মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস

গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১৩

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:২৬ পিএম, ০৬ নভেম্বর ২০২৪

গোমতীর স্রোত: কতরং

দেখেছ কি তাকে সন্ধ্যার নীলাম্বরের আয়োজনে
দূর থেকে চেয়ে থাকি অসমাপ্ত প্রয়োজনে

শুক্লপক্ষের রাত্রি।
দ্বিপ্রহর।
গোমতী নদীতটের একটি ভগ্ন শিবমন্দিরের চাতালের ওপর সুকান্ত অনেকক্ষণ বসে চন্দ্রার জন্য অপেক্ষা করছে।
সুকান্তের জননী যতদিন জীবিত ছিলেন; ততদিন রমেশ চক্রবর্তীর পরিবারের সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল। বিমলা ও সুকান্তের জননী উভয়ের প্রণয় ছিল। সুকান্তের জননী গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রমেশ চক্রবর্তীর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তাও গত হয়েছে। রমেশ চক্রবর্তী দরিদ্রের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত মনে করেন না; তবে বালক বয়স থেকেই সুকান্ত ও চন্দ্রার ভাবপ্রণয় তৈরি হয়েছে; এক সময় উভয় পরিবারই মনে করে যে, সুকান্ত ও চন্দ্রা শুভবন্ধনে আবদ্ধ হবে। ক্রমে তাদের বয়স বাড়তে থাকে, ক্রমেই তারা বুঝতে পারে যে, এই প্রণয় শেষপর্যন্ত সুখে পরিণত হবে না; তারপরও তাদের ভাব অব্যাহত থাকে।

আজ চন্দ্রার অনুরোধেই সুকান্ত এখানে এসেছে। চন্দ্রার সঙ্গে তার স্মৃতিগুলোই এখন তার মস্তক দখল করে আছে। সে স্মৃতি মন্থন করতে করতে নিজেকে বলতে লাগল: লোকে বলে, বাল্যপ্রেম সার্থক হয় না। আবার কেউ কেউ বলে, বাল্যপ্রেমে অভিসম্পাত আছে। যাই হোক, আজ তার সমাধান করতেই হবে। আবার ভাবে: অনেক দিন পরে সে আসবে, কাছে বসবে, কথা বলবে—এই স্মৃতিটুকুই না-হয় বুকে বয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেব।

পায়ের শব্দ হলো।
অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে চন্দ্রা এসে উপস্থিত হলো। দূরে রবি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুকান্তের পাশে এসে চন্দ্রা দাঁড়াল। সামনে চন্দ্রাকে দেখতে পেয়ে সুকান্তের বিস্ময়ের সীমা রইল না।
সুকান্ত বলল, বসো।
চন্দ্রা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল।
সুকান্ত আবার বলল, বসো। কীসের এত বাধা!
চন্দ্রালোয় দুইজন মুখোমুখি হয়ে ভগ্ন শিবমন্দিরের চাতালের ওপর উপবেশন করল। কিয়ৎক্ষণ কেউই কথা বলতে পারল না। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে সুকান্ত বলল, আমাকে ডাকলে কেন?
মুখ তুলে আবেগায়িত কণ্ঠে চন্দ্রা বলল, প্রয়োজন আছে।
বিস্ময় কাটিয়ে সুকান্ত বলল, কীসের প্রয়োজন?
বলছি।
অতঃপর আবারও নীরবতায় ছেয়ে গেল ভগ্ন শিবমন্দিরের চাতালের ওপর। কিন্তু সুকান্তের মনে কৌতূহল বৃদ্ধি পেতে থাকলে সে আবারও নীরবতা ভাঙল, বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল: কিছুই তো বলছ না!
বলছি।
শব্দটি উচ্চারণ করেই চন্দ্রা অপলকে তাকিয়ে থাকে সুকান্তের মুখের দিকে। তার দৃষ্টিতে সুকান্তের মুখশ্রী চমৎকার দেখাচ্ছে। কোমল। অরূঢ়। তার মধ্যে একটি ব্যক্তিত্ব আছে—চন্দ্রা তা স্পষ্ট বোঝে, কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারে না। জেদ-তেজ-কাঠিন্য না-থাকলেও মর্যাদা-আভিজাত্য ধরনের কী একটা যেন রয়েছে। চোখ গভীর, চঞ্চলতা নেই। শান্ত স্বভাবের। কখনো গলার স্বর সামান্য কঠিন শোনালেও, তিক্ততা থাকে না। সামান্য উপহাস হয়তো-বা।
ভাঙাচোরা কণ্ঠে সুকান্ত বলল, অপেক্ষা করছি চন্দ্রা।
সুকান্তের মনের অবস্থা অনুধাবন করল চন্দ্রা। অভিমান যে হচ্ছে না, তা নয়; তবে এই অভিমান তার মুখের রেখায় আর চাউনিতে সুস্পষ্ট হতে দিলো না। অবশেষে বলল, আমার মনের কথা তুমি বোঝো না? নাকি বোঝার চেষ্টা করো না? এত অস্থির হলে কি চলে? না, চলে না। এত চঞ্চল হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রয়োজনও নেই।
মাথা নাড়ল সুকান্ত। বলল: এই অস্থিরতা তোমাকে পাওয়ার জন্য। এই চঞ্চলতা তোমাকে দেখার জন্য। আমার ব্যাকুলতা কি তোমাকে স্পর্শ করে না, চন্দ্রা?
চন্দ্রা কিছুক্ষণ মৌন থাকে, তারপর বলল: স্পর্শ না করলে কি সকল বাধা অতিক্রম করে এখানে এসেছি? তোমার মতো আমি সহজে অন্তরের কথা প্রকাশ করতে পারি না।
সুকান্তের প্রাণ ছলছল করতে লাগল। সে নিজেকে আনন্দ দিতে চায়, এই ক্ষণটি তার এখন উপস্থিত—যে-ক্ষণটি মানুষের জীবনে বিদ্যুতের মতো একবার চকিতে দেখা দেয়—তারই আলোক যে ধরে রাখতে পারে, জীবনে তার আলোর অভাব ঘটে না। কিন্তু তার সঙ্গে গ্রথিত রয়েছে দুষ্কৃতির সূত্রে আর স্মৃতিতে। অবশ্য সে স্মৃতিকে সরিয়ে রাখতে চায় না। অনুভূতির পরিধি তার সুসংস্কৃত হয়ে ব্যাপক হয়ে গেছে। কেবল চন্দ্রাকেই পুনঃপুন দেখে তার মনে ভরে নিতে চায়, যেন পৃথিবীর কোনো রূপান্তর ঘটেনি। কণ্টকবনের পঙ্কিল সংকীর্ণ পথে সে একাই যেন চলেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সুকান্ত বলল: মাথার ওপর চাঁদ, আর নিচে তুমি। এমন সমাবেশ অনন্তকালের মধ্যে আর কখনো হবে না।
তুমি যা বললে তা এত বেশি সত্য যে, না বললেও চলতো।
আক্ষেপের স্বরে সুকান্ত বলল, পার্থক্য আছে, চন্দ্রা।
তীব্র-তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চন্দ্রা প্রশ্ন করল, যেমন?
একেবারে অনন্ত-অসীম।
একথা বলেই যেমন হঠাৎ হেসে উঠল সুকান্ত, ঠিক তেমন করেই থেমে গেল। সুকান্তের হাসি থেমে যেতে-না-যেতে চন্দ্রা আকুল কণ্ঠে বলে উঠল, সহজ ভাষায় ব্যক্ত করো।
আমি ঘর-বাঁধার চেষ্টায় ছিলাম। কিন্তু খবর পেলাম, তুমি এই ঘরে পা দিতে কুণ্ঠিত। এতদিন ধরে মনে-মনে ঘর সাজাচ্ছিলাম, তোমাকে আহ্বান করার জন্য, আপন নিলয়ে এসো। কিন্তু শুনলাম, অন্যের জন্য তুমি বধূ সাজে রঞ্জিত হচ্ছ।
হঠাৎ ক্রোধে ফেটে পড়ল চন্দ্রা, বলল: তুমি বিবাহপ্রস্তাব দিলে না কেন?
দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে চন্দ্রার কথার প্রতিবাদ করতে চাইল সুকান্ত, বলল: বিয়ের ব্যাপারে সকলের চেয়ে জরুরি হচ্ছে পাত্রী, তার পরেই পাত্র।
অবাক করলে! তাই বলে কি পাত্রীপক্ষ বিবাহপ্রস্তাব পাঠাবে?
এখানে এসে চন্দ্রা খেই হারিয়ে ফেলল। তার পরে যা বলতে চাইল, মুখ দিয়ে তা বের হলো না। নাক-মুখ দিয়ে শুধু উষ্ণ বাষ্প বেরিয়ে আসতে লাগল।
চন্দ্রার কথা শুনে সুকান্ত যেন দিশে হারাল, তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে থাকল; পরক্ষণে বলল: আমরা আধুনিক যুগের মানুষ। এক পক্ষ দিলেই তো হয়। তাই না?
আমার মিনতি রাখো। এই মুহূর্তে কবির লড়াই শুরু কোরো না।
সুকান্ত চমকে উঠল, বলল: কিন্তু...
চন্দ্রার চমকের সঙ্গে বিস্ময়ও মিশে গেছে। সে হেসে বলল, কিন্তু আবার কী! যার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে তার কতটুকু যোগ্যতা আছে তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের, শঙ্কা আর বিস্ময়ের মাখামাখি সুকান্তের চোখে-মুখে। বলল: কিন্তু তোমার পিতা তো এই সম্বন্ধে রাজি।
অন্তরে ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়েছে চন্দ্রার। ঘোর-ঘোর লাগছে তার। স্নায়ুতন্ত্র অবশ হয়ে আসছে যেন। জিভও জড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও বলল: এখনো রাজি হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। আমি তার একমাত্র কন্যা। ইচ্ছে করলেই কুলীন কুল থেকে অন্য কুলে ভাসিয়ে দিতে পারেন না। কুলকে জলাঞ্জলি দিয়ে এই গ্রামে শান্তিতে বসবাস করা যাবে না।
কিন্তু আমি তো শুনেছি তোমার পিতা অর্থপিপাসু। তার ইচ্ছে, তোমাকে বিয়ে দিয়ে কিছু অর্থ লাভ করা।
অকস্মাৎ পাথরবৎ হয়ে গেল চন্দ্রা। তারপর তার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। অতঃপর মৃতপ্রায় কণ্ঠে বলল, তাহলে তুমি অর্থ জোগাড় করো। অর্থের বিনিময়েই না-হয় তুমি আমাকে বিয়ে করো। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো চন্দ্রার।

নরম চন্দ্রকিরণ চন্দ্রার সর্বাঙ্গজুড়ে। তার চোখে, অধরে, নাসিকায়, গণ্ডে, দুই বাহুতে চন্দ্রালোক ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই চন্দ্রালোই চন্দ্রার দেহসৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সে অত্যন্ত রূপময়ী। তার মনোমোহিনী রূপ দেখে সুকান্ত মুগ্ধ। যতক্ষণ কাছে থাকে, বিভোর চোখে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। বিভোর কণ্ঠে সুকান্ত বলল, তুমি রেগে যাচ্ছ কেন?
সুকান্তের কাতর মুখ দেখে চন্দ্রার মমতা হলো, কিন্তু সে মর্মাহত হয়ে চড়া গলায় বলল: রাগ নয়, অভিমান। আমার বাবাকে তুমি অর্থপিপাসু বললে। তারপরও বলছ, আমি কেন অভিমান করছি!
সুকান্ত দুঃখিতভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে এবং মৃদু হেসে বলল, আমার অন্যায় হয়ে গিয়েছে। তবে এমন কথা গ্রামের লোকজন বলছে।
কেবল অসম্ভবের স্বপ্ন দেখে আর উলটো কথা বলে চমক লাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই। সত্য হচ্ছে একজন ব্রাহ্মণ তার জাতিকুল রক্ষা করবেই। আজ তোমাকে সত্যকথা বলার জন্যই এখানে ডেকেছি। হয়তো-বা আর অবসরও পাব না। তাই সমস্ত কথা খুলে বলছি: আমি তোমাকে অতীতে ভালোবেসেছি, এখনো ভালোবাসি। পার্থের ঘরে স্থান করে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
একথা বলে চন্দ্রা এমনভাবে বসে রইল যেন তার নিশ্বাসও পড়ছে না। সুকান্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে চন্দ্রাকে দেখে নিলো। তারপর আনন্দঘন কণ্ঠে বলল: যে কথা শুনে আমি মনমরা হয়েছিলাম, এখন দেখছি তা একেবারে উলটো।
চন্দ্রার ওষ্ঠ ঈষৎ কম্পিত হলো। ম্লানমুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মাঝেমধ্যে মনটাকে উলটে না দেখলে কি হয়, বলো!
তার দরকার নেই। আমার ইচ্ছে ভবিষ্যতের পথ রচনা করা।
একে একে মনে পড়ে জীবনের কথা। চন্দ্রা বলল, নিজের বাঁধা প্রেমটা দিয়েই চিরদিনের মতো যদি তোমাকে আগা-গোড়া বেঁধে রেখে নিতে পারি তাহলে...
সুকান্তের চোখ কপালে উঠে গেল না—একটু বড় হলো মাত্র। বলল, তাহলে কী চন্দ্রা!
চন্দ্রা ভুরু কুঁচকে রসিকতার গলায় বলল, সময় হলেই বুঝতে পারবে। যা হওয়ার তা-ই হবে।

বেলাভূমিতে বাতাসের রমণ
হরিৎ শস্যক্ষেতে হৃৎস্পন্দন

দুই দিন অতীত হলো।
তৃতীয় দিনে গঙ্গামণি এসে উপস্থিত হলেন অক্ষয় দাসের কাছে। গঙ্গামণির কাছে মনে হলো: মেঘাবৃত আকাশের মতোই যেন চারদিক—পরিবেশ। এখানে কোনো উচ্ছল-আনন্দ-হাস্য-কৌতুকময় উৎসব নেই। অবশেষে অনেক চিন্তা করে গঙ্গামণি সংকল্প করলেন, তার অন্তরের অসহ্য যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে হবে। তিনি হাঁক ছাড়লেন, কর্তা বাড়িতে আছেন?
কিছুক্ষণ পর, অক্ষয় দাস এসে উপস্থিত হলেন। গঙ্গামণিকে সম্মুখে দণ্ডায়মান দেখে তিনি যেন ঈষৎ চমকে উঠলেন। তারপর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে গঙ্গামণির ওপর কিঞ্চিৎ উদ্বেগের ছায়াচ্ছন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, কী খবর পণ্ডিত?
গঙ্গামণির কর্ণমূলে রক্তিম রেখা ফুটে উঠল। পরক্ষণেই সেই ভাব দমন করে প্রশান্ত মুখে বললেন, খবর তো কর্তা আপনার কাছেই। কয়েকদিন পর আসতে বলেছিলেন, তাই এলাম। যদি সিদ্ধান্তটা...
গঙ্গামণিকে বাক্য শেষ করতে না দিয়ে অক্ষয় দাস বললেন, আজ্ঞে।
গঙ্গামণি প্রস্তরমূর্তির মতো শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার সমস্ত মুখ যেন পাংশু হয়ে উঠল। চোখে-মুখে যেন শঙ্কা ও সংকোচের রেখাবলি ফুটে উঠেছে। অতঃপর রক্তশূন্য কণ্ঠে অতি ধীরেআস্তে বললেন, আজ্ঞে কী কর্তা!
অক্ষয় দাস কিছুক্ষণ শূন্য মনে গঙ্গামণিকে নিরীক্ষণ করে বললেন, অনেক চিন্তা করে দেখলাম—জাত ভালো। অনেক অনুসন্ধান করে অবগত হলাম—পাত্রী সুন্দরীও বটে। তাই যত শীঘ্র বিবাহবন্ধনের ব্যবস্থা করা যায় ততই মঙ্গল।
অক্ষয় দাসের কথা শেষ হওয়ার পর এবং গঙ্গামণির কথা বলার পূর্বে যে-একটি মুহূর্ত অতিবাহিত হলো, এই মুহূর্তের মধ্যেই গঙ্গামণির জীবনের অনন্ত সুখ এবং তার সুখানুভূতির প্রত্যেকটি পরমাণু বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়ে গেল। অতঃপর গঙ্গামণি বললেন: আজ্ঞে কর্তা, আমিও তা-ই বলি। আগামী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লগ্ন ভালো। যদি অনুমতি দেন... শুভকাজে বিলম্ব করতে নেই।
আজ্ঞে, তাই করুন।
কর্তা!
গঙ্গামণির মুখের ওপর আলো এসে পড়ছে—কিন্তু গঙ্গামণির এই ছবিটি অক্ষয় দাসের সহ্য হলো না। সরে গিয়ে তিনি মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন: আবার কী?
অর্থ নেই, কিন্তু দেনা আছে, ক্ষুধাও আছে; তাই গঙ্গামণি প্রভুভক্ত কুকুরের মতো এক মুহূর্ত অক্ষয় দাসের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার নীরবতাই যেন গঙ্গামণিকে নরকের দিকে ঠেলতে থাকে। কাজেই গঙ্গামণি মাথা ঠান্ডা রেখে বললেন, সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু আমার দিকে যদি একটু...
অক্ষয় দাস ত্রস্তনেত্রে চারদিক একবার দেখে নিয়ে বললেন, আপনার দিকে!
অক্ষয় দাসের কথায় গঙ্গামণির মুখে পরপর কয়েকটি বেদনারেখা ফুটে উঠল। একটু ম্লান হাসির মধ্য দিয়ে জবাব দিলেন: আজ্ঞে, পেন্নামি বলে তো একটা কথা আছে—তাই না কর্তা!
গঙ্গামণির বেদনার রেখাগুলো অক্ষয় দাসের তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ধরা পড়ল। আত্মসংবরণ করতে না পেরে তিনি মুখ টিপে হাসলেন। তারপর কী যেন ভেবে বললেন, সময়মতো সবই হবে। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
গঙ্গামণি বিস্ময়ে বললেন: তা-ই বটে, বটেই।

একথা বলেই গঙ্গামণির অন্তর থরথর করে কেঁপে উঠল। মুখাবয়ব এমনই শুষ্ক হয়ে উঠল যে, যেন তার আয়ুষ্কাল দুঃসহ ক্ষিপ্রগতিতে নিঃশেষিত হয়ে আসছে—তার শিরা-উপশিরা দিয়ে নিদারুণ একটা কষ্টতরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। গঙ্গামণির এমন অবস্থা উপলব্ধি করেই হয়তো সদ্যস্ফুট শুভ্র মল্লিকার মতো হাসিমুখে তার দিকে অগ্রসর হলেন অক্ষয় দাস। অতঃপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে কিছু কড়ি বের করে গঙ্গামণির হাতে দিতে দিতে বললেন, এগুলো রাখুন।

কড়ির গন্ধে ও স্পর্শে গঙ্গামণির সর্বশরীরে একটা অভূতপূর্ব পুলক শিহরণ সৃষ্টি হলো। মনে হলো, কোনো স্বর্গীয় নির্ঝরিণী থেকে অমৃতধারা নেমে এসেছে, আর তা তিনি সমস্ত ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করছেন। হঠাৎ নিজেকে সংযত করে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, আপনি আমার অভিভাবক। আপনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার যাতে ভালো হয়, তাই চান। আপনার কুশল প্রার্থনা করি।

অতঃপর গঙ্গামণি কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার অক্ষয় দাসকে দেখে নিয়ে হরি, হরি বলে চলে গেলেন।
বিমলা জানেন, সুকান্তের নিজের প্রয়োজন না থাকলেও তার যথেষ্ট প্রয়োজন আছে চন্দ্রার। সুকান্ত ছেলেটি ভালো, বিদ্যাও আছে, অর্থোপার্জনের শক্তিও আছে—আর তার বিনয় ও মিষ্ট ব্যবহারে সে সকলের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। সুতরাং সুকান্ত যদিও রমেশ চক্রবর্তীর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তবুও বিমলার হৃদয়জুড়ে তার অবস্থান সুদৃঢ়ই রয়েছে। বিমলা অনেক রাত্রি পর্যন্ত নিজের ঘরে বসে সুকান্তের কথাই ভেবে চলেছেন। সুকান্তই যেন তার জীবনের অন্তরতম আশা ও আকাঙ্ক্ষা। তার মঙ্গল কামনায়ই যেন তিনি ব্যগ্র। জীবনে সে যেন সুখী হয় তা-ই তার একমাত্র ইচ্ছে। রমেশ চক্রবর্তীর কথা শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়েছিলেন। তিনি কখনই কল্পনা করতে পারেননি যে, রমেশ চক্রবর্তীর মন অক্ষয় দাসের পরিবারের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে! সুকান্তের প্রতি রমেশ চক্রবর্তীর বিদ্রুপ ভাব কেন জন্মেছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। একটা গভীর চিন্তা ও উদ্বেগ তার অন্তরকে পীড়িত করছে, যেসবের চিহ্ন তার চোখে-মুখে সুস্পষ্ট। এই চিন্তা ও উদ্বেগ নিয়ে তিনি চন্দ্রার কাছে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি তার মেয়েকে কোলের কাছে বসিয়ে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন: তুই কি ঠিকই বুঝেছিস!
চন্দ্রা বলল, কোন্ ব্যাপারে মা?
সুকান্তের কথা বলছি। ওর ব্যাপারে। সে ভারি চঞ্চল ছেলে। সেজন্যই ওকে এত স্নেহ করি। দ্যাখ্ না, সে কেমন এলোমেলো।
সুকান্তের প্রতি তার অসীম অনুরাগের কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ না করে চন্দ্রা বলল: সে গোছালো হলেই বরং সমস্যা হতো। ছন্নছাড়া বলেই হয়তো, তার যা পাওয়ার তা পেয়ে যায়।
স্নিগ্ধ স্বরে বিমলা বললেন, সত্যিই বলছি, ওর ছেলেমানুষি আমার বড্ড পছন্দ হয়।
চন্দ্রা হেসে বলল, ছেলেমানুষি মেনে নেওয়াটাই হচ্ছে মায়ের ধর্ম। মায়ের কাছে ছেলের সবকিছুই অসাধারণ।
চন্দ্রার হাসিতে বিমলা যোগ দিলেন না। তার মুখ কেমন বিবর্ণ হয়ে গেল। চোখের পাতা অশ্রুসজল হয়ে উঠল। তিনি একটা চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন: দেখেছিস চন্দ্রা, ওর দুরন্ত মন আজকাল কেমন যেন স্থির হয়ে আছে। ওকে দেখে আমার বড্ড মমতা হয়।
চন্দ্রা ভাবতে লাগল: মা সত্যই কি সুকান্তকে এতো ভালোবাসে? তারপর বলল, এসব আমাকে বলছ কেন মা?
চন্দ্রার প্রশ্ন শুনে বিমলার মনে হলো এর মধ্যে হয়তো কোনো গূঢ় রহস্য রয়েছে। বিমলার মন অকূলসাগরে নিমজ্জমান ব্যক্তির ন্যায় শেষ আশ্রয় অবলম্বন করে উদ্বেগ ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, সুকান্ত যে তোকে খুব পছন্দ করে।
চন্দ্রা ঈষৎ সন্দিগ্ধভাবে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, অবশ্যই সে তা করে।

অস্পষ্ট অন্ধকারময় কক্ষ। একটি ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলছে বটে, কিন্তু তাতে ঘরের অন্ধকার সম্পূর্ণ দূর করতে পারছে না। বিমলার চোখ সেই ক্ষীণ প্রদীপের ওপর নিক্ষেপ করে বললেন, কিন্তু তোর বাবা হচ্ছেন আমার সকল ভাবনার বিষয়।
চন্দ্রা অত্যন্ত উদারভাবে হেসে বলল: বাবাকে আমি খুবই ভালোবাসি, মা।
কোনো গোপনশত্রু যেমন অতর্কিতভাবে আঘাত করতে উদ্যত হলে তা জানতে পেরে কেউ আত্মরক্ষার্থে প্রস্তুত হয়, তেমনই সচকিত হয়ে বিমলা বললেন: কিন্তু মা, তোর হেঁয়ালি আমি সব সময় বুঝতে পারি না। তবে আসন্ন সমস্যায় বিব্রত আছি। আমি ঠিকই জানি, সুকান্তকে নিয়ে সংসার পাততে চাইলে তোর পিতাকে খানিকটা কষ্ট দিতেই হবে। তা ব্যতীত অন্য কোনো উপায় নেই!
ললাটে চিন্তারেখা, ঈষৎ কুঞ্চিত ভুরুযুগলে উদ্বেগ ও সংশয়ের চিহ্ন ফুটিয়ে চন্দ্রা বলল: কিন্তু বাবা... কিছুই মানতে পারেন না। নিজের মেয়ের মনের কথাও তিনি বোঝেন না। তার কাছে আমি মেয়েমানুষ। আমার কোনো মূল্য নেই। সুকান্তের অস্তিত্ব তিনি দেখেও দেখেন না। এমন অবস্থায় আমি কী করতে পারি? যতই দাবি করব বরং ততই আমি বঞ্চিত হব।
ধীরেআস্তে বিমলা মাথা সঞ্চালন করে বললেন, তাহলে তুই কী করতে চাস, চন্দ্রা?
অত্যন্ত সহানুভূতিসূচক কোমল স্বরে চন্দ্রা বলল: আমি জানি না, মা। তবে এইটুকু জানি, মন যেখানে নেই সেখানে সংসার পাতার কল্পনা করা সম্ভব নয়।
বিমলা সহজ কণ্ঠে বললেন, তুই সত্যি এক অসাধারণ মেয়ে। একটা-না-একটা পথ তুই খুঁজে বের করবিই, এটি আমার দৃঢ়বিশ্বাস।
চন্দ্রা চাপা গলায় বলল: মা, সময়ে মানুষের মন যতই স্পষ্ট করে কথা বুঝতে পারে, ততই শক্ত হয়ে তার ধাক্কা সহ্য করতে পারে।

অদূরে একটি লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডেকে উঠল। গভীর নিশীথে এই গভীর শব্দে বিমলা একটু চমকে উঠলেন। চন্দ্রাও।
অমিতের প্রতি একটা প্রীতির বন্ধন দীর্ঘ-উন্নত-বলিষ্ঠ শরীরের পার্থের রয়েছে। অমিতের দৃঢ়প্রতিভাব্যঞ্জক উন্নত ললাট দূর থেকে দেখে পার্থের মনে হলো, সে একজন সাধারণ যুবক নয়। তার চলনে ভস্মাচ্ছাদিত বহ্নির মতো কী যেন এক তেজ লুকিয়ে রয়েছে। বয়সের অনুপাতে তার মুখমণ্ডল একটু বেশি বিষণ্ণ, গভীর। পার্থ ডাকতে লাগল: অমিত... অমিত...
অমিতের কোনো উত্তর নেই।
পার্থ দৌড়ে অমিতের কাছে এসে বলল, এত ডাকছি তবুও শুনতে পারছিস না যে!
অমিত বলল, না, শুনতে পাইনি।
অমিতের আয়ত চক্ষু দিয়ে যেন তার হৃদয়ের প্রতিটি রেখা প্রকাশ পাচ্ছে। পার্থের মনে হলো অমিতের হৃদয়ে কোনো কুটিলতা নেই। ভীরুতা কিংবা কাপুরুষতাও নেই। সত্যই প্রকাশ পাচ্ছে আপন গরিমায়। এই চোখের দিকেই তাকিয়ে পার্থ বলল, তুই কি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছিস!
এড়িয়ে যাওয়ার কী আছে! তবে তোর সঙ্গে দেখা হাওয়াটা আমার প্রত্যাশা নয়।
পার্থের মন অনুতপ্ত। তার সেই দিনের রূঢ় ব্যবহার মনে হতেই ঈষৎ লজ্জিত হয়ে বলল, তুই আমার ওপর এখনো রেগে আছিস!
অমিত নিজের অজ্ঞাতসারেই একটা চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, রাগ করাটা কি অন্যায়?
না। তবে, তুই যদি আমার ওপর রাগ করিস, তাহলে আমার কষ্ট হয়। জানিস তো, তুই আমার একমাত্র বন্ধু যাকে আমি সবকিছু বলতে পারি, সহজে।
অমিতের মুখে বিরক্তিরেখা ফুটে উঠল। অত্যন্ত কুণ্ঠিতভাবে বলল, তাহলে বল্ তোর জন্য নতুন করে আবার কী করতে হবে?
পার্থ ঈষৎ হেসে বলল: অনেক কিছুই করতে পারিস, কিন্তু আমি কী করব! সুশীলা আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা। আর অন্যদিকে চন্দ্রার পরিবার জাতে দশের ওপর। এই পরিবারকে আমার পিতার পছন্দ হয়েছে। পিতাকে অমান্য করা আমার পক্ষে অসম্ভবই বটে। তাছাড়া আমি আর কোনো পথেরও সন্ধান পাচ্ছি না।
পার্থের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাতেই অমিত বুঝতে পারল, তার চোখ-মুখ রোদে পুড়ে গেছে। মনোরাজ্যে অহর্নিশি যে-দ্বন্দ্ব চলছে তারই বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্টভাবে পার্থের চোখে-মুখে পড়েছে। এই কয়েক দিনের মধ্যে তার চেহারার কী ঘোর পরিবর্তন! চোখের মাধুর্যদীপ্তি এখন ক্লান্ত। দেহকান্তি এখন ম্লান। হয়তো সে পথে-ঘাটে ব্যথিতচিত্তে নিঃসঙ্গভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে না-জানি কত কষ্ট সহ্য করছে। তারপরও অমিতের অভিমানের লাঘব হলো না। বলল: শোন্ পার্থ, তোর এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তুই জানিস, কোন্ পথটা তোর জন্য ভালো। তাই তোকে একটা পথই বেছে নিতেই হবে। প্রেম বা জাত। তুই যে-পথ ধরে অগ্রসর হবি সেই পথের জন্য তুই একাই দায়ী থাকবি। তবে অনুরোধ, তুই প্রেমকে ঘুলিয়ে ফেলিস না।
পার্থ চিন্তিতভাবে বলল, তুই যা বলতে চাইছিস তা স্পষ্ট করে বল্।

অমিত ও পার্থ উভয়ই কিছুক্ষণ একে অপরের প্রতি নীরবে তাকিয়ে রইল।
অবশেষে অমিত বলল, তোকে আমি কী বলব? তবে আমি সুস্পষ্ট জানি, পৃথিবীর যত জাতপাত এক জায়গায় জমা করে পর্বতপ্রমাণ করলেও হৃদয় যাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে সে যতই সমাজের চোখে দুর্বল কিংবা হীন হোক-না কেন, তাকে বঞ্চিত করা অন্যায়। ফাল্গুনের পবনান্দোলিত বৃক্ষপত্রের মর্মরশব্দ যেমন প্রেমিকের কানে মধুর শোনায়, তেমনই আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষের সঙ্গসুখের মাধুর্য মনের অজ্ঞাতসারেই সমস্ত হৃদয় তা গ্রহণ করে। মনে রাখবি, প্রেম তৃষ্ণার জলের মতোই স্নিগ্ধ। তাই প্রেমের যা প্রাপ্য তা-ই দিতে হয়। তবে তোর জন্য আমার করুণা হয়, প্রেম কাকে বলে তা তুই জানিস না। তাই তোর সঙ্গে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুই ভালো থাকিস। আমি গেলাম।

ভাঁটি ফুলের বন্দকি, ছায়াতরুর বসতি
ঘনশূন্য সুদীর্ঘ বন্ধনী, একলা চলা বসুমতী

সুকান্ত বিহ্বলের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরল। চন্দ্রাকে ছেড়ে এই কয়েকদিন নিজের কল্পনায় নিজেকে আবদ্ধ রেখে শুধু সুখ-দুঃখ লাভ-ক্ষতি খতিয়েই দেখেনি বরং চন্দ্রা যে তার জীবনে কতখানি অচ্ছেদ্য বন্ধনে গ্রথিত, তাকে ছাড়া বেঁচে থাকা যে কত কঠিন, কত দুঃখকর—এসব কথাই বাড়িতে ফিরে এসে সুকান্ত নিজের মধ্যে পর্যালোচনা করতে লাগল। একটি চাপা হাহাকার চৈত্র-অপরাহ্ণের তৃষ্ণার মতো সর্বাঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে। চন্দ্রা ছেলেবেলা থেকেই আমার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। সময় কাটানোর সঙ্গী হিসেবেই তাকে দেখে আসছি। তাই হয়তো-বা তাকে বিশেষ করে প্রেমিকারূপে দেখেনি। দেখার কথাও ভাবেনি। সুকান্ত একবার ডুকরে উঠল। কান্না-মেশানো কণ্ঠে অস্পষ্ট ভাষায় নিজেকে বলতে লাগল: কিন্তু এখন, ওর বিবাহপ্রস্তাব আসার পর থেকে ওকে হারানোর দুশ্চিন্তা আমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে। হয়তো ওকে পাব না। শেষপর্যন্ত হয়তো সে পার্থেরই হয়ে যাবে। এই দুশ্চিন্তায় এখন আমি জর্জরিত।

সেই রাত্রির ঘটনা, অথচ চন্দ্রার দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা আজও তার চোখে সুস্পষ্ট। সুকান্ত শুকনো হেসে মনে-মনে বলল: সেদিন জোর করেই আমি তার গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো ভাঙনটা ভাঙনের মুখেই বেঁধে যাবে। তবুও আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। উদ্বিগ্ন হচ্ছি পাছে চন্দ্রাকে হারাতে হয়।
ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ অন্তরে চিন্তার মাঝখানে উদ্ভ্রান্ত মানুষের মতো থমকে গেল সুকান্ত। এক তিক্ত যন্ত্রণা আরও অসহনীয় লাগছে তার। সারা মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে মনে-মনে বলল: কী সাংঘাতিক অন্যায়! ভাবছি, কী করে পার্থকে সরিয়ে দেওয়া যায়!
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আধমরা মনে নিশ্চুপভাবে সুকান্ত বলতে লাগল: চন্দ্রাকে তো আমি চিনি। সে ব্যক্তিত্বময়ী। জানে, সে আমার আপন মানুষ। তাই তো সেই রাত্রির অন্ধকারে, অসংকোচে আমার কাছে এসে এমন করে দাঁড়িয়ে ছিল। পার্থের সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়েছে, কিন্তু কেউই তাকে তো সম্মত করতে পারছে না। আর তো সে চুপ করে থাকবে না। এখন সবকিছু সে প্রকাশ করে দেবে। সুকান্তের চোখ-মুখ উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
সেই রাত্রিও এরকমই তার অবস্থা হয়েছিল।
সুকান্ত মনে-মনে বলতে লাগল: চন্দ্রাকে আমার কাছে টেনে আনি। চন্দ্রা বাধা দেয়নি। দোষ নেই বলেই হয়তো বাধা দেয়নি। এতে তার অধিকার ছিল, তাই হয়তো বাধা দেয়নি। কিন্তু চন্দ্রার বাবার অমতে আমার সঙ্গে কীভাবে সংসার বাঁধবে! কিন্তু পার্থের সঙ্গে বিয়ে হলে আমি কীভাবে বাঁচব?

সকাল।
মিথুন কাজে যাওয়ার আগে সপ্রশান্ত দৃষ্টিতে সুশীলার দিকে তাকিয়ে বলল, এমন দুর্ঘটনার মধ্যেও তুই কী করে মাথা ঠান্ডা রেখে চলেছিস! পার্থদার ব্যাপারে তুই কী ভাবছিস?
সুশীলা বলল, আমি কিছুই ভাবছি না। নিজের পরিবারের কথা ভেবেই আকুল। তুই তো দেখতেই পাচ্ছিস আমাদের কী অবস্থা। তাছাড়া ওর কথা ভেবে আমার কী লাভ!
প্রায় ফিসফিস করে মিথুন বলল, পার্থদা কি আমাদের কোনো খবর রাখে না?
জানি না।
দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মিথুন বলল, অসম্ভব! তারপর সে ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল সুশীলার দিকে, বলল: তুই যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিস।
সুশীলা সামান্য মাথা নেড়ে বলল, কেমন?
ভুরু কুঁচকে মিথুন বলল, রোগা-রোগা দেখাচ্ছে তোকে। মুখখানি শুকনো, যেন কত বয়স হয়ে গেছে তোর।
সুশীলার চোখ কপালে উঠে গেল। বলল, তুই যে কী বলছিস!
তোর পরনের শাড়ির দিকে তাকিয়েছিস?
শাড়ি? বেঁচে আছি এই তো বড় কথা।
তুই পার্থদাকে নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছিস, তাই না?
ওকে নিয়ে কষ্ট পেতে যাব কেন?
আমার মনে হয়, পার্থদার সঙ্গে তোর সরাসরি কথা বলা উচিত।
ওর সঙ্গে কথা বলার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। শোন্, এই ব্যাপারে তোর কোনো চিন্তা করতে হবে না, তুই বরং কাজে যা।
তুই নিজেও বলবি না, আবার আমাকেও বলতে দিবি না। এভাবে তো হয় না, চলতে দেওয়াও যায় না।
কী চলতে দেওয়া যায় না?
দ্যাখ্ দিদি... তোদের ব্যাপার নিয়ে প্রায় সকলেই কথা বলছে। সবাই তো তোর আর পার্থদার সম্পর্কের কথা জানে। পার্থদা এখন অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, আর তুই বলছিস: আমার কিছুই করার নেই! তা হয় না, দিদি। আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। তোর অপমান মানে আমার অপমান। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। এটির একটা বিহিত করতেই হবে। ফেরার পথে একবার পার্থদার সঙ্গে দেখা করে আসব।
মিথুন প্রায় লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুশীলা গাঢ়শ্বাস ফেলে বলল: দাঁড়া, মাথা গরম করিস না। লক্ষ্মী ভাইটি আমার, শোন্...
মিথুন উঠোন পেরিয়ে চলে গেল।

মিথুনের গমন পথে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুশীলা মনে-মনে বলতে লাগল: অসম্ভব বলেই কি আমি পার্থের আশা ত্যাগ করতে বসেছি! কিন্তু তার ব্যবহারের কোনো কৈফিয়ত তো আমি চাইনি। আমার কাছে সে জবাবদিহি করুক তাও চাই না। নদীতটে এসে দাঁড়ালে ওদের বাড়িটা দেখা যায়, পাছে দেখা হয়ে যায়, এই ভয়ে আমি আর নদীতটে যাই না। কিন্তু নির্বিঘ্নে যখন এই কয়েকটি দিন কেটে গেল, তার কোনো দেখা পেলাম না, তখন ভাবতে বসেছি ওর হয়তো লজ্জাশরম আছে, তাই আমার ব্যাপারে সে নীরব। কিন্তু ওর ব্যবহার আমাকে আঘাত করছে। আমার মুখ ফুটতে চায় না, বুক ফেটে গেলেও। কিন্তু শান্তি পাচ্ছি না। অভূতপূর্ব কষ্টে আমার সমস্ত বুক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। রয়ে রয়ে হৃদয়ের অন্তরতম স্থল পর্যন্ত এমন করে নিরাশায়, বেদনায়, আশঙ্কায় কেঁপে উঠছে। তবুও তো আমি কোনো কথাই লোকমুখে প্রকাশ করতে পারি না। পার্থের বিয়ে পর্যন্ত হয়তো আমাকে মৌনই থাকতে হবে। তার বিয়ের কথা মনে এলে আমার অন্তরে-বাইরে এমন আগুন জ্বলে ওঠে কেন? হায় ঈশ্বর, আমাকে শান্তি দাও। আমাকে বাঁচার পথ বলে দাও। হায় ঈশ্বর... ঈশ্বর...

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।