বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক সামাজিক আখ্যান


প্রকাশিত: ০৭:০০ এএম, ২৮ জুন ২০১৬

তিনখণ্ডে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক উপন্যাসের প্রথম খণ্ড ‘তালপাতার পুথি ১’ । ২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিবুল আলমের এই উপন্যাসটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী রচনা। মহিবুল আলম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বই পড়েছেন। তাছাড়া বাল্যকালে জাতির পিতাকে নিয়ে বিচিত্র বিভ্রান্তির জবাব খুঁজেছেন। বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক নানান বই পড়তে পড়তে লেখার ইচ্ছা জাগে। সেই ইচ্ছার পিছনে আরেকটা ইচ্ছা ছিল বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করে যথার্থ ইতিহাস জানানো। স্বপ্ন, ভালোবাসা আর মহান মানুষকে নিজের করে নেওয়ার আত্যন্তিক প্রয়াসই এই উপন্যাসের কাহিনি। কাহিনিতে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। উপরন্তু কাল্পনিক চরিত্রগুলো সেই সময়ের আবহ তৈরিতে কাজে লেগেছে। লেখকের কথা- ‘ঘটনা প্রবাহেও আমি কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি প্রচুর। এটি উপন্যাস। সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে উপন্যাস। এটা কোনো ইতিহাসের বই নয়।’ তাঁর মতে, তিনি একটি নিটোল সামাজিক উপন্যাস লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে সমাজ সত্য রূপায়িত। স্বামী, পিতা ও ভালোবাসার মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু অঙ্কিত হয়েছেন। পয়তাল্লিশ বছরের মধুর বিবাহিত জীবন এবং পঞ্চান্ন বছরের জীবনকাল গুরুত্ববহ। পঠনপাঠন থেকে উপকরণ ব্যবহার করেছেন তিনি।

সামাজিক উপন্যাস লিখছেন বলেই মহিবুল বঙ্গবন্ধুর প্রতি এবং পিতৃরূপকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কেবল রাজনীতিবিদ এবং শাসক হিসেবে তাঁর অনন্য নেতৃত্বকে তুলে ধরেননি। বন্ধু হিসেবে তিনি মহান এবং রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সহানুভূতিশীল, মমতায় শিখরস্পর্শী। মহিবুল মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু দুটি শ্রেষ্ঠ ঘটনা না দেখেও উপন্যাসটি লিখেছেন। প্রবাসে অবস্থান করে পঠন-পাঠনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তিনি সাফল্যের দিশা খুঁজে পেয়েছেন। চল্লিশ বছর আগের জীবিত বঙ্গবন্ধুকে তারও আগের ইতিহাসের পটভূমিতে রেখে লেখক কাল্পনিক চরিত্রগুলো তৈরি করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের একটি দিনের ঘটনাকে রূপ দিয়েছেন ৪১৫ পৃষ্ঠায়। নির্মম হত্যার আগের দিনটিতে জাতির পিতা নানা আলোকছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছেন। জীবনের অনেক অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন লেখক। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্রে রেখে মোশতাক, জিয়া, খালেদ মোশাররফ, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক প্রভৃতি চরিত্র আবির্ভূত হয়েছে। এছাড়া কাল্পনিক চরিত্রগুলো কাহিনির প্রয়োজনে সম্পৃক্ত হয়েছে বিচিত্র ঘটনা ধারায়। সাংবাদিক জাহিদ ও লোকমান যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তেমনি দরিদ্র বেগুনির জীবনও অঙ্কিত হয়েছে দরদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুকে বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে- তাঁর নিজের আচরণ এবং ষড়যন্ত্রকারী, সামরিকবাহিনী ও সাধারণ জনগণের দৃষ্টিতে। কাহিনির সকল আয়োজন হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে রেখায়িত করা, জীবন্ত করে তোলা। তার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের কথা, নেতা হয়ে ওঠা এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতা হিসেবে বাংলাদেশ সৃজন- জীবনের সবই এই আখ্যানে রূপলাভ করেছে। আখ্যানের ঘটনাসমূহ বর্তমানকে স্পর্শ করেছে, সমস্ত চরিত্রের জীবন্ত আচার-আচরণে। বেগম মুজিব, তাদের পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুত্বের নিটোল ও সরব উপস্থিতি রয়েছে। লেখক খুবই সতর্কতার সঙ্গে ১৪ আগস্টকে ঘটনার পর ঘটনাসজ্জায় বিচ্ছুরিত করেছেন। এমনকি ষড়যন্ত্রকারীদের পারিবারিক জীবনকে বাস্তব করে তুলেছেন। জিয়ার স্ত্রী, রশিদ, ফারুক প্রভৃতির জীবনের তরঙ্গ পাঠককে বিমোহিত করে।

মহিবুল এক স্পর্ধিত পরিকল্পনায় কাহিনি বিন্যস্ত করেছেন। তিনি দেখালেন বাঙালির দেশপ্রেমহীনতার স্বরূপ। দেখালেন ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে কতটা বর্বর এই জাতি। নিমকহারাম ঘনিষ্ঠজনরা। জাতির পিতা হত্যার জন্য তারা বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছে। জাতিকে অভিভাবক শূন্য করে নিজেদের কলঙ্কজালে আবদ্ধ করেছে। পিতৃহীন রাষ্ট্র আমাদের বিশ্বের কাছে ভাবমূর্তি নস্যাৎ করে। আমরা পুরো জাতি অন্ধকারে নিমজ্জিত হই। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। হাতে গোনা কিছু লোক হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। তবে জাতীয় মূল্যবোধকে লুণ্ঠন করে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। মহিবুল তাঁর উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন ওই কুলাঙ্গারদের প্রকৃত স্বরূপ। জাতির পিতাকে পরিবারের ভেতরে রেখে কথামালা উপহার দিয়েছেন লেখক। যেখানে তাঁর স্ত্রী এবং অন্যান্যরা এসেছে তার চারপাশে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি, অনুস্মৃতি, ফিরে দেখা জীবনের সামগ্রিক অনুষঙ্গ আছে কাহিনিতে। ফলে প্রজ্ঞাবান এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে নির্মাণ করা গেছে সহজে।

‘তালপাতার পুথি ১’ উপন্যাসে মহিবুল আলম বঙ্গবন্ধুর জীবনকেন্দ্রিক ঘটনাগুলো সাজিয়েছেন যথাক্রমে গ্রামীণ নিন্মবর্গ ও বীরাঙ্গনা বেগুনির জীবনবাস্তবতা অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাৎভূমিকে সামনে এনে প্রসারিত করেছেন তাঁর দৃষ্টিসীমা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের দিকে। এজন্য পর্যায়ক্রমে উপস্থাপিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্কের বিচিত্র বয়ান। যেহেতু লেখক সামাজিক উপন্যাস লিখতে বসেছেন সেহেতু তাঁর প্রেক্ষণবিন্দু কেন্দ্রীভূত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও বেগম মুজিবের গৃহকেন্দ্রিক দৃশ্যসমূহে এবং জাতির পিতার বিরুদ্ধে ইতিহাসের নির্মম ষড়যন্ত্রের নানা অনুষঙ্গে। বেগুনি, জাহিদ, লোকমান, দোলনচাঁপা কিংবা কিবরিয়া বয়াতি প্রভৃতি কাল্পনিক বা অনৈতিহাসিক কিন্তু সামাজিক মানুষের পরিধির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পারিবারিক-সাংসারিক ঘটনাসমূহ নির্মাণ এবং মোশতাক গংদের ষড়যন্ত্র সুশৃঙ্খলবিন্যাসে উপস্থাপিত।

পরিচ্ছেদ সংখ্যা নির্দেশ না থাকলেও বঙ্গবন্ধু ও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর ক্রিয়াকলাপ বিবৃত হয়েছে যথাক্রমে নিন্মোক্ত অংশসমূহে- বঙ্গবন্ধু : ২, ৪, ১৫, ১৭, ২১, ২৩, ৩২। ষড়যন্ত্রকারী- ৬, ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৮, ২০, ২২, ২৪, ২৬, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৪।  অন্যদিকে অনৈতিহাসিক চরিত্রসমূহের বিবরণ পাওয়া যায় নিন্মোক্ত পরিচ্ছেদসমূহে- বেগুনি : ১। কিবরিয়া : ৭, ৯, ২৫, ২৭। জাহিদ : ৩, ৫, ১১, ১৩, ১৬, ১৯, ৩৩, ৩৫। মোশতাক, মেজর ফারুক, রশিদ এবং জিয়া, তাহের ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী প্রভৃতি ষড়যন্ত্রকারীর মনোবৃত্তি, ক্ষমতালিপ্সা চিত্রিত করতে ১৫টি পরিচ্ছেদ ব্যয় করেছেন লেখক। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুকে মাত্র ৭টি পরিচ্ছেদে বেগম মুজিব ও পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে সম্পর্কের বহুমাত্রিকতায় রূপায়ণ করা হয়েছে। অবশ্য জাহিদ, লোকমান এবং নিন্মবর্গের বেগুনি-কিবরিয়া বয়াতি প্রভৃতির ঘটনা অনুষঙ্গে যে বিবরণ যুক্ত হয়েছে তা গুরুত্ববহ বঙ্গবন্ধুর জনমানুষ সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গে। সেখানে সর্বমোট ১৩টি পরিচ্ছেদ নিয়ে বিষয়গুলো উপস্থাপিত।  

নিন্মবর্গের মানুষের জীবন বাস্তবতা দিয়ে ‘তালপাতার পুথি ১’ উপন্যাসের পটভূমি উন্মোচিত হয়েছে। বেগুনি নামের বীরাঙ্গনা নারীর কষ্টকর জীবনযাপন সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের পিছনের কাহিনিতে পাঠককে নিয়ে গেছেন ঔপন্যাসিক। পঙ্গু মেয়ে মর্জিনাকে নিয়ে বেগুনির জীবনের পরিসরে স্বামী আকবর আলীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কের ঘটনাও জড়িত হয়েছে। স্বামী হারানোর পিছনে রাজাকার সর্দার কফিলউদ্দীনের ভূমিকা এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর বীরাঙ্গনা নারী বেগুনির জীবন সংগ্রামের সূচনা দিয়ে শেষ হয়েছে প্রথম পরিচ্ছেদ।

ক) বঙ্গবন্ধুর জীবন কেন্দ্রিক ঘটনাসমূহ :

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনে প্রবেশ করেছেন লেখক। এসময় জাতির পিতার পঞ্চান্ন বছর বয়স। তিনি দেশের প্রেসিডেন্ট কিন্তু জনগণের কাছে ‘মুজিবভাই’। স্ত্রী ফজিলাতুননেছার সঙ্গে চারযুগের সংসার চিত্রের একটি দৃশ্য অঙ্কিত হয়েছে এই অংশে। তাদের পারিবারিক ও সাংসারিক জীবনের স্বপ্ন-কল্পনা-সংগ্রাম এবং দেশ পরিচালনার কথা এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। বড় ছেলে শেখ মণির প্রসঙ্গও। পারিবারিক পরিমণ্ডলের সুন্দর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। রাসেলের সপ্রতিভ উপস্থিতি আবেগময়। বাকশাল গঠনের পর দেশের উন্নয়ন, কাছের মানুষের দূরে চলে যাওয়া, মোশতাক ষড়যন্ত্র সমস্যা এখানে উপস্থাপিত।

চতুর্থ পরিচ্ছেদে বত্রিশ নম্বরের বাসার চিত্র- ছেলের বউ সুলতানার প্রসঙ্গ, রোজী-জামাল প্রসঙ্গ এসেছে। বঙ্গবন্ধুর মনোজগতের উন্মোচন ঘটিয়েছেন লেখক। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের নির্ভরশীলতাও। বেগম মুজিব ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর পথচলা রেখায় সমন্তরাল বিকশিত হয়ে উঠেছেন। পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে পুনরায় গণভবনে বঙ্গবন্ধুর চিত্র অঙ্কিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার আগে তার চেতনায় সেখানকার ১৯৪৯ সালের ছাত্র জীবনের স্মৃতি ভেসে এসেছে। পিতার কথা মনে পড়েছে। পিতার দেখানো পথে এগিয়ে জনগণের জন্য রাজনীতি করেছেন শেখ মুজিব। বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্নের কথা ভেসে ওঠে। আন্তর্জাতিকভাবে দেশের অবস্থানও তাঁর চিন্তায় রেখাপাত করেছে।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদে বিমানবাহিনীর প্রধান একে খন্দকারের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করে মোশতাকের তোষামোদি চরিত্র তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর দেশগড়া ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উদ্ঘাটিত। গাঁয়ের ছেলে জাতির জনকের ছাত্ররাজনীতি থেকে শুরু করে সমস্ত প্রসঙ্গ এসেছে ক্রমান্বয়ে। টুকরো টুকরো অতীত স্মৃতিতে রাজনীতি- দেশ, জাতি, পারিবারিক পরিবেশ উদ্ভাসিত। বাকশাল গঠন এবং তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তান আমলের রাজনীতির অনেক প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন লেখক।

একুশ পরিচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক পরিচয়- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আলোকিত। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী বাল্যকাল থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত লেখার প্রসঙ্গ এসেছে। মাহবুব তালুকদার সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে ডিকটেশান নেন। আগে আবদুল গাফফার চৌধুরী ও আবদুল তোয়াব খান আসতেন। নিজের জীবনী রচনার এবং বেগম মুজিবের পরামর্শ সবই এখানে উল্লেখ্য; ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক রূপায়িত। মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হৃদ্যতাও প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু খুটিনাটি বিষয়ে সতর্ক থাকতেন। ভাল ও যোগ্য মানুষকে কাছে টানতেন তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন লেখক। তেইশ পরিচ্ছেদে বেগম মুজিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কের নানামাত্রা তুলে ধরা হয়েছে। স্মৃতিচারণ আছে পুত্র, পুত্রবধূ ও সন্তানদের নিয়ে। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন তার স্বরূপ উদ্ঘাটিত এখানে। বাল্যকালের চিন্তার প্রসঙ্গে গ্রাম- টুঙ্গিপাড়া, নদীর চিত্র পাখির ডাক সব মিলে মধুময় বর্ণনা রয়েছে। মধুমতি-বাইগার নদী, হিজল তমাল বনে পাখির কলতান- গ্রামীণ জীবনের আবেশ তৈরি করেছেন ঔপন্যাসিক।

বত্রিশ পরিচ্ছেদে নিন্মবর্গ বেগুনি, কিবরিয়া বয়াতি, আর শহুরে মধ্যবিত্ত জাহিদের পাশে যেমন ষড়যন্ত্রকারীদের কর্মকাণ্ড চলেছে তেমনি বঙ্গবন্ধুকে আবর্তন করে ঘটনা এগিয়েছে। তাঁর বাল্যস্মৃতি, গণভবনের পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হওয়া, মাহবুব, গাফফার চৌধুরী প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীদের পছন্দ করার বিষয় এসেছে। বঙ্গবন্ধু একসময় প্রবন্ধ লিখতেন ইত্তেফাকে। লিখেছিলেন- ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুই অর্থনীতি কেন?’ একসময় ‘নতুন দিন’ পত্রিকা বের করতেন। পত্রিকা বন্ধ হলে স্টেশনারি দোকান দেন ঢাকা নিউমার্কেটের সামনে। গাফফার চৌধুরীর প্রশংসা করলেও শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক নষ্ট হয় তার সাথে। গাফফার কষ্ট দেন বঙ্গবন্ধুকে। মনগড়া কথা বলে অপমানিত করেন শেখ মণি ও বঙ্গবন্ধুকে।  অথচ জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত বঙ্গবন্ধু। তিনি নিজেও ক্ষমা করতে জানতেন। তাহের ঠাকুরের সাক্ষাৎ বর্ণিত হয়েছে এখানে, তার চামচামিও। রাসেলের প্রসঙ্গ এসেছে। ছোট ছেলের সঙ্গে পিতার গভীর বন্ধনের ঘটনাগুলো তুলে ধরেছেন মহিবুল। তিনি ঠাকুরকে পরামর্শ দিয়েছেন বাকশালের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক তাহের ঠাকুরের মধ্য দিয়ে বিবৃত করেছেন লেখক।

খ) নিন্মবর্গ ও সাধারণ মধ্যবিত্ত : অনৈতিহাসিক চরিত্র চিত্রণ

তৃতীয় পরিচ্ছেদে জাহিদ চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে। কবি জাহিদ ও লোকমান চরিত্রের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমের পরিবেশ-পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন লেখক। বাকশাল কায়েম হলে একটি অধ্যাদেশ জারি করে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির পক্ষে উচ্চকণ্ঠ পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ হয়। জাহিদের ছাত্র জীবনের প্রসঙ্গে ছাত্র রাজনীতি এসেছে। পঞ্চম অংশে জাহিদের জীবন, বাংলাদেশের কবিতা ও কবি এবং দোলনচাঁপার সঙ্গে তার প্রেম ও সংকট রূপায়িত। সপ্তম পরিচ্ছেদে গ্রামীণ পটভূমিতে চলে গেছেন লেখক। কিবরিয়া বয়াতির জীবনের পরিচয় রয়েছে। রয়েছে রাজাকার রইসউদ্দীনের কথাও। রইস জাহিদের পিতা। কিন্তু ভূইয়াবাড়ি ও পিতার বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল জাহিদ। জাহিদের স্বপ্ন-কল্পনা ও স্বপ্নভঙ্গের প্রসঙ্গ আছে; আছে হিন্দুজনগোষ্ঠীর উন্মূলিত হওয়ার ঘটনা। কিবরিয়া বয়াতির সূত্রে গানের প্রসঙ্গে ‘তালপাতার পুথি’ শব্দের ব্যাখ্যা উপস্থাপিত হয়েছে। তালপাতা হচ্ছে দেহ। তালপাতার মতো দেহও একদিন শুকিয়ে যাবে। তালপাতা শুকালেও তাতে লেখা গান রয়ে যাবে মানুষের মনের ভেতর সারাজীবন। (পৃ ১১৫) ছয়জন সাগরেদ নিয়ে কিবরিয়া বয়াতি সংসার বিবাগী। নবম পরিচ্ছেদে কিবরিয়া বয়াতির জীবনচিত্র ও গ্রামীণ পটভূমি আলোকিত হয়েছে। নিন্মবর্গের জবানিতে বঙ্গবন্ধু উন্মোচিত এখানে। সুলতান মিয়া, মন্টু মিয়া কিংবা যোগেশ পোদ্দারের অভিব্যক্তি রয়েছে। বয়াতির জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ভেসে আসে। সেসঙ্গে আসে জাহিদের যুদ্ধজীবন। ডাকাতদলের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার ঘটনাও সম্পৃক্ত এই অংশে। ডাকাতদের দেশপ্রেম চিত্রিত হয়েছে ১৯৭১-এর পটভূমিতে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডাকাতদের প্রকৃত জীবিকা সৃষ্টি না হওয়ায় পুনরায় আগের পেশা অর্থাৎ চুরি ও ছিনতাইয়ে নিযুক্ত হয় তারা। কিবরিয়া বয়াতির যোগ তৈরি হয় জাহিদের সঙ্গে; উপন্যাসে বেগুনির প্রাসঙ্গিক দৃশ্য পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়। একাদশ পরিচ্ছেদে জাহিদের কাহিনিতে নূরজাহান বেগমের চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। দোলনচাঁপা-জাহিদের সুসম্পর্কের ভেতর নূরজাহানের কর্তৃত্ববাদি আচরণ পীড়াদায়ক। ভবেশের মেয়ে দোলনচাঁপা একইগ্রামের পাশের বাড়ির। যুদ্ধের সময় তাদের পারিবারিক বিপর্যয় জাহিদকে কষ্ট দেয়। তার নিরাপত্তার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসে সে। এই পরিচ্ছেদে ১৪ আগস্টের ঘটনাসমূহের কিছু অনুষঙ্গ এসেছে। বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন তাও উল্লেখিত হয়েছে। জাহিদের পিতা-মাতা-সৎ মাতার প্রসঙ্গ এসেছে।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদে জাহিদের পরিবেশ-পরিস্থিতি নূরজাহানের স্বামী ও জাহিদের দুলাভাই জুবায়ের চৌধুরীর সূত্রে দেশের প্রশাসনে নানান অসন্তোষ, আর্মিসহ নানা দেশবিরোধী চক্রান্ত উঠে এসেছে; পত্রিকা বন্ধের প্রসঙ্গও। ষোড়শ পরিচ্ছেদেও রয়েছে জাহিদের প্রসঙ্গ। তার ছাত্রজীবনের কথা- ১৯৬২-এর ছাত্র রাজনীতি এসেছে, নিউক্লিয়াসের কথা- আছে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের কথাও। ১৯৬৫ সালে গঠিত যুবলীগের প্রসঙ্গ আছে। ১৯৭০ সালে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান বঙ্গবন্ধুর বিশাল জনসভায় ভাষণের পর উচ্চারিত হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন ১৯৭১-এর মার্চের অসহযোগের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনায় বিন্যস্ত। জাহিদের মনোলোকে উদ্ভাসিত ইতিহাস বাঙালির চেতনার মহিমাময় সংগ্রামের দলিল। উনিশ পরিচ্ছেদে লোকমান ও জাহিদ চরিত্রের কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেয়েছে। দুজনই বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র। তারা বেগম মুজিবের প্রশংসা করেছে। বঙ্গবন্ধুর সমুন্নতি সম্পর্কে বেগম মুজিবের সতর্কতা ও উপলব্ধি তুলে ধরা হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি ও পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতি করার সময় সংসার আগলে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় বেগম মুজিবের অনন্য অবদান স্মরণ করেছে তারা দুজনে। শেখ মুজিব ৬ দফা আন্দোলন দিলে তা বন্ধ করতে প্রলোভন দেখায় আইয়ুব খান কিন্তু নির্লোভী বঙ্গবন্ধু তা মানতে পারেননি। বেগম মুজিব মাথা বিক্রি করতে দেননি।(পৃ ২৬৮)

পঁচিশ পরিচ্ছেদে বেগুনির জীবন পুনরায় কাহিনির ভেতর উপস্থাপিত। তার ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে তবারক মিয়া যুক্ত হয়েছে। সাতাশ পরিচ্ছেদেও বেগুনির কাহিনি উন্মোচিত। তবারক ও মর্জিনা সব মিলে একটি নিন্মবর্গের জীবনের প্রসঙ্গ।  তেত্রিশ পরিচ্ছেদে জাহিদের গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাওয়ার ঘটনা আছে। জাতির পিতার ভক্ত বলেই লোকমান অন্যসব মেনে নেয়। প্রেসিডেন্ট হয়েও সকলের বন্ধু জাতির পিতা। ব্যক্তিগত চরিত্র, রাষ্ট্রীয় পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় তিনি মহান হয়ে উঠেছেন অন্যের দৃষ্টিতেও। ১৯৫৩-৫৪ সালে মাদারীপুরে বঙ্গবন্ধু যে লোকমানকে দেখেছিলেন  পরবর্তীতে তাকেই তিনি দৈনিক আজাদের সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় দেখতে পান। পঁয়ত্রিশ পরিচ্ছেদে গণভবনে জাহিদদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ বর্ণিত হয়েছে। মাহবুব তালুকদারের প্রসঙ্গ ও ষাট দশকের সাহিত্য বিশেষত কবিতার বিষয় উঠে এসেছে। হুমায়ুন কবিরের প্রসঙ্গও। গণভবনে এসে জানা যায় জেলায় জেলায় গভর্নর নিয়োগ, প্রশাসনের ব্যাপক পরিবর্তন ও কার্যকর করার ইতিবৃত্ত। তারা এসে তাহের ঠাকুরকে বের হয়ে যেতে দেখে। এখানে বঙ্গবন্ধুর  মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়ার মহৎ গুণ বর্ণিত হয়েছে। তাঁর আছে একটা ভালোবাসার হৃদয়।(পৃ ৪১৪) বঙ্গবন্ধু জাহিদকে চিনতে পারেন। সে ছাত্রনেতা ছিল একসময়ে।

গ) ষড়যন্ত্রকারীদের প্রসঙ্গ :   
ষষ্ঠ অংশে মেজর ফারুকের ড্রইংরুমে প্রবেশ করেছেন লেখক। অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ, জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্র, গুপ্তচর, কূটনৈতিক ছায়াসঙ্গীদের নীলনকশা অনুযায়ী সে এগুচ্ছে। পিতা-মাতা নিষ্ঠাবান সরকারি কর্মকর্তা হলেও ফারুক সে রকম নয়। সামরিক অভ্যুত্থান যেখানে সেনাপ্রধানের দিক থেকে বা জেনারেল-মেজর জেনারেল বা বিগ্রেডিয়ারের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার কথা সেখানে ফারুকের আস্ফালনে তার পিতা ডা. রহমানও আশ্চর্য হন। ফারুকের মনস্তত্ত্ব উন্মোচন করেছেন ঔপন্যাসিক। বড় কাজে তার দোলাচলের বিষয়টিও রূপ লাভ করেছে। পাকিস্তান-ইরান-সৌদি আরব-লিবিয়া-তানজেনিয়া-সুদান-নাইজেরিয়ার সহায়তা সত্ত্বেও অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে পারে। ফারুক মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে মাত্র চারদিনের জন্য। প্রকৃত যুদ্ধ সে করেনি। সে বদমেজাজি, অহংকারী, একগুঁয়ে। এ অংশে মেজর রশিদের পরিচয় আছে। চট্টগ্রামের আন্ধাহুজরের প্রসঙ্গও এসেছে। সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে ফারুকের স্পৃহা বৃদ্ধির কথা আছে। এই পরিচ্ছেদে ঘটনা এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে মনে হয় অভ্যুত্থান সন্নিকটে। কিন্তু লেখক টানটান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃজন করে কাহিনি এগিয়ে নিয়েছেন। সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি উন্মোচন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা বিভাজন থেকে শুরু করে সামগ্রিক চিত্র আছে এখানে। সেনাপ্রধান হিসেবে জিয়াকে বিবেচনায় না আনা এবং শফিউল্লাহর ভূমিকাও ভবিষ্য-প্রসারী। অষ্টম পরিচ্ছেদে মেজর ফারুকের মনোজগৎ উন্মোচিত হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি, সরকার পরিবর্তন, রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবের উচ্ছেদ, মুজিবকে হত্যা- এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় ফারুকের মধ্যে। সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ উন্মোচিত হয়েছে এখানেও। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের প্রতি স্নেহ থাকলেও চারদিনের মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের সিনিয়রিটি নেই। তার মামা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। কারো কারো বিরোধিতা ছিল তার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি নিয়ে। মামার জোরে ওই উপাধি পায় সে। এখানে রক্ষীবাহিনীর পরিচয় দিয়েছেন লেখক।

দশম পরিচ্ছেদে সেনাবাহিনীর জয়দেবপুরের অ্যাম্বুশ ডেমনস্ট্রেশন পরিদর্শনে জিয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। ৩৯ বছরের জিয়া অবসরে যেতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর ওপর আস্থা ছিল তার। তার দৃষ্টিতে জাতির পিতা কিছু লোক দ্বারা বৃত্তবন্দি। মোশতাক এজন্য সামনে এসেছে। পিছনে পড়েছেন তাজউদ্দীন আহমেদ। সেনা-উপপ্রধান হয়ে খুশি হলেও বাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপের দ্বন্দ্বময় চিত্র এসেছে এই পরিচ্ছেদে। বঙ্গবন্ধুকে খালেদ মোশররফ ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতা কানপড়া দিয়ে জিয়াকে শত্রু বানিয়েছে এটাই তার উপলব্ধি। সেনাবাহিনীর চিত্র পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। জনপ্রিয়, অজনপ্রিয় অফিসার এবং গ্রেড স্কেল প্রভৃতি বিষয়ে পরিশ্রমী আলোকপাত রয়েছে। জিয়াকে উন্মোচন করে মেজর নূর তাকে খুঁজতে এসেছিলেন সে খবরও দিয়েছেন লেখক।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদে তাহের উদ্দীন ঠাকুরের ঘোরের ঘটনা এবং মোশতাকের প্রসঙ্গে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি প্রসঙ্গ সম্পৃক্ত হয়েছে। মোশতাক ছাত্র জীবন থেকে মুজিবকে চেনেন। তাহের ঠাকুরও বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় ছাত্ররাজনীতি করেছে। ১৯৭৪ সালে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে চলে যায়। এসব খবর তারা রাখে। ষড়যন্ত্রকারীদের পূর্ণ চিত্র ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছে, অন্তর্দ্বন্দ্বও। তাহের ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী প্রভৃতি চরিত্র এসেছে। চতুর্দশ পরিচ্ছেদে তাহের ঠাকুরের সূত্রে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা অঙ্কিত হয়েছে। দ্বন্দ্বও দেখানো হয়েছে। জুলিয়াস সিজারের প্রিয় সেনা ব্রুটাস কর্তৃক বিশ্বাসঘাতকতাকে স্মরণ করেছে তাহের ঠাকুর। মোশতাক ১৯৭৩ থেকে সরাসরি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। জিয়াসহ তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ জিয়া নিষ্ক্রিয় ছিল। ষড়যন্ত্রের নানা বৈঠক একের পর এক অনুষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার ঢাকা নগরীতে চাষী, ঠাকুর একত্রিত হয় যেখানে।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদে মোশতাকের সঙ্গে বাঙালি কিন্তু মনেপ্রাণে পাকিস্তানি ষাট বছর বয়সের জুবায়ের চৌধুরী এবং আরো অনেকের সম্পর্কসূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। জাহিদের এই দুলাভাই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত। মোশতাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় সে। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসভাজন হয়ে শেষে ঝোপ বুঝে কোপ দেন মোশতাক। বঙ্গবন্ধুও তোষামোদকারীদের পছন্দ করতেন সেই দুর্বলতাও চিহ্নিত করেছেন লেখক। জুবায়ের-মোশতাক-তাহের ঠাকুর এভাবে চক্রান্তকারীদের পরিসর বাড়তে থাকে কাহিনির অগ্রসরণে। বিংশ পরিচ্ছেদে আটজন মিলে মোশতাক দশপাড়া গ্রামে ষড়যন্ত্রে মিলিত হয়। সে শেখ ফজলুল হক মণিকে দাবার গুটির মতো ব্যবহার করেছে। যদিও মণি নিজের জানের চেয়েও নিজের মামা মুজিবুরকে ভালোবাসতেন। এদের প্রসঙ্গ তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে জেলা পরিষদ ও গভর্নর নিয়োগ নিয়ে কথা বলেছেন লেখক। এইভাবে একদিকে ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা অন্যদিকে বাংলাদেশের নানা প্রসঙ্গ মুজিব প্রশাসনের নানাদিক উন্মোচিত হয়েছে। মাহবুবুল আলম চাষী ও মোশতাকের নির্মম কৌতুক ও ষড়যন্ত্র আমাদের মনে শঙ্কা তৈরি করে এগিয়েছে কাহিনি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৪ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের সহযোগিতা সব এসেছে এ পরিচ্ছেদে; আর বঙ্গবন্ধুর কথা মোশতাক প্রসঙ্গে উচ্চারিত। তাহের ঠাকুর অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা করেছে। স্পষ্ট হয়েছে মেজর আবদুর রশিদ, ফারুক, সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে চায়। মোশতাক আশ্বস্ত করেন অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে না বলে। দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদে ষড়যন্ত্রকারীদের ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা উন্মোচিত। মেজর রশিদ ও সেনাবাহিনীর রাতের ট্রেনিং-এর ইতিহাসসম্মত প্রসঙ্গ এসেছে। চব্বিশ পরিচ্ছেদে মেজর রশিদের স্ত্রী জোবাইদা এবং মেজর ফারুক ও স্ত্রী ফরিদার প্রসঙ্গ এসেছে রশিদের নানা ঘটনার সূত্রে। সেনাবাহিনীর মধ্যে ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন লেখক। নাইট প্যারেডের অনুমতি নিয়ে এবং সেদিনকার প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরেছেন লেখক।

ছাব্বিশ পরিচ্ছেদে মোশতাকের সঙ্গে আমেরিকা দূতাবাসের সম্পর্কের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত। অন্যদিকে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। মোশতাকের পরিচয় আরো স্পষ্ট হয়েছে। সংকীর্ণ মানসিকতা, স্বার্থপরতা এবং তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে প্রথম ষড়যন্ত্র সবই উদ্ভাসিত। মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথাও আছে। অর্থাৎ মোশতাকের ষড়যন্ত্র হঠাৎ করে শুরু হয়নি। তার অতীত আছে, আছে বর্তমানও। সবই উন্মোচিত হয়েছে এই পরিচ্ছেদে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ও। আটাশ পরিচ্ছেদে মেজর রশীদের প্রসঙ্গ এসেছে, ফারুকসহ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সে। এজন্য প্রাত্যহিক জীবনে, ব্যবহারে, মনোলোকে আলো ফেলেছেন লেখক। নাইট প্যারেডের প্রসঙ্গ এবং রক্ষীবাহিনীর অবস্থা নিয়েও আলোচনা করেছে তারা। একইসঙ্গে এসেছে ডেপুটি আর্মি চিফ জেনারেল জিয়ার প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর সমর্থক ও ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকেও তারা ষড়যন্ত্রে এগিয়ে গেছে। এসেছে ডালিমও। ঊনত্রিশ পরিচ্ছেদেও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত বর্ণনায় উঠে এসেছে। মোশতাক-চাষীর সম্মিলিত প্রয়াসে ঘটনা এগিয়েছে। ত্রিশ পরিচ্ছেদে মেজর ফারুক, রশীদের কথায় ফিরেছেন লেখক। মেজর রশীদের মনোজগৎ ফুটে উঠেছে। ফারুকের নীলনকশার সঙ্গে সে জড়িত হয় মার্চ মাসে। অথচ রশিদের কোনো ক্ষোভ নেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি। ডালিমের সম্পৃক্ততা পরিষ্কার হয়েছে এখানে।

একত্রিশ পরিচ্ছেদে মোশতাকের আগামাসি লেনের ষড়যন্ত্রের বাড়িটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। তাহের ঠাকুর তাঁর সৃষ্টি। পাকিস্তান, ইরান ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত যুক্ত হয় তাঁর বাসায় এসে। মোশতাক ষড়যন্ত্রের ফল পাবার আগেই প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তার মনস্তত্ব উন্মোচিত হয়েছে এখানে।   (পৃ ৩৬৬) এসেছে তাজউদ্দীনের প্রসঙ্গ- মুজিবকে নিঃসঙ্গ করার ষড়যন্ত্র। তাজউদ্দীন সড়ে যাবার পর মোশতাক ১৯৭৩ সালের শুরুতেই ক্ষমতা আরোহণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় থেকে পুরোদমে ষড়যন্ত্র করে শক্তিশালী চক্র গড়ে তোলেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ কাজ শুরু হয়। পাঁচ মাসে সফলতা আসে। মেজর রশিদ এই পাঁচ মাসে সেনাবাহিনীর মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়ে, মিথ্যাচার করে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করেছে। ঠাণ্ডা মাথায় মেজর রশিদ সফল হয় তার গুটির চালে। জিয়া নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে চলেন। আগামাসি লেনের বাসার ছাদে মুজিব বিরোধী মিটিং করে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বোস্টার। কুমিল্লার বার্ড, গাজিপুর শালনা হাইস্কুল, দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ, দশপাড়া গ্রামের বাড়িতে রশিদ, ফারুক, অন্যান্য সেনা অফিসার মিলিত হয়ে ভবিষ্যতের ১৫ আগস্ট সম্পন্ন করে।

চৌত্রিশ পরিচ্ছেদে জিয়ার কাহিনি এসেছে। পারিবারিক জীবনের চিত্র- স্ত্রী পুতুল, ছেলে পিলো ও কোকোর প্রসঙ্গ আছে। একইসঙ্গে আর্মি পলিটিক্স উঠে এসেছে। সেনাপ্রধান না হতে পারার কষ্ট বর্ণিত হয়েছে। আবার জিয়ার অনুপ্রেরণা যে বঙ্গবন্ধু তাও ব্যক্ত করেছেন লেখক। তবে এখানে কর্নেল তাহেরের প্রসঙ্গ এসেছে। বিপ্লবী সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং জিয়ার পক্ষে থাকা প্রভৃতি ইতিহাস বর্ণিত। অবসরের পর জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের পরিকল্পনাও এসেছে।

প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি ঘটে বঙ্গবন্ধুর হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে যাওয়া দিয়ে। স্বাধীনতার পর বিভেদ, ষড়যন্ত্র, মারামারি, খুনাখুনি, কাটাকাটি কার্যকলাপের জন্য তিনি বিমর্ষ। যুবসমাজের প্রতি তার আন্তরিক ভালোবাসাও প্রকাশ পেয়েছে কথোপকথনে।  
মহিবুল ঐতিহাসিক ঘটনাধারা অবলম্বনে সামাজিক উপন্যাস নির্মাণের প্রয়াস শুরু করেছেন দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ থেকে। বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন নেছাকে নিয়ে যে বর্ণনা ও কথোপকথন সাজিয়েছেন তা কল্পনার বিস্ময়কর দ্যুতিতে অনন্য। একটি অংশ : ‘বঙ্গবন্ধু আবার চোখ খুললেন। দেখলেন, তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা তাঁর দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু হাসলেন। গোঁফ জোড়া চমৎকারভাবে বেঁকে উঠল। চোখের ভ্রূ দুটোও। বেগম ফজিলাতুন নেছাও মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী বুড়ার ঘুম ভাঙল?’(২৩-২৪)

রাজনৈতিক বন্ধুরা কেউ তাঁকে প্রেসিডেন্ট ডাকে না। স্ত্রী ছোটবেলায় তাকে ‘দুলা’ ডাকতেন যখন সকলে ডাকত ‘খোকা’। তারপর ‘হাসুর বাপ’, ‘পুতুলের নানা’ আর পঞ্চান্ন বছর বয়সে ডাকছেন বুড়া। প্রায় চারযুগের বিবাহিত জীবনে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে বেগম মুজিবকে তিনি ডেকেছেন, রেণু বলে। একটি দৃশ্য- ‘এইভাবে হাসবো না- তো কী? তুমি তো বাংলাদেশের ফার্স্টলেডিই। অথচ দেখো, তোমার কী ছিরি। হা-হা-হা।. . .

- আমার কী এমন ছিরি খারাপ?

-বাংলাদেশের ফার্স্টলেডির দুই ঠোঁট বেয়ে পানের কষ পড়ছে।.. . (পৃ. ৩১-৩২)

কেবল স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের বয়ানে নয় রাষ্ট্রনায়কের মনোবেদনা তুলে ধরা হয়েছে অনেক জায়গায়। যার ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কান্নার স্বর স্পষ্ট হয়েছে। আজীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফল শূন্য। রাজনৈতিক বন্ধু, সেনাবাহিনীর নিকটজনরা দূরে চলে গেছে। গভীর শূন্যতার ভেতর পড়ে আছেন একা বঙ্গবন্ধু। মহিবুল এঁকেছেন সেই দৃশ্যও।  

মহিবুল মেজর ফারুকের পিতা ডা. রহমানের যে পরিচয় তুলে ধরেছেন তাতে রয়েছে তার বিস্তৃত পঠনের সক্ষমতা। কারণ এ পর্যন্ত কোনো ঔপন্যাসিক তার পিতাকে নিয়ে এভাবে লেখেননি। তাছাড়া অবসর জীবনে তিনি ফার্মগেটে একটি চেম্বারে গরিব-দুস্থদের সেবার জন্য ডাক্তারী করেন।(পৃ ৮২-৮৩) এমনকি ফারুক ও ফরিদার দাম্পত্য জীবনের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তাতেও জীবন্ত কথোপকথন রয়েছে। মেজর রশিদের এই শালিকা জোবাইদা টিংকুর ছোটবোন। চট্টগ্রামে অবস্থানরত ফরিদার সঙ্গে ফারুকের কথোপকথনে লেখকের কল্পনার পেখম উদ্দাম হয়ে উঠেছে। (পৃ ১১৮-১২৪) জিয়ার বিষয়ে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর কিছু করতে না পারার প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন এরকম তথ্য দিয়েছেন লেখক।(পৃ ১৫৪-১৫৫) এই বিষয়টি পুনরুক্তি হয়েছে ৪০০ পৃষ্ঠায় যেখানে জিয়ার প্রসঙ্গ আছে। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ইতিহাস সম্মতভাবে উপস্থিত।

মহিবুল চরিত্রের দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন। যেমন তাহের ঠাকুরের ভেতর। সে একদিকে বঙ্গবন্ধুর মুখ অন্যদিকে চক্রান্তকারী হিসেবে নিজের মুখ দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।(পৃ ১৭৪) অশ্রুসজল বঙ্গবন্ধুর চিত্র রয়েছে উপন্যাসে- ‘বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতের চোখ নিয়ে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন বুনছেন, একটি স্বর্গসুখে সুখী জাতি, একটি ভালোবাসার লীলাভূমি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু গুনগুন করে গেয়ে উঠলেন, ‘... তোমার বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন, ওমা আমি নয়নজলে ভাসি, আমার সোনার বাংলা। আমি তোমায় ভালোবাসি...’ গানটা গুনগুন করে গাইতে গাইতে বঙ্গবন্ধুর চোখ কখন যে ভিজে এল!... (পৃ ২০৪) এভাবে বঙ্গবন্ধুর আপন মুহূর্তগুলো সুন্দর করে তুলে ধরেছেন মহিবুল। জাতির পিতা নিজে নিজে একাকী মুহূর্তে কবিতা বাঁধেন। এলোমেলো কবিতা। যেমন-

আমার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে.. .
বাংলার ভদ্রলোকেরা চুরি করে-
আর গোপনে বোঁচকা বাঁধে।’.. .(পৃ ৩০৫)
কাহিনি বয়ানে লেখক বিভিন্ন জনের মুখে ফ্ল্যাশব্যাকে ঘটনা নিয়ে এসেছেন। আবার বর্তমান থেকে অতীতে পরিভ্রমণ করেছেন নির্বিকারচিত্তে। পারম্পর্য রক্ষা করে। প্রথম খণ্ডের শেষাংশে বঙ্গবন্ধু বিমর্ষ হয়ে গেছেন। এই দৃশ্য অঙ্কন করেছেন ঔপন্যাসিক।(পৃ ৪১৬) একইভাবে আনিসুল হক সন্তানহারা মুজিবকে অঙ্কন করেছেন মর্মস্পর্শী বর্ণনায় :
‘গোপালগঞ্জ থেকে অতিথিদের বিদায় দিয়ে মুজিব রওনা দিলেন টুঙ্গিপাড়ার পথে। খবর পেয়েছিলেন, রেনুর শরীরটা ভালো নয়। কিন্তু ছেলে যে মারা গেছে, জানতেন না।

সেটা শুনলেন সমীর মাঝির কাছে। নৌকায় চড়ে বসার পরই সমীর মুখ খুলল, ‘মিয়া ভাই, এত দিনে আইলেন। ছাওয়ালটার মুখটাও তো দেখতে পারলেন না। ভগবান ভগবান।’
সমীর মাঝির মুখের দিকে তাকাতে সাহস পেলেন না মুজিব। তিনি শীতার্ত নদীটির দিকে তাকালেন। তখন সন্ধ্যা। আকাশ লাল হয়ে আছে। লালচে ঢেউগুলো তিরতির করে কাঁপছে।
আকাশে একঝাঁক পাখি। ঘরে ফিরছে।
একটা মাছ লাফিয়ে উঠল বইঠার আঘাত পেয়ে।
তাঁর চোখে জল এসে যাচ্ছে। তিনি চশমাটা খুলে কাচ মুছলেন পকেট থেকে রুমাল বের করে। চশমার কাঁচের দোষ নাই, আসলে তাঁর চোখই ঝাপসা।’ (যারা ভোর এনেছিল, আনিসুল হক, প্রথমা, ২০১২, পরিচ্ছেদ : ৮, পৃ ৫৩-৫৪)

বঙ্গবন্ধুর চোখের জল বাস্তবিক ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরই বিশ্ববাসী দেখেছিল। সেলিনা হোসেন ‘আগস্টের একরাত’(২০১৩) উপন্যাসে প্রথম থেকেই বেগম মুজিবের কান্নার দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। কিন্তু কোথাও বঙ্গবন্ধু কাঁদছেন এরকম বর্ণনা নেই।  
মহিবুলের গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সেনাবাহিনীর ভেতর-বাইরের অসন্তোষের বিস্তারিত বিবরণ আছে।(পৃ ১২৬-২৯) বিশেষত মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের কখপোকথনে আছে সেনাবাহিনীর ভেতরের নানা প্রসঙ্গ। তবে দু’জনেরই মনোজগতে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আতঙ্কিত হওয়ার ভাবনাও দেখা যায়। ধরা পড়লে নিজেদের করুণ পরিণতি নিয়েও তারা ভেবেছে। তবু রাষ্ট্রপতিকে উৎখাতের পরিকল্পনা ছিল প্রায় প্রকাশ্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার দালিলিক নানা প্রমাণ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ফারুক-রশিদ-ডালিম-মোশতাক প্রভৃতি মুষ্টিমেয় গংদের ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

মহিবুলের ‘তালপাতার পুথি-১’ উপন্যাসে ঐতিহাসিক চরিত্র নির্মাণে ইতিহাস ও কল্পনা সমন্বয় ঘটলেও ইতিহাসের অনুপুঙ্খ অনুসৃতি কয়েকটি জায়গায় অনুপস্থিত। হয়ত এসব প্রসঙ্গ তাঁর দ্বিতীয় খণ্ডে থাকবে। যেমন, ১৯৭৫ সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বাহিনীর ইন-চার্জ হিসেবে বত্রিশ নম্বর বাসভবনে মেজর ফারুক নিয়মিতভাবে আসা-যাওয়া করত। আত্মস্বীকৃত খুনি বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে কথা স্বীকার করেছে। এছাড়া ক্যাপ্টেন হুদা, ডালিম এবং নূরও ধানমন্ডির বাসাতে যাতায়াত করত। ক্যাপ্টেন হুদা মাঝেমধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ডিউটি ফোর্স দেখাশোনার জন্য যেত। মেজর নূর শেখ কামালের বন্ধু হিসেবে সেই বাড়িতে উপস্থিত হতো। মেজর ডালিম অনেকবার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে। মহিবুলের গ্রন্থে এই দিকটি একেবারে অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর পরিচিত, তাঁর গৃহে যাতায়াতকারীরা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। বিষয়টি চরিত্র নির্মাণে দ্বান্দ্বিক একটা পটভূমি তৈরি করতে পারত। বিশেষত যেখানে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ফারুক-রশিদ গং মাঝেমধ্যেই ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আসামি ও সাক্ষ্যদাতাদের জবানবন্দি এক্ষেত্রে চরিত্রের মনস্তত্ব তৈরিতে সহায়তা করত। মহিবুল জবানবন্দি নথির ব্যবহার সে অর্থে করেননি। তাঁর উপন্যাসে হত্যাকারীদের সঙ্গে বত্রিশ নম্বর বাড়িটির সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার এবং টু ফিল্ড আর্টিলারি। মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ টু ফিল্ড আর্টিলারি কমান্ডিং অফিসার ছিল, সেটি ছিল ৪৬ ব্রিগেডের অধীন। ল্যান্সার ইউনিটির কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মোমিন ছুটিতে থাকায় ১৫ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত সিআইসি মেজর ফারুক ছিল। যৌথ নাইট প্যারেড ও কিলিং অপারেশনে যাওয়ার বিষয়ে ব্রিগেড কমান্ডাররা কোনো ব্যবস্থা নেননি অথবা তাঁরা ছিলেন উদাসীন। অবশ্য মহিবুল সামরিক ষড়যন্ত্রের বেশ কিছু বিষয় হুবহু অনুসরণ করেছেন। যেমন, ১৪ আগস্ট ব্রিগেডিয়ার এ কে এম শাহজাহানের ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের টু-আইসি হিসেবে জয়দেবপুরে ছিলেন। ১৪ আগস্ট তাদের রেজিমেন্টের অ্যামবুশ ডেমোনেস্ট্রেশন ছিল। ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সাফায়েত জামিল, ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টার দিকে অ্যামবুশ ডেমোনেস্ট্রেশন শেষ হয়। ডেমোনেস্ট্রেশন শেষ হওয়ার পর টু ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ শাহজাহানের কাছে এসে তার ট্রুপস নিয়ে রাতে নিউ এয়ারপোর্টে যেতে বলে। শাহজাহান সাফায়েত জামিল ও খালেদ মোশররফকে বিষয়টি জানালে তাঁরা যেতে নিষেধ করেন। রশিদ এরপরও চেষ্টা করলে শাহজাহান সাফায়েত জামিলকে জানিয়ে দেন শেষ অনুরোধটিও। ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা ঔপন্যাসিক ২৯৫-৯৯ এবং ৩১৪-১৮ পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করেছেন। রশিদ ও তার স্ত্রী জোবায়দার একটি খণ্ড চিত্র আছে যেখানে ফারুকের পিতাকে ‘শালা’ এবং নিজ স্ত্রীকে ‘ইডিয়েট’ বলেছে সে।(পৃষ্ঠা ৩০০) এভাবে ইতিহাসের ভেতর পারিবারিক ও সাংসারিক জীবন চিত্রণে মহিবুল তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

ডিজিএফআই প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফ ১৫ আগস্ট ঘটনার কিছুদিন আগে মেজর ডালিম এবং মেজর নূরসহ কিছু অফিসারের সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৪  আগস্ট রাত থেকে ফারুক-রশিদের এতো তৎপরতা, অস্ত্র গোলাবারুদ এবং ট্যাংকসহ দুটি ইউনিটের রাষ্ট্রপতির বাসভবনের দিকে যাওয়া, ঘণ্টাখানেক সময় ধরে রাষ্ট্রপতির বাসভবন ঘিরে অবস্থান নেয়া- এসবের কিছুই তারা জানতে পারেননি। মহিবুল এই প্রসঙ্গে না গিয়ে ফারুক-রশিদের নানা তৎপরতা বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসে জিয়া অন্যতম ঐতিহাসিক চরিত্র। তাঁর মনোবেদনা ও অবস্থান দেখানো হয়েছে খুবই স্বল্প পরিসরে। লেখকের দ্বিতীয় পর্বে হয়ত আমরা বিস্তৃত বিবরণ পাব। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর সেনাপ্রধান হয়ে তিনি খুনিদের যেমন খুশি কার্যক্রম চালানোর সব ব্যবস্থা করেছিলেন, তেমনি তাদেরকে পরবর্তী সময় পুনর্বাসিত করেন এবং জাতির পিতা হত্যার বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও অনুমোদন করেন।

জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর অনুগত করেই অঙ্কন করেছেন মহিবুল। তবে সেসময় সামরিক বাহিনীতে নানা অপপ্রচার ও অসন্তোষ দানা বেধে উঠেছিল। সেনাবাহিনী প্রধান শফিউল্লাহর অভিযোগের ভিত্তিতে কর্নেল তাহের অবসর নিলে বাহিনীতে প্রতিক্রিয়া হয়। তাহের মনে করতেন জিয়ারই আর্মি চিফ হওয়া উচিত। রক্ষীবাহিনী গঠন ও রক্ষীবাহিনীকে কার্যকর করার জন্য গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হলে সামরিক বাহিনীতে অপপ্রচার এবং অসন্তোষ দেখা দেয়। ১৯৭৪ সালের ‘লেডিস ক্লাবে’র ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর ডালিম, মেজর নূর প্রভৃতির চাকরি চলে গেলে জিয়া মাঝে মাঝে পরিবারসহ মেজর ফারুকের বাসায় চলে যেতেন। দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন। দেশ বাঁচানোর জন্য কিছু একটা করতে বলতেন। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে পরিস্থিতি ভিন্নরকম হয়। রশিদের বাসায় বসে দেশে কোনো পরিবর্তন করার আলোচনার সময় জোবায়দা ও রশিদ উপস্থিত থাকত। জিয়া ফারুকদের কিছু করতে পারলে করার পরামর্শ দিতেন। ১৯৭৫-এর পর মোশতাকের দুই বিশেষ সহকারীদের নাম হলো- ফারুক ও রশিদ। ১৩ আগস্ট বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধুর তলবে গণভবনে যান তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। অন্যদিকে রশিদ মোশতাক শেষ বৈঠক হয় ১৪ আগস্ট।

প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সামাজিক উপন্যাস রচনা করেছেন মহিবুল আলম। ঐতিহাসিক উপন্যাসে ইতিহাসের ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অন্যদিকে সামাজিক উপন্যাসে সামাজিক ঘটনা, সমস্যা, সমাজের প্যাটার্নের ও মানসিক বৃত্তের ভাঙচুর বেশি তাৎপর্য পায়। উপন্যাসের সঙ্গে সমাজগতির সম্পর্ক নিবিড়। মহিবুল এসব মাথায় রেখেই সমাজের প্রতিষ্ঠাভিত্তিকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থেকেছেন। সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধের বিপরীতে নতুন কিছু উপস্থাপনও করেননি। ইতিহাসের চরিত্রের সামাজিক রূপ তুলে ধরার ইচ্ছা থাকলেও প্রাধান্য পেয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের নানা তৎপরতা, তাদের মানসিকজগৎ, মনোবৃত্তি, নিষ্ঠুরতার ইঙ্গিত। তবে দ্বান্দ্বিক মনোজগতের বিস্তৃত বিবরণও আছে উপন্যাসে। তবে মোশতাকের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। নিশ্চিন্ত ষড়যন্ত্রকারী সে।

সহজ-সাবলীল গদ্যে লিখিত উপন্যাসটি সুখপাঠ্য। কেউ কেউ মহিবুলের তথ্য ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিংবা বলতে পারেন বর্ণনার যথার্থ প্রয়োগ নিয়ে। লেখক তথ্য ব্যবহার করেছেন নিবিড়ভাবে। কোনো তথ্যনির্দেশ না দিয়ে ইতিহাসকে রক্ষা করেছেন। বরং উপন্যাসটি নতুন প্রজন্মকে নানা বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করবে এবং ইতিহাসের সত্যকে পুনঃআবিষ্কারে সক্ষম হবে তারা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ছাত্র জীবন থেকে শুনে আসা অপপ্রচারের ইতিহাস ভেদ করে প্রকৃত ইতিহাস আবিষ্কারই লেখকের অন্যতম কাজ। গ্রামীণ জীবনে পাওয়া শিক্ষা ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বৈরি মনোভাব এবং বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টির সঙ্গে জাতির পিতার মৃত্যুর পর নিজের পিতার বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর লেখককে পরবর্তীকালে উপন্যাস রচনায় আগ্রহী করে তোলে। ‘তালপাতার পুথি ১-’ উপন্যাস সেই আগ্রহেরই বাস্তব রূপায়ণ। এ আখ্যানে বঙ্গবন্ধুকে জীবন্ত করে চিত্রণে মহিবুল আলম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।

(তালপাতার পুথি ১- মহিবুল আলম, শোভা প্রকাশ, ২০১৫, মূল্য : ৬০০ টাকা।)

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।