মোরশেদুল ইসলামের কবিতা: রিফিউজি
(ফিলিস্তিনি কবি মোসাব আবু তোহার অনুভূতি অবলম্বনে)
গাজায় যারা থাকে তারা বারবার মরে
হয়তো এয়ারস্ট্রাইকে পরিবার হারিয়ে
কপালে বেঁচে মরে যায় কেউ
কেউবা আশা হারিয়ে মরে যায়
আমিই একত্রিশ জনকে হারিয়েছি পরিবারের
রোজ রাতে নতুন জীবন পাই
ঘুমাই; ভাবি আজ হয়তো সবাই মিলে মারা পরবো
এভাবেই বারবার মরি
আর নিহতদের মধ্যে নিজেকে গুনি
গাজা ছেড়ে নিউইয়র্কে যখন গত বছর আসি
রাফা ক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম
মিশর আমাদের কাউকে নেয়নি
বলছি না এটা নতুন জীবন
ফেলে আসা প্রিয়জনদের সঙ্গে
এখনো গাজায় পড়ে থাকি আমি
এখানে কী–খাবারটুকুই পাই যা–
নিজের জন্য নয়, বাচ্চাদের জন্য
সেটুকুর জন্যও গাজায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো
আমার বন্ধু-বান্ধবরা এখনো থাকে যেমন
বাচ্চাদের জন্য এক বোতল পানি পাচ্ছি
দোকানে গিয়ে তাদের জন্য খেলনা কিনতে পাচ্ছি
আইসক্রিম কিনে দিতে পাচ্ছি–এই আর কী
আমার চার বছরের বাচ্চাটা
যুদ্ধ মানে কী সে জানে
সে জানে এয়ারক্রাফট মানে কী
সে জানে বোমা মানে কী
সে জানে এয়ারস্ট্রাইক মানে কী
বিস্ফোরণ কেমন জানে
ড্রোনের মানেও জানে
জানে এফ-সিক্সটিন কী
আমার ছয় বছরের মেয়েটা
এয়ারস্ট্রাইক থেকে বাঁচার জন্য
পড়ন্ত বোমা থেকে বাঁচার জন্য
কম্বল মুড়ি দিতো
বাচ্চাদের বাঁচার কী আকুতি–
আলতো কম্বলকে তারা ঢাল বানায়
আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়
ঘরগুলো কেঁপে ওঠে যখন থরথর
একে অপরের মুখের দিকে তাকাই
সন্ত্রস্ত তবু সুখী
যাক, আমরা বেঁচে গেলাম এবার
বাচ্চারা আঁকতে শিখবে কী
রং করতে শিখবে কী
সাইকেল চালাতে শিখবে কী
জীবন বাঁচাতে শিখবে কী
স্রেফ সারভাইভ করতে শেখে এখানে
বিছানাই কারো কারো কবর হয়ে গেছে
ইসরায়েলি এয়ারস্ট্রাইকে ধূলো হয়েছে বাড়ি
শতসহস্র বাড়ি আজ কবর হয়ে গেছে
খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার
বেইত লাহিয়া, বেইত হানুন, জাবালিয়া থেকে
নুসেইরাত ক্যাম্প, দেইর আল বালাহ, খান ইউনিস,
এয়ারস্ট্রাইক মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে সব
সহমর্মিতার মতো দুঃখেরও পাখা আছে
আগুন হয়ে পুড়ছে
জেনিন, নাবলুস, রামাল্লা আর হেবরন
ওরা একটা বইও ঢুকতে দিতে চায় না গাজায়
লাইব্রেরিগুলো নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে
মসজিদ, গীর্জা, হাসপাতাল, রিফিউজি ক্যাম্প বাদ যায়নি কিছুই
একটা রিফিউজি ক্যাম্পে জন্মেছিলাম আমি
আমার মা-বাবাও জন্মেছিলেন সেখানে
আমার পিতামহও
কেমনে ভুলে যাই আমি সেটা
সেই ক্যাম্প থেকে যুবকদের ধরে নিয়ে যায়
নির্যাতন করে ইসরায়েলি আর্মি
এক রাত্রে যখন আমাকে ধরে নিয়ে যায় ওরা
স্রেফ একটাই কথা ‘হাঁটু গেঁড়ে বসো!’
মনে পড়ে ইসরায়েলি সেনারা
ঘুষি মেরেছিল আমার মুখে
উপর্যুপরি লাত্থি মরেছিল পেটে
কয়েক ঘণ্টা হাঁটু গেঁড়ে থেকে
ব্যথায় কাতর আমি কখন মুর্ছা গেছি, জানি না
জ্ঞান ফিরলে দেখি ক্যাম্পের পাশে পড়ে আছি
চোখ বাঁধা, হ্যান্ডকাফ হাতে
ইসরায়েল তখনো চিনতাম না আমি
ওটাই প্রথম–আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল
আমার মাতৃভূমিতে, আমার দেশে
যাকে আমি ফিলিস্তিন নামে জানি
আমারই দেশে আমাকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা
চোখ বেঁধে, হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে
আমার ছেলেটাই শুধু মার্কিন নাগরিক পরিবারে
ওর জন্ম হয়েছিল ওখানে
ওর কারণেই গাজা ছাড়ার অনুমতিপ্রাপ্তদের
তালিকায় নাম ওঠে আমাদের
মার্কিন প্রশাসন আমাদের কথা ভেবেছিল
আমরা মানুষ বলে নয়
আমরা মজলুম বলে নয়
আমরা ক্ষুধার্ত বলে নয়
শুধু আমার ছেলে আমেরিকান বলে
আর তার মার্কিন পাসপোর্ট থাকার কারণে
পারিবারে কারো বিদেশি নাগরিকত্ব না থাকলে
গাজার কেউ সৌভাগ্যবান নয়
তারা মূল্যহীন
কেউ তাদের কথা ভাবে না
বরং কেউ কেউ বোমা পাঠায়
অস্ত্র, রসদ পাঠায় আমাদের হত্যার জন্য
এবং শেষে সে হত্যারও স্বীকৃতি দেয় না কেউ
রিফিউজি ক্যাম্পে জন্ম
নির্যাতনের মধ্যে বেড়ে ওঠা
এবং যুদ্ধের সঙ্গে সখ্য গড়া
এক, দুই কিংবা তিন বছরের জন্য নয়
অধিকাংশের জন্যই তা আজীবনের
গত পঁচাত্তর বছর ধরে ভুগছি আমরা
আমার বাবা ভুগতে ভুগতে শহীদ হয়েছেন
দাদা ভুগতে ভুগতে শহীদ হয়েছেন
দাদা অবশ্য ‘নাকাবা’ দেখেছিলেন
সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনির জাতিগত নিধন
প্রত্যেকটা বাড়ি, প্রত্যেকটা গ্রাম
মৃত্যুর প্রহর গোনে
সর্বদা ড্রোন পাহারা দেয় মাথার ওপরে
বর্ডার পাড় হওয়ার সময়
মাতৃভূমিতে ফেলে এসেছি আমাদের ছায়া
তারা বড় নিঃসঙ্গ
আহত রাতের অন্ধকারে তারা লুকায়
ভয়ে বরফের মতো জমে থাকে
দেশত্যাগে ছায়ারও যে ভিসা লাগে
ছায়ারা আমাদের ফেরার প্রতীক্ষায় থাকে
গৃহহীন শিশুদের সঙ্গে সকালে স্কুলে যেতে চায়
গ্রীষ্মের দুপুরে খেলতে চায়
কিন্তু ক্লাসরুমে ঢুকতে চায় না
আমাদের ছায়াগুলোর ঠান্ডা লেগেছে
সর্দি লেগেছে, কাশি হয়েছে
তবু ‘সেরে যাবে’ বলার মতো কেউ নেই
ট্যাঙ্ক আর হুমভিসের নিচে পিষ্ট অনবরত
বুক ঝাঁজরা বুলেট আর সার্পনেলে
তবু ডানা ছাড়াই উড়ে চলে তারা
ঝরে কালো কালো রক্ত
আমি টের পাই অনুভব আর অভিজ্ঞতায়।
এসইউ/জেআইএম