শাহানাজ শিউলীর গল্প: প্রতিদান
কলিং বেলটি বেজে উঠলো। মায়া মনে মনে ভাবলো এ অসময়ে আবার কে এলো? চারদিকে করোনার যে পরিস্থিতি; বাড়িগুলো তো শ্মশানের মতো মনে হয়। ঘর থেকে কেউ বের হয় না। বিশ্বটা যেন জনমানবশূন্য হয়ে গেছে। কেউ কারোর বাড়িতে উঁকি পর্যন্ত দেয় না। তাহলে অসময়টাতে এলো কে? দেখি গেটটা খুলে। গেটটা খুলতেই হতভম্ব হয়ে গেল মায়া। গেটের সামনেই তার স্বামী শাহেদ।
এই অসময়ে তুমি বাড়ি ফিরলে? কিছু হয়নি তো?
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শাহেদ জবাব দিলো, শরীরটা কাঁপছে, মনে হয় জ্বর আসবে। বলেই খুসখুস করে কাশি দিলো শাহেদ। মায়ার বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। একটা অশনিসংকেত মনে হলো। শাহেদ কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘরে বসলো।
মায়া বলল, মসলা চা করে নিয়ে আসি।
শাহেদ সম্মতি জানালো। সে বসে বসে সংবাদ দেখছে টিভিতে।
মায়া চায়ের কাপ হাতে দিয়ে বলল, দেখি তো গায়ে জ্বর আসছে কি না। কপালে হাত দিয়েই সে আৎকে উঠল। একি! গায়ে তো দেখছি অনেক জ্বর।
শাহেদ বলল, তেমন কিছু না। হালকা জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু মায়ার মনের ভেতর কু ডেকে উঠলো। চিন্তার বলিরেখা কপালে ভেসে উঠলো। রাত যতই গভীর হলো, শাহেদের জ্বরের প্রকোপটা ততই বেড়ে যেতে লাগলো।
মায়ার চিন্তার কারণটা হলো, শাহেদ একজন গ্রাম্য ডাক্তার। এমবিবিএস ডাক্তাররা যেখানে রোগী দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন; সেখানে শাহেদ নির্ভীক যোদ্ধার মতো রোগী দেখে চলেছে। সে করোনার কোনো নিয়ম-কানুনের ধার ধারে না। নিজের ইচ্ছামতো রোগী দেখে। প্রথম প্রথম বাসায় এসে একটু নিয়ম-নীতি মেনে চলতো। কিছুদিন পরে তা-ও বাদ দিলো। মায়া ভাবলো রোগীদের কাছ থেকে সে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। যদি করোনা হয় তাহলে?
এক অজানা আতঙ্ক মায়াকে ঘিরে ধরলো। মায়া মনে মনে যে ভয় পাচ্ছিল, ঠিক তা-ই হলো। শাহেদের জ্বর ভীষণ বাড়তে থাকলো। ১০৪ ডিগ্রির নিচে জ্বর নামছে না কখনো। অল্প সময়ের জন্য একটু কমলেও আবার একই রকম জ্বর বেড়ে যাচ্ছিল। সারারাত ধরে মায়ার চোখে কোনো ঘুম ছিল না। বারবার গামছা ভিজিয়ে গা মুছিয়ে দিচ্ছিল আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় লেবু-মসলা চা বানিয়ে এনে খাওয়াচ্ছিল। সবকিছুর তোয়াক্কা না করে শাহেদের পাশেই থাকলো মায়া সর্বক্ষণ।
এভাবে পাঁচদিন গত হয়ে গেল তার সেবা-যত্নের কমতি ছিল না। কোনো কিছুতেই যেন শাহেদ সেরে উঠছে না। মায়া বলল, একটা টেস্ট করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে শাহেদ ভ্রূ কুঁচকে বলল, কিসের টেস্ট?
মায়া বলল, করোনার টেস্টটা করো প্লিজ।
কড়াভাবে শাহেদ জবাব দিলো, আমার কোনো করোনা হয়নি যে করোনার টেস্ট করতে হবে?
মায়া অনুনয়-বিনয় করে বলল, না হলে ভালো কথা। তবে টেস্ট করলে সমস্যা কী?
শাহেদ আবার বলল, ডাক্তার তুমি? না আমি? যা বোঝ না, সে সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করো না।
শাহেদ চিরকালই একরোখা। অন্যের মতামতকে কখনো মূল্য দেয় না। নিজে যেটা বুঝবে সেটাই ঠিক। তা শতভাগ ভুল হলেও।
মায়া বলল, তোমাকে তো আমি চিনি। এখন ভালো থাকতে কথা শুনবে না। কথা তখনই শুনবে; যখন করার কিছু থাকবে না। এই বলে মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
এভাবে দশদিন চলে গেল। শাহেদের জ্বরের কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। এবার এর সাথে যোগ হলো কাশি ও শ্বাসকষ্ট। মায়া সারাদিন পরিশ্রম করে রাতে একটু ঘুমাতে পারে না। শাহেদের শ্বাসকষ্ট ও কাশির জন্য। সরিষার তেল গরম করে বুকে ও পায়ের তলায় ম্যাসাজ করতে থাকে প্রতিদিন রাতে। তার সাথে আছে গরম মসলার চা। আদা, কালোজিরা, রসুন, লেবু কতো কিছু দিয়েই বানিয়ে দেয় মায়া। মায়া ভাবে এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। যা কিছু করার আমাকেই করতে হবে। ওর কথা শুনলে ওকে বাঁচাতে পারবো না। প্রয়োজন হলে হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবো। মায়া এতদিন পরিবারের অন্য কাউকে জানায় না। সবাই আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তায় থাকবে বলে।
মায়ার সুগার আছে। তবুও নিজেকে নিয়ে তোয়াক্কা না করে শুধু শাহেদের কথাই ভাবতে থাকলো। শাহেদের অবস্থা আরও গুরুতর হতে লাগলো। মায়া শাহেদের কোনো কথা কর্ণপাত না করে সে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে হসপিটালে নিয়ে গেল।
তাড়াতাড়ি শাহেদকে ভর্তি নিয়ে করোনা ইউনিটে থাকতে দিলো। সেখানকার করুণ অবস্থা দেখে মায়া ও শাহেদের মনের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। কোনো ডাক্তার কাছে আসছে না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনে শুনে চলে যাচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে জ্বরটুকু কেউ মাপছে না। অক্সিজেনেরও ঘাটতি ছিল। সময়মতো অক্সিজেন দিতে পারছিল না। মায়া ভাবল এখানে এ অবস্থায় রাখলে শাহেদকে বাঁচানো যাবে না। তাই সে নার্সদের সাথে কথা বলে জোর করে বাসায় নিয়ে চলে এলো।
ছেলে, মেয়ে ও মায়ার পরিচর্যায় শাহেদ অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। ছেলেমেয়েদের নিষেধ করার পরও তারা সব সময় কাছে এসে বসে থাকতো। কাছে আসতে নিষেধ করলে ছেলেমেয়েরা বলতো, মরলে একসাথে মরবো আর বাঁচলে একসাথে বাঁচবো। আমার বাবা-মা আমাদের সামনে ধুকে ধুকে মরবে আর আমরা নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য চেয়ে চেয়ে দেখবো, এরকম শিক্ষায় আমাদের মানুষ করোনি তোমরা। এই বলে দুই ছেলে-মেয়ে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরল।
বাসায় চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হলো। অক্সিজেন নিয়ে রাখা হলো। ঠিকমতো ওষুধ ইনজেকশন ট্রিটমেন্ট যা প্রয়োজন কিছুই বাকি রাখল না মায়া। তারপর মায়েরও করোনা টেস্ট করা হলো। তার রিপোর্টও পজিটিভ এলো। তবুও নিজেকে নিয়ে সে কখনো দুশ্চিন্তা করেনি। কিন্তু সে নিজের জন্য কোনো ট্রিটমেন্ট নিলো না। একটাই চিন্তা, কী করে শাহেদকে ভালো করে তুলবে। সংসারের কাজ, শাহেদকে সেবা-যত্ন পরিচর্যা সবকিছু মায়া নিজ হাতে করতো। ধীরে ধীরে শাহেদ সুস্থ হতে লাগল।
এক মাসের ভেতর শাহেদ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার চেম্বার করা শুরু করল। শাহেদ কখনো এতটুকু কৃতজ্ঞতা মায়াকে জানায়নি। মায়া ডায়াবেটিসের রোগী হয়েও নিজের জীবনের কথা না ভেবে দিনরাত পরিশ্রম করে তাকে সুস্থ করে তুলল, একথা সে কখনো মনে করলো না। চাকরি, টিউশনি, সংসার, সন্তান সব একা হাতেই সামলায়। তবুও চেম্বার থেকে ফিরে এসে কাজের কৈফিয়ত নেয়। কথায় কথায় খোটা দেয়, কী কাজ করো সংসারে? একটু ত্রুটি হলে আর রক্ষা নেই। চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ে।
মায়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমাকে সুস্থ করে তুললাম এক সপ্তাহ হয়নি। এর ভেতরেই এরকম ব্যবহার?
মুখের ওপর অকৃতজ্ঞের মতো জবাব দিলো, তুমি না থাকলে কি আমি সুস্থ হতাম না? টাকা থাকলে মানুষের কোনো অভাব হয় না।
মায়া কোনো উত্তর দিলো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো শাহেদের মুখের দিকে। নিজেকে ধিক্কার দিলো মায়া। ভালোবেসে আমি এই লোকটাকে বিয়ে করেছিলাম? কি না করেছি এই সংসারের জন্য। শূন্য থেকে আজ প্রতিষ্ঠিত। সহযোদ্ধা হয়ে কাজ করে গেছি। সবকিছু বৃথা হলো? মায়ার চোখ থেকে অশ্রু নিভৃতে ঝরে পড়ল। গ্রিলটা ধরে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
এসইউ/এএসএম