মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-১১
গোমতীর স্রোত: রাজমালা
সুধা ছানিয়া কে-বা সুধা ঢেলে রে
তেমতি শ্যামের চিকণ দেহ রে
একদিন কৃষ্ণাভামিনীর কাছে সংবাদ এসে পৌঁছায় যে, রাজবিদূষকের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করায় মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের বীরবৃন্দ শশিভূষণের এক কর্মচারীকে আহত করেছেন। কৃষ্ণাভামিনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, সে আর এসব ঝামেলা সহ্য করবে না। সে তার কর্মচারীদের ডেকে জানিয়ে দিলো মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের কাজে অবহেলা প্রদর্শন করার জন্য। তারপর মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সঙ্গে তার বোঝাপড়া হবে। তাছাড়াও তার নির্দেশ: বীরদের প্রতিও যেন উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়। সে এ-ও সিদ্ধান্ত নিলো, এসব জানিয়ে তার ভগিনী সুহাসিনীর কাছে একটি পত্র দেবে।
শ্রাবণ এসে পড়েছে।
আকাশে মেঘ ঘন। দিনের বেলায়ও কক্ষ অন্ধকার হয়ে থাকে। গবাক্ষ পথে শূন্যপানে তাকালে দেখা যায়, আকাশ মেঘভারে ব্যাকুল।
সমস্ত দিনব্যাপী বৃষ্টি ঝরছে। এখনো বর্ষণের ক্ষান্তি নেই। প্রবল হাওয়ারও সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির ছাট এসে ভরিয়ে দিচ্ছে প্রাসাদগৃহ।
হঠাৎ পশ্চাতে কার যেন একটি সুগোপন দীর্ঘনিশ্বাস শুনতে পেলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য। চক্ষু দ্রুত উন্মীলিত করে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলেন রাধারমণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গেই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের উত্তাপ কণ্ঠ প্রকাশ পেল, জিজ্ঞেস করলেন: আপনি এই অসময়ে আমার কাছে কেন? আমার যে সঠিকভাবে সেবাযত্ন হচ্ছে কি না সেদিকে আপনার কোনো লক্ষ্য নেই। খিদেয় আমার পেট জ্বলছে। যান, রাজবিদূষককে ডেকে নিয়ে আসুন। আমার এখন খাবারের প্রয়োজন।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুতের শিহরণের মতো দেহ শিউরে উঠল রাধারমণের। মেঘগর্জনের সঙ্গে আচম্বিত বিদ্যুতের শিখা আকাশপটে নেচে উঠল। বললেন: প্রভু কী হয়েছে তা বলতে পারি না, তবে মনে হচ্ছে, আপনি এখানে তেমন সমাদৃত হচ্ছেন না।
তা-ই মনে হচ্ছে আপনার?
ভুল হলে ক্ষমা করবেন। আপনার ওপর কোনো অন্যায় হলে চুপ করে থাকা সমীচীন নয় বলেই কথাটি বললাম।
কথাটি আমারও মনে হচ্ছিল, তবে নিজেরই মনের ভুল ভেবে সেটি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি। আপনি গিয়ে আমার কন্যাকে বলুন, আমি তার দর্শনপ্রার্থী।
এই বৃষ্টি ও হাওয়া ভেঙে কৃষ্ণাভামিনী তার পিতার গৃহের দিকে এগিয়ে আসছে। কৃষ্ণাভামিনীর শাড়ি উড়ছে। ধুতরো ফুলের মতো দেহ ভিজে যাচ্ছে। তবুও সে এগিয়ে চলেছে। রাধারমণকে বেশি দূর যেতে হয়নি, গৃহদ্বারেই দেখা হয়ে গেল দুইজনের। কী যেন এক দুঃখ ছড়িয়ে আছে কৃষ্ণাভামিনীর চারপাশে। ক্ষোভে যন্ত্রণায় সে এসে উপস্থিত হল মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সম্মুখে। তার ভুরু কুঁচকানো। ঘরের দেওয়াল থেকে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিকণা মহারাজের চোখে-মুখে এসে পড়লে তিনি বললেন: কী ব্যাপার কৃষ্ণাভামিনী! সম্প্রতি তোমার চোখের ভুরু প্রায়ই কুঁচকানো থাকে কী কারণে?
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে কৃষ্ণাভামিনী বলল: পিতা, আপনার প্রশ্রয় পেয়ে শুধু রাজবিদূষকই নয়, অন্যরাও প্রতি মুহূর্তে দাঙ্গাহাঙ্গামা করে চলেছে। ভেবেছিলাম আপনাকে বললে কাজ হবে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আপনি নিজেই তাদের রক্ষক। তাদের রক্ষায় প্রধান ভূমিকা পালন করে চলেছেন। আপনার শুভবুদ্ধির ওপর সব সময়ই আমি নির্ভরশীল থাকলেও এখন দেখছি আপনি আপনার সেই শুভবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন।
কী এমন পাপ ছিল, কী এমন জঘন্য অপরাধ ছিল মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের, যার জন্য কৃষ্ণাভামিনীর মুখে এমন কথা শুনতে হচ্ছে! মহারাজ ঈশ্বর-বিশ্বাসী। তিনি সরল। বিদ্যাবুদ্ধিতে সকলের চেয়ে প্রবল। কিন্তু আজ তার কন্যার মুখে এসব শুনতে হচ্ছে! তিনি অন্ধকার দেখতে লাগলেন। তার মুখ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মগজে ঘূর্ণ্যমান রাগ সপ্তমে উঠে গিয়েছে, বললেন: কী বললে?
কৃষ্ণাভামিনী মনে-মনে বলল: মহারাজের সঙ্গে বাক্যালাপ বৃথা। তিনি সমস্যা বুঝছেন না। অতঃপর দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এবং পাখির পালকের মতো ঠোঁট দুটি নেড়ে কৃষ্ণাভামিনী বলল: পিতা, আমার সমস্যা সঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। বয়স হয়েছে বলেই কি আপনি আর সত্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন মনে করছেন না? আপনি এখানে আছেন ভালো কথা, কিন্তু আপনার অনুগামীদের এখানে থাকা কি উচিত? আমার প্রাসাদগৃহকে আপনার অনুগামীরা মনে করছে একটি সরাইখানা। তাই বলছি, আপনার এসব উচ্ছৃঙ্খল ও দাঙ্গাবাজ অনুগামীর সংখ্যা কমানো উচিত। কয়েকজন ভালো ও ভদ্র অনুগামীকে রেখে বাকিদের বিদায় দিন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হলো। মনে ঝড় উঠল। আয়ত নয়ন বিস্তীর্ণ তার কন্যার ওপর। কিছুক্ষণ স্থির চিত্রার্পিতের মতো নির্বাক হয়ে বসে রইলেন, কিন্তু নিস্পন্দ নন তিনি। নিশ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতর রণশঙ্খশব্দ উঠছে আর নামছে। নিমিষে বিবর্ণ আর ফ্যাকাশে দেখাতে লাগল মহারাজকে।
হঠাৎ মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার ঘোড়া প্রস্তুত কোরো। আমার অনুগামীদের সমাবেশ করতে বোলো। আমি আর কৃষ্ণাভামিনীকে কষ্ট দেব না।
কৃষ্ণাভামিনী কোনো উত্তর দিলো না।
প্রফুল্লিত বনস্পতি, কুটিল তমালতল
ঝংকৃত বাঁশি, কৃষ্ণ রাসকুঞ্জতল
সুহাসিনী ও উদীয়মানের প্রাসাদগৃহে এসে উপস্থিত হলেন মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য, সঙ্গে রাজবিদূষক, রাধারমণ ও বীরবৃন্দ। মহারাজের আবির্ভাব যেন সুহাসিনী ও উদীয়মানকে এক দুঃস্বপ্নে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারা বুঝতে পারল, এটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর সত্য। তাদের হৃৎপিণ্ডের রক্তস্রোত যেন বন্ধ হয়ে গেল। নিশ্বাসেও যেন কোনও অনুভূতির সন্ধান নেই। হয়তো তাই তারা মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করে, যুক্তি প্রদান করে তারা অসুস্থ ও ক্লান্ত। মহারাজ ভাবলেন: মানুষ কী বিচিত্র! যতই ভাবতে লাগলেন ততই কন্যাদ্বয়ের সকল দোষ তার স্মৃতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। এক কন্যার অত্যাচারে পীড়িত হয়ে অন্য কন্যার কাছে এসে এটা কেমন কঠোর, নির্দয়, হৃদয়হীন ব্যবহার! এই দুই কন্যাকে ঘিরেই তো তার জীবনের যত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-কান্না—অতীতের স্মৃতি আর ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচিত হয়েছিল। জীবনের শেষ মুহূর্তে এই কন্যাদ্বয়ের কাছে তিনি তার অন্তরের নিগূঢ়তম দুঃখ প্রকাশ করতে পারছেন না। এমনটি তিনি কোনো দিনই কল্পনা করেননি। অসহায়ভাবেই তিনি নিতান্ত দরিদ্র ভিক্ষুকের মতো, গৃহতাড়িত কুকুরের মতো তার দ্বিতীয় কন্যার কাছে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এই মুহূর্তে তিনি নিজেকে এমনটাই মনে করছেন। একথা ভেবেই তার হৃদয় তীব্র বেদনায় ছিন্ন হয়ে যেতে লাগল। তার সকল মানাভিমান, ক্রোধ-ঘৃণা সুহাসিনী ও উদীয়মানকে ঘিরে রচিত হতে লাগল। তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন। রাগ তার স্বভাবানুযায়ীই চরমে উঠল। চারদিক রাগে উদ্ভাসিত। তিনি আবার খবর পাঠালেন, সুহাসিনী ও উদীয়মানকে যে করেই হোক-না কেন, এখানে এসে উপস্থিত হওয়ার জন্য।
এই চরম বার্তা পেয়ে, কিছুক্ষণ পর, দরজা ঠেলে সুহাসিনী ও উদীয়মান উদিত হলো। সুহাসিনীর পরনে গাঢ় একরঙা থামি। সে সুমিষ্ট সম্ভাষণে আপ্যায়িত করে বলল: মহামান্য মহারাজকে দেখে আমরা অতীব সুখী, খুবই খুশি।
মহারাজ বললেন, কিন্তু আমি তোমাদের ও তোমার দিদির আচরণে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।
যন্ত্রণাসূচক শব্দ করতে করতে উদীয়মান বলল, মনে হয় আপনি আমাদের বুঝতে ভুল করছেন। আমার শরীর অসুস্থ, সকাল থেকে উঠতে পারছি না। তারপরও আপনার ডাকে সাড়া দিতে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছি।
বিরক্ত হয়ে সুহাসিনী বলল, দিদি আপনাকে কষ্ট দিতে পারে সেকথা আমি বিশ্বাস করি না।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, আমার কথা কি তোমাদের বিশ্বাস হয় না?
বিশৃঙ্খল পিতাকে শৃঙ্খলিত করার বাসনায় সুহাসিনী বলল, তবে দিদি যদি আপনার অনুগামীদের দাঙ্গাহাঙ্গামা আটকানোর চেষ্টা করে থাকে, তাহলে নিশ্চয় তার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের অজানা ছিল, কৃষ্ণাভামিনী দূত পাঠিয়ে এসব কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাই ঝাঁঝিয়ে বললেন, চুলোয় যাক সে!
সুহাসিনী বলল: পিতা, এখন আপনার বয়স হয়েছে, উত্তেজিত হওয়া আপনাকে শোভা পায় না। তার চেয়ে বরং আপনারই তার কথা শুনে চলা উচিত। তাতে আপনারই মঙ্গল হবে। আপনি রাগ না করে বরং তার কাছে ফিরে যান। গিয়ে বলুন, আপনি তার প্রতি অন্যায় ব্যবহার করেছিলেন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য উচ্চ স্বরে বললেন, আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব?
সুহাসিনী বলল, আমি তা বলিনি। তবে আপনি তার কাছে ফিরে যান।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তীব্র স্বরে বললেন, কখনই নয়! সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। অপমান করেছে। তার ওপর অভিশাপ নেমে আসুক।
সুহাসিনী বলল, রেগে গেলে আপনি আমাকেও এইভাবে অভিশাপ দেবেন।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে, অতি ধীরে, অতি মৃদু—পাছে গলার স্বর কর্কশ যেন না শোনায়—মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন: আমি তোমাকে অভিশাপ দেব কেন? তোমার কোমল স্বভাব কোনোদিনই তোমাকে কঠোর হতে দেবে না। তোমার স্নিগ্ধ চোখ তো তার মতো জ্বলে ওঠে না, বরং মনে প্রশান্তি এনে দেয়। তুমি তো পিতা ও কন্যার মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধন। সৌজন্য কৃতজ্ঞতা সবই তো তোমার মধ্যে আছে। আমার রাজ্যের অর্ধেক যে তোমাকে দান করেছি সেকথা তুমি নিশ্চয় ভোলোনি।
সুহাসিনীর আঁতে ঘা লাগল, বলল: তা আমার অজানা নয়, পিতা। এজন্যই লজ্জায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
ক্রোধদৃপ্তলোচনে সুহাসিনীর মুখের ওপর তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ়কণ্ঠে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, যখন দিয়েছি তখন আমাকে কি ফিরে যেতে হবে?
এতক্ষণ উদীয়মান মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন আর সে নিশ্চুপ থাকতে পারল না। বলল: এটা কেমন কথা মহারাজ, অর্ধেক রাজ্য দিয়েছেন বলে গলায় ছুরি বসাবেন? আমরা ছাড়া কি আপনার কোনো গতি আছে?
সুহাসিনী বলল, অবশ্যই আছে। মনোমোহিনী ও নিত্যানন্দ রয়েছে। আমি কিংবা দিদিকে অপছন্দ করলে মণিপুরে যেতে তার কোনও সমস্যা নেই।
উদীয়মান বলল, এতদিন চক্ষুলজ্জায় কিছুই বলিনি। আজ যখন অর্ধেক রাজ্যের কথা পাড়লেন তখন সবকিছু স্পষ্ট করাই ভালো। যেখানে ভালোবাসা আছে সেখানেই আপনার ঠাঁই। তাই আগেভাগে পথ দেখাই আপনার জন্য উত্তম।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, আজ আমার চক্ষু ফুটল।
সঙ্গে সঙ্গেই সুহাসিনী বলল: ঈশ্বর করুন, আপনার চোখ যেন ফোটে। আমি আপনাকে আহত করতে চাই না। তবে সত্য কথা হচ্ছে, আমরা আগে নিজের ভালো-মন্দ বুঝি—আগে পেটের ভাত, পরার কাপড়—তারপর পিতৃসেবা।
উদীয়মান বলল: মহারাজ, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না। আপনার ভালোর জন্যই বলছি, এখানে আপনার থাকা উচিত নয়। আমরা আপনাকে ময়নামতীর রাজপ্রাসাদ ফিরিয়ে দিচ্ছি, সেখানে আপনি চলে যান। তারপর দেখেশুনে আটঘাট বেঁধে চলুন। আপনার তো লোকের অভাব নেই। তাদের দিয়ে আপনি স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারেন। কিন্তু এখনো আমাদের জীবনের অনেকটা বাকি। যদি আমরা আবেগের বশে কিছু করি, তাহলে আর রক্ষা পাব না।
সুহাসিনী বলল, আপনার এই বিশাল বাহিনীর ব্যয় বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা না-খেতে পেয়ে মরে গেলে কেউ দয়া করবে না।
উদীয়মান বলল, খুব সাবধানে দেখেশুনে না চললে কি আমাদের চলে?
অন্যমনস্কভাবে ঘাড় নেড়ে সুহাসিনীর উদ্দেশ্যে মহারাজ বললেন, তবে তা-ই হোক। তুমি বা তোমার দিদির সঙ্গে আমি আর থাকব না।
তখনই আগমন-বাদ্য বেজে উঠল। সদলবলে কৃষ্ণাভামিনী ও শশিভূষণ এসে উপস্থিত হলো। সুহাসিনী বলল, নিশ্চয় দিদি এসেছে।
কৃষ্ণাভামিনী ও শশিভূষণকে দেখে মহারাজ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, তোমরাই সেই লোক যারা আমার প্রশ্রয়ে মাথায় উঠেছ। তোমরা আমার চোখের সম্মুখ থেকে দূর হও।
কৃষ্ণাভামিনী এগিয়ে এলো। সেদিকে দৃষ্টিপাত না করেই সুহাসিনীকে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তুমি ওর হাত ধরে ওকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
কৃষ্ণাভামিনী বলল: পিতা, আপনার হাত ধরে নয় কেন? আমি কী এমন অপরাধ করেছি? আপনি আপনার বক্রচোখে আমার সবকিছুই অঠিকই দেখেন?
মেজাজ সপ্তমে তুলে মহারাজ বললেন, তুমি চুপ করো। আমার লোককে অপমান করা হলো কেন, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো?
শশিভূষণ বলল, তার জন্য তাদের ঔদ্ধত্যই দায়ী।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তুমি বলছ?
শশিভূষণ বলল, আজ্ঞে, আমিই বলছি।
কিছুক্ষণ সুহাসিনী অধোবদনে নিশ্চুপ রইল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল: পিতা, আপনি এই মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত দিদির কাছেই থাকবেন। তারপর ইচ্ছে হলে আমার কাছে চলে আসতে পারেন। তখন না-হয় আমরা আপনার দেখাশোনার ভার নেব। কিন্তু এখন অবশ্যই নয়। তাই অনুরোধ করছি, আপনি দিদির সঙ্গে ফিরে যান।
হতাশার স্বরে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তার চেয়ে বরং আমি নেকড়ে কিংবা পেঁচার সঙ্গে থাকব। আগেই বলেছি, তুমি কিংবা তোমার দিদির সঙ্গে আমি আর থাকব না। প্রয়োজন হলে আমি আমার কনিষ্ঠ কন্যার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করব, তবুও তোমাদের সঙ্গে থাকব না।
সুহাসিনী বলল, সেটি আপনার ব্যাপার। মনোমোহিনী ও নিত্যানন্দ আপনার প্রিয়পাত্র। তাই ভালোবাসা যেখানে সেখানেই তো আপনার আশ্রয়স্থল।
সুহাসিনীর উদ্দেশ্যে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য বললেন, তোমরা আমাকে এত কষ্ট দিলে! বিদায়। যেদিন তোমাদের লজ্জা পাওয়ার দিন আসবে, সেইদিন অবশ্যই তোমরা লজ্জিত হবে। ততদিন পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধারণ করে থাকব। তোমাদের আমি সব দিয়ে বসে আছি। হায় ঈশ্বর, আমাকে সহ্য করার শক্তি দাও! তুমি এই হতভাগ্য বৃদ্ধের দিকে ফিরে তাকাও।
কৃষ্ণাভামিনীর ক্লেশ হচ্ছে। তবুও পিতার কথা শুনে, এক মুহূর্তের জন্য হলেও, হৃদয়ে একটু ব্যথা অনুভব করল। পরক্ষণেই সে এই ব্যথাটুকু ঝেড়ে ফেলে বলল, আপনার কনিষ্ঠ কন্যার কাছে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে অসুবিধা হবে না।
কৃষ্ণাভামিনীর ওপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি স্থাপন করে মহারাজ বললেন: আমি তোমাদের ওপর এমন প্রতিশোধ নেব যে, সমস্ত পৃথিবী... তোমরা ভাবছ আমি কাঁদব? না, কাঁদব না। যদিও অশ্রুবর্ষণের সম্পূর্ণ কারণ রয়েছে, তবুও না। রাধারমণ, চলুন আমরা এখান থেকে চলে যাই। এই হবে আমাদের জন্য উত্তম। পৃথিবীর স্থলগুলো ঘুরে বেড়াব আমি। হেঁটে চলব গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-প্রান্তরে। সন্ধান করব পুণ্যভূমির, যেখানে মানুষের নির্বাণ লাভের পথে কোনও অন্তরায় থাকে না।
দিবস রজনি গণি গণি, কি হৈল অন্তরের ব্যথা
খলের বচনে পাতিয়া শ্রবণে খাইনু আপন মাথা
ঝড় শুরু হতে বেশিক্ষণ বাকি নেই।
প্রকৃতি এই মুহূর্তে নিষ্ঠুর। হৃদয়হীন।
প্রকৃতি মানুষের দুঃখকষ্টবিপদ বোঝে না। মানুষের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করারও সে প্রয়োজন মনে করে না। নিজের ইচ্ছেমতো অনন্তকালের পথে ঠিক নিয়মিতভাবেই ছুটে চলে।
প্রকৃতির উদাসীন হৃদয়হীনতার মধ্যে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের গমন পথের দিকে উদীয়মান, সুহাসিনী, শশিভূষণ ও কৃষ্ণাভামিনী নির্বাক নিস্পন্দভাবে তাকিয়ে রইল। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করল উদীয়মান। বলল: চলো, অন্দরে যাওয়া যাক। ঝড় শুরু হতে বেশি বাকি নেই।
সুহাসিনীর চোখে অশ্রুর বান ছাপিয়ে এলো। এই অশ্রুধারায় তার দুই গণ্ড ভেসে যেতে থাকে। কিয়ৎক্ষণ সে কোনো কথাই বলতে পারল না। অবশেষে বলল: আমাদের প্রাসাদগৃহ ভীষণ ছোট, পিতা তার দলবল নিয়ে এখানে কীভাবে থাকতে পারেন?
কৃষ্ণাভামিনীও ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সুহাসিনীর গলা জড়িয়ে রুদ্ধকণ্ঠে বলল, এখান থেকে চলে যাওয়াটা তার উচিত হয়নি। তার মূর্খতার ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। তার অদৃষ্টে যা আছে তা-ই ঘটবে। ঈশ্বর যার প্রতি নিষ্ঠুর, তার প্রতি আমার তীব্র শুভবাসনা থাকলেও এর বেশি কী করা যায়!
সুহাসিনী ধীরে ধীরে চোখের জল মুছল। অশ্রুপ্রবাহ নিরোধ করে শান্তকণ্ঠে বলল, যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এখন আর ভেবে লাভ নেই! কিন্তু আমি খুশিমনেই তাকে এখানে থাকতে বলেছিলাম, কিন্তু তার দলবলসমেত কখনই নয়।
সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণাভামিনী দেখল, তার কমনীয় কান্তি এর মধ্যেই শুকিয়ে উঠেছে, চোখ-মুখ বসে গেছে, যেন দীর্ঘকাল পরে রোগশয্যা থেকে উঠে এসেছে সে। তার মুখের ওপর দৃষ্টি রেখেই নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৃষ্ণাভামিনী বলল, আমিও তা বলেছিলাম।
শশিভূষণ তার স্ত্রী ও স্ত্রীর ভগিনীকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে তা বুঝে উঠতে পারল না। সে কেবল নিরুপায়ভাবে তাকিয়ে রইল। অন্তর তার বিহঙ্গের মতো ছটফট করে থাকে। অবশেষে বেদনাতুর কণ্ঠে বলল, মহারাজ ভীষণভাবে খেপে গিয়েছিলেন।
মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যকে নিয়ে যতই উদীয়মান ভাবতে থাকে, ততই তার মাথা ঘুরতে থাকে। অন্ধকারাচ্ছন্ন অসীম ভবিষ্যতের মধ্যে সে কোনো কূলকিনারা দেখতে পেল না। রাজ্য বিলিয়ে দেওয়ার পর তো শশিভূষণ ও কৃষ্ণাভামিনীর জীর্ণ প্রাসাদগৃহে মাথা গুঁজে ছিলেন, এখন পথে দাঁড়ানো ভিন্ন তার আর গন্তব্য নেই। একথা ভাবতেই তার দেহ শিহরণ দিয়ে উঠল। তাকে অনাহারেই পথের ধারে কুকুর-বিড়াল যেমন মরে, ঠিক তেমনই অসহায়ভাবে মরতে হবে। তার হৃৎপিণ্ডে কে যেন সহসা সজোরে হাতুড়ির আঘাত করে তাকে অসাড় করে দিচ্ছে। এই অসাড় অবস্থায়ই সে বলে উঠল, তিনি যাচ্ছেন কোথায়?
শশিভূষণও এতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল: সর্বস্বহারা মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য নির্মম নিয়তির চাকারতলে আজ পরাজিত, নিষ্পেষিত; এক সময় তিনি বিলুপ্ত হয়ে যাবেন। তখনই তার কানে উদীয়মানের প্রশ্নটি এসে ধাক্কা খেল। সঙ্গে সঙ্গেই দৃঢ়ভাবে কিন্তু অমমতাপূর্ণ কণ্ঠে বলল, আমার জানা নেই।
উদীয়মান মৃদু হেসে অবিচলিতভাবে বলল, যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই যেতে দেওয়া উচিত।
উদীয়মানের কথা শুনে কৃষ্ণাভামিনীর বুক কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ বজ্রাহতবৎ স্তম্ভিত হয়ে রইল, তারপর কম্পিত কণ্ঠে বলল: তাকে জোর করে এখানে রাখা অন্যায় হতো।
শশিভূষণ দিগন্তের দিকে তর্জনী হেলিয়ে জলদগম্ভীর কিন্তু ভীতিজড়িত কণ্ঠে বলল, অন্ধকার নেমে এসেছে। প্রবল ঝড়ও শুরু হয়েছে...
শশিভূষণের দিকে সুহাসিনী একবার অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল, বলতে লাগল: পিতাকে নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। লাভও নেই। তার সঙ্গে অনেক দুর্দান্ত লোক রয়েছে। তারা তাকে কী পরামর্শ দেবে কে জানে!
চলবে...
এসইউ/এএসএম