বারো কবি-লেখকের বিদায়
বেশি বিষণ্ন করেছে হেলাল হাফিজের ‘প্রস্থান’
বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে ২০২৪ সাল। অনেক আনন্দময় প্রাপ্তির মাঝেও হারানোর বেদনা আমাদের আহত করেছে। এ বছর ১২ জন কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আমাদের বিষাদের অন্ধকারে ফেলে চলে গেছেন চিরদিনের জন্য। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বিষণ্ন করেছে দ্রোহ ও প্রেমের কবি হেলাল হাফিজের ‘প্রস্থান’। সেইসব উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রস্থান নিয়েই আজকের আয়োজন—
খালেক বিন জয়েনউদদীন
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক খালেক বিন জয়েনউদদীন ১৪ জানুয়ারি দুপুরে রাজধানীর নিজ ফ্ল্যাটে ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যান। তিনি ১৯৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার চিত্রাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মো. জয়েন উদ্দীন। তিনি ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন। জীবদ্দশায় তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক বিখ্যাত ছড়া-কবিতা।
হোসেনউদ্দীন হোসেন
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও গবেষক হোসেনউদ্দীন হোসেন মারা যান এ বছর। যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০ মে বিকেলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। হোসেনউদ্দীন হোসেন ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর ঝিকরগাছা ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৯ সালে সম্পন্ন করেন উচ্চ মাধ্যমিক। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম কবিতা কলকাতার দৈনিক পত্রিকা লোকসেবকে প্রকাশিত হয়। জীবদ্দশায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
অসীম সাহা
এ বছর খ্যাতিমান কবি অসীম সাহা মারা যান। ১৮ জুন বিকেল ৪টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবি অসীম সাহা পারকিনসন (হাতকাঁপা রোগ), কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলায় তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অসীম সাহা। তার পৈতৃক নিবাস মাদারীপুর। তার বাবা অখিল বন্ধু সাহা ছিলেন অধ্যাপক। পেশাগত জীবনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
মাকিদ হায়দার
সত্তরের দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনীতি সচেতন কবি মাকিদ হায়দার মারা যান। ১০ জুলাই সকাল ৯টা ৫ মিনিটে রাজধানীর উত্তরার নিজ বাসায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি মাকিদ হায়দারের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাবনার দোহারপাড়ায়। তার বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ ও মা রহিমা খাতুন। সাত ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। সাত ভাইয়ের বোনও ছিল সাতজন। মাকিদ হায়দারের ভাই রশীদ হায়দার, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার সবাই সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত।
ড. মাহবুবুল হক
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, গবেষক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন হৃদরোগ ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। ২৪ জুলাই রাত ১টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনি মারা যান। তিনি ১৯৪৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান ফরিদপুরের মধুখালি। শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আরও পড়ুন
ড. গোলাম মুরশিদ
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক, গবেষক, আভিধানিক, প্রফেসর ড. গোলাম মুরশিদ মারা যান। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। ২২ আগস্ট বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে লন্ডনের সাউথএন্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে কুইন্স হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
আশরাফুল আলম পিনটু
সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার আশরাফুল আলম পিনটু মারা যান। ২৭ আগস্ট ভোরে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। আশরাফুল আলম পিনটুর জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৫ মার্চ বরেন্দ্রভূমির নানাবাড়ি কাদিপুরে। দাদাবাড়ি তালপুকুর। বাবার বাড়ি রাজশাহী শহরের শালবাগান। দাদাবাড়ি আর নানাবাড়িতেই কেটেছে তার বেশিরভাগ সময়।
ড. মনিরুজ্জামান
ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মারা যান। ২৭ আগস্ট বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৫ ফ্রেরুয়ারি। পুলিশ অফিসার বাবার কর্মস্থল ব্রিটিশ ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার ঝিনাইদহে। পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর রায়পুরার আদিয়াবাদে। তার বাবার নাম মাে. নাদিরুজ্জামান, মা মােসাম্মৎ ফরিদান্নেছা।
অঘোর মন্ডল
জ্যেষ্ঠ ক্রীড়া সাংবাদিক এবং কলামিস্ট অঘোর মন্ডল ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি জাগো নিউজে নিয়মিত কলাম লিখতেন। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করেছেন কাজের সুবাদে। বিভিন্ন পত্রিকায়ও কলাম লিখেছেন নিয়মিত। ‘এক্সট্রা টাইম’ ও ‘ইনজুরি টাইম’ তার উল্লেখযোগ্য বই।
অঞ্জনা সাহা
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহার মৃত্যুর চার মাস পর মারা যান তার স্ত্রী কবি অঞ্জনা সাহা। ২৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অঞ্জনা সাহা একজন কবি ও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। তার জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজবাড়ী শহরে। সেখানেই শৈশবের প্রথম পর্যায় কাটে। বাবার চাকরির সূত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর ফলে পড়াশোনা করেন বিভিন্ন স্কুলে।
মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও সভাপতি প্রফেসর মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ মারা যান। ২৬ নভেম্বর দুপুর ২টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের আসামের তিনশুকিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার প্রয়াত বাবা রহিমুদ্দিন আহমেদ আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। যিনি চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন।
হেলাল হাফিজ
দেশবরেণ্য কবি ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রবীণ সদস্য হেলাল হাফিজ মারা যান। ১৩ ডিসেম্বর দুপুরের দিকে রাজধানীর শাহবাগের সুপার হোস্টেলের বাথরুমে দরজা খুলে মৃত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় কবিকে। পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর রক্তপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়। হেলাল হাফিজ ৭ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিংশ শতাব্দির শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কবিতা সংকলন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তার মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়।
এসইউ/এমএস