো সেখানে শুইয়ে রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। বেডের সামনে দিকটা পর্দাঘেরা। গ্রামের বৌঝিয়েরা পর্দার ভেতর থেকে ডাক্তারের সাথে কথা বলে। ফিনাইলের তীব্র ঝাঝালো গন্ধ। ডাক্তারের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে থাকে অর্চনা আর আব্দুল্লাহ শেখ। ডাক্তারের সাথে সাদা কাপড়ে লাল ক্রস দেয়া কাপড়ের পর্দার ওপাশে কাঠের দরোজা পেরোয় পরি। ডাক্তারের সাথে ছোট কক্ষের ভেতরে আসে সে। ঘরের ভেতর একটা লোহার বেড সাদা চাদর বিছানো। দেখলেই লাশের কথা মনে হয়। মনে হয় এক্ষুনি সে মরে যাবে। ডাক্তার সাহেব তার উপর শুতে বলে পরিকে। পরি চিত হয়ে শোয়। ডাক্তার পরির রক্তের প্রেশার মাপে। কানে স্টেথিস্কোপ লাগিয়ে পরির বুকে চেপে ধরে,
-বয়স কত
-জ্বি, সতের
-সমস্যা কি
-মাথা যন্ত্রণা করে। সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। পরতে বসলে মাথা মনে হয় ছিড়া পইড়া যায়।
-মাসিক ঠিকমত হয়
-জ্বি?
-হায়েজ ঠিক সময় মত হয় কিনা জিজ্ঞাস করি। এর সাথে মাথা ব্যথার সম্পর্ক আছে।
-জ্বি ডাক্তার সাব ঠিকমতই হয়।
-মাসিকের আগে বাদকের ব্যথা হয়?
-জ্বি?
-  মাসিকের আগে তলপেটে আর বুকে কি ব্যথা হয়?
-জ্বি হয়। বেশিনা হালকা বেদনা।
-এখন তোমার কয়দিন চলে?
-বিশদিন
-তাইলেত বাদকের ব্যথার সময় হইছে। দেখত আমি চাপ দিলে তুমি ব্যথা পাও কিনা।
ডাক্তার পরির বুকে হাত রাখে। চাপ দেয়। পরি বুজতে পারেনা তার মাথা ব্যথার সাথে এই চাপের কি সম্পর্ক। পরি ডাক্তারের হাত সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু হাত সরেনা। ডাক্তার সাহেব নিলর্জ্জের মত দাঁত বের করে হাসে। পরি জানে এই বিষয় কাউকে বলা যাবে না।

ভেতরের ঘর থেকে পরির সাথে বের হয়ে ডাক্তার সাহেব। নতমুখী পরি কোনো কথা বলেনা। কথা বলে ডাক্তার,
 -মেয়ের তেমন কিছু হয় নাই। পরীক্ষার চিন্তায় বেসামাল। সেই জন্যেই মাথাটা ধরে। বেশি পানি খাইতে হবে। নিয়মিত কোষ্ঠ পরিষ্কার হইলে শরীর থাকবে ঝরঝরা। অধিক রাত জেগে যেন পড়াশুনা করা ঠিকনা। জীবনে পড়ার যেমন প্রয়োজন আছে তেমন প্রয়োজন আছে ঘুমেরও। মেয়েরা মায়ের জাত। পরিরে দেইখ্যা আমার মায়া লাগছে। যেন আমার মরা মায়ের মুখটা তার মুখে বসায়ে  রাখছে। তারে আমি খুব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখছি। যে ওষুধটা দিলাম সেটা সকালে আর রাতে এক ট্যাবলেট সাত দিন খাইতে দিবেন সাথে দিবেন প্রচুর পানি। পানির আরেক নাম জীবন। পানির সাথে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্য বের হয়ে যায়। আমরা জীবন দান করতে পারিনা। জীবনকে শুধু সুস্থ রাখার গুরু দায়িত্ব নিয়েছি।

মন্ত্রমুগ্ধের মত ডাক্তারের কথা শুনে আবদুল্লাহ শেখ আর অর্চনা। শুধু পরি নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের দিকে, কোনো কথা তার কানে যায় না। গলার ভেতরটা কেমন শুকিয়ে খসখস করছে। মুখে একদলা থুতু জমা হয়। থুতু কোথায় ফেলবে পরি দিশা পায় না।  

।।পাঁচ।।
 তোমার চেতনার রংয়ে পান্না হল সবুজ
চূনী হল লাল
আমি চোখ রাখলাম আকাশে
আকাশে ফুটলো তারা।
এই জায়গাটা জাহিদের খুব পছন্দের। চোখ যতদূর যায় খোলা মাঠ। সবুজের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়। বাতাস এসে ঘাসগুলোর মাথা নুইয়ে দেয়। একটু দুরে পানি। পানির ওপারে পাড় দেখা যায় না। টুপ করে একটুখানি আকাশ শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়ে ভিজছে। কোনো রা নেই। যেন এই নিরন্তর ভিজে যাওয়াতেই তার আনন্দ। একটা ভাঙ্গা মন্দির দাঁড়িয়ে আছে সময়ের সাক্ষী হয়ে। একসময় মানুষে মানুষে গমগমে ছিলো। দুপুর হলে আলু কুমড়া পটলের সুক্তের সাথে আলো ভাতের গন্ধ ছিলো। শাখের ধ্বনির সাথে কিশোরী বধুর নরম হাতে শাখা ছিলো। এখন কিছু নেই। কায়ক্লেশে দাঁড়িয়ে আছে ভাঙ্গা মন্দিরের কংকাল। ভেতরে গেলে হয়তো দেখা যাবে দুর্গন্ধে টেকা দায়।  খুব চেপে গেলে আসতে যেতে পথিকেরা গাদা গাদা জল-বিষ্ঠা রেখে যায়।

পরির কোলের উপর চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখে জাহিদ। আজকাল সময়ের বড় দাম বেড়েছে। হাতের নাগালে পাওয়াই মুশকিল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস পরির। আকাশে আলোটা ফিকে থাকতেই উঠে পরে। নিয়মমত ছাদে যায়। ঢাকা শহরে এক টুকরো আকাশ সকালে না দেখলে পরির দিন কাটেনা। গায়ে মুখে আকাশের ফিকে আলো মেখে ঘরে ফিরেই স্নানঘরে গিয়ে ঢোকে। জলের ঝাপটায় পেছনের দিনের গøানি মুছে যায়। শুরু হয় একটি তরতাজা নতুন দিন। অলটাইম হাফ পাউরুটি কিনলে পরির ছয়দিনের নাস্তা হয়ে যায়। ফ্রিজ থেকে বের করা দুই পিস ঠান্ডা পাউরুটি একমগ চায়ে ভিজিয়ে খেলেই মিটে গেলো সকালের ক্ষুধা। মা যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন সকালে পেটভরে গরম ভাত খাওয়া হত। কখনো গতরাতের বাসি তরকারি, কখনো ডাল চচ্চরি কিংবা ডিম ভাজার সাথে। মা অদ্ভুত এক এক রকমের ডিম ভাজতো। খোসা ছাড়ানো পেয়াজ মিহি করে কুঁচানো। শুকনা মরিচ তেলে ভেজে হাতে টিপে গুড়ো করে সেই গুড়ো মরিচ পেয়াজের সাথে ডিম ফেটিয়ে শরষের তেলে ফুলো ফুলো করে ভাজা। ইচ্ছে হত ভাতের পাতিলশুদ্ধ কামড়ে খেয়ে ফেলে। পরি ডিম ভাজার কৌশলটা মার কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলো কিন্তু কখনো ভাজেনি। থাক, আবার যদি কখনো কোথাও অন্য কোনো জন্মে মায়ের সাথে দেখা হয় তাহলে আবার এই ডিমভাজা খাওয়া যাবে।

সাত তাড়াতাড়ি শাড়িটা বদলে আরেকটা তাঁতের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নেয় পরি। হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে ধানমন্ডির বাসে চড়ে। একত্রিশ নাম্বার রোডে পরির অফিস। পত্রিকা অফিস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের পড়াটা শেষ হবার আগেই এই পত্রিকা অফিসে জয়েন করেছে পরি। চিফ এডিটর কামাল ভাই, আধা বয়েসি মানুষ। মানুষ বলা যায় কি? ঠিক মানুষ না, তিনি আসলে ভগবান। পরির এই বাইশ বছরের জীবনে মানুষতো কম দেখা হলোনা। চামড়া দিয়ে ঢেকে রাখা মানুষ রূপী। ভেতরে আসলে কেউ দেবতা আর কেউ চন্ডাল।

-আমার দিকে না তাকিয়ে বলতে পারবে, আজ আমি কি রংয়ের শাড়ি পরেছি?
-আজ তোমার কুসুম রং। এখনকার ফার্মের মুরগীর ডিম না। গ্রামের বাড়িতে রাতের বেলা খোয়ারের ভেতর ডিম পাড়ে হাসে। সকালে মেয়েরা তুলে নেয় ডিম। ডিম ভাংলে নরম কুসুম। তোমার শাড়িতে আজ পেতি হাসের ডিমের কুসুম। সাবধানে থেকো মেয়ে, কখন না জানি আমি তোমায় ভেজে খেয়ে ফেলি।
-আচ্ছা হলো। এবার বলো আমার চুল খোলা না বেনী না হাতখোপা।
-একবার নওগায় এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন আমি কলেজের সবে কলেজে পা দিয়েছে। নো নলেজ উইদাউট কলেজ। আমার নলেজ বাড়তে শুরু করেছে আর নিজের মধ্যে হেন করেংগা তেন করেংগা একটা ভাব। তো, আমরা একসাথে ছিলাম পাঁচ বন্ধু। ওদের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে খেতে প্রায় আছরের আজান দিয়ে দিত। খাওয়া শেষ করে হারাধনের বাছারা হাঁটতে বের হলাম। যার বাড়ি গিয়েছিলাম তার নাম আবু। আবু বললো, চল মরাখোলা মানে শ্মশানের দিকে যাই। বাকিরা ভয়ে যেতে চায় না। কেবল আমি আর আবু রাজি। আমাদের গলায় জোর বেশি বাকিরাও আস্তে ধীরে রাজি হয়। শ্মশানের ভেতরে একটা পুকুর। শান বাঁধানো। পুকুরে ফুটে আছে লাল শাপলা। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল শাপলা ফুল। কি যে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য পরি! আমি পুকুরের পারে এগিয়ে যাই। সিঁড়ি যেখান থেকে শুরু হয়েছে সেখানে কেমন একটা গর্ত মতন। আমি একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে খুচাই। গর্তটা ক্রমশ বড় হতে থাকে। আমাকেও কেমন নেশায় পেয়ে বসে। একটু পরে যে দৃশ্যটা দেখলাম পরি! একসাথে তিরিশ চল্লিশটা বাচ্চা সাপ নিয়ে বসে আছে মা সাপ। কালো মিশমিশে। সূর্যের আলো পড়লে ঝিকমিক করে। বাচ্চাসাপগুলোর মাথা একটু একটু করে দুলছে। বন্ধুরা আমায় সরে আসার জন্য হন্যে হয় ডাকে। আমি সরে আসতে পারিনা। কি এক সম্মোহনী মায়ায় আমি তাকিয়ে থাকি! ছোবলে বিষের ভয় জেনেও আমি সরে আসতে পারিনা। পরি, আজ তোমার খোলা চুল। বাতাসে একটু একটু উড়ছে। আর আমি অপেক্ষায় আছি সেই সর্বনাশের।
-জাহিদ তুমি এমন করে কিভাবে বলো? আমার দিন রাত হয়, রাত দিন হয় কিন্তু তোমার ভাবনা ফুরায় না।
-আমি তোমাকে ভালোবাসি পরি। তুমি গ্রামের মেয়ে দৃশ্যটা বেশ বুজতে পারবে। তোমাদের গ্রামে পাটের আবাদ করেনা?
-করে
-ধরো, পাট গাছগুলো লম্বায় একহাত। যখন বর্ষা নামে গাছগুলোর পা ছুঁয়ে থাকে পানি। তোমার পায়ে আলতা নেই কেনো? চন্দ্রমার রাতে শুকনো উঠোনে বসে আমি তোমার পায়ে আলতা পরিয়ে দেবো। ঝর বাদলের রাতে তুমি ভয় পেয়ে চমকে উঠলে আমি তোমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলবো, লীলাবতী-ভয় পেয়োনা। আমি আছি তোমার পাশে-যতদিন ঝড় আছে যতদিন বিজলী আছে যতদিন আমার বুকে প্রাণ আছে।

পত্রিকা অফিসে এটা পরির দ্বিতীয় চাকরী। এই অফিসে প্রথম জয়েনিংয়ের দিন সকালে এসে রিসেপশন রুমের একটা সোফায় বসেছিলো পরি। কিছুক্ষণ পর এক যুবক এসে হাসিমুখে দাঁড়ালো। নিজের নাম জানালো জাহিদ হোসেন। সাথে করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে পরির বসার জায়গা দেখিয়ে বলল, আজ থেকে এখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করুন। কথাবার্তায় আন্তরিক যুবককে পরির বেশ পছন্দ হয়ে যায়। চায়ের পর জাহিদ পরিকে নিয়ে যায় চিফ এডিটর কামাল মোস্তফার রুমে। মোটাসোটা ভদ্রলোক। একমুখ দাড়িগোফ, মাথায় টাক। চোকগুলোও কুতকুতে। প্রথম দেখায় পছন্দ হয়না টাইপের মানুষ কামাল ভাই।
-আপনার নামতো অপর্ণা রানী, তাইনা। তো আমরা কি আপনাকে এই নামেই ডাকবো নাকি সহজ সরল আরো কোনো নাম আছে?
-আমাকে পরি বলে ডাকতে পারেন। মনে মনে রাগে গর্জায় পরি। এতো আগ্রহ কেন বাবা তোমার? তোমার কুতকুতে চোখ দেখেই ঠাহর পাওয়া যায় তুমি বেটা ভালো মানুষ না। পরির সেই ভুল ভাঙ্গতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগেনি।
-আমার একটা সমস্যা আছে, বয়সে ছোট কাউকে দেখলে আপনি বলতে পারিনা। হে হে হে।
-আপনি আমাকে নিশ্চিন্তে তুমি বলতে পারেন। রাগে পরির গা জ্বলে। পুরুষের এই হে হে হাসির অর্থ তার জানা আছে। এই হাসির মানে হলো, বুকের কাপড় সরাও কন্যা। আমি তোমার বক্ষ দেইখ্যা চক্ষু জুড়াই।
-আচ্ছা পরি, পত্রিকা অফিসে এটাতো আপনার দ্বিতীয় চাকরী। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, প্রথমটার কি হয়েছিল?

সবে রেজাল্ট বেড়িয়েছে। গায়ে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ধটা লেগে আছে। এক বন্ধুর কাছে খবর পেয়ে দেখা করতে গিয়েছিলো দৈনিক পত্রিকাটির অফিসে। ঘন্টাখানেক কথা বলার পর সম্পাদক সাহেব বলেছিলেন, আপনি চাইলে কালই জয়েন করতে পারেন। সৌখিনদার মানুষ বলে মনে হয় সম্পাদককে। সুন্দর করে কথা বলেন। কথা বলার ভঙ্গীটি আন্তরিক নয় তবে টানে বেশ। একমাস শেষ হয়ে পঞ্চম দিনে পিয়ন এসে বড় স্যারের সালাম দিয়ে যায় পরিকে। সুন্দর সাজানো ঘর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা দিচ্ছে। টেবিলের উপর ফুলদানিতে ভিজিয়ে রাখা তিনটি রজনীগন্ধা।
-আসেন পরি। বসেন।
-আমায় ডেকেছেন?
-পরি এইক’দিন আপনাকে সময় দিয়েছি অফিসের এনভায়রনমেন্ট বোঝার জন্য। আজ থেকে শুরু হবে মূল কাজ। তার আগে আপনার সাথে আমার বোঝাপড়াটা ভালো থাকা জরুরি। কি বলেন?
-জ্বি, অবশ্যই। আমি ভালো করে কাজ করবো বলেই এখানে এসেছি।
-বাড়িতে আমার দুটি ছেলে। স্ত্রী গত চার বছর ধরে অসুস্থ। সব থেকেও আমি একলা মানুষ। আপনাকে প্রথম দেখেই মনে হয়েছে, এতদিনে দূর হবে আমার একাকিত্ব।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। পরির সামনে এসে হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে তোলে। নিঃশ্বাসের শব্দ ঘন হয়। পরি কিছু বুঝে উঠার আগেই এতগুলো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বহমান কালের মত সময় বয়ে যায়। এবার সে পুরোপুরি জড়িয়ে ধরে পরিকে। শাড়ির আঁচলের নিচে হাত চলে যায়। শক্ত কর্কশ হাত। পরির মনে হয় মাকড়সার রোমশ হাতগুলো কিলবিল করছে তার পেটের উপর অংশে ব্লাউজের কাছে। হঠাৎ নিজেকে ফিরে পায় পরি। ঝাড়া দিয়ে মাকড়সা সরায় গা থেকে। দরজার দিকে আগায় সে। পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরে অসুর। পরি সব গুলিয়ে ফেলে, নিজেকে আর পরি বলে মনে হয় না এখন। মনে হয় দুঃশাসনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দ্রৌপদি। বস্ত্র হরণের কাল সমাগত। কিন্তু দ্রৌপদীরা কখনো বস্ত্র হারায় না। মন্দিরে দুলে উঠে ঘন্টা। বাতাসে ভেসে আসে মঙ্গল শাখের আওয়াজ, উলুধ্বনি। পরি ধীরে এগোয়। শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে অসুরের গালের উপর চড় বসিয়ে দেয়। পরি জানে লম্পটদের সাহস কম থাকে। এইসকল মানুষের জোর থাকে বীর্যে, বুকে নয়। দরোজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে পরি।

রাস্তায় যখন নেমেছে পরি ততক্ষণে দুপুর হয়ে গিয়েছে। নিচে নেমেই টের পেলো বাতাস বেশ গরম। পাঁচ মিনিট হাঁটার পরই ঘামতে শুরু করেছে। শাড়ির আঁচলে জমে উঠা মুখের ঘাম মুছে। আনমনে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায়। আবার উঠে দাঁড়ায় পরি। সম্পাদকের লোভী চোখ মনে পরে। বুকের উপর আঁচলটা ঠিকঠাক করে গনগনে রোদের নিচে আবার হেঁটে সামনের দিকে এগোয় পরি। এগিয়েই চলে। যা দেবী বটবৃক্ষেসু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমাহা

।।ছয়।।

ক’দিন থেকে অফিসে আসছেনা জাহিদ। ফোন করলেই মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে, এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কি হলো মানুষটার। অসুখ বিসুখ নয়তো? শরীর খারাপ করলে পরিকে না জানানোরতো কোনো কারণ নেই। তবে কি হলো। মমতায় আদ্র হয় মন। আজ জাহিদের অফিসের পর জাহিদের বাসায় যাবে বলে ঠিক করে পরি। আরো একদিন জাহিদের বাসায় গিয়েছিলো পরি। সেদিন বাসায় কেউ ছিলনা। শুধু ছিলো জাহিদ আর পরি আর ভালোবাসায় মাখামাখি একটি সন্ধ্যা।

অগুছালো একটি ঘর। মুখোমুখি সোফায় বসা দুজন মানুষ। মুগ্ধতার আবেশে বুজে থাকা চোখ,
-পরি, আমি তোমায় ভালোবাসি
-সে কি আমি জানিনা? বাচ্চা ছেলেদের মত এই কথাটি কতবার তুমি আমায় বলেছো! হাসে পরি।
-তুমি জানো আমিও জানি। কিন্তু কি জানো, এই কথাটি তোমায় বার বার বলতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছোট বেলায় যখন পড়া করতাম আমি নিঃশব্দে পড়তে চাইতাম। মা বলতো,
-জোরে জোরে আওয়াজ করে পড়। কিছু যখন মনে গেঁথে নেয়ার দরকার হয় তখন সেটা জোরে উচ্চারণ করতে হয়। একবার তুই পড়াটি চোখে দেখলি আর উচ্চারণের সাথে শব্দটি কানে গেলে আবারো মাথায় গেলো। তাই উচ্চারণে কোনোকিছু মনে থাকে দ্বিগুনবার। ছোট মায়ের শেখানো সেই কথা মনে থাকে আমার। পরি, তোমাকে আমি লালন করি বুকের ভেতর। যখন শব্দ করে উচ্চারণ করি ভালোবাসি তখন সেটা ঢুকে যায় মগজের ভেতর। আর তখন আমি তোমাকে দুইবার ভালোবাসার সুযোগ পাই। নিশিগ্রস্থার মত শোনে পরি জাহিদের কথা। জাহিদ আবার বলে,
-শোনো পরি আমার বাপ একটা হিটলার। যখন জানবে তোমার আমার সম্পর্কের কথা কিছুতেই মেনে নেবেনা। শ্রেণি বৈষম্য করা তার স্বভাব। কিন্তু আমি তোমার জন্য সব  বৈষম্য ভেঙ্গে দেবো। তুমি আমার পরি। এ জীবনে তোমায় ছাড়া আমার আর কিছু চাইনা। কিচ্ছু না।

ঘরের বাইরে বিকেলটা সন্ধ্যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে প্রায়। ঘরের ভেতর বেহুলা কন্যা লক্ষীন্দরের বাসর ঘরে। আজ উঝার বিনে সাপের মরণ। এই মরণে বিষ নেই শুধু আনন্দ। পরির আনন্দময় চোখের তারায় স্থির হয় সময়। ভ্রমরেরা গুনগুনিয়ে যায়, সুখে থাকো বাছারা। প্রেমিকের করতলে সমর্পিত পরির মুখ। ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারে ঘরটিতে সেদিন মহাকাল ঘনিয়েছিলো।   

সি এন জি থেকে নেমে মিটার দেখে ভাড়া মেটায় পরি। মূল রাস্তা থেকে একটুখানি হেঁটে গেলে জাহিদের বাসা। গলির মোড় পেড়িয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাড়িটি আলোকময়। দোতলা বাড়ির আগাগোড়া আলোকসজ্জিত। উৎসবের ছোট ছোট লাল নীল সবুজ আলোগুলো একবার উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে আরেকবার নিচে নেমে আসছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে উঠতি বয়েসি কিছু ছেলে। তাদের গায়ে উৎসবের সাজ। পরিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন এগিয়ে আসে।
-আপা আপনি কি কাউকে খুঁজছেন
-আমি এসেছিলাম জাহিদ সাহেবের কাছে। আপনি কি তাকে একটু ডেকে দিতে পারেন। আমার নাম পরি।
-জাহিদ ভাই বাড়িতেই আছেন। আজ তার গায়ে হলুদ। কাল সন্ধ্যায় বিয়ে। আপনি ভেতরে যান।
-থাক তবে, সে নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকবে এখন। আমি যাই।
-আপনি তার কে হন
-আমি? কেউনা। আমি তার কেউনা।

কি আশ্চর্য! পরির কান্না পাচ্ছেনা। কেবল মায়ের কথা মনে পড়ছে। পরি তখন ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে একটিতে সুযোগ পেয়েছিল আর একটিতে ছিলো ওয়েটিং লিস্টে। ঢাকায় এবার স্থায়ীভাবে থাকার পালা। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েও নানাজানকে ঢাকা আসার জন্য রাজি করাতে পারেনি পরি। কিন্তু সোমত্ত মেয়ে একা থাকবে তাই চলে এসেছিলো অর্চনা। আজিমপুরে ছোট্ট একটা ভাড়ার বাসা। মায়ে-ঝিয়ে দিন কেটে যায়। ছুটিছাটা পরলে গ্রামের বাড়ি যায় নানাজানকে দেখতে।

সুস্থ মানুষ অর্চনা। পরি রোজদিনের মত ক্লাস শেষে টিউশনি সেরে ঘরে ফিরেছে। রাত দশটার দিকে পাশের ঘর থেকে ক্ষীণ গলায় অর্চনা ডাকে পরিকে। পরি ছুটে যায়। অর্চনা ঘরের মেঝেতে পরে আছে। জ্ঞ্যান হারায়নি তখনো। পরির চিৎকারে প্রতিবেশিরা ছুটে আসে। কোলের ওপর মায়ের মাথাটা রেখে ঢাকা মেডিকেলের গেটের সামনে নামে। সারারাত ছোটাছুটি। ডাক্তার জানিয়েছিলো মাথার ভেতর ছিড়ে গিয়েছে রক্তবাহী শিরা। মগজের মধ্যে ছড়িয়ে পরেছে রক্ত। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে তিনদিন একই রকমভাবে শুয়ে থাকার পর ভোরের দিকে ডাক্তার নিষ্ঠুরের মত খুলে নিয়েছিল অর্চনার শরীরে লাগানো সমস্ত যন্ত্রপাতি। পরি যখন মরা মায়ের হাত ধরে বসে আছে কাছের মসজিদে তখন ফজরের আজান পড়ছে। গত তিনদিনে অর্চনা তার প্রিয় মেয়ের সাথে একটিও কথা বলেনি। বলেনি, এত বড় পৃথিবীতে ছয় আংগুলে ছোট্ট পরি কিভাবে থাকবে। নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলো শুধু। কিছু বলে যায়নি। পরির জীবন থেকে তার প্রিয় মানুষগুলো কিছু না বলে একে একে চলে যাচ্ছে। পরির জন্য ফেলে রেখে যায় স্মৃতির কিছু লীলাখেলা আর কিছু মায়া।

অফিস থেকে পরি বেড়িয়ে এসেছিলো বৃহস্পতিবারে। আজ মঙ্গলবার। এর মধ্যে আর অফিস যায়নি। তার যে খুব মন খারাপ, বিষয় তেমন না। পরি কখনোই ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে না। সে শুধু তার কাজগুলো ঠিকমত করে যায়। নানাজানের কাছে শিখেছিলো এই অভ্যাস। নানাজান বলতেন,
-কাজ কখনো কালকার জইন্যা ফালায়া রাখবিনা। নিশ্বাসের বিশ্বাস নাই। কি বিশ্বাস তুই কাইল বাঁচবি কিনা। তাই সময়ের কাজ সময়ে শেষ করবি। কিন্তু গত ছয়দিনে তার কাজ বাকি পরে যায়। শুয়ে বসে সময় কাটে। সিনেমা দেখে বই পড়ে গান শোনে। কামাল ভাই প্রতিদিন ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। অফিসের খোঁজ দেয়। বিশেষ কোনো বিষয় থাকলে পরির সাথে ফোনেই আলাপ করে নেয়। ফোন রাখার আগে বলে,
-মন খারাপ করোনা পরি। ভালো হয়ে কাজে ফিরে আসো। হারামিদের কথা বেশিদিন মনে রাখতে নেই। তোমার মত মেয়ের আমার অফিসে খুব প্রয়োজন।

হাতে ভালো কিছু বই জমে আছে। সময়ের অভাবে পরা হয়নি। শেলফে পরে ধুলোবালি জমছিলো শুধু। এখন সময় পেয়ে এক এক করে পড়ে নিচ্ছে। আকাশটা সকাল থেকে গুম মেরে ছিলো। এখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। হাতের বইটা বিছানার উপর উল্টো করে রাখে পরি। রান্নাঘরে এসে ঢোকে। চুলার কাছে ম্যাচ থাকার কথা কিন্তু সেটা জায়গামত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বিরক্তিতে কুঁচকানো কপাল নিয়ে বারান্দায় আসে পরি আর ঠিক তখন মনে পড়ে, কালরাতে ইলেকট্রিসিটি চলে যাবার পর মোম জ্বালানোর জন্য ম্যাচটা ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সব যদি ঠিক থাকে ম্যাচটা তাহলে বালিশের নিচে থাকার কথা।

চা নিয়ে আবার বারান্দায় এসে বসে পরি। এটা পরির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। ছাদটাও পছন্দের কিন্তু ছাদে যখন তখন যাওয়া যায় না। কোনোদিন মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেলে বারান্দায় বসে থাকে পরি। অফিস থেকে ফেরার পথে মতিমামার দোকান থেকে প্রয়োজনীয় সদাইপাতিগুলো কিনে একবারে ঘরে ফেরে পরি। অনেক সময় বাহিরের কাপড় না ছেড়েই চা হাতে বারান্দায় চলে আসে সে। ঠিক এই সময়টাতেই জাহিদ ফোন করতো। ঘন্টা কেটে যায় কথা ফুরায় না। কথা তেমন গুরুত্বপূর্র্ণ কিছু না। এলেবেলে টাইপ কথাবার্তা। যেমন ধরা যাক,
-পরি, তুমি এখন কি পরে আছ
-সারাদিন যে শাড়ি পরা দেখেছ সেটাই
- সেকি তুমি কাপড় বদলাওনি
-ভাল্লাগছিলনা। চা নিয়ে সোজা বারান্দায় বসেছি আর তোমার ফোন এলো। কথা শেষ হলে চানে ঢুকবো।
-তুমি যখন আমার বৌ হবে তখন এরকম করা চলবেনা। বাইরে থেকে ফিরেই তুমি গোসল করবে। সাদা একটা ম্যাক্সি পরবে। আমি বারান্দায় বসে থাকব তুমি চা হাতে যখন আসবে, মনে হবে সাদা একটা পরি এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে।

দরোজায় কলিংবেল বাজে। পরির উঠতে ইচ্ছে করছে না। এসেছে হয়তো পাশের বাড়ির কেউ। না খুললেও চলবে। বিকেলে দেখা হলে যখন জিজ্ঞেস করবে তখন উত্তর দেয়া যাবে, ঘুমাচ্ছিলাম খালাম্মা একদম শুনতে পাইনি। বেলটা বেজেই চলছে। যে এসেছে সে নাছোরবান্দা টাইপ। হাই তুলে উঠে দাঁড়ায় পরি। দরোজা খুলে দেখে দাঁড়িয়ে আছে নওশাদ, অফিসের পিওন। অবাক হয়ে পরি ভেতরে ডেকে নেয় নওশাদকে। সে একটা কাগুজে ডকুমেন্ট ধরিয়ে দেয় পরির হাতে। কোনো মেইলের প্রিন্টেড কপি। নওশাদের চোখে হাসির ঝিলিক দিচ্ছে।

একটা ইনভাইটেশন। তেরটি দেশের সাংবাদিকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা পনেরদিনের কর্মশালা হয়। তিনমাস আগে লেখা জমা দিয়েছিল পরি কামাল ভাইয়ের আগ্রহে। পরি বলেছিল, দুইতিন হাজার লেখা জমা পরবে তার মধ্যে থেকে আমার লেখা সিলেক্টেড হবেনা কামাল ভাই। কামাল শুধু বলেছিলে, পাঠায়ে দেও। চেষ্টা করতে দোষ কি। সিলেক্ট হইলে বিরাট ব্যাপার। লন্ডনে পনের দিনের ওয়ার্কশপ। দেশে ফিরা আসলে তোমারে নিয়া টানাটানি পইড়া যাবে, তখন কিন্তু কামাল ভাইয়েরে ভুইল্যা যাইয়ো না।

চিঠিটা হাতে নিয়ে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে পরি। টেবিলের উপর ফোন বাজছে। ফোন কানে তোলে পরি। ওপ্রান্তে কামাল ভাই।
-তুমি এটা ডিসার্ভ কর পরি। আমি ঘন্টা দুয়েক আগে ব্যাপারটা জানতে পারি। ভাবলাম তোমারে একটা সারপ্রাইজ দেই। প্রিন্ট কপি দিয়ে তাই নওশাদরে পাঠায়ে দিলাম তোমার বাসায়।   

জাহিদের আলোয় সাজানো বাড়ি দেখে ফিরেছে চারদিন হয়। এই চারদিন ঘরেই ছিল পরি, বড়জোর মতিমামার মুদির দোকানে গেছে এটাসেটা কিনতে। পৃথিবীতে একা একজন মানুষ। কি অদ্ভুত, এই ক’দিনে তার একটুও কান্না পায়নি। হাতের চিঠিটার দিকে আবার তাকায় পরি। নানাজানকে এই আনন্দের সংবাদ জানাতে হবে। তার আগে কিছুক্ষণ কাঁদবে পরি। মেয়েদের চোখের পানির মূল্য অনেক। অযথা কেঁদে সে পানি ফুরিয়ে ফেলতে নেই। আজ আনন্দে কাঁদবে সে। বারান্দার রেলিংয়ে মাথা রাখে, হাতে ধরা মোবাইল ফোন। নানাজানকে ফোন করার আগে আজ অনেকক্ষণ কাঁদবে পরি বিষাদে নয় আনন্দে।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।